সবর কী এবং কেন করতে হবে?

সবর কী এবং কেন করতে হবে?

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

সবর (صْبِرْ) একটি আরবী শব্দ যার আভিধানিক অর্থ ধৈর্য ধারণ করা, বাধা দেয়া বা বিরত রাখা বা আটকে রাখা। শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে চাপড়ানো ও  জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা থেকে বিরত রাখা।

জুনায়েদ বাগদাদী রহ. কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ ‘হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা’। জুন্নুন মিসরী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা। তাই বলা যায় বিপদে-আপদে, বালা- মুসিবতে এবং সুখে-দুখে আল্লাহ ফয়সালা মেনে নেওয়াই হল সবর।

পারিভাষিকভাবে আমরা সবর বলতে ধৈর্য্য ধারন করা কে বুঝি। এই জন্য কার কোন বিপদ ঘটনে, কেউ মারা গেল, কার জান মালের  ক্ষতি সাধণ হলে কিংবা অনাকাংখিত কোন ঘটনা ঘটলে তাকে আমরা সবর বা ধৈর্য্য ধারন করতে বলি। সবর বা ধৈর্য্য ধারণ করা মানুষের একটি উত্তম স্বভার যার প্রশংসা মহান আল্লাহ করেছেন। এই মহৎগুনটি মানুষকে অসুন্দর, অসুচিৎ ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি এমন একটি আত্মিক শক্তি যা দিয়ে মানুষ নিজেকে সুস্থ্য, সুরক্ষিত ও মধুময় করে রাখতে পারে। ইসলামি শরীয়তে সবর হল, বিপদের মুখেও এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যান অনুমতি শরীয়ত আমাদের দেয়নি। যেমন, কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা, দুঃখে-কষ্টে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা, আল্লাহ পাকের শানে অসঙ্গত কথা বলা কিংবা মনে মনে অসঙ্গত কোনো বিশ্বাস পোষণ করা ইত্যাদি। এসবে না জড়িয়ে দয়াময় আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিয়ে তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করার নামই হল সবর। এই সবর প্রকৃত মুমিনের হাতিয়ার।

সবর করতে হবে কেন?

কোন কর্মের কারনে মানুষ কষ্ট পেলে, রাগ হলে, যন্ত্রনা থাকলে, পরিশ্রম ব্যর্থ হলে, তার মনে দুঃখ ও ক্ষোপের সৃষ্ট হয়। এই দুঃখ ও ক্ষোপ থেকে পরিত্রানের উপায় বলা দুস্কর। ইসলাম কিন্তু এর একটি সহজ সরল সমীকরণ দাড় করিয়ে দিয়েছে। আর তা হলো, এই সকল কষ্ট, রাগ, যন্ত্রনা ব্যর্থতার বিপরীত শুধু সবর করা এবং এর প্রতিদান শুধু মহান আল্লাহ নিকট কামনা করা। আকাঙ্ক্ষা বা অভিলাষ পূরনের জন্য পরিশ্রম করতে থাকে, ব্যর্থ হলে নিজের উপর বা কর্মের উপর ক্ষোপের সৃষ্ট হয়। এখান থেকে পরিত্রানের এক মাত্র ঔষধ সবর বা ধৈর্য্য ধারন করা। এর বিপরীদও আর একটি চিত্র আছে, যেখান আমাদের কোন হাত নেই। যেমনঃ দৈব দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুখ-বিসুখ, জান-মালের ক্ষতি ইত্যাদি। যেখান কোন হাত নেই, সেখানে সবর বা ধৈর্য্যই একমাত্র সম্ভল।

সমাজে খোজ নিলে হয়ত দেখা যাবে, কেউ হয়তো চাকরি হারিয়ে অভাবে কষ্টে জীবন করছে। কেউ হয়তো বাবা-মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তানদের জটিল অসুখের চিকিৎসায় দিনরাত সংগ্রাম করছে। কেউ হয়তো নিজেরই নানা ধরনের জটিল অসুখে ভুগছে। কেউ হয়তো জমি-জমা, সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের সাথে শত্রুতায় জড়িয়ে পড়ছে। কেউ হয়তো শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচারে অধিষ্ট। কেউ হয়তো ছেলে বউয়ের কারনে বৃদ্ধাশ্রমে। কেউ হয়তো দুশ্চরিত্র স্বামী দ্বারা কষ্ট পাচ্ছে যে, পরকিয়ায় সময় পার করছে। কোন স্বামী হয়তো এমন নারীর কারনে অসুখি যে, পর পুরুষে আসক্ত। কোন পিতা হয়তো এমন ছেলে জন্য কষ্ট পাচ্ছ যে, ড্রাগে আসক্ত হয়ে পরিবারের মুখে কালিমা লেপে দিচ্ছে। এমনিভাবে সমাজে হাজার সম্যস্যা দ্বারা জর্জরিত। কোন মানুষই এই ধরনের সমস্যায় পড়তে চায় না বরং সে যে কোন কিছুর বিনীময় এ সমস্যা থেকে মুক্তি চায়। এই সকল সমস্যা সমাধানের জন্য মহান আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করে ফরিয়াদ করতে হবে এবং নিজের সাধ্য অনুসারে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তার পরও যতি সমস্যার সমাধান না হয় তবে সবর করতে হবে। মহান আল্লাহ মানুষ সৃ্ষ্টির অন্যতম কারন হল তাকে পরীক্ষা করা। তার পরীক্ষার অন্যতাম উপদান হলো, মানুষকে দুঃখ কষ্ট প্রদান।

এই পরীক্ষায় পাসের একমাত্র উপর করন হলো সবর করা। যদি কেউ সবর করতে ব্যর্থ হয় তবে সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য।  মহান আল্লাহ বলেন,

*وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ*

অর্থঃ আমি তোমাদের কে অবশ্যই পরীক্ষা করবো যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাঁচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদকারী এবং কে ধৈর্যশীল৷ (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩১)

মহান আল্লাহ আরও এরশাদ করেন,

*أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى*

অর্থঃ মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে? (সুরা কিয়ামা’ত ৭৫:৩৬)।

মহান আল্লাহ আরও এরশাদ করেন,

إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا

অর্থঃ আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে। (সুরা কা’হফ ১৮:৭)

ন্তব্যঃ মহান আল্লাহ মানুষে পৃথিবীতে দায়িত্বহীন করে ছেড়ে দেননি। সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ সন্তুষ্টি অন্নেষণ করবে। এই সকল আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে এই অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সময় তার উপর নানাবিধ বিপদ আসবে, আর মহান আল্লাহ দেখবের কর্মে কে ভাল। অর্থাৎ বিপদে কে সবর করে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment