সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : প্রথম কিস্তি

সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : প্রথম কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সালাতের বিদআত ভুল আমলঃ

আমাদের উপমহাদেশে সালাতের আমল নিয়ে প্রচন্ড ধরনের বাড়াবাড়ি। সবাই নিজের আমলকে সঠিক ধরে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু একটি মজার বিষয় হল মহান আল্লাহ রহমতে সালাতে ফরজ ওয়াজিব নিয়ে তেমন কোন বিরোধ নাই। যত বিরোধ সুন্নাহ আর মুস্তাহাব নিয়ে। এই ধরনের মতভেদ সাহাবী, তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ীদের যুগেও বিদ্যমান ছিল। এমন কি আমাদের মাঝে আজ যে মাযহার সৃষ্টি হয়েছে তা এই সুন্নাহ সম্মত আমলের মত পার্থক্যের কারনে। সকল স্থানের আ্লোচনায় বিদআত গুরুত্ব পেলেও এবারের অলোচনায় সালাতের বিদআত আলোচনায় চেয়ে মতভেদ আর মতবিরোধকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হবে। কে হানাফি আর কে আহলে হাদিস কাউকেই বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হবে না। সকল মতকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হবে। সাথে সাথে আমরা সালাতে যে

 

১। দ্রুততার সাথে দৌড়িয়ে নামাযে শরীক হওয়াঃ 

আমাদের অনেকেই ঠিক সময় সালাতে হাজির হতে পারি না। মসজিদে ঢোকার সাথে সাথে যদি দেখি ইমাম সাহব সালাত পড়াচ্ছেন, আর দেরি না করেই তাকবীরে তাহরীমা পাওয়ার জন্য বা রুকু পাওয়ার জন্য দৌড়িয়ে বা দ্রুত হেঁটে ছালাতে শামীল হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন তোমরা ইকামত শুনতে পাবে, তখন সালাত এর দিকে চলে আসবে, তোমাদের উচিত ধীরস্থীরতা ও গাম্ভীর্যতা বজায় রাখা। তাড়াহুড়া করবেনা। ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় তা পূরা করে নিবে। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ৬০৮ ইফাঃ)

 

২। জায়নামাযে দাড়িয়ে প্রচলিত দোয়াটি পাঠ করা কি শরিয়ত সম্মত?

আমাদের সমাজে অনেক সালাত শুরুর আগেই জায়নামাজের দোয়া নামে একটি দোয়া পড়ে থাকে। দোয়াটি হলঃ

**ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাত্বরস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্ ও হানিফা অমাআনা মিনাল মুশরিকীন**

অর্থঃ আমি একনিষ্ঠ হয়ে আমার মুখ সে মহান সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিলাম যিনি আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই 

সালাতের আগে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে এই দোয়া পড়ান কোন প্রমান কুরআন সুন্নাহে পাওয়া যায় না। তবে তাকবীরে তাহলীমার পরে কিছু দোয়া পাঠের কথা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। কিন্তু সালাত শুরুর আগে কোন দোয়া পাঠ শরীয়তের কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় বিধায় বলা যায়, জায়নামাযের দোয়া বলতে শরীয়তে কিছু নেই। অবশ্য উপরোক্ত দোয়াটি রাসুলুল্লাহ ﷺ কখনো তাহাজ্জুদের নামাযে তাকবীরে তাহরীমার পর সানার স্থানে পড়তেন বলে প্রমাণিত আছে। তিনি যে দোয়াটি পড়তেন তার প্রাথমিক কিছু অংশ হল দোয়াটি। এসম্পর্কে আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত সহিহ মুসলিমে একটি দীর্ঘ হাদিস আছে। পাঠকের সুবিধার জন্য অংশ বিশেষ তুলে ধরলাম।

‘আলী ইবনু আবূ তুলিব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সলাত আদায় করতে দাঁড়াতেন তখন এ বলে শুরু করতেনঃ

ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা হানীফাওঁ ওয়ামাআনা মিনাল মুশরিকীনা ইন্না সলাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রব্বিল লামীনা……. .

(সহিহ মুসলিম ১৬৮৫ ইসলামী ফাউন্ডেশন, হাদিস একাডেমী ১৬৯৭, ইসলামীক সেন্টার ১৬৮৯)

কাজেই, সালাতের শুরুতে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তহরীমার আগে কোন প্রকারের দুআ পড়া হাদিস সম্মত নয়। তবে তাকবীরে তহরীমার পর সানা বা নামায শুরুর দোয়া হিসাবে একাধিক দোয়া হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। সেগুলো থেকে যে কোন দু্আ পড়া যেতে পারে। যেমনঃ

১। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরে ও কিরাআতের মধ্যে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মাতাপিতা আপনার উপর কুরবান হোক, তাকবীর ও কিরাআত এর মধ্যে চুপ থাকার সময় আপনি কী পাঠ করে থাকেন? তিনি বললেনঃ এ সময় আমি বলিঃ

 *اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ ‏”‏‏.‏*

(আল্লাহুম্মা বা-ইদ-বাইনি ওয়াবায়না খাতা ইয়া ইয়া-কামা বা আদতা বাইনাল মাশরিকি ওয়ালমাগরিবি, আল্লাহুম্মা নাক্কিনি মিনাল খাতাইয়া কামা ইউ নাক্কাস সাউবুল আবইয়াযু মিনাদদানাস্‌ , আল্লাহুম্মাগসিল খাতা ইয়া ইয়া বিল্‌মায়ি ওয়াস্‌সালজি ওয়ালবারাদ)।

হে আল্লাহ্! আপনি মাশরিক ও মাগরিবের মধ্যে যেরূপ দুরত্ব সৃষ্টি করেছেন, আমার ও আমার ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে ঠিক তদ্রুপ দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন। হে আল্লাহ! শুভ্র বস্ত্রকে যেরূপ নির্মল করা হয় আমাকেও সেরূপ পাক-সাফ করুন। আমার অপরাধসমূহ পানি, বরফ ও হিমশিলা দ্বারা বিধৌত করে দিন। (সহিহ বুখারী ৭০৮ ইফাঃ, ৭৪৪ তাওহীদ)।

২। আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায আরম্ভ করতেন তখন এই দু’আ পাঠ করতেনঃ সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গায়রুকা।” (সুনানে আবুদাউদ ৭৭৬ ইফাঃ)

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নামায শুরু করতেন তখন বলতেনঃ সুবহানাকা আল্লাহুমা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা (তিরমিজি ২৪৩)

৩। আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে সলাতের জন্য দন্ডায়মান হলে তাকবীরে তাহরীমা বলার পর এ দু‘আ পড়তেনঃ সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গায়রুকা। অতঃপর তিনবার “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” ও তিনবার “আল্লাহু আকবার কাবীরান” বলার পর “আ‘উযু বিল্লাহিস সামি‘ইল-‘আলীমি মিনাশ-শাইত্বানির রজীম মিন হামযিহি ওয়া নাফখিহি ওয়া নাফসিহি” বলতেন। তারপর ক্বিরাআত পাঠ করতেন। (আবু দাউদ ৭৫৫ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

৪। আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়িশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে নামায আদায় করাকালে কোন দু’আটি পড়তেন? তিনি বলেন, যখন তিনি রাতে তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের জন্য উঠতেন, তখন এই দু’আ পাঠ করতেনঃ আল্লাহুম্মা রব্বা জিবরীল ওয়া মীকাঈল ওয়া ইসরাফীল ফাতিরাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা, আলিমুল গায়বি ওয়াশ শাহাদাতে, আনতা তাহকুমু বাইনা ইবাদিকা ফীমা কানূ ফীহে ইয়াখতালিফুন। ইহ্‌দিনী লিমাখতুলিফা ফীহে মিনাল হাক্‌কি বিইয্‌নিকা, ইন্নাকা আনতা তাহদী মান তাশাউ ইলা সিরাতিম মুসতাকীম। (আবু দাউদ ৭৬৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ হাদীসে এমন বেশ কয়েকটি দুআ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর যে কোন একটি পড়লেই ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে। তাই আমাদের এই সকল সুন্নাহ বিরোধী কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। যদি কেউ জানার পরও ভাল মনে করে সওয়াবের আশায় সালাতের পূর্বে এই দোয়া পড়ে তবে বিদআত হবে তাকে কোন প্রকার সন্দেহ নাই। দ্বীনের মাঝে এই রকম মন গড়া আমল আবিস্কারই হল বিদআত।

৩।  ছালাত শুরুর সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করাঃ 

আমাদের সমাজের কিছু অজ্ঞ লোক আছে যারা সালাত আদায় করেনা। তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন সালাত আদায় করেন না? তারা বলবে সালাতের নিয়তই জানিনা। কারন বাল্যকালে যখন মকতবে গিয়েছিল তখন গদবাধা এক প্রকারের নিয়ত মুখস্তের চেষ্টা করে ছিল। এখন আর সেই নিয়ম স্মরণ নেই। এই গদ বাধা নিয়তকে তারা সালাতেরই অংশ মনে করেছিল। কারন মকতবে এই নিয়ত খুবই গুরুত্ব সহকারে পাড়ান হত। উদারহণ হিসাবে সেই গদবাধা নিয়ত থেকে দুই রাক-আত ফজরের ফরজ নামাজের নিয়ত তুলে ধরছি। “নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা-আলা রাক-আতাই সালাতিল ফাজরি ফারদুল্লাহিতা-আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলাজিহাতিল কা-বাতিশ্‌ শারীফাতি আল্লাহু আকবার”।

নিয়ত আরবী শব্দ। যার অর্থ হল, ইচ্ছা বা সংকল্প। আর ইচ্ছার স্থান হচ্ছে অন্তর। তা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহ বলেন,

*قُلْ إِن تُخْفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللّهُ وَيَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ*

অর্থঃ বলে দিন, তোমরা যদি মনের কথা গোপন করে রাখ অথবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ সে সবই জানতে পারেন। আর আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সেসব ও তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। (সুরা ইমরান ৩:২৯)

উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর -১)

একজন বিবেকবান, সুস্থ মস্তিষ্ক, বাধ্য করা হয়নি, এমন লোক কোনো কাজ করবে আর সেখানে তার কোনো নিয়ত বা ইচ্ছা থাকবে না সেটা সম্ভব নয়। নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল, সুতরাং নামাজের পূর্বে নিয়ত করা প্রয়োজন। নিয়ত হল অন্তরের সাথে দৃঢ় সংকল্প, শব্দের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

তারপরও কেউ কেউ “নাওয়াইতুয়ান” মুখে উচ্চারণ করে পড়ে থাকেন এবং অনেক সময় কিছু মূর্খ লোক এই নিয়তটি পড়তে বলে। অথচ হাদিসে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোথাও পাওয়া যাবে না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করেছেন বা করতে বলেছেন। বরং তিনি মনে মনে নিয়ত করেছেন।

আর “নাওয়াইতুয়ান” নামক এই আরবী বাক্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের অনেক বছর পর মানুষের দ্বারা নতুন আবিষ্কৃত বাক্য। সহীহ হাদীস তো দূরের কথা কোন যঈফ হাদীসেও মুখে নিয়ত উচ্চারণের কথা বলা নেই। তাই ইসলামের শরীয়াতের বিধান হল মনে মনে নিয়ত করা।

নিয়ত সম্পর্কে বিশিষ্ট কয়েক জন আলেমদের মন্তব্য তুলে ধরা হলোঃ

১) মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ত্রিশ হাজার ওয়াক্ত নামায আদায় করেছেন। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই কথা বর্ণিত নেই যে, আমি অমুক অমুক ওয়াক্ত নামাযের নিয়ত করছি। সুতরাং মুখে নিয়ত উচ্চারণ না করাটাই সুন্নাত। জেনে রাখুন, শব্দ উচ্চারণ করে মুখে নিয়ত করা জায়েয নয়। কারণ এটা বিদআত। সুতরাং যে কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি তা যে করে সে বিদআতি। [দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬-৩৭

২) আব্দুল হাই লাখনৌভী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। [দেখুনঃ সিরাতুল মুস্তাকীম]

৩) আবদুল হক দেহলভী হানাফী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবা কেরাম, তাবেঈ কারো হতেই কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন শুধু “আল্লাহু আকবার” বলতেন। এর পূর্বে মুখে নিয়ত পড়ার কোন শব্দ হাদীসে নেই। সে জন্য মুহাদ্দিসগণ মুখে নিয়ত পাঠ করাকে বিদআত ও মাকরূহ বলেছেন। [দেখুনঃ ফাতহুল কাদীর ।। মাদারিজুন নাবুওয়্যাত]

৪) আল্লামা শাফী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ চার ইমাম থেকেও মুখে নিয়ত পড়া প্রমাণিত নেই। [শামী, ১/৩৮৬ ।। বাহরূর রায়িক, ১/২৭৮]

৫) মালিকী মাযহাব মতে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা মাকরূহ। [দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬]

৬) হাম্বলী মাযহাব মতে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। [দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬]

৮) হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ কারো হতেই কোন প্রমান পাওয়া যায় না। মুখে পাঠের এই পদ্ধতি শয়তানের একটি কুমন্ত্রণা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন শুধু “আল্লাহু আকবার” বলতেন। আর আগে কিছু বলতেন না। সুতরাং মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। চার ইমামও এরূপ নিয়তনামা পড়াকে পছন্দ করেন নি। (ইগাসাতুল লুহফান, ১/১৩৬ ।। যাদুল মাআদ, ১/৫১)

৮) সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আরবী নিয়ত শব্দের অর্থ হল মনে ইচ্ছা পোষণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটা প্রমাণিত নেই। না প্রমাণিত আছে কোন সাহাবী এবং তাবেঈ থেকেও। তাই মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ৩৩৯-৩৪০ পৃষ্ঠা)

৯) ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ শব্দ করে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা নিকৃষ্ট বিদআত। যে ব্যক্তি একে উত্তম বা মুস্তাহাব বলবে তাকে তওবা করার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে তওবা করে নেয় তাহলে ভাল, অন্যথায় তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। (মাজমুআহ ফাতাওয়াহ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ)

১০) মদীনার মসজিদে নববীর খতীব এবং মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা আবু বাকার জাবির আল জাযায়েরী তার রচিত গ্রন্থে লিখেছেনঃ নামাযী যে নামাযের জন্য দাঁড়াবে, মনে মনে তার নিয়ত করা আবশ্যক। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের বিরোধী অর্থাৎ বিদআত। চার ইমাম সহ তার কোন অন্ধ অনুসারীও মুখে মুখে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে বলেন নি। [পবিত্রতা অর্জন ও নামায আদায়ের পদ্ধতি, পৃষ্ঠা ২০]

 (১১) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহিমাহুল্লাহ তার নিজ রচিত গ্রন্থে লিখেছেনঃ মুখে নিয়ত করা যাবে না। কেননা শরীয়তে এরূপ করার হুকুম নেই বরং এটা একটি বিদআত। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা সাহাবীগণ মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করেন নাই। [নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়ার পদ্ধতি, পৃষ্ঠা ৫]

 মন্তব্যঃ তাই গদবাধা তরিকায় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা একটি বিদআত। কেননা এর পক্ষে কোন সহিহ বা কোন যঈফ হাদীছও পাওয়া যায় না। এ ভাবে নিয়ত না রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না ছাহাবায়ে কেরাম না তাবেঈন না তাবে-তাবেঈন না চার ইমামের কেহ করেছেন। এটা কোন বুযুর্গ ব্যক্তির তৈরী করা প্রথা। তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং কোন কিছু করার জন্য অন্তরে ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করলেই সে কাজের নিয়ত হয়ে গেল। তা মুখে বলতে হবে না।

৪। কাতারে মাঝে ফাঁকা না রাখাঃ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা তোমাদের কাতার সোজা করে নাও। কেননা, আমি আমার পিছন হতেও তোমাদের দেখতে পাই। আনাস (রাযি.) বলেন আমাদের প্রত্যেকেই তার পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাতাম। (সহিহ বুখারী ৭২৫ তাওহীদ, ৬৮১ আধুনিক, ৬৮৯ ইফাঃ)

আবূ মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে আমাদের স্কন্ধ স্পর্শ করে বলতেনঃ তোমরা কাতারে এলোমেলো হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে তোমাদের অন্তর এলোমেলো হয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তারা আমার কাছে দাঁড়াবে। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি এবং তারপর যারা তাদের কাছাকাছি। আবূ মাসউদ বলেনঃ আজকাল তোমাদের মধ্যে প্রচণ্ড মত বিরোধ। আবূ আবদুর রহমান বলেনঃ আবূ মা’মারের নাম আবদুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ। (নাসাঈ ৮০৮, ইবনু মাজাহ হাঃ ৯৭৬, মুসলিম ৮৬৭ ইসলামিক সেন্টার)

নুমান ইবনু বশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমবেত ব্যক্তিদের নিকট উপস্থিত হয়ে তিনবার বলেনঃ তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর। আল্লাহর শপথ! তোমরা কাতার সোজা করে দন্ডায়মান হবে, অন্যথায় আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করবেন। রাবী বলেন, অতঃপর আমি মুসল্লীদেরকে পরস্পর কাঁধে কাঁধ, পায়ে পা এবং গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি। (সুনানে আবুদাউদ ৬৬২ ইফাঃ হাদিসের মান সহিহ, আরও দেখুন আবু দাউদ – ৬৬৬)।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কাতারের মধ্যে পরস্পর মিলে মিশে দাঁড়াও। এক কাতার অপর কাতারের নিকটে কর এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! আমি শয়তানকে নামাযের কাতারের মধ্যে বকরীর ন্যায় প্রবেশ করতে দেখেছি। (সুনানে আবুদাঊদ ৬৬৭ ইফাঃ)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কাতারে পরস্পর মিশে দাঁড়াও। কাতার সমূহকে পরস্পর নিকটবর্তী রাখ এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! আমি শয়তানকে দেখছি ছোট ছোট বকরীর মত কাতারের মধ্যে প্রবেশ করতে। (সুনানে নাসাঈ ৮১৬ ইফাঃ)

মালিক ইবন আবি আমীর (রহঃ) হইতে বর্ণিত, উসমান ইবন আফফান (রাঃ) তাহার খুতবায় বলিতেন এবং তিনি যখনই খুতবা দিতেন, তখন প্রায় ইহা বলিতেনঃ জুম’আর দিন ইমাম খুতবার উদ্দেশ্যে যখন দাঁড়ান, তখন তোমরা মনোযোগী হইয়া শুনিবে এবং নীরব থাকিবে। কেননা খুতবা শুনিতে না পাইয়াও যিনি নীরব রহিয়াছেন তাহার জন্য সওয়াব হইবে শুনিতে পাইয়া নীরবতা অবলম্বনকারীর সমান। অতঃপর যখন নামাযের ইকামত বলা হয়, কাতার বরাবর করিয়া লও এবং কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া লও। কেননা কাতার বরাবর করা নামাযের পূর্ণতার অংশবিশেষ। তারপর যতক্ষণ কাতার সোজা করার জন্য নিযুক্ত লোকজন আসিয়া ‘সফ’ সোজা হইয়াছে বলিয়া সংবাদ না দিতেন, ততক্ষণ তিনি (নামাযের) তকবীর বলিতেন না। (মুয়াত্তা মালিক হাদিস নম্বর ২২৭)।

মন্তব্যঃ উপরের হাদিসগুলোর থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলোঃ জামা‘আতরত অবস্থায় মুসল্লীগণ পরস্পর এঁটে এঁটে দাঁড়াবে, পরস্পরের মাঝে কোন ফাঁক রাখবে না। মুসল্লীগণ তাদের কাঁধের সাথে কাঁধ, পায়ে সাথে পা মিলাবে যাতে তাদের পরস্পরের মাঝে কোন ফাঁকা না থাকে। কারন হাদিসে আলোকে জানা যায়, ফাঁকা রাখা স্থানে শয়তান প্রবেশ করে। অথচ আমরা কাতাদের মাঝে ফাঁকা রাখাকে আমাদের ফ্যাসন হিসাবে নিয়েছি। যে সকল মুসল্লীগণ কাঁধের সাথে কাঁধ, পায়ে সাথে পা মিলাতে চেষ্টা করে, আমরা তাদের অপমান  করছি। তাদের ক্ষেত মনে করে তাড়িতে দিচ্ছি। অনেক আলেম দাবিদারকেও এ সম্পর্কে ব্যাঙ্গ করে ওয়াজ করতে শুনা যায় যা খুবই দুঃখ জনক। অনেক আলেম আবার যুক্তি দেখিয়ে বলে থাকেন, কাঁধের সাথে কাঁধ, পায়ে সাথে পা মিলানোর উদেশ্য হল কাতার সোজা করা। বর্তমানে যেহুতু মসজিদগুলোতে কাতার সোজা রেখে সালাতের সারি তৈরি আছে, তাই পরস্পর কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাড়ালেই হবে, পায়ের সাথে পা না মিলালেও চলবে। তারা মনে করেন, পায়ে সাথে পা মিলাতে কিছু লোক বাড়াবাড়ি করে তা যেমন ঠিক নয়, ঠিক তেমনি যারা পায়ের সাথে পা মিলাতে অহিনা করে তারাও ঠিক নাই। আসল কথা হলো, হাদিসে এসেছে, পায়ের সাথে পা লাগান। তাই, আসুন জামাতে সালাত আদায়ের সময়ে, কাতার কে সোজা রাখি, কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ে সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হারান সুন্নাহকে পুনুরুজ্জীবিত করি। আমাদের প্রায় সকলের আমল এই হাদিসের বিপরীত। উপমহাদেশের অনেক আলেম যারা বুখারী শরীফ পড়ান। তারাও সালাতে, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলানকে উপহাস করে থাকে। সাধারণ লোকের কথা বাদই দিলাম। তবে আশার কথা হলো বর্তমানে অনেক আলেম বিষয়টি বুঝে সালাতে পাশাপাশি পা মিলিয়ে দাড়াতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। যা হোক হাদিসের উপর আমল করাকে জরুরী মনে করতে হবে। সময় সুযোগ থাকা সত্বেও মুস্তাহাব বলে পরিত্যাগ করা যাবেনা। হ্যা, যদি সমাজের অধিকাংশ লোক এই কাজে বাঁধা দেন তবে, তাদের সঠিক দাওয়াত পৌছাতে হবে। দাওয়াত প্রদানে হিকমা প্রয়োগ করতে হবে। সমাজের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না, তবে হক পৌছাতে পিছ পাও হওয়ার অবকাশ নেই। 

৫। সালাতে হাত বাঁধার স্থানঃ

সালাতে হাত বাঁধার স্থান নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে বিশার এক বিতর্ক। কেউ বলে নাভীর নিচে, কেউ বলে নাভীর উপরে আবার কেউ বলে বুকের উপরে। তাদের এই তর্ক বিতর্কের মাঝে এক দল বলে হাত যে কোন স্থানে বাঁধালেই চলবে। বিষয়টি নিয়ে দুটি পক্ষ এতটাই মারমুখি যে আপনি সঠিক হাদিস উপস্থান করলেও যদি তার মতের বিরোধী হয় তবে মেনে নিবে না। কোন বিষয় যদি কেউ সমাধানের আগেই সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাকে বুঝান যায় না। আমাদের সমাজে হাত বাধার বিষয়টিও ঠিক অনুরুপ। অপর পক্ষে ইসলামের সৌন্দর্য হল, একই বিষয় একাধীক মতামত থাকলে দুটিকে সঠিক জেনে আমল করা। যার কাছে যেটা অধিক সঠিক সে তারই আমল করবে কিন্তু অপর মতামতকেও ভুল প্রমানের চেষ্টা চালাবে না। মনে মনে ভাববে আমার আমলতো সঠিক কিন্তু যদি তার আমল আমার চেয়েও সঠিক হয়। এমনি ভাবে উম্মতের মাঝে ঐক্য রক্ষা করে চলেত হবে। সামান্য সুন্নাহ ও মুস্তাহাব মাসায়েল যাতে একাধিক মত ও পথ আছে তার জন্য বিরোধে জড়ান হারাম কাজ। এমনই একটি সুন্নাহ আমল হলো, সালাতে হাত বাঁধার স্থান। একাধীক মতামত পাওয়া যায়। কাজেই যারা তাককিক করে আমল কতে পারবেন না, তারা যেকোন বিশ্বাস যোগ্য আমলদার আলেমের মতামতের ভিত্তিতে আমল করবেন কিন্তু অপরের আমলের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখবেন। আর যাদের তাহকিক করার ক্ষমতা আছে, তারা সরাসরি হাদিসের সাথে আমলটি মিলিয়ে সঠিকভাবে আমল করবেন।

৬। ডান হাত বাম হাতের উপর রাখাঃ

হাদিস নিয়ে গবেষনা করে জানা যায়, অধিকাংশ হাদিসে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ সহিহ বুখারীত হাত বাঁধা সম্পর্কে একটি হাদিসই এসেছে যাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার কথা বলা হয়েছে। হাদিসটি হলোঃ

সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের নির্দেশ দেয়া হত যে, সালাতে প্রত্যেক ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে। আবূ হাযিম (রহ.) বলেন, সাহল (রহ.) এ হাদীসটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করতেন বলেই জানি। ইসমাঈল (রহ.) বলেন, এ হাদীসটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেই বর্ণনা করা হতো। তবে তিনি এমন বলেননি যে, সাহল (রহ.) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করতেন। (সহিহ বুখারী ৭০৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ৬৯৬ আধুনিক প্রকাশনী)।

ঠিক তেমনি সহিহ মুসলিমেও এসেছে, ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা সম্পর্কে। হাদিসটি হলোঃ

ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছেন তিনি যখন সালাত শুরু করলেন তখন উভয় হাত উঠিয়ে তাকবীর বললেন। রাবী হাম্মাম বলেন, উভয় হাত কান বরাবর উঠালেন। তারপর কাপড়ে ঢেকে নিলেন (গায়ে চাঁদর দিলেন)। তারপর তার ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন তারপর রুকু করার সময় তার উভয় হাত কাপড় থেকে বের করলেন। পরে উভয় হাত উঠালেন এবং তাকবীর বলে রুকুতে গেলেন। যখন سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বললেন , তখন উভয় হাত তুললেন। পরে উভয় হাতের মাঝখানে সিজদা করলেন। (সহিহ মুসলিম ৭৮১ ইফাঃ)

এ সম্পর্কিত  আরও কয়েকটি হাদিসঃ

ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে নামায পড়ছিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখতে পেয়ে তাঁর বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে দেন। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫৫ ইফাঃ)

আসেম থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাবী বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জি ও এর জোরে আকড়িয়ে ধরেন রাবী বলেন, অতঃপর আমি কিছুদিন পর সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে, সাহাবায়ে কিরাম অত্যধিক শীতের কারণে শরীর আবৃত করে রেখেছেন। এবং তাদের হাতগুলো স্ব-স্ব কাপড়ের মধ্যে নড়াচড়া করছে। (সুনানে আবুদাউদ ৭২৭ ইফাঃ)

হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন নামাযরত ব্যক্তির নিকট দিয়ে গমন করছিলেন, যিনি ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে নামায পড়ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত খুলে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখলেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নম্বর ১৫০৯০)

৭। বুকের উপর হাত বাঁধাঃ

যারা বুকের উপর হাত বাঁধাকে সঠিক মনে করে থাকেন তারা দলীল হিসেবে আবু দাঊদ বর্ণিত নিম্মের হাদিসটি পেশ করেন।

তাউস (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযরত অবস্থায় ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে তা নিজের বুকের উপর বেঁধে রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নম্বর ৭৫৯ ইসলমি ফাউন্ডেশন হাদিসের মান সহিহ)

৮। যারা নাভীর উপরে বা নিচে হাত বাঁধার দলীলঃ

আমি মুলত আমাদের উপমহাদেশের সিয়া সিত্তাহ নামে খ্যাত, সহিহ বুখারী, সহহি মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ এর হাদিসের আলোকে পর্যালোচনা করছি। এই সকল হাদিসের কিতাবে নাভীর নিজে বা উপরে হাত বাধার কোন সহিহ বর্ণানা পাওয়া যায় না। সুনানে আবু দাউদে কয়েকটি যঈফ বর্ণনা পাওয়া যায়।  যেমনঃ

আবূ জুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আলী (রাঃ) বলেন, নামাযে রত অবস্থায় নাভির নীচে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের তালু রাখা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নম্বর ৭৫৬ ইসলমি ফাউন্ডেশন হাদিসের মান যঈফ)

ইবনু জুরাইজ থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি আলী (রাঃ)-কে নামাযে নাভির উপরে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি ধরে রাখতে দেখেছি। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নম্বর ৭৫৭ ইসলমি ফাউন্ডেশন হাদিসের মান যঈফ)।

আবূ ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, আমি নামাযে নাভির নীচে (বাম) হাতের উপর (ডান) হাত রাখি। আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) ইসহাক আল-কূফীকে দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করতে শুনেছি। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নম্বর ৭৫৮ ইসলমি ফাউন্ডেশন হাদিসের মান যঈফ)।

এই গবেষনার পাঠ্যসুচি, সিয়া সিত্তাহ হাদিস গ্রন্থ সহিহ বুখারী, সহহি মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ এর বাহিরও হাজার হাজার সহিহ হাদিস বিদ্যমান। তাই যারা নাভীর নিচে হাত বাধান জন্য এর বাহিরের হাদিস গ্রন্থ উল্লেখ করে, তাদের মতামত উল্লেখ না করলে নিশ্চয় জুলুম হবে। নাভীর নিচে হাত বাধার সম্পর্কে বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে। তেমনি একটি প্রবন্ধ যা একটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমন একটি প্রবন্ধ থেকে এ সম্পর্কে কিছু তুলে ধরছি। নাভীর নিচে হাত বাঁধা সম্পর্কে “মাসিক আল কাউসারে নভেম্বর ২০১১ সংখ্যায়”, মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ এর লিখিত প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি হাদিস/আসার নিম্মে উল্লেখ করছি যা তারা আলোচ্য বিষয়ের প্রমান হিসাবে তুলে ধরছেন। 

** তাবেয়ী আবু মিজলায লাহিক ইবনে হুমাইদ রাহ. (মৃত্যুঃ ১০০ হিজরীর পর) নামাযে কোথায় হাত বাধঁবে এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের উপর নাভীর নিচে রাখবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৩, এই রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ)

** বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও (মৃত্যু : ৯৬ হি.) এই ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩৯৬০

এই রেওয়ায়েতের সনদ হাসান)।

** ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রাহ. (১৮৯ হি.) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. নাভীর নিচে হাত বাঁধতেন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমরা এই নিয়মই অনুসরণ করি এবং এটিই (ইমাম) আবু হানীফার সিদ্ধান্ত।’ (কিতাবুল আছার, হাদীস – ১২১)

** ইমাম মুহাম্মাদ বলেন, ‘ডান হাতের তালু বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে, নাভীর নিচে। সুতরাং কব্জি থাকবে হাতের তালুর মাঝে।’ (কিতাবুল আছার, হাদীস  ১২০)

তাদের দাবিঃ খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস ও ফিকহের বিখ্যাত ইমামগণও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এটি সাহাবীদের যুগ থেকে চলে আসা একটি রীতি। তারা অনেক সময় নাভীর নিজে হাত বাঁধার যঈফ হাদিসগুলি উল্লেখ করেন কিন্তু প্রমানের জন্য বলেন না, যা তাদের আমনতদারীরই বহিঃপ্রকাশ।

মন্তব্যঃ হাত বাঁধার উপরে বর্ণিত হাদিসগুলি পর্যালোচনা করে বলা যায়ঃ

১। সহিহ হাদিসের বিপরীতে এরূপ যঈফ হাদিসের আমল করে নাভীর নিচে হাত বাঁধা সঠিক হবে না। কাজেই বুকের উপর হাত বাঁধার হাদিসের উপর আমল করতে হবে।

২। আমাদের উপমহাদেশের আলেমগন নাভীর নিজেন হাত বাধার পাশাপাশি বুকের উপর হাত বাধার হাদিসগুলোকে সহিহ মনে করে থাকেন। তার প্রমান যারা নাভীর নিজে হাত বাধেন, তাদের মা বোনেরা বুকের উপর হাত বাধেন। অথচ সহিহ বা যঈফ কোন সনদেই বর্ণিত হয় নাই যে, পুরুষগণ নাভীর নিজে আর মহিলাগন বুকের উপর হাত বাধবে।

৩। চলে আসা রীতি বলে বলে নাভীর নিজে হাত বাধা কোন যুক্তি হতে পারেনা। কারন মক্কা মনীনার অধিকাংশ আলেম নাভীর নিচে হাত বাধেন না। তারা বুকের উপর হাত বাধেন। আর উপমহাদেশের আলেমগন অধিকাংশ নাভীর নিচে হাত বাধেন। তাহলে ইসলামের চলে আশা রীতি কোনটা ধরব, মক্কা মনীনা না কি ভারতীয় উপমহাদেশ?

৩। আমাদের উপমহাদেশের অনেক আলেম যেহেতু সহিহ সনদে অনেক আসার তুলে ধরেছেন তাদের দাবী এই আসারগুলির সনদ সহিহ। কাজেই তারা যদি এর উপর আমল করে তবে তাদের আমলকে হবে বলে উড়িয়ে দেয়াও সঠিক হবে না। কারন আমাদের সালফে সালেহীনও (সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ) আমাদের আমলের দলীল। তাই বলা যায় তারাও দলীল ভিত্তিক আমল করছেন।

৪। আবু দাউদের দুটি হাদিস পর্যালোচনা করলে সঠিক হাত বাঁধার নিয়ম হবেঃ

তাউস (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযরত অবস্থায় ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে তা নিজের বুকের উপর বেঁধে রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নম্বর ৭৫৯ ইসলমি ফাউন্ডেশন হাদিসের মান সহিহ)

আসেম থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাবী বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জি ও এর জোরে আকড়িয়ে ধরেন রাবী বলেন, অতঃপর আমি কিছুদিন পর সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে, সাহাবায়ে কিরাম অত্যধিক শীতের কারণে শরীর আবৃত করে রেখেছেন। এবং তাদের হাতগুলো স্ব-স্ব কাপড়ের মধ্যে নড়াচড়া করছে। (সুনানে আবুদাউদ ৭২৭ ইফাঃ)

এই সহিহ হাদিস দুটির আলোকে বলা যায়ঃ ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জিকে আকড়িয়ে ধরে বুকের উপর বাঁধা। যারা সম্পুর্ণ ডান হাতকে সম্পুর্ণ বাম হাতের উপর রেখে দাড়ান তাদেরটি কতটুকু শুদ্ধ হবে? নিম্মের চিত্রে কিছু আলেমদের হাত বাধার পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে। যা এই দুটি হাদিসের আলোকেই মনে হচ্ছে সঠিক মনে হচ্ছে। আল্লহু আলাম।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment