অজু কেন্দ্রিক ভুলভ্রান্তি এবং বিদআত

অজু কেন্দ্রিক ভুলভ্রান্তি এবং বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

এই পরিচ্ছেদের শিরোনামই বলে দেয় মুসলিমদের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ইবাদাত সালাত সম্পর্কে আলোচনা করার ক্ষেত্রে বিদআতের পাশাপাশি এর কিছু মতভেদ পূর্ণ মাসায়েল সম্পর্কে আলোচনা করব। যাতে করে বিরোধে না জড়িয়ে সঠিক পদ্ধতিতে সালাত আদায় করা যায়। এই সালাতে সাথে অজু ও আজান জড়িত বিধায় এই দুটি ইবাদতের বিদআতও আলোচনায় নিলাম। প্রথমেই অজু সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ 

অজুর সঠিক পদ্ধতিঃ

অজু বিধান সরাসরি মহান আল্লাহ প্রদত্ত একটি ফরজ কাজ। মহান আল্লাহ বলেন,

*يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُواْ وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُواْ بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ *

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের জন্য তৈরী হও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত দুটি কনুই পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো, মাথার ওপর হাত বুলাও এবং পা দুটি গোড়ালী পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো। (সুরা মায়েদা ৫:৬)

 অজুর বিদআত আলোচনার পূর্বে কুরআন সুন্নাহের আলোকে অজুর সঠিক পদ্ধতির একটি ছোট বর্ণনা দিব যাতে বিদআত আলোচনায় খুব সহজে ধরা পড়ে অজুর কোন কাজটি বিদআত।   কুরআন ও সুন্নাহর আলোকো অজুর সঠিক নিয়ম হলোঃ

মনে মনে অযু করার নিয়ত বা সংকল্প করবেঃ

অজুর শুরুতে মনে মনে নিয়ত করে নিবে। যে কারন অজু কবরে সেই কারনটি মনে মনে সংকল্প করে নিলেই অজুর নিয়ত হয়ে যাবে। মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা সহিহ সু্ন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়।  

আলকামা ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর -১)

তারপর বিসমিল্লাহবলবেঃ

রাবাহ ইবন আবদির রাহমান ইবনু আবী সুফইয়ান ইবনু হুওয়ায়তিব (রহঃ) তাঁর পিতামহী থেকে বর্ণনা করেন। আমার পিতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) নিবে না, তার অজু হবে না। (সুনানে তিরমিজি ২৫ ইসলামি ফাউন্ডেশন, ইবনু মাজাহ ৩৯৯ হাদিসের মান হাসান)

ডান দিক থেকে শুরু করাঃ

উম্মু আতিয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যা [যয়নাব (রাঃ)]-কে গোসল করানোর সময় তাঁদের বলেছিলেনঃ তোমরা তার ডানদিক এবং অজু এর স্থান থেকে শুরু কর। (সহিহ বুখারি হাদিস ১৬৮ ইফাঃ)

একটি সহিহ হাদিসেই অজুর সকল বিধানঃ

উসমান ইবনু ‘আফ্‌ফান (রাঃ) এর আযাদকৃত গোলাম হুমরান (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি ‘উসমান (রাঃ) কে অজুর পানি আনাতে দেখলেন। তারপর তিনি সে পাত্র থেকে উভয় হাতের উপর পানি ঢেলে তা তিনবার ধুয়ে ফেললেন। এরপর তাঁর ডান হাত পানিতে ঢুকালেন। এরপর কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিয়ে নাক ঝেড়ে ফেললেন। এরপর তাঁর মুখমণ্ডল তিনবার এবং উভয় হাত কুনই পর্যন্ত তিনবার ধুলেন, এরপর মাথা মাসেহ করলেন। এরপর প্রত্যেক পা তিনবার ধোয়ার পর বললেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমার এ অজুর ন্যায় অজু করতে দেখেছি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি আমার এ উযূর ন্যায় উযূ করে দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করবে এবং তার মধ্য কোন বাজে খেয়াল মনে আনবে না, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। (সহিহ বুখারি হাদিস ১৬৫ ইফাঃ)

আংটি থাকলে পানি পৌঁছানোর চেষ্টা করবেঃ

সহিহ বুখারির (ইসলামি ফাউন্ডেশন) ১৬৬ নম্বর হাদিসের পূর্বের আলোচনায় ইবনে সিরিন রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে লেখা হয় তিনি অজু করার সময় তার আংটির জায়গা ধুতেন। (সহিহ বুখারি ইসলামি ফাউন্ডেশনের ১৬৬)

দাড়ি খিলাল করাঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অজু করতেন, তখন তিনি এক কোশ পানি হাতে নিয়ে থুতনির নীচে দিয়ে তা দ্বারা দাড়ি খেলাল করতেন। তিনি আরো বলেনঃ আমার প্রতিপালক আমাকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৪৫ ইফাঃ)

পায়ের আংগুল সমূহ খিলাল করাঃ

মুসতাওরিদ ইবনু শাদ্দাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অজুর সময় স্বীয় পদদ্বয়ের অংগুলিসমূহ হাতের কনিষ্ঠ অংগুলি দ্বারা খিলাল করতে দেখেছি। (সুনানে আবু দাউদ ১৪৮ ইফাঃ)

সম্পূর্ণ মাথা মাসেহ করাঃ

আবদুল্লাহ ইবনু যায়িদ ইবনু আসিম আনসারী (রাঃ) যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। রাবী বলেন, তাঁকে বলা হল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অজু করে আমাদের দেখিয়ে দিন। তখন তিনি পানির পাত্র আনালেন। তারপর তা থেকে দুই হাতের উপর পানি ঢেলে উভয় হাত তিনবার ধুইলেন, তারপর পাত্রে হাত ঢূকিয়ে পানি নিয়ে কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন একই আজলা দিয়ে। এরুপ তিনবার করলেন। আবার পানিতে হাত ঢূকিয়ে পানি নিয়ে আবার মুখমন্ডল ধুইলেন। দুই হাত কনুই পর্যন্ত দুইবার করে ধুইলেন। তারপর হাত ঢূকিয়ে বের করে মাথা মাসেহ করলেনদুই হাত সামনের দিকে আনলেন ও পিছন দিকে নিলেন। তারপর উভয় পা গ্রন্থি পর্যন্ত ধুইলেন, এরপর বললেনঃ এরুপ ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উযূ। (সুনানে আবু দাউদ ৪৪৮ ইফাঃ)

অজুর পরের দোয়াঃ

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ তোমাদের যে কেউ উত্তমরূপে অজু করার পর এরূপ বলেঃ

*اشْهَدُ انْ لّآ اِلهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً اعَبْدُهوَرَسُولُه  *

(আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু; ওয়া-আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্‌দুহু ওয়া রাসুলুহু”) তার জন্যে আটটি জান্নাতের সমস্ত দরজা খোলা হবে বা খুলে যাবে। সে ব্যক্তি সেচ্ছায় যে কোন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (সুনান আবু দাউদ (ইফাঃ) এর ১৬৯ হাদিসের অংশ বিশেষ, সহিহ মুসলিম ইফাঃ হাদিস নম্বর ৪৪৬ ও ৪৪৭ কাছাকাছি অর্থে)

তিরমিজিতে সহিহ সনদে এই দুয়ার সাথে অতিরিক্ত নিম্মের দোয়াটি সংযুক্ত আছে। দোয়াটি হলোঃ 

*لْمُتَطَهِّرِينَ مِنَ اجْعَلْنِ وَ يالتَّوَّابِينَ مِنَ جْعَلْنِي للَّهُمَّ *

(আল্লাহুম্মা জায়ালনী মিনাততাওয়া-বিন, ওয় জায়ালনী মিনাল মুতাতাহ-হিরিন)

হে আল্লাহ্! আমাকে তওবাকারীদের মধ্যে শামিল কর এবং পবিত্রদের অন্তর্ভুক্ত কর। (তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৫৫ ইফাঃ, ইবনু মাজাহ ৪৭০)

অজুর বিদআতঃ অজুর সঠিক নিয়ম জানার পর এবার অজুর বিদআত যারা সহজ হবে। তাই ধারা বাহিকভাবে অজুর বিদআত আলোচনা করা হয়।

নিয়তে বিদআতঃ

সঠিক পদ্ধতি অজু করার সময় দেখেছি, অজুর কোন মৌখিক নিয়ত নেই। অন্তরের সংকল্পই অজুর নিয়ত। আমাদের সমাজে আবরী উচ্চারণে অজুর যে নিয়ত প্রচলিত আছে তার কুনআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। নিয়তটি হলোঃ (নাওয়াইতু আন আতাওয়াজ্জায়া লিরাফয়িল হাদাসি ওয়া ইস্তিবাহাতা লিছছালাতি ওয়া তাকাররুবান ইলাল্লাহি তা’য়ালা)।

অর্থঃ আমি ওযুর নিয়ত করছি যে নাপাকি দূর করার জন্য বিশুদ্ধরূপে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহ তা’য়ালা।

এই নিয়তের পাশাপাশি মানুষ আর একটি বিদআতি দোয়া আবিস্কার করেছে। অজুর সেই দোয়াটি হলোঃ

বাংলা উচ্চারণঃ (বিসমিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম। ওয়াল হামদুলিল্লাহি আলা দ্বীনিল ইসলাম। আল ইসলামু হাক্কুন। ওয়াল কুফরু বাতিলুন। ওয়াল ইসলামু নুরুন। ওয়াল কুফরু জুলমাত)।

অর্থঃ মহান ও পরাক্রান্ত আল্লাহ তায়ালার নামে আরম্ভ করছি। আমি দ্বীন ইসলামের উপর আছি। তাই আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা। নিশ্চই ইসলাম সত্য ও কুফুর বাতিল এবং ইসলাম আলো ও কুফুর অন্ধকার।

মন্তব্যঃ এই দোয়াটির অর্থ খুব সুন্দর হলেও অজুর জন্য এই দোয়াটি খাস করে নিলে বিদআত হবে। কাজেই এই দোয়া না করে, সরাসরি হাদিস বর্ণিত বিসমিল্লাহ বলে অজু শুরু করা।

প্রতি অঙ্গের জন্য বিশেষ দোয়া করাও বিদআতঃ

সমাজে প্রচলিত আছে, বুজুর্গ ওলামায়ে কেরাম অজুর ক্ষেত্রে প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় স্বতন্ত্র দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। এই সকল দোয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে প্রমানিত নয় যে, তিনি অমুক অঙ্গ ধোয়ার সময় অমুক দোয়া পড়েছেন। কিন্তু যারা এই সকল আমল করে থাকের তাদের যুক্তি হল,  এর ফলে অজুর সময় ধ্যান খেয়াল ও মনোযোগ আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট থাকবে। বিদআত যেহেতু ভাল কাজ নেকীর আশায় করা হয়, তাই প্রতিটি বিদআতেরই যুক্তি থাকবে। আসুন দেখি নেই অজুতে কি কি বিদআতি দোয়া পড়া হয়।

ওজু শুরু করার দোয়াঃ

বুজুর্গানে দ্বীন বলেছেন, ওজু শুরু করার সময় এই দোয়া পড়বে, 

بسم الله العلى العظيم والحمدلله على ملت الا سلام

আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি, এবং সকল প্রশাংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি ইসলামের দৌলত প্রদান করেছেন।

কবজি ধোয়ার দোয়াঃ

এরপর হাতের কবজি ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم انى اسئلك اليه من والبركة واعوذبك من الشؤم والهلاكة

আয় আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণ ও প্রাচুর্যের প্রার্থনা করছি, এবং ধ্বংস ও অমঙ্গল থেকে

আপনার আশ্রয় চাচ্ছি।

কুলি করার দোয়াঃ

এরপর কুলি করার সময় এই দোয়া পড়াবে, 

اللهم اعنى على تلا وة القران وذكرك وشكر وحسن عبادتك

আয় আল্লাহ, আমাকে কোরআন তেলাওয়াত আপনার জিকির ও শোকর এবং সুন্দর মতো আপনার

ইবাদত করার তাওফিক দিন।

নাকে পানি দেওয়ার দোয়াঃ

নাকে পানি দেয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم ارحنى دائحة الجنة والا ترحنى دائحةالنار

আয় আল্লাহ আমাকে জান্নাতের সুগন্ধি শোকান এবং জাহান্নামের দুর্গন্ধ শোকাবেন না।

চেহারা ধোয়ার দোয়াঃ

চেহারা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم بيّض وجهى يوم تبيّضُ وجوه وسودّ وجوه

আয় আল্লাহ যে দিন কতক চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কতক চেহারা মলিন হবে সেই দিন আপনি আমার চেহারা উজ্জ্বল রাখুন। 

ডান হাত ধোয়ার দোয়াঃ

এরপর কনুইসহ ডান হাত ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم اعطنى كتابى بيمينى وحاسبنى حسابايسيرا

আয় আল্লাহ আমার আমলনামা আমার ডান হাতে দিন, এবং আমার হিসেব সহজ করে দিন।

বাম হাত ধোয়ার দোয়াঃ

বাম হাত ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

মাথা মাসেহ করার দোয়াঃ বুজুর্গানে দ্বীন মাথা মাসেহ করার সময় এই দোয়া পড়তে বলেছেন, 

اللهم اظللنى تحت ظل عرشك يوم لاظل الا ظل عرشك

আয় আল্লাহ! আপনি আমাকে ওই দিন আপনার আরশের ছায়া দিন, যে দিন আপনার আরশের ব্যতিত কোনো ছায়া থাকবে না।

গর্দান মাসেহ করার দোয়াঃ

গর্দান মাসেহ করার সময় এই দোয়া করা উচিত, 

اللهم اعتق رقبتى من النار

আয় আল্লাহ আমার গর্দান জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ করে দিন।

ডান পা ধোয়ার দোয়াঃ

ডান পা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم ثبت قدمى على الصراط يوم تضل فيه الا قدام

আয় আল্লাহ! সেদিন পা পুলসিরাতের ওপর দৃঢ়পদ রাখুন, যেদিন লোকজনের পা পিছলে যাবে।

বাম পা ধোয়ার দোয়াঃ

এর পর বাম পা ধোয়ার সময় এই দোয়া পড়বে, 

اللهم اجعل ذنبى مغفوراً وسعيى مشكورا وتجارتى لن تبورا

আয় আল্লাহ, আমার গুনাহ মাফ করে দিন। আমি যা কিছু করেছি, আপনি আপনার অনুগ্রহে তার প্রতিদান দিন এবং আমি যে ব্যবসায় করেছি।

মন্তব্যঃ প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার জন্য আলাদা কোনো দোয়া নেই। অজুর শুরু হচ্ছে বিসমিল্লাহ বলে। শুধু বিসমিল্লাহ বলে অজু শুরু করা সুন্নাহ। এর পর অজুর মধ্যে আর কোনো দোয়া নেই। এই দোয়াগুলো নতুন আবিষ্কৃত, বিদআত।

অজুতে ঘাড় মাসাহ করার বিধানঃ

অজু করার সময় ঘাড় মাসাহ করার পক্ষে সহীহ কোন প্রমাণ নেই। এর পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জাল ও মিথ্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অজু করার সময় ঘাড় মাসাহ করেছেন এ মর্মে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কিত জাল ও বানোয়াট দলীলগুলো নিম্নরূপঃ

১) ওয়ায়েল বিন হুজর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অজুর পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন। অতঃপর তিনি তিনবার তার মাথা মাসাহ করেন এবং দুই কানের পিঠ মাসাহ করেন ও ঘাড় মাসাহ করেন, দাড়ির পার্শ্ব মাসাহ করেন মাথার অতিরিক্ত পানি দিয়ে। [ত্বাবারানী কাবীর, হাদিস নং ১৭৫৮৪]

তাহক্বীক্বঃ বর্ণনাটি জাল। (সিলসিলা যঈফাহ, হাদিস নং ৬৯ ও ৭৪৪] ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “এটা জাল, নবী (সাঃ) এর বক্তব্য নয়”, আল মাজমু শারহুল মুহাযযাব, ১/৪৬৫ পৃষ্ঠা)।

২) আমর ইবনু কাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অজু করার সময় আমি দাড়ির পার্শ্ব এবং ঘাড় মাসাহ করতে দেখেছি। (ত্বাবারানী কাবীর, ১৯/১৮১)

তাহক্বীক্বঃ বর্ণনাটি জাল। ইবনুল ক্বাত্তান বলেন, এর সনদ অপরিচিত। মুসাররফ সহ তার পিতা ও দাদা সবাই অপরিচিত। (লিসানুল মীযান, ৬/৪২ পৃষ্ঠা; তানক্বীহ, পৃষ্ঠা ৮৩)।

৩) ত্বালহা ইবনু মুসাররফ তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখেছি তিনি একবার তাঁর মাথা মাসাহ করতেন এমনকি তিনি মাথার পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তা হল ঘাড়ের অগ্রভাগ। (আবু দাউদ, হাদিস নং ১৩২, ১/১৭-১৮ পৃষ্ঠা)

.

তাহক্বীক্বঃ হাদীসটি মুনকার বা অস্বীকৃত। মুসাদ্দাদ বলেন, তিনি মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিক পর্যন্ত মাসাহ করেন এমনকি তার দুই হাত কানের নিচ দিয়ে বের করে নেন এই কথা ইয়াহইয়ার কাছে বর্ণনা করলে তিনি একে অস্বীকৃতি জানান। ইমাম আবু দাউদ বলেন, আমি ইমাম আহমাদকে বলতে শুনেছি। ইবনু উআইনাহ বলতেন, মুহাদ্দিসগণ ধারণা করতেন এটা সহীহ হাদীসের বিরোধী। তিনি এটাও বলতেন, ত্বালহা তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে এ কথা কোথায় পেল? (যঈফ আবু দাউদ, হাদিস নং ১৩২ এর আলোচনা)

৪) “ঘাড় মাসাহ করলে বেড়ি থেকে নিরাপদ থাকবে”।

তাহক্বীক্বঃ বর্ণনাটি জাল। (সিলসিলা যঈফাহ, হাদিস নং ৬৯, ১/১৬৮ পৃষ্ঠা] ইমাম সুয়ূতি জাল হাদীসের গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। [হাফেয জালালুদ্দীন আস সুয়ূতি, আল লাআলিল মাসনূআহ ফিল আহাদীসিল মাওযুআহ, পৃষ্ঠা ২০৩; সিলসিলা যঈফাহ, ১/১৬৮ পৃষ্ঠা)

৫) “যে ব্যক্তি অজু করবে এবং ঘাড় মাসাহ করবে তাকে কিয়ামতের দিন বেড়ি দ্বারা বাঁধা হবে না”। (আবু নুআইম, তারীখুল আসবাহান, ২/১১৫ পৃষ্ঠা)

তাহক্বীক্বঃ বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। (সিলসিলা যঈফাহ, হাদিস নং ৭৪৪, ২/১৬৭ পৃষ্ঠা) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী উক্ত বর্ণনাকে জাল বলেছেন। [আল মাসনু ফী মারেফাতিল হাদীসিল মাওযু এর পৃষ্ঠা ৭৩; সিলসিলা যঈফাহ, ১/১৬৯ পৃষ্ঠা] উক্ত বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু আমল আল আনসারী ও মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনে মুহাররম নামের দু’জন রাবী ত্রুটিপূর্ণ। মুহাদ্দিসগণ তাদেরকে দূর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। [সিলসিলা যঈফাহ, ১/১৬৯ পৃষ্ঠা]

মন্তব্যঃ ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা আরো আছে। এর দ্বারা প্রতারিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং ঘাড় মাসাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে এবং ঘাড় মাসাহ না করেই অজু সম্পন্ন করতে হবে। কিন্ত আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম ঘাড় মাসাহকে মুস্তাহাব বলেন। এমন কি আহলে হাদিসের অনুসারী ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও ঘাড় মাসাহ করার কথা বলেছেন। ইমাম শাওকানী রাহিমাহুল্লাহুও অজুতে ঘাড় মাসাহ করার কথা বলেছেন। হয়তো তাদর নিকট হাদিস পৌছে ছির কিন্তু তাজকীক পৌছায় নাই। তাই তারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন নাই। যা হোক অজুতে ঘাড় মাসাহ করা সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত নয়।

মাথা মাসাহ করা সম্পর্কে মতভেদ টুকুঃ

সম্পুর্ণ মাথা মাসাহ করা ফরজ। আমাদের সমাজে প্রচলিত মাথার চার ভাগের এক একভাগ মাসাহ করা ফরজ। তাই ব্যপারটি একটি খতিয়ে দেখা দরকার।  যারা বলেন মাথার চার ভাগের এক একভাগ মাসাহ করা ফরজ, তাদের দলীলগুলি আগে পর্যালোচনা করি। প্রথমত তারা সহিহ মুসলিমের একটি সহিহ হাদিস দিয়ে দলীল প্রদান করে থাকেন। আসলে হাদিসটি সহিহ কিন্তু তারা এর অনুবাদকে সুকৌসলে বিকৃতি ঘটিয়েছে। আমি উক্ত হাদিসটি অনুবাদ আমাদের ইসলামি ফাউন্ডেশনের অনুবাদ থেকে তুলে ধরলাম। হাদিসটি হলোঃ

মুগীরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, (এক সফরে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছনে রয়ে গেলেন। আমিও তাঁর সাথে পেছনে পড়লাম। তিনি হাজত পূরণ করে বললেন, তোমার সাথে কি পানি আছে? আমি একটি পানির পাত্র নিয়ে এলাম। তিনি উভয় হাতের কবজা পর্যন্ত এবং মুখমন্ডল ধূইলেন তারপর উভয় বাহু বের করতে চাইলেন, কিন্তু জোব্বার আস্তিনে আটকে গেল। এতে জোব্বার নিচ থেকে তিনি হাত বের করলেন এবং জোব্বাটি কাঁধের ওপর রেখে দিলেন। উভয় হাত ধুইলেন, মাথার সম্মুখভাগ এবং পাগড়ি ও উভয় মোযার ওপর মাসেহ করলেন। তারপর তিনি সাওয়ার হলেন এবং আমিও সাওয়ার হলাম। (সহিহ মুসলিম ৫২৬ ইফাঃ)

এই হাদিসটি মান সহিহ। আমরা জানি সফরে পাগরী ও মুজার উপর মাসেহ করা যায়। এই হাদিস দ্বারা বুঝা যায় তিনি মাথার সম্মুখভাগ এবং পাগড়ি উপর মাসাহ করেছেন। তিনি মাথার চার ভাগের এক একভাগ মাসাহ করছেন বলে এই হাদিসে প্রমান বহন করে না। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল হাদিসের অনুবাদ বিকৃতির মাধ্যমে দলীল পেশ করা। দেখুন মাথার চার ভাগের এক একভাগ মাসাহ প্রমান করার জন্য এই হাদিসটি অনুবাদ করা হয়েছে।

মুগীরা ইবনে শু’বা রাঃ বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে ছিলাম। তিনি প্রাকৃতিক প্রওয়াজন শেষ করে আমাকে বললেন:তোমার সাতে কি পানি আছে? আমি এক মটকা পানি নিয়ে আসলাম। রাসূল অজু কররেন……..এবং মাথার চারভাগের একভাগ মাসেহ করলেন।

দ্বিতীয় যে হাদিসটি দিয়ে দলীল প্রদান করে থাকেন, সে হাদিসটি যঈফ। এই যঈফ হাদিসটি সুনানে আবু দাউদে আছে। হাদিসটি হলোঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিতরিয়াহ্ নামীয় পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় অজু করতে দেখেছি। এ সময় তিনি তার হাত পাগড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে মাথার সম্মুখভাগ মাসেহ্ করেন, কিন্তু পাগড়ী খুলেননি। (আবু দাউদ ১৪৭ ইফাঃ, এই হাদিসটির মান যঈফ)

এবার আসুন, সহিহ হাদিস সমুহে ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে কি বর্ণিত হয়েছে, তা একবার দেখে নেয়া যাক। সম্পূর্ণ ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে অসংখ্যা হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো।

 মালিক ইবনু আনাস (রহঃ) থেকে আমর ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) উপরোক্ত সুত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এতে বলেছেন, “কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিলেন তিনবার” আর আজলার কথা বলেন নি। অবশ্য “সম্মুখের দিকে আনলেন ও পিছনের দিকে নিলেন- কথার পর বৃদ্ধি করেছেন, “মাথার সম্মুখ থেকে পেছন পর্যন্ত মাসহ করেছেন এভাবে যে, মাথার সম্মুখ ভাগ থেকে মাসহ আরম্ব করলেন, এরপর উভয় হাত ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে গেলেন; পুনরায় উভয় হাত ফিরিয়ে আনলেন যে স্হান থেকে আরম্ভ করেছিলেন সে স্থান পর্যন্ত, তারপর উভয় পা ধুইলেন। (সহিহ মুসলিম ৪৫০ ইফাঃ)

আমর ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) থেকে পূর্ব বর্ণিত সনদের অনুরুপ বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসের রাবী বলেনঃ অতঃপর তিনি তিনবার তিন অঞ্জলী দিয়ে কুলি করেন, নাকে পানি দেন ও নাক ঝেড়ে নেন। তিনি আরো বলেনঃ এরপর সম্মুখ থেকে পেছনে এবং পিছন থেকে সম্মুখে (হাত নিয়ে) একবার মাথা মাসহ করেন। রাবী বাহয বলেনঃ উহায়ব আমাকে হাদীসটি লিখিয়েছেন, উহায়ব বলেনঃ আমর ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) আমাকে এই হাদীসটি দুইবার লিখিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম ৪৫১ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ এমন ষ্পষ্ট বর্ণনার পর আর ব্যাখা করার কিছু নেই। মাথা মাসাহ করার জন্য সামনের দিক থেকে পেছনে আসবে এবং পেছনের দিক থেকে সামনে আসবে, এটা কঠিন বা সমস্যার কোনো বিষয় নেই। এটা খুবই সহজ বিষয়। প্রত্যেক চুলের গোড়ায় গোড়ায় যেতে হবে এমনটি নয়। মাসাহ করার অর্থ হচ্ছে হাত বুলিয়ে নেওয়া। এর অর্থ এই নয় যে প্রত্যেক চুল আপনাকে ভেজাতে হবে বা প্রত্যেকটা চুল স্পর্শ করতে হবে। মেয়েদের পুরা চুল সামনে নিয়ে আসতে হবে এটা শর্ত নয়। এটা চুলের ওপর দিয়ে করতে হবে। কাজেই সহিহ হাদিসের উপর আমল করি এবং সম্পুর্ণ মাথাই মাসাহ করি।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment