মিলাদ কিয়াম একটি বিদআতি আমল

মিলাদ কিয়াম একটি বিদআতি আমল

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। মিলাদ মাহফিলঃ

আমাদের সমাজে ব্যাপক প্রচলিত একটি ইবাদতে নাম মিলাদ। মসজিদের ইমাম সাহেব সালাত শেষে প্রায়ই ঘোষণা করে থাকেন, দোয়া বাদ মিলাদ আছে। যেহেতু ইমাম সাহেব ঘোষনা করছেন আর আমল করা হবে মসজিদে, তাহলে ইবাদাত না বিদআত প্রশ্ন করা অন্যায়। তার পরও দেখি সমাজের এক শ্রেণীর লোক এর বিরোধীতা করে থাকেন। কিন্তু কেন? আমরা দেখি সাধারণত কেউ ভাল কোন কাজ করার ইচ্ছা করলে মিলাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। নতুন ঘর তোলার পূর্বে, নতুন ঘরে উঠার পূর্বে, দোকান বা কোম্পানী উদ্ভোদন করার সময়, বিয়ের পূর্বে, বিয়ে পড়ানোর পরে, নতুন জাহাজ বা নৌকা পানিতে ভাষানোর পূর্বে, বাড়ির কল্যাণ কামনায়, কারো সুস্থতা কামনায়, মৃত্যু বার্ষিকীতে, চল্লিশায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম উৎসবে (ঈদে মিলাদুন্নবীতে), বিশেষ কোন দিবস পালন বা বিশেষ কোনো উপলক্ষে মিলাদের মাহফিল বা অনুষ্ঠান করে থাকে। সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত এই ইবাদাতটি কতটুকু ইসলামি শরীয়ত সম্মত? হয়তো অনেক প্রশ্ন করতে পারেন এত প্রচলিত একটি ইবাদাত সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা অন্যায়। কিন্তু না, এই কথা কয়েক দশক আগে বললে সাধারন মানুষ কেন হয়ত মৌলভীদেরও বুঝান কষ্ট হত। এখন ইসলামি জ্ঞান সহজ লভ্য, তাই পাড়ার ছোট ছাত্র ভাইটিকে আর বুঝাতে কষ্ট হয় না। তাহলে চলুন মিলাত সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। 

অনেকে মিলাদ ও ঈদে মিলাদুন্নবী এক করে দেখেন। কারণ এই দুটির মাঝে পরিভাষাগত বা আমলগত পার্কথ্য সমান্যই। ভুমিকায় দেখেছি বিভিন্ন কারনে মিলাদের অনুষ্ঠান করা হয়। মিলাদ মাহফিলের জন্য কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষন লাগে না কিন্তু ঈদে মিলাদুন্নবী যেহেতু  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জম্ম দিন কে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয়ে থাকে তাই এর দিনক্ষন নির্দষ্ট। বছরে একবার, ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে পালন করা হয়।

মিলাদ একটি আবরি শব্দ যার বাংলা অর্থ থাকলেও মুসলিম সমাজে মিলাদ অর্থেই সমধিক পরিচিত। মিলাদ (ميلاد), মাওলেদ (مولد) এবং মাওলুদ (مولود) এ তিনটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে হল জন্মদিন, জন্মকাল ও জন্মস্থান প্রভৃতি। প্রসিদ্ধ আল মুনজিদ নামক আরবি অভিধানের الميلاد – وقت الولادة অর্থাৎ মিলাদ অর্থ জন্মসময়। المولد – موضع الولادة او وقتها মাওলেদ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। المولود الولد الصغير মাওলুদ অর্থ ছোট শিশু। অনুরূপ মিসবাহুল লুগাতের বলা হয়েছে, ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মসময়। ‘মাওলেদ’ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। ‘মাওলুদ’ অর্থ ছোট শিশু। সারকথা আরবিতে ‘মিলাদ’ শব্দটি জন্মকাল বা জন্মদিন ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হয় না।

অপর পক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী (مَوْلِدُ النَبِيِّ) হল আরবি তিনটি শব্দের সম্মিলিত রূপ। ঈদ, মিলাদ ও নবী এই তিনটি শব্দ নিয়ে এটি গঠিত। আভিধানিক অর্থে ঈদ অর্থ খুশি, মিলাদ অর্থ জন্ম, নবী অর্থ বার্তাবাহক। পারিভাষিক অর্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়াতে আবির্ভাবের আনন্দকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হয়। কাজেই ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বলতে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনকে বিশেষ পদ্ধতিতে উদযাপন করাকেই বোঝান হয়। জন্মদিনকে উদযাপন বা পালন বা জন্ম উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করাই মীলাদুন্নবী হিসেবে মুসলিম সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত।

মিলাদ ও ঈদে মিলাদুন্নবী মাঝে মিল ও অমিলগুলি হলঃ

০১। মিলাদ এর অর্থ জম্মদিন অপর পক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনের আনন্দ।

০২। বছরের যে কোন সময় মিলাদ মাহফিল করা হয়, শুধু মাত্র ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা হয়।

০৩। যে কোন শুভ কাজের শুরুতে বা বীপদ থেকে মুক্তির আশায় মিলাদের আয়োজন করা হয় অপর পক্ষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনের আনন্দ প্রকাশের জন্য আয়োজন করা হয়। এই দিনেও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

এই দুটি বিদআত কোন প্রকার দলীল ছাড়াই সমাজে প্রচলিত আছে। মিলাদ সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করব তারপর ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

২। মিলাদ মাহফিলের নিয়মঃ

বিদআতিদের নিকট মিলাদ মাহফিল যেহেতু একটা ইবাদাত কাজেই তারা এর মাঝে কিছু ধারা বাহিক নিয়ম নীতি চালু করছে। কুরআন সুন্নাহ বর্জিত এই সকল নিয়ম নীতিগুলিই মিলাদ পড়ার নিয়ম। মিলাদ মাহফিল সমাজে খুবই প্রচলিত কাজেই আমরা প্রাই সকলে এর নিয়ম সম্পর্ক অবহিত। তাই সংক্ষেপে এই মিলাদ পাঠের নিয়ম আলোচনা করা

৩। মিলাদের শুরুতে পরিত্র কুরআন তিলওয়াতঃ

মিলাদের শুরুতে পরিত্র কুরআন থেকে তিলওয়াত করা হয়। কুনআন থেকে সাধারণত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত সূরা তাওবা ও আহযারের আয়াতগুলি তিলওয়াত করা হয়।  যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

 لَقَدۡ جَآءَڪُمۡ رَسُولٌ۬ مِّنۡ أَنفُسِڪُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡڪُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٌ۬ رَّحِيمٌ۬ (١٢٨) فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُلۡ حَسۡبِىَ ٱللَّهُ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ‌ۖ عَلَيۡهِ تَوَڪَّلۡتُ‌ۖ وَهُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ (١٢٩)

অর্থঃ তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। এ সত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে বলে দাও, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী নেই। আমি তাঁরই ভরসা করি এবং তিনিই মহান আরশের অধিপতি। [সুরা তাওবা ৯:১২৮-:১২৯]

মহান আল্লাহ বলেন,

مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

অর্থঃ মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। [ সুরা আহযাব ৩৩:৪০ ]

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থঃ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর। (সুরা আহযাব ৩৩:৫৬)

৪। দুরত পাঠঃ

আহযাবের ৫৬ নম্বরের এই আয়াতটি তিলওয়াত করার সাথে সাথে সবাই খুবই মহব্বতের সাথে নিম্মের দুরুতটি পাঠা করে।

বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ছল্লীআলা সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ। ওয়াআ’লা আলি সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ।

এর পরই রাসুলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত কাসিদা বাংলা, ফার্সি ও উর্ধুতে সুর দিয়ে গাইতে থাকে। একটা কাসিদা পাঠ করার পর একবার উপরের দুরুদটি পাঠ করে করে।

যেমনঃ

[ক্বুল কা’য়িনাত সবাই বলেন, আজকে মোদের ঈদের দিন। এ জমিনে তাশরীফ আনলেন রহমাতুল্লিল আলামীন। আল্লাহুম্মা ছল্লীআলা সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ। ওয়াআ’লা আলি সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ।]

[গাছে চিনলো মাছে চিনলো চিনলো বনের হরিণে উম্মত হইয়া চিনলাম নারে দুঃখ রইলো মনেতে। আল্লাহুম্মা ছল্লীআলা সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ। ওয়াআ’লা আলি সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ।]

[নূর নবীজির পাক বদনে মসা মাছি পড়তনা। আল্লাহুম্মা ছল্লীআলা সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ। ওয়াআ’লা আলি সাইয়্যিদিনা মাওলানা মুহাম্মাদ।]

৫.। কিয়াম করা বা দাড়িয় সালাম করাঃ 

এভাবে কয়েকবার সম্মিলিতভাবে দুরুদ ও কাসিদা পাঠ করার পর সকলেই দাড়িয়ে রাসুলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম প্রদান করে। ইহাকে মিলাদের কিয়াম বলা হয়। বিদআতিগন ইহাকে কিয়াম শরীফ বলে। এখানেও রাসুলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম প্রদানের সময় প্রতিবার একটি করে কাছিদা গাওয়া হয়। প্রতিবার সালমের প্রদানের সময় এই দুরুদ পড়ে সালাম প্রদান করা হয়।

صلي الله علي رسول الله *

* صلي الله عليه و سلم *

* صلي الله علي حبيب الله

*- صلي الله عليه و سل

বাংলা উচ্চারণঃ সল্লাল্লাহু আলা রাসুলাল্লা, সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সল্লাল্লা হু আলা হাবিবাল্লাহ  সল্লাল্লা হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।

সালাম প্রদানের পদ্ধতিঃ সবাই সালাম প্রদানের জন্য নিম্মের বাক্যগুলি পাঠ করে থাকে।

আস-সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ। আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ। আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ। সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।

[মদিনার সবুজ মিনারে দেকে নিন আপনার কিনারে চুমিবো মুবারক ক্বদম এই আশা গোলামের অন্তরে,

আস সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।]

[দিদার হো রওজেকি তামান্না দিলমে হো ইয়েহি তারানা হো ক্যায়সে মদিনা যানা ব্যকুল হ্যায় দিলে দিওয়ানা,

আস সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।[

[আরশো কা ক্বাবা মদিনা, পরশো কা ক্বাবা মদিনা ক্বাবাতুল ক্বাবা মদিনা জান্নাত কা নকশা মদিনা,

আস সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।[

[গিরনে ওয়া-লোকো সামালো মরণে ওয়ালোকো বাঁচালো ক্বায়েদ ছে হামকো ছুড়ালো আপনি দামান মে ছুপালো,

আস সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।]

[সায়্যিদে ইয়া রাসুলুল্লাহ ইয়া হাবিবুল্লাহ, আপনি তো শাহে মাদিনা গোলাম যে আপনার দিওয়ানা দিদারে রওজা পাকে আপনার নিয়ে যান শোনার মদিনা

আস সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবাল্লাহ আস সালামু আলাইকুম ইয়া নাবিয়াল্লাহ সালাওয়া তুল্লা আলাইকুম।]

৬। শেখ শাদির লেখা কবিতা পাঠঃ

কিয়াম করে সালাম প্রদানের পর আবার বসে পড়েন এবং শেখ শাদির বিখ্যাত একটি কবিতা পাঠ করা হয়। কবিতাটি হলঃ

বালাগাল উলা বিকামালিহি।

কাশাফাদদুজা বিজামালিহি। 

হাসুনাত জামিইউ খিছলীহি।

ছল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।

৭। ছওয়াব রেসানী করাঃ

অতঃপর ছওয়াব রেসানী করে দোয়া মুনাজাত করা হয়। ছওয়াব রেসানী করার নিয়ম

ক।  ইস্তিগফার শরীফ তিনবার। (আসতাগফিরুল্লাহা রব্বি মিন কুল্লি জাম্বিউঁ ওয়াতুবু ইলাইহি)। )

খ।  আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সহ সূরা ফাতিহা একবার।

গ। বিসমিল্লাহ সহ সূরা ইখলাছ তিনবার।

ঘ। দরূদ শরীফ পাঁচ বার।

৮। দুয়ার মাধ্যমে মাহফিল শেষ করাঃ

অতঃপর সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার উসীলা দিয়ে দোয়া করা হয়। দোয়ার শুরুতে, মাঝে এবং শেষে অবশ্যই দরূদ শরীফ পাঠ করতে হবে।

৯। মিলদের ইতিহাসঃ

ঐতিহাসিকগণ মতে যারা সর্বপ্রথম এই বিদআতকে রূপদান করে তারা হল, বনী উবাইদ আল কাদ্দাহ। এরা নিজেদেরকে ফাতেমী বলে অবিহিত করত এবং নিজেদেরকে আলী রাদিয়াল্লাহুর বংশধর বলে দাবী করত। এরাই ফাতেমী দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/২০২

ইসলামের নামে মিলাদ প্রচলনে এই ফাতিমীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, দ্বীন ইসলামের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে তার মধ্যে এমন কিছু ঢুকানো যার অস্তিত্ব দ্বীনের মধ্যে ছিল না। কারণ, ইসলামী শরীয়ত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত থেকে মানুষকে দূরে সরানোর সব চেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, তাদেরকে বিদআতের মধ্যে ব্যস্ত রাখা। ইতিহাসবিদদের মতে, এদের অবস্থান ইসলাম থেকে শুধু দূরেই নয় বরং এরা ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর দুশমনও যদিও এরা বাহ্যিক ভাবে তা স্বীকার করে না।

হিজরী ৬০৪ সনে আরবিলার সুলতান মুজাফফরউদ্দীন মওসিল শহরে (ইরাকের পার্শ্ববর্তী একটি শহর) এই মিলাদ নামক বিদ’আতের প্রথম প্রচলন করেন।যে সময় ক্রুসেডের মহাসমরে লক্ষ লক্ষ খৃষ্টান সৈন্য সিরিয়া ও জেরুজালেম শহরে আগমণ করে। যিশু খৃষ্টের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আকর্ষণীয় মেলা দেখে সুলতান মুজাফফরের হৃদয়ে রাসূলে কারীম (সাঃ) এর জন্মদিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের প্রেরণা জাগ্রত হয়, অনুগত একজন মৌলভীকে দিয়ে এই মিলাদের আনুষ্ঠানিকতা চালু করা হয়।

সুলতান মুজাফফরউদ্দীন সম্পর্কে আল্লামা যাহাবী (রহঃ) বলেন, বাদশাহ(মুজাফফরউদ্দীন) রাসূল(সাঃ) এর মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বাৎসরিক ৩ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করতেন।  (দুলিল ইসলাম, ২/১০২; মিনহাজুল ওয়াজেহ, ২৫০)

সুলতান মুজাফফরউদ্দীন এর আদেশে ওমর ইবনে দাহিয়া আবুল খাত্তাব নামের এক মৌলভী মিলাদ সম্পর্কে একখানা বইও লেখেন। মন মাতানো ভাবভঙ্গিমায় পূর্ণ বই দেখে সুলতান তাকে এক হাজার মুদ্রা পুরষ্কারও প্রদান করেন। (দুলিল ইসলাম, ১/১০৪)

মুজাফফরউদ্দীন সম্মানিত ইমামগন ও সালফে সালেহীনদের শানে অত্যন্ত অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করত। নগ্ন ও অশ্লীল বাক্য বলতে দ্বিধাবোধ করত না। নির্বোধ ও দাম্ভিক প্রকৃতির লোক ছিল। ধর্মীয় আদেশ ও নিষেধাবলী তুচ্ছজ্ঞান করে বেপরোয়াভাবে শৈথিল্য প্রদর্শন করত”। (লিসানুল মিজান, ৪/২৯৬)

আল্লামা ইবনে বুখারী (রহঃ) বলেন, মওসিল শহরের সকলেই একথার ওপর একমত ছিল যে, মিলাদ প্রবর্তক ও মিলাদ সম্পর্কিত বইয়ের লেখক উভয়েই মিথ্যাবাদী ও ধর্মকর্মে অকর্মণ্য ছিল।-(লিসানুল মিজান, ৪/২৯৫)

নব আবিষ্কৃত বিদ’আতের নির্দেশদাতা সুলতান মুজাফফরউদ্দীন ও ওমর ইবনে দাহিয়া আবুল খাত্তাব এর সাথে সে যুগের ভন্ডপীর ও মাজার-পূজারীগণ এসে সম্পৃক্ত হল, নির্দিষ্ট দিনে যখন দেশের বাদশাহ, মোল্লা-মৌলভী ও ভন্ডপীরগণ সম্মিলিতভাবে বিরাট জাঁকজমক করে বিপুল পরিমাণ টাকাপয়সা ব্যয় করে আকর্ষণীয় মেলার আয়োজন করা শুরু করল। তখন দেশের সরলপ্রাণ মুসলিম জনসাধারণ এটাকে দ্বীন মনে করে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে এই বিদ’আতই ইবাদতের মূল্যবান প্রলেপে আবৃত হয়ে সুদূর ইরাক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বসীমা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

সউদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতি শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আলুশ শাইখ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এই বিদআত তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবস পালনের প্রথা সর্ব প্রথম চালু করেন আবু সাঈদ কূকুবূরী। [ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল ৩/৫৯]
যদিও এ মর্মে অন্য আরও একাধিক মত রয়েছে।

 উবাইদিয়াদের শাসনামলে মিলাদ চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে তা ব্যাপকতা লাভ করতে লাগল। মুসলমানগণ জিহাদ ছেড়ে দিল এবং তারা রূহানী ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এই বিদআতটি সাধারণ মানুষের মনে শিকড় গেড়ে বসল। এমনকি অনেক মূর্খ মানুষের নিকট এটা আকীদা-বিশ্বাসের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ালো।

কিছু আলেম যেমন ইমাম সুয়ূতী রহঃ এই বিদআতের পক্ষে প্রমাণাদি খুঁজতে বাধ্য হলেন যাতে মীলাদের বিদআতকে বৈধতা দেয়া যায়। (তিনি মিলাদের পক্ষে কতিপয় দলিল পেশ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য আলেমগণ তার যথপযুক্ত জবাব দিয়েছেন -আল হামদুলিল্লাহ।

অথচ পরিতাপের বিষয় হলো উক্ত মিলাদের উৎপত্তিস্থান মওসিল শহরের লোকজন বহুদিন আগে থেকেই মিলাদকে বিদ’আত বুঝতে পেরে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে, আর তদস্থলে কতিপয় স্বার্থান্বেষী পীর ও ভোগবিলাসী আলেম নামধারী ধর্মব্যবসায়ীদের ধোঁকায় পড়ে উপমহাদেশের সরলপ্রাণ মুসলিমগণ উক্ত বিদ’আতকে ইবাদত মনে করে পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খাচ্ছেন।

হুজ্জাজে কেরামগণ পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফে সফর করেন, রাসূল(সাঃ) এর দেড় হাজার বৎসর পরেও আরব দেশে মিলাদ নামক ‘পূণ্যানুষ্ঠান’ অপরিচিত।

১০। মিলাদের পক্ষের দলীল ও তার খন্ডনঃ

যারা মিলাদের স্বপক্ষে দলীল দিয়ে থাকেন তারা প্রথমে সাধারণত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জম্ম সংক্রান্ত কোন হাদিস বা কুরআনের আয়াত তুলে ধনের। মিলাদ অর্থ হল জম্ম তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জম্ম সংক্রান্ত কিছু পেলেই মিলাদ বলে চালিয় দেয়। আসলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ বা জম্ম বিদআত নয়। এ সম্পর্কিত আলোচনা ও বিদআদ নয়। বিদআত হল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জম্ম তারিখ বা সাল কে কেন্দ্র করে যে সকল আমল আবিস্কার  করা হয়েছে। ইসলামে ইবাদতের পদ্ধতি আবিস্কার করার কোন ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। কিন্তু বিদআতি আলেমগন এর জম্মা সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা মিলাদের মত বিদআতী আমলের প্রচলন করেছেন। তারা যে আয়াত ও হাদিসগুলির সাহায্যে এর দলীল পেশ করে তা সম্পর্কে একটু আলোক পাত করা হল।

১১। দলীল-০১

মিলাদ কে জায়েয করা জন্য সুরা আল ইমরানের ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াত দুটি ব্যবহার করে থাকে। আয়াত দুটির অর্থ ঠিক রেখে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে মুসলীমদের প্রতারিত করে থাকে। তালে দেখুন আয়াত দুটির ব্যাখ্যা কি আর তারা বুঝে কি?

মহান আল্লাহ বলেনঃ

 وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِيثَـٰقَ ٱلنَّبِيِّـۧنَ لَمَآ ءَاتَيۡتُڪُم مِّن ڪِتَـٰبٍ۬ وَحِكۡمَةٍ۬ ثُمَّ جَآءَڪُمۡ رَسُولٌ۬ مُّصَدِّقٌ۬ لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُ ۥ‌ۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَٲلِكُمۡ إِصۡرِى‌ۖ قَالُوٓاْ أَقۡرَرۡنَا‌ۚ قَالَ فَٱشۡہَدُواْ وَأَنَا۟ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّـٰهِدِينَ (٨١) فَمَن تَوَلَّىٰ بَعۡدَ ذَٲلِكَ فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمُ ٱلۡفَـٰسِقُونَ (٨٢) 

অর্থঃ স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন, আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করেছি, কাল যদি অন্য একজন রসূল এই শিক্ষার সত্যতা ঘোষণা করে তোমাদের কাছে আসে, যা আগে থেকেই তোমাদের কাছে আছে, তাহলে তোমাদের তার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে৷ এই বক্তব্য উপস্থাপন করার পর আল্লাহ জিজ্ঞেস করেনঃ তোমরা কি একথার স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং আমার পক্ষ থেকে অংগীকারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে প্রস্তুত আছো? তারা বললো, হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করলাম৷ আল্লাহ বললেনঃ আচ্ছা, তাহলে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম, এরপর যারাই এ অংগীকার ভংগ করবে তারাই হবে ফাসেক। (সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৮১-৮২]

মন্তব্যঃ এই আয়াত দুটির মর্ম হলঃ প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে এই মর্মে অংগীকার নেয়া হয়েছে যে, দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে তোমাদের নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তোমাদের সেই দায়িত্ব তোমাদর পালন করতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নবীকে পাঠানো হবে তাকে সবাই দীন মানার মাধ্যমে সহযোগিতা করতে হবে। এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে আহ্‌লি কিতাবদের এই মর্মে সতর্ক করা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত অংগীকার ভংগ করছো এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার ও তাঁর বিরোধিতা করে তোমাদের নবীদের থেকে যে অংগীকার নেয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধাচরন করছো। কাজেই এখণ তোমরা ফাসেক হয়ে গেছো। কিন্ত বিদআতিগন এই আয়াতে মিলাদের গন্ধ খুজে পায় তারা বলেঃ

পৃথীবিতে আগমনের আগেই সমস্ত আম্বিয়া কেরামগনকে নিয়ে আল্লাহ তায়ালা এই মিলাদের আয়োজন করেছিলেন।এই মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালা। তিঁনি নিজে ছিলেন মীরে মাজলিস বা সভাপতি। সকল নবীগন ছিলেন শ্রোতা বা ঐ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া দর্শক। আর সেটাই ছিল সর্বপ্রথম ঈদে মিলাদুন্নবী বা নূর নবীজির শুভ আগমনের খুশি উদযাপন।

বিদআতিদের দাবিঃ ঐ মজলিসের উদ্দেশ্য ছিল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভ আগমন, শান-শওকত ও মান-মর্যাদা, সম্মান ও স্বীকৃতি দান ইত্যাদি অন্যান্য নবীগনের সামনে তুলে ধরা এবং তাঁদের থেকে রাসূলের উপর ঈমান আনয়ন ও সাহায্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতি আদায় করা। তাই এটাকে তারা বলে, নবীজীর সম্মানে এটাই ছিল সর্বপ্রথম  মিলাদ মাহফিল এবং মিলাদ মাহফিলের উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সুতরাং মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত বা তরিকা।

তাদের এই মনগড়া ব্যাখ্যা কোন কালে কোন তাফসির কারক করেনি, চার মাজহাবের কোন মুজতাহীদ ইমামও করেনি। এটা তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা ও আমল আবিস্কারের হাতিয়ার মাত্র।

১২। দলীলঃ-২

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার নিজ বংশে আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  আগমনের জন্য  দোয়া করেছিলের যার উল্লেখ মহান আল্লাহ বলেনঃ

رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولاً۬ مِّنۡہُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡہِمۡ ءَايَـٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيہِمۡ‌ۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ (١٢٩)

অর্থঃ হে আমাদের রব! এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতি পরিসর থেকে এমন একজন রসূল পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং এদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করবেন। অবশ্যি তুমি বড়ই প্রতিপত্তিশালী ও জ্ঞানবান। (সুরা বাকারা ২:১২৯)

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোয়ার কবুলের প্রমান হল এই আয়াত এবং তার ফলাফল হল তার বংশে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদআতীগন বলেনঃ  হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ৪০০০ বৎসর পূর্বেই মুনাজাত আকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর শুভ আবির্ভাব, রাসূলের সারা জিন্দেগীর কর্ম চাঞ্চল্য ও মানুষের আত্নার পরিশুদ্ধির ক্ষমতা বা রাসূলের ওসিলায় নাপাকি হতে মুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধি লাভ বর্ননা করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভ আগমনের সারাংশ পাঠ করেছেন তথা আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন। নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর দোয়ার ফসল। যেমনঃ হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে।

সাহাবী হযরত ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আঁমি আল্লাহর নিকট শেষ নবী হিসেবে লিখিত ছিলাম যখন আদম (আঃ) কাদা মাটির মাঝে মিশ্রিত ছিল।আর অচিরেই আঁমি তোমাদেরকে আঁমার প্রথম অবস্থা সম্পর্কে খবর দিচ্ছি। আঁমি হলাম ইব্রাহিম (আঃ) এঁর দোয়ার ফসল, ঈসা (আঃ) এঁর সুসংবাদ এবং আঁমার মায়ের ঐ দর্শন যেটা মা দেখেছিলেন যে ,তিঁনি আঁমাকে ভূমিষ্ট (পৃথিবীতে আগমনের সময়ে) করেছেন এমতাবস্থায় তার থেকে একটি নূর বের হলো যা তার সামনে সিরিয়ার প্রাসাদ সমূহকে আলোকিতা করেছিল। (শরহুস সুন্নাহ লিল বাগাভী,মেশকাত- ৫৭৫৯, নাসিরুদ্দীন আলবানী উক্ত হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)।

তাদের দাবিঃ বর্তমান মিলাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুভ আবির্ভাবের যে বর্ননা দেয়া হয় তা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর দোয়ার তুলনায় সামান্যতম অংশ মাত্র। সুতরাং আমরা যে মিলাদ শরিফ পাঠ ও কিয়াম করি হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালামেরই সুন্নাত।

মন্তব্যঃ কত বড় জাহেল হলে এমন কথা বলতে পারে। এই আয়াত যার উপর নাজিল হল তিনি বুঝলেন না যে এর দ্বারা মিলাদ কিয়াম করতে হবে। অথচ বাংলার নামধারী সুন্নী, জাহেল, নবী প্রেমীক দাবিকারীগণ, বুঝলেন ইহা হল  হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালামেরই সুন্নাত। ইহা আর একটি ধোকা কারণ হাদিসে এসেছে, একদা উমার (রাঃ) তাওরাতের কয়েকটি পাতা নিয়ে পড়ছিলেন। তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হয়ে বললেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! যদি মুসাও জীবিত হয়ে এসে যান, আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তাঁর অনুসারী হয়ে যাও এবং আমাকে বর্জন কর, তাহলে অবশ্যই তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। নিশ্চয় উম্মতের মধ্যে তোমরা আমার অংশ এবং নবীগণের মধ্যে আমি তোমাদের অংশ। (আহমাদ ১৫৮৬৪, ১৮৩৩৫)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, যদি মূসা তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ ছাড়া তাঁর জন্য অন্য কিছু বৈধ হতো না। (আহমাদ ১৪৬৩১, শুআবুল ঈমান বাইহাক্বী ১৭৯, আবূ য়্যা’লা ২১৩৫)

কাজেই ইব্রাহীম আলাহিস সালামেরই সুন্নাত বলে আমল করা যাবে না। ধোকাবাজী করে অজ্ঞ মুসলীমদের ভুল বুঝাতে সক্ষম হলেও কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ সামনে বিদআতকে সুন্নাহ বলে বুঝান সম্ভব হবে না। ইনশাআল্লাহ।

১৩। দলীলঃ- ০৩

মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ

অর্থঃ (স্মরণ কর) যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা (আঃ) বললঃ হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বললঃ এ তো এক প্রকাশ্য যাদু। (সুরা সফ ৬১:৬)

বিদআতিগন এই আয়াতের ব্যাখ্যা করে মিলাদ কিয়ামকে ঈসা আলাইহিস সালাম  সুন্নাহ বলে প্রচার করে থাকে। তাদের দাবী, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর পৃথিবীতে শুভ আগমনের ৫৭০ বৎসর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আবির্ভাব। তিঁনি তাঁর উম্মত হাওয়ারী (বনি ইসরাইল) কে নিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মিলাদ শরীফ পাঠ করেছেন। তিনি তার উম্মতের কাছে আখেরী জামানার পয়গম্বর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম ও সানা সিফাত এবং আগমন বার্তা এভাবে বর্নণা করেছেন। বিদআতীগন এও দাবী করে থাকে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর উম্মতদেরকে লক্ষ্য করে যে ভাষন দিয়েছেন, তা দাঁড়িয়েই দিয়েছেন। এ থেকে মিলাদের কিয়ামও জায়েয। সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর সুন্নাত।

মন্তব্যঃ এটি কুরআন মজীদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। কারণ এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করে তাঁর আগমণের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এই সংবাদ সকল ইহুদী ও খৃষ্টান পাদ্রীগণ জানতেন কিন্তু তারা নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে রাখার জন্য ইহুদী ও খৃষ্টান জনগনের নিকট গোপন রাখেন। মহান আল্লাহ কুরআনে এই আয়াতের মাঝে আবার স্মরণ করিয়ে দেন যে, এক জন সত্য নবী আসবেন যার নাম হবে আহম্মদ। অথচ বিদআতিগণ ইহুদী ও খৃষ্টানদের মত উম্মতে মুহাম্মদীকে ভূল বুঝিয়ে এই আয়াত দ্বারাও মিলাদ কিয়ামের গদ্ধ খুজে পায়।

বিদআতীরা যে তিনটি সুরাকে (৩:৮১-৮২; ২:১২৯; ৬১:৬) মিলাদের দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে তাতে মিলাদ নামক কোন বস্তুর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না। এটা তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা মাত্র। অথচ মীলাদের সমর্থনে বিগত ৮০০ বৎসরে অনেক প্রসিদ্ধ লেখক অনেক দলীল, যুক্তি, মত, কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদির কথা লিখেছেন। তবে তাঁরা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে মীলাদ ছিল না। এজন্য তা বিদআতে হাসানা। (হাদিসের নামে জালিয়াতি) অথচ আমরা জানি বিদাতে হাসানা বলে ইসলামে কোন বিদআত নেই।

১৪। দলীলঃ- ০৪

 হযরত নোবাইহাতা ইবনে ওহাব রাহিমহুল্লাহ আলাইহি তাবেয়ী হতে বর্নিত, একদিন হযরত কা’ব আহবার (তাবেয়ী) হযরত আয়েশা রাদ্বি আল্লাহু তালা আনহার খেদমতে উপস্থিত হলেন, অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তথা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শানে মানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

** হযরত কাব (রঃ) বললেন, এমন কোন দিন উদয় হয়না যে দিনে ৭০ হাজার ফেরেস্তা নাজিল হয়ে রাসুলুল্লাহ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজা মোবারাক বেষ্টন করে তাঁদের নুরের পাখা বিস্তার করে সন্ধা পর্যন্ত হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ না করেন। অতঃপর যখন সন্ধা হয়ে আসে তখন তাঁরা আকাশে আরোহন করেন এবং তাদের অনুরূপ সংখ্যায় (৭০হাজার) ফেরেস্তা দ্বারা অবতরন করে তাদের মতই দুরুদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন। আবার কেয়ামতের দিন যখন জমিন (রওজা মোবারক) বিদীর্ন হয়ে যাবে, তখন তিনি ৭০ হাজার ফেরেস্তা দ্বারা বেস্টিত হয়ে প্রেমাস্পদের (আশেক) রুপ ধারন করে আসল প্রেমিকের (মাশুক) সাথে শীঘ্রই মিলিত হবেন। (দারমী)

মন্তব্যঃ বিদআতীদের এই হাদিস জাল কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন হাদিসে মহান আল্লাহকে মাশুক বা প্রেমিকা বলে উল্লেক করনি। আর হাদিস সহিহ হলেও দুরুদ পাঠ করার ফজিলত পাওয়া যায় কিন্তু মিলাদ পড়ায় কোন প্রমান বহন করে না। কাজেই তাদের এই হাদিসের আলোকে মিলাদ পড়ার বিধান দেয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

১৫। দলীল-০৫

বিদআতীদের দাবি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভ আগমনের দিন শয়তান ব্যতীত সবাই খুশি হয়েছিল। যেমনঃ হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। আবু রবি ইবনে সালিম বলেন, বাক্বি ইবনে মাখলাদ তাঁর তাফসিরে লেখেন,নিশ্চয়ই ইবলিশ চারবার বড় আওয়াজে চিৎকার করেছে।একবার যখন তাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। আরেকবার যখন তাকে দুনিয়ায় নামানো হয়েছে। আরেকবার যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে আগমন করেছেন। আরেকবার যখন সুরা ফাতিহা অবতীর্ণ করেছেন। (উইনুল আছার,১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩৪)

অপর বর্ননায় এসেছে। শয়তান চারবার উচ্ছস্বরে কেঁদেছিল। যখন আল্লাহ তাআলা তাকে অভিশপ্ত আখ্যা দেন, যখন তাকে বেহেশত থেকে বের করে দেওয়া হয়, যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এঁর পবিত্র বেলাদত তথা ধরাধামে শুভ আগমন হয় এবং যখন সূরা ফাতেহা নাযিল হয়। (ইবনে কাসীর কৃত আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ২/১৬৬পৃঃ)

মন্তব্যঃ হাদিস দুটির মান জানিনা, সহিহ, যঈফ বা জাল যে কোন একটা হতে পারে। হাদিস দুটি যদি সহিহও হয় তবে আমল প্রতিষ্ঠিত হয় না। ভাল ভাবে পড়ে দেখুন এর দ্বারা মহা মানব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম আগমনের সংবাদ পাওযা যায়। কিন্ত কোন আমল প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু  বিদআতীগন দাবি করে থাকে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে শুভ আগমন হয় তাই তার স্মরণে এই দিনে মিলাদের মাহিফির করতে হবে।

৬। দলীলঃ – ৬

মিলাদের সমর্থনে অনেক জাল হাদিস বর্নণা করে থাকে। তাদের বর্ণিত একটি জালা হাদিস হলোঃ 

আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে। উমার (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে সে ইসলামকে জীবিত করবে। উসমান (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে যেন বদর বা হুনাইনের যুদ্ধে যোগদান করলো। আলী (রা) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে এবং মীলাদুন্নবী পাঠের কারণ হবে, সে দুনিয়া হতে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হাসান বসরী (রাহ) বলেন: আমার কামনা হয় যে, যদি আমার উহদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তবে আমি তা মীলাদুন্নবী পড়ার জন্য ব্যয় করতাম। … ইমাম শাফিয়ী (রাহ) বলেন: যদি কেউ মীলাদুন্নবীর জন্য বন্ধুদেরকে জমায়েত করে, খাবার প্রস্ত্তত করে, স্থান খালি করে দেয়, দান-খয়রাত করে এবং তার কারণে মীলাদুন্নবী পড়া হয় তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণের সাথে উত্থিত করবেন এবং সে জান্নাতে থাকবে।…’’এভাবে আরো অনেক তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণের নামে মীলাদুন্নবী ‘পড়া’-র ফযীলতে অনেক বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। (‘আন-নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়িদি ওয়ালাদি আদাম’’ (বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আদম সন্তানদের নেতার জন্মের মধ্যে’ হাদিসের নামে জালিয়াতি)

মন্তব্যঃ এই হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর হাদিসের নামে জালিয়াতী বইয়ের ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীল রাহিমাহুল্লাহ জালা হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন।

১৭। দলীলঃ-০৭

মিলাদের সমর্থনে তারা নিম্মের জাল হাদিস বর্নণা করে থাকেঃ  ইবন আববাস বলেন, একদিন তিনি নিজ বাড়িতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের ঘটনাবলি বর্ণনা করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ আগমন করেন এবং বলেন, তোমাদের জন্য আমার শাফাআত পাওনা হলো।

মন্তব্যঃ এটি হাদিস নয়, মিথ্যা কথা কারন ইবন আববাসের বয়স ৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকাল হয়। তিনি কি ৫/৬ বৎসর বয়সে ছেলেমেয়েদের হাদীস শুনাচ্ছিলেন।

১৮। দলীলঃ-৮

আবূ দারদা (রা) বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে আমির আনসারীর (রা) বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি তাঁর সন্তান ও পরিবারের মানুষদের তাঁর জন্মের ঘটনাবলি শেখাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, আজই সেই দিন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য রহমতের দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন এবং ফিরিশতাগণ তোমাদের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে।

মন্তব্যঃ এগুলোর কোন রূপ সনদ কেউ উল্লেখ করেন নাই। এমনকি ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে সংকলিত কোনো গ্রন্থে এগুলো সনদসহ বা সনদ ছাড়া সংকলিত হয়েছে বলেও কেউ প্রমাণ বা দাবি করেন নি। (হাদীসের নামে জালিয়াতি, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে মানতে হলে হাজার বৎসরের সকল হাদীস সংকলক মুহাদ্দিসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দুশমন (!!) বলে গণ্য করতেই হবে। কারণ, ইবন আববাস (রা), আবূ দারদা (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের মর্যাদা বিষয়ক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস এবং আবূ বকর (রা), উমার (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের হাদীসগুলো তাঁরা গোপন করেছেন। এ সকল সাহাবী (রা) থেকে সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদে বর্ণিত অতি সাধারণ বিষয়ে অগণিত হাদীস তাঁরা সংকলন করলেন, অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তাঁরা কেউ কোনোভাবে সংকলন করলেন না!!

ইসলামের প্রথম হাজার বৎসরে সংকলিত হাদীসগ্রন্থগুলোতে হাঁটাচলা, পানাহার, মলমূত্র ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। কিন্তু ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘ইহতিফালুল মাওলিদ’ (মীলাদ উদযাপন) ইত্যাদি নামে এ সকল হাদীসের গ্রন্থে একটি অধ্যায় তো দূরের কথা, একটি পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদও তারা লিখেন নি এবং একটি হাদীসও তাঁরা সংকলন করেন নি।

ইমাম আবূ হানীফাসহ চার ইমাম ও ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ফকীহ একইভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদা ও মীলাদের দুশমন বলে গণ্য হবেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ফিকহী গ্রন্থগুলোতে অতি সামান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কারো গ্রন্থে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘তাযীমুল মাওলিদ’ (মীলাদের তাযীম) ইত্যাদি নামে কোনো একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা মাসআলা তাঁরা লিখলেন না। এর গুরুত্বও বললেন না! উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল আলিমই মীলাদ-বিরোধী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদার দুশমন (!!!) বলে গণ্য হবেন। কারণ, ৬০৪ হিজরী সালে মীলাদুন্নবী পালনের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে বিগত ৮০০ বৎসরে উম্মাতের আলিম ও বুজুর্গগণ মীলাদুন্নবী বিষয়ে হাজার হাজার পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। কিন্তু এর আগের ৬০০ বৎসরে একজন আলিম বা বুজুর্গ মীলাদুন্নবী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন নি। মীলাদের সমর্থক আলিমগণও বারবার উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদ বিষয়ক প্রথম বই রচনা করেন আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনু দেহিয়া (৬৩৩ হি.)। তাঁর রচিত এ বইয়ের নাম: ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’। (হাদীসের নামে জালিয়াতি, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ)

১৯। মিলাদ বিদআত কেন?

১। মিলাদ রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবী, তাবেই, তাবে-তাবেইন দের যুগ পর্যন্ত ছিলইনা।

২। মিলাদ একটা ইবাদত মনে করা হয় যার পক্ষে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন নির্দেশনা নেই। তাই এই আমল নব আবিস্কার ও বিদআত।

৩। মিলাদ আমল হিসাবে আদায় করা হয় এবং এর পদ্ধতিও আবিস্কার করা হয়েছে। প্রত্যেক আদায়কারী এর মাধ্যমে সওয়াব আশা করে থাকে। কাজেই এটা বিদআত।

৪। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্মের শুকরিয়া হিসেবে সোমবার ব্যক্তিগত সিয়াম পালন করতেন। এই সোমবারের সিয়াম সাহাবের নিয়ে একত্রে পালন করতেন বা কোনো সাহাবীকে এই সোমবার সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রমান নেই এবং তিনি বাত্সরিক কোনো উত্সব বা কোনো সাহাবী রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিন উপলক্ষে কোনো উত্সব পালন করেছেন এর কোনই প্রমান নাই। নিজের জন্মদিন উপলক্ষে শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য জম্মদিনে স্ব স্ব ব্যক্তি সিয়াম পালন করতে পারে। কিন্তু একজনের জন্মের দিনে অন্যজন উত্সব করবে এমনটা শরীয়ত সম্মত নয়। এই মিলাদ সম্পর্কে যারা দলিল উপস্থাপন করেন তারা তাদের মত ব্যাখ্যা ব্যতীত আর কিছুই তুলে ধরতে সক্ষম হয় না। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার সিয়াম পালন করতেন সেটা তাঁর নিজের কৃতজ্ঞতা বোধ আল্লাহর প্রতি। আজকে যারা মিলাদুন নবীর কথা বলে তারা কিন্তু প্রতি সপ্তাহে সোমবারের কথা কিছুই বলে না। ভন্ডামি করে এই সোমবারের উদাহরণ পেশ করে বাত্সরিক মিলাদ করে থাকে। 

মিলাদ কেন্দ্রিক একটি শির্কি আকিদাঃ মিলাদ কেন্দ্রিক একটি অন্যতম শির্কি বিশ্বাস হল মিলাদের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। এই মাহফিলের মাঝে তারা কিয়াম করে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন উপলক্ষে দাড়িয়ে সম্মান করে। তাদের বিশ্বাস মিলাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম প্রদান করলে তিনি স্বশরীরে মিলাদ মাহফিলে হাজির হয়ে যায় তাই তার সম্মনে মাহফিলের এক পাশে চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। মিলাদ মাহফিল চলা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন করে এমন বিশ্বাস মুসলিমদের মাঝে কোন কালেই ছিল না। এ সম্পর্কে কোন কালে কোন বিতর্কও ছিল না। “নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কোন অলীর হাজির নাযির নয়, বরং আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা, দর্শন, জ্ঞান ও শুনার দ্বারা সর্বত্র হাজির নাযির” কুরআন হাদিসের স্পষ্ট বর্নণাকে ভুল মিথ্যা ও মনগড়া ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুবই গর্হিত কাজ।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে জম্মের আগে পরে তিনি  এমন জ্ঞানের অধিকারি ছিলেন না। বিভিন্ন নবীদের ঘটনা ও দাওয়াত দান কালে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির নাযির ছিল না।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন:

 وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ ٱلۡغَرۡبِىِّ إِذۡ قَضَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَى ٱلۡأَمۡرَ وَمَا كُنتَ مِنَ ٱلشَّـٰهِدِينَ (٤٤) وَلَـٰكِنَّآ أَنشَأۡنَا قُرُونً۬ا فَتَطَاوَلَ عَلَيۡہِمُ ٱلۡعُمُرُ‌ۚ وَمَا ڪُنتَ ثَاوِيً۬ا فِىٓ أَهۡلِ مَدۡيَنَ تَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَـٰتِنَا وَلَـٰكِنَّا ڪُنَّا مُرۡسِلِينَ (٤٥) 

অর্থঃ (হে মুহাম্মদ!) তুমি সে সময় পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত ছিলে না৷ যখন মূসাকে এ শরীয়াত দান করেছিলাম এবং তুমি সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্তও ছিল না৷ বরং এরপর (তোমার যুগ পর্যন্ত) আমি বহু প্রজন্মের উদ্ভব ঘটিয়েছি এবং তাদের ওপর অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে৷ তুমি মাদয়ানবাসীদের মধ্যেও উপস্থিত ছিলে না, যাতে তাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে পারতে কিন্তু আমি সে সময়কার এসব তথ্য জানাচ্ছি৷ (কাসাস ২৮:৪৪-৪৫)

আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন:

 ذَٲلِكَ مِنۡ أَنۢبَآءِ ٱلۡغَيۡبِ نُوحِيهِ إِلَيۡكَ‌ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيۡہِمۡ إِذۡ أَجۡمَعُوٓاْ أَمۡرَهُمۡ وَهُمۡ يَمۡكُرُونَ (١٠٢) 

অর্থ: হে মুহাম্মদ! এ কাহিনী অদৃশ্যলোকের খবরের অন্তরভুক্ত, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি৷ নয়তো, তুমি তখন উপস্থিত ছিলে না যখন ইউসুফের ভাইয়েরা একজোট হয়ে যড়যন্ত্র করেছিল৷  (ইউচুফ ১২:১০২)।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হাজির নাযির বিশ্বাস করলে মুলত মিরাজ অস্বিকার করা হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন:

سُبۡحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلاً۬ مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكۡنَا حَوۡلَهُ ۥ لِنُرِيَهُ ۥ مِنۡ ءَايَـٰتِنَآ‌ۚ إِنَّهُ ۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ (١) 

অর্থঃ পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতে নিজের বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন, যাতে তাকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখান৷আসলে তিনিই সবকিছুর শ্রোতা ও দ্রষ্টা৷ (বনী ইসরাইল ১৭:১)।

মিরাজ হল মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্‌সা অতপর সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশে আজিমে পৌছান। রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা সর্বদা হাজির নাযির থাকলেতো আর আরশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি তো সেখানেই হাজিরই ছিলেন। তাহলে মিরাজ আর রইল কোথায়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির নাযির বলাটা বাহ্যিকভাবে সম্মানজনক মনে করা হলেও আসলে তা শির্ক, যা একজন মুসলিম কে ইসলাম থেকে বাহির করে দেয়। এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজকে অস্বীকার করা হয়।

ইন্তিকাল পরবর্তী জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিলাদ মাহফিল চলা কালে আগমনে করে বা হাজরি নাজিন থাকেন মনে করলেতো সহিহ হাদিস অস্বীকার করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘‘যখনই যে কেউ আমাকে সালাম করে তখনই আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন, যেন আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি। (আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/২১৮। হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য]।

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কেউ আমার কবরের কাছে থেকে আমার উপর দরুদ পাঠ করলে আমি শুনতে পাই। আর যদি কেউ দূর থেকে আমার উপর দরুদ পাঠ করে তাহলে আমাকে জানান হয়।’’ (বাইহাকী, হায়াতুল আম্বিয়া ১০৩-১০৫ পৃ.; সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী ১৫৪ [সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৮৩; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২১৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪১০; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮১৭,; যায়ীফাহ ১/৩৬৬-৩৬৯পৃ.)।

হাদীসটির একটি সনদ খুবই দুর্বল হলেও অন্য আরেকটি গ্রহণযোগ্য সনদের কারণে ইবনু হাজার, সাখাবী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ সনদটিকে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।

মিলাদ বিদআত হলেও এই শির্ক আকিদা গ্রহণকারী বিদআতীগন ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। কাজেই কুরআন সুন্নাহ বুঝে আমল করার চিন্তা করি।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment