সিয়াম এর প্রকারভেদ (দ্বিতীয় পর্ব)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

ইসলামি শরিয়তে প্রতিটি আমলের মাঝে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ ও নফলের হুকুম থাকে। যদিও ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ ও নফলের হুকুম মহান আল্লহ ও তার রসুল (সঃ) ভাগ করে দেননি, তাই সাহাবি (রাঃ) সব আমল দুভাগে ভাগ করেছেন। আর তা হল ফরজ ও সুন্নাহ বা নফল। কিন্তু ইসলামের অতন্ত্র প্রহরী মুহাদ্দিসগন আল্লাহর বিধান উম্মতকে সহজে বুঝার জন্য সকল আমলকে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ ও নফলের হুকুম দান করেছেন। যাতে উম্মত আল্লাহ হুকুমের গুরুত্ব বুঝে আমল করতে পারে। সিয়ামের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুহাদ্দিসগন সিয়াম পাঁচভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ

১। ফরজ সিয়াম

২। ওয়াজির সিয়াম

৩। সুন্নাত বা নফল সিয়াম

৪। মাকরূহ সিয়াম  এবং

৫। হারাম সিয়াম

এই পর্বে শুধু সুন্নাত বা নফল সিয়াম সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

 সুন্নাহ বা নফল সিয়ামঃ

 যে সকল সিয়াম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেখেছেন আবার ছেড়েছেন সে সকল সিয়ামকে আমরা সুন্নাহ/নফল সিয়াম হিসাবে উল্লেখ করব। এই ধরনে সিয়াম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত করতেন আবার কখন নিয়মিত করতেন না। সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুদের আমলও এমটাই ছিল। কোন ব্যক্তি যদি সুন্নাত ও নফল সিয়াম বিনা কারণে ভঙ্গ করে তবে তা আর আবার কাযা করতে হবেনা। কারন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নফল সিয়াম পালনকারী তার নিজের উপর কর্তৃত্বশীল। চাইলে সে সিয়াম পালন করে যাবে বা ইচ্ছা করলে তা নাও রাখতে পারে। (আহমাদ-২৬৩৫৩, তিরমিযী)।

সুন্নাহ বা নফল সিয়াম পালনের এতটি সঠিক নীতিমালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণ করতেন। নিম্মের হাদিসটি পড়লেই তার সুন্নাহ বা নফল সিয়াম পালনের নীতিমালা জানতে পারবেন।

আবূ কাতাদাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে হাযির হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিভাবে সিয়াম রাখেন? তার কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হলেন। ‘উমার  তাঁর রাগ দেখে বলে উঠলেন,

“আমরা রব হিসেবে আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট। দীন হিসেবে ইসলামের ওপর সন্তুষ্ট। আর নাবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর সন্তুষ্ট। আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের গযব হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই”।

‘উমার  এ বাক্যগুলো বার বার আওড়াতে থাকেন। এমনকি এ সময় রসূলের রাগ প্রশমিত হলো। এরপর ‘উমার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! যে ব্যক্তি একাধারে সিয়াম রাখে তার কী হুকুম? তিনি বললেন, সে ব্যক্তি না সিয়াম রেখেছে, আর না ছেড়েছে। অথবা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, না সিয়াম রেখেছে আর না সিয়াম ছেড়ে দিয়েছে। (অর্থাৎ এখানে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রসূলুল্লাহ কি لَا صَامَ وَلَا أَفْطَرَ বলেছেন, না কি لَمْ يَصُمْ وَلَمْ يُفْطِرْ বলেছেন)।

তারপর ‘উমার  জিজ্ঞেস করলেন, ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে কি হুকুম, যে দু’ দিন সিয়াম রাখে আর একদিন তা ছাড়া থাকে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কেউ কী এমন শক্তি রাখে? তারপর ‘উমার  বললেন, ওই ব্যক্তির ব্যাপারে কি হুকুম, যে একদিন রাখে আর একদিন রাখে না? এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা হলো দাঊদ (আঃ)-এর সিয়াম।

‘উমার  জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ওই ব্যক্তির ব্যাপারে কি হুকুম যে, একদিন সিয়াম রাখে আর দু’দিন রাখে না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি এটা পছন্দ করি যে, এতটুকু শক্তি আমার সংগ্রহ হোক। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এক রমজান থেকে আর এক রমজান পর্যন্ত প্রতি মাসের তিনটি সওম একাধারে রাখার সমান। ‘আরাফার দিনের সিয়ামের ব্যাপারে আমি আশা করি আল্লাহ এর আগের ও পরের বছরের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। আর ‘আশূরার দিনের সিয়ামের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমার প্রত্যাশা, আল্লাহ এর দ্বারা আগের বছরের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৪৪, মুসলিম ১১৬২, আবূ দাঊদ ২৪২৫, তিরমিযী ৭৫২, ইবনু মাজাহ ১৭৩৮, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২০৮৭, শু‘আবূল ঈমান ৩৮৮৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৩২, ইরওয়া ৯২৫, সহীহ আত্ তারগীব ১০১৭, সহীহ আল জামি‘ ৩৮৩৫)।

আবদুল্লাহ ইবনু শাক্বীক (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছি যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি গোটা মাস সিয়াম রাখতেন? তিনি [আয়িশা (রাঃ)] বললেন, আমি জানি না যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ছাড়া অন্য কোন মাস পুরো সিয়াম রেখেছেন কিনা? কিংবা এমন কোন মাসের কথাও জানি না যে, মাসে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মোটেও সিয়াম রাখেননি। তিনি প্রতি মাসেই কিছু দিন সিয়াম পালন করতেন। এ নিয়মেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জীবন কাটিয়েছেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৩৭, মুসলিম ১১৫৬)।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ব্যতীত কোন মাসে পুরা মাসের সাওম সিয়াম পালন করেন নাই। তিনি এমনভাবে (নফল) সিয়াম পালন করতেন যে, কেউ বলতে চাইলে বলতে পারতো, আল্লাহর কসম! তিনি আর সিয়াম পালন পরিত্যাগ করবেন না। আবার এমনভাবে (নফল) সিয়াম ছেড়ে দিতেন যে, কেউ বলতে চাইলে বলতে পারতো আল্লাহর কসম! তিনি আর  সিয়াম পালন করবেন না। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৪৭)।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মাসে এভাবে  সিয়াম ছেড়ে দিতেন যে, আমরা মনে করতাম, তিনি এ মাসে আর  সিয়ামপালন করবেন না। আবার কোন মাসে এভাবে  সিয়ামপালন করতেন যে, আমরা মনে করতাম তিনি এ মাসে আর  সিয়াম ছাড়বেন না। আর তুমি যদি তাঁকে রাতে সালাত আদায়রত অবস্থায় দেখতে চাইতে তবে তা দেখতে পেতে, আবার যদি তুমি তাঁকে ঘুমন্ত দেখতে চাইতে তবে তাও দেখতে পেতে। সুলা্য়মান (রহঃ) হুমায়দ (রহঃ) সূত্রে বলেন যে, তিনি আনাস (রাঃ) কে  সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন।(সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৪৮)।

হদিসগুলো দ্বারা সুন্নাহ বা নফল সিয়াম এর কিছু নিয়ম নীতি সম্পর্কে জানতে পারলাম। সুন্নাহ বা নফল সিয়াম পারন করা প্রয়োজন কিন্তু এ সিয়াম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা জায়েয নয়। প্রতি মাসেই কিছু দিন সিয়াম পালন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নত। প্রতিদিন সিয়াম পালন বিদআত। তাই আসুন সুন্নাহ বা নফল সিয়াম সম্পর্কে জেনে নেই। সুন্নাহ/নফল সিয়াম প্রায় বার প্রকার। যথাঃ

১। শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম

২। যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের সিয়াম

৩। আরাফাতের দিনের সিয়াম

৪। আশুরার সিয়াম

৫। মুহাররম মাসের সিয়াম

৬। প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩. ১৪, ১৫- এ তিন দিনের সিয়াম

৭। সাপ্তাহিক সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম

৮। শাবান মাসের সিয়াম

৯। দাঊদ আলাইহিস সালাম এর সিয়াম

১০। বিবাহে অসামর্থ ব্যক্তিদের সিয়াম।

১১। আল্লাহর পথে (ধর্মীয় যুদ্ধের সময়) সিয়াম

১২। মৃত্যুর পক্ষ থেকে সিয়াম

১। শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়ামঃ

সহিহ কিছু হাদিস দ্বারা শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম প্রমানিত। যেমন হাদিসে এসেছেঃ

আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমযানের সিয়াম পালনের পর শওয়াল মাসের ছয়দিন সিয়াম রাখল, সে যেন সারা বছর সিয়াম রাখল।” (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬২। সহিহ মুসলিম ইঃ ফাঃ হাদিস নম্বর ২৬২৯, ২৬৩০, ২৬৩১; এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ৭৫৯, আবূ দাউদ ২৪৩৩, ইবনু মাজাহ ১৭১৬, আহমাদ ২৩০২২, ২৩০৪৪, দারেমী ১৭৫৪; মিশকাত-২০৪৭,:, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২১১৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৩৪, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৯১৮, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৯০৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৩১, সহীহ আত্ তারগীব ১০০৬)।

 

মন্তব্যঃ কোন কারণে যদি ফরয সিয়াম হয়ে যায়, তাহলে কাযা সিয়াম আগে রাখবে। শাওয়ালের  এ সিয়াম একাধারে বা মাঝে বিরতি দিয়ে রাখা যাবে। তবে একাধারে বিরতিহীনভাবে রাখলে সাওয়াব বেশী পাবে। যেহেতু এই সিয়াম সুন্নাত তাই কাযা করার নিয়ম নাই।

২। যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের সিয়ামঃ যিলহাজ্জ মাসের দিনগুলোতে কৃত ইবাদতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এই দিনগুলির (অর্থাৎ যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিনের) তুলনায় এমন কোন দিন নেই, যাতে কোন সৎকাজ আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে কোন (মুজাহিদ) ব্যক্তি যদি তার জান মালসহ বের হয়ে যায় এবং তার কোন কিছুই নিয়ে আর ফিরে না আসে।” (অর্থাৎ শাহাদত বরণ করে, তাহলে হয়তো তার সমান হতে পারে)। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫২। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ৯৬৯, তিরমিযী ৭৫৭, আবূ দাউদ ২৪৩৮, ইবনু মাজাহ ১৭২৭, আহমাদ ১৯৬৯, ৩১২৯, ৩২১৮, দারেমী ১৭৭৩]

৩। আরাফাতের দিনের সিয়ামঃ

আবূ কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আরাফার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তার পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গোনাহ মোচন করে দেয়।” [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫৮)।

মন্তব্যঃ  যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ যেদিন হাজীরা আরাফাতের মাঠে সমবেত হন সেই দিন এই সাওম পালন করতে হবে। কিন্তু  যে সকল হাজ্বিগণ আরাফাতের মাঠে হাজ্জ পালনরত থাকবে তারা এ সাওম পালন করবেনা। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজ্জ পালন অবস্থায় এ দিনে রোযা রাখনেনি। হাজ্জের পরবর্তী কার্যক্রম সম্পাদরেন শক্তি অর্জনের জন্য এ দিনে হাজীদের রোযা না রাখার মধ্যে সওয়াব বেশী।

৪। আশুরার সিয়ামঃ

ইবনু ‘আব্বাস  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় গমন করার পর দেখলেন ইয়াহূদীরা ‘আশূরার দিন সওম রাখে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনটার বৈশিষ্ট্য কি যে, তোমরা সওম রাখো? তারা বলল, এটা একটি গুরুত্ববহ দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। আর ফিরাউন ও তার জাতিকে (সমুদ্রে) ডুবিয়েছেন। মূসা (আঃ) শুকরিয়া হিসেবে এ দিন সওম রেখেছেন। অতএব তাঁর অনুসরণে আমরাও রাখি। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ দীনের দিক দিয়ে আমরা মূসার বেশী নিকটে আর তার তরফ থেকে শুকরিয়া আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরা বেশী হকদার। বস্তুত ‘আশূরার দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সিয়াম রেখেছেন অন্যদেরকেও রাখার হুকুম দিয়েছেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৬৭, বুখারী ১৮৭৮ ইঃ ফাঃ, মুসলিম ১১৩০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৬৯৭, ইবনু মাজাহ ১৭৩৪, আহমাদ ৩১১২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬২৫)।

ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, যখন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার সওম পালন শুরু করলেন এবং অন্যদেরকেও এ সওম পালনের নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবারা রাদিআল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, এটাতো ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের সম্মান করার দিন। (একই দিনে সওম পালন করলে আমরা কি তাদের সাদৃশ্য বনে যাবো না?) উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (বেঁচে থাকলে) ইনশাআল্লাহ আগামী বছর (১০ তারিখের সাথে) ৯ তারিখেও সওম পালন করব। (ফলে আমাদের ইবাদত অমুসলিমদের সাথে আর সামঞ্জসপূর্ণ হবে না)। কিন্তু পরবর্তী বছর আসার আগেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছিলেন। (সহিহ মুসলীম ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ২৫৩৭)

 আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমাযান (রমজান) মাসের সওমের পরে উত্তম সওম হলো আল্লাহর মাস, মুহাররম মাসের ‘আশূরার সওম। আর ফরয সলাতের পরে সর্বোত্তম সলাত হলো রাতের সলাত (অর্থাৎ- তাহাজ্জুদ)।  (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৩৯, মুসলিম ১১৬৩, আবূ দাঊদ ২৪২৯, তিরমিযী ৪৩৮, নাসায়ী ১৬১৩, আহমাদ ৮৫৩৪, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ১১৩৪, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১১৫৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪২১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৩৬, ইরওয়া ৯৫১, সহীহ আত্ তারগীব ৬১৫)।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কখনো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সওম পালনের ক্ষেত্রে ‘আশূরার দিনের সওম ছাড়া অন্য কোন দিনের সওমকে এবং এ মাস অর্থাৎ রমাযান ছাড়া অন্য কোন মাসের সওমকে অধিক মর্যাদা দিতে দেখিনি। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৪০, বুখারী ২০০৬, মুসলিম ১১৩২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৮৩৭, আহমাদ ৩৪৭৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৩৯৮।

জাবির ইবনু সামুরাহ্  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম প্রথম আমাদেরকে ‘আশূরার দিন সওম রাখার হুকুম দিয়েছেন। এর প্রতি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন; এ দিন আসার সময় আমাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কিন্তু রমাযানের সওম ফরয হবার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আর আমাদেরকে এ দিনের সিয়াম রাখতে না হুকুম দিয়েছেন, না নিষেধ করেছেন। আর এ দিন এলে আমাদের না কোন খোঁজ-খবর নিয়েছেন। [হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৬৯, মুসলিম ১১২৮, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৩৫৮, আহমাদ ২০৯০৮, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৮৬৯, সুনানুল কাবীর লিল বায়হাক্বী ৮৪১৩।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার (মুহাররম মাসের দশম) দিনে স্বয়ং রোযা রেখেছেন এবং ঐ দিনে রোযা রাখতে আদেশ করেছেন। [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫৯। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ২০০৪, ৩৩৯৭, ৩৯৪৩, ৪৬৮০, ৪৭৩৭, সহিহ মুসলিম ১১৩০, আবূ দাউদ ২৪৪৪, ইবনু মাজাহ ১৭৩৪, আহমাদ ১৯৭২, ২১০৭, ২১৫৫, ২৬৩৯, ২৮২৭, ৩১০২, ৩১৫৪, ৩২০৩, দারেমী ১৭৫৯

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আগামী বছর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব।” (অর্থাৎ নবম ও দশম দু’দিন ব্যাপী রোযা রাখব)। [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬১। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৩৪, আবূ দাউদ ২৪৪৫, আহমাদ ২১০৭, ২৬৩৯, ২৮২৭, ২১০২, ৩১৫৪, দারেমী ১৭৫৯

আবূ কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আশুরার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তা বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।” [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬০। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৬২, আহমাদ ২২০২৪, ২২১১৫।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আশূরার  দিনে কেউ চাইলে সিয়াম পালন করতে পারে। ( সহিহ বুখারি-১৮৭৪ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে ‘আশূরার পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমযানের সাওম সিয়াম ফরয করা হল তখন যার ইচ্ছা আশূরার  সিয়াম পালন করত আর যার ইচ্ছা করত না। (সহিহ বুখারি-১৮৭৫, ১৮৭৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আশূরা (আশুরা/আসুরা/আসূরা)র দিনকে ইয়াহুদীগণ ঈদ মনে করত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরাও এ দিনে সিয়াম পালন কর। (সহিহ বুখারি-১৮৭৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

সালামা ইবনু আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলাম গোত্রের এক ব্যাক্তিকে লোকজনের মধ্যে এ মর্মে ঘোষণা দিতে আদেশ করলেন যে, যে ব্যাক্তি খেয়েছে, সে যেন দিনের বাকি অংশে সিয়াম পালন করে আর যে খায় নাই, সে যেন সাওম সিয়াম পালন করে। কেননা আজকের দিন ‘আশূরার দিন। (সহিহ বুখারি-১৮৮১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

এভাবে বহু হদিস দ্বারা আশুরার সিয়ামের হুকুম ও ফজিলত প্রমানিত। চান্দ্রমাস মুহাররমের দশ তারিখ কে আশুরার দিন বলা হয়। তবে হাদিসের আলোকে বলা যায এই মাসের ৯ ও ১০ তারিখ এ দু’দিন রাখা উত্তম। অথবা ১০ ও ১১ তারিখেও রাখা যায়। শুধুমাত্র ১০ তারিখে রোযা রাখাকে উলামায়ে কিরাম মাকরূহ বলেছেন।

এই দিনের সাওম পালনের সাথে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু’র শহীদ হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। বরং আশুরার এ দিনটি পূর্ববর্তী যামানার নাবীদের সময় থেকেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূণ দিন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এ দিনে মূসা (আঃ) কে ফিরআউনের হাত থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন। তবে এ দিনের অনেক কাহিনী শোনা যায় যার কিছু হল দুর্বল, আর বেশীর ভাগই তথ্য নির্ভর নয়। এরপরও এ দিনটি আল্লাহর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদা সম্পন্ন।

কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় জালিয়াতগন এ সম্পর্কেও বহু জাল হাদিস রচনা করেছে। ডক্টর খন্দকর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ এর রচিত “হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থে থেকে আশুরা সম্পর্কে দুটি জাল হাদিস তুলে ধরছিঃ

জাল হাদিস-১:  যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে। হযরত () আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।… তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে। (মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৪৩০-৪৩১। পুনশ্চ: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ২৯৮-৩০০)।
জাল হাদিস-২:  ‘হযরত রাসূলুল্লাহ () এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। … মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।… তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন… মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে …। (মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩)।

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস।(ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১২-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯-১৫১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৯-১৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৫)।

৫। মুহাররম মাসের সিয়ামঃ

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মাহে রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা, আল্লাহর মাস মুহাররম। আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায রাতের (তাহাজ্জুদ) নামায।” (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫৪। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৬৩, তিরমিযী ৪৩৮, ৭৪০, আবূ দাউদ ২৪২৯, ইবনু মাজাহ ১৭৪২, আহমাদ ৭৯৬৬, ৮১৫৮, ৮৩০২, ৮৩২৯, ১০৫৩২, দারেমী ১৭৫৭, ১৭৫৮

মন্তব্যঃ মুহাররম মাস অধিক পরিমাণে নফল সওম পালন করা উত্তম। তবে পূর্ণ মাস নয়।

৬।প্রতি মাসে তিনটি সিয়ামঃ

প্রত্যেক চদ্র মাসে শুক্ল পক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের সিয়াম পালন সম্পর্কে হাদিসে এসেছেঃ

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূ যার! তুমি যখন কোন মাসে তিনদিন সওম পালন করতে চাও, তাহলে তেরো, চৌদ্দ ও পনের তারিখে করবে। (হাদিসের মান হাসান সহিহ: মিশকাত-২০৫৭, রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৭০; তিরমিযী ৭৬১, নাসায়ী ২৪২৪, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২১২৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৪৫, ইরওয়া ৯৪৭, সহীহ আত্ তারগীব ১০৩৮, সহীহ আল জামি‘ ৬৭৩, আহমাদ ২১৪৩৭)।

আবু কাতাদাহ ইবনে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৭১। এই হাদিসটি আরও আছেঃ আবূ দাউদ ২৪৪৯, নাসায়ী ২৪৩২)।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ও সফরে কোথাও শুক্লপক্ষের (তিন) দিনের রোযা ছাড়তেন না।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৭২। হাদিসের মান হাসান (নাসাঈ), নাসায়ী ২৩৪৫)।

        আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন; প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা পালন করা। চাশতের দু’ রাকআত নামায আদায় করা এবং নিদ্রা যাবার পূর্বে বিতির নামায পড়া। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৬। সহিহ মুসলিম ইঃফাঃ হাদিস নম্বর ১৫৪৫; এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ১১৭৮, ১৯৮১, তিরমিযী ৭৬০, নাসায়ী ১৬৭৭, ১৬৭৮, ২৪০৬, আবূ দাউদ ১৪৩২, আহমাদ ৭০৫৮, ৭১৪০, ৭৪০৯, ৭৪৬০, ৭৪৮৩, ৭৫৪১, ৭৬১৫, ৮০৪৪, ৯৬০০, ৯৯০৩, ১০১০৫, দারেমী ১৪৫৪, ১৭৪৫)।

আবূ দরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এমন তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন, যা আমি যতদিন বেঁচে থাকব, কখনোই ত্যাগ করব না; (১) প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা পালন করা, (২) চাশতের নামায পড়া এবং (৩) বিতির না পড়ে নিদ্রা না যাওয়া।’ [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৭। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ৭২২, আবূ দাউদ ১৪৩৩, আহমাদ ২৬৯৩৫, ২৭০০৩

আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখা, সারা বছর ধরে রোযা রাখার সমান।” [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৮। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ১১৫৯, ১৯৭৫)।

মুআযাহ আদাভিয়্যাহ কর্তৃক বর্ণিত, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল কি প্রতি মাসে তিনটি করে রোযা রাখতেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘মাসের কোন কোন দিনে রোযা রাখতেন?’ তিনি বললেন, ‘মাসের যে কোন দিনে রোযা রাখতে তিনি পরোয়া করতেন না।’ [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৯। সহিহ মুসলিম ইঃফাঃ ২৬১৫। এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ৭৬৩, আবূ দাউদ ৩৪৫৩, ইবনু মাজাহ ১৭০৯, মিশকাত-২০৪৬, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৪৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৫৭, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২১৩০)।

মন্তব্যঃ  প্রতি চন্দ্রমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে মোট ৩ দিনের সিয়াম পালনে করা সুন্নাত যা উপরে হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এ ৩ দিনকে শরীয়াতের পরিভাষায় “আইয়ামুল বীদ” বলা হয়। বীদ অর্থ সাদা বা আলোকিত। কারণ এ ৩ দিনের রজনীগুলো ফুটফুটে চাঁদের আলোতে উদ্ভাসিত থাকে।

 ৭। সাপ্তাহিক সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়ামঃ

প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার- এ দু’দিন সিয়াম পালন করা সুন্নাত। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু’দিন রোযা রাখতে পছন্দ করতেন।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (মানুষের) আমলসমূহ সোম ও বৃহস্পতিবারে (আল্লাহর নিকটে) পেশ করা হয়। তাই আমি ভালবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোযার অবস্থায় থাকি।” (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৪। মিশকাত-২০৫৬,  হাদিসের মান হাসান (তিরমিযী), এই হাদিসটি ইমাম মুসলিমও এটি বর্ণনা করেছেন, তবে তাতে রোযার উল্লেখ নেই। এই জন্য দেখুন সহিহ মুসলিম ২৫৬৫, তিরমিযী ৭৪৭, ২০২৩, আবূ দাউদ ৪৯২৬, ইবনু মাজাহ ১৭৪০, আহমাদ ৭৫৮৩, ৮১১৬, ৮৯৪৬, ৯৯০২, ২৭৪৯০, ২৭২৫০, মুওয়াত্তা মালিক ১৬৮৬, ১৬৮৭, দারেমী ১৭৫১]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার জন্য সমধিক সচেষ্ট থাকতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৫, হাদিসের মান সহিহ মিশকাত-২০৫৫, হাদিসের মান হাসান (তিরমিযী), আরও দেখুন তিরমিযী ৭৪৫, নাসায়ী ২৩৬১-২৩৬৪, ইবনু মাজাহ ১৭৩৯]

আবূ কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সোমবার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “ওটি এমন একটি দিন, যেদিন আমার জন্ম হয়েছে, যেদিন আমি (নবীরূপে) প্রেরিত হয়েছি অথবা ঐ দিনে আমার প্রতি (সর্বপ্রথম) ‘অহী’ অবতীর্ণ করা হয়েছে।” [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬৩। এই হাদিসটি আরও আছেঃ মিশকাত-২০৪৫, সহিহ মুসলিম ১১৬২, আবূ দাঊদ ২৪২৬, আহমাদ ২২৫৫০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৩৪, শু‘আবূল ঈমান ১৩২৩।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবার সওম রাখতেন। তাঁর কাছে আরয করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! আপনি অধিকাংশ সময়ই সোম ও বৃহস্পতিবার সওম রাখেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সোম ও বৃহস্পতিবার হলো ঐ দিন, যেদিন আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমকে মাফ করে দেন। কিন্তু ওদেরকে মাফ করে দেন না যারা সম্পর্কচ্ছেদ করে রাখে। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)-কে (ফেরেশতাগণকে) বলেন, ওদেরকে ছেড়ে দাও যে পর্যন্ত তারা পরস্পর সম্পর্ক ঠিক করে নেয় (এরপর তাদেরকে মাফ করে দেয়া হবে)। (হাদিসের মান সহিহ : মিশকাত-২০৬৮, ইবনু মাজাহ ১৭৪০, সহীহ আল জামি‘ ২২৭৮, সহীহ আত্ তারগীব ১০৪২)।

৮। শাবান মাসের সিয়ামঃ

শাবান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচুর পরিমাণ সিয়াম পালন করতেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাস চাইতে বেশি নফল রোযা অন্য কোন মাসে রাখতেন না। নিঃসন্দেহে তিনি পূর্ণ শাবান মাস রোযা রাখতেন।’ অন্য বর্ণনায় আছে, ‘অল্প কিছুদিন ছাড়া তিনি পূর্ণ শা‘বান মাস রোযা রাখতেন।’

(হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫৫। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ৪৩, ১১৩২, ১১৫১, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৮৭, ৬৪৬১, ৬৪৬২, ৬৪৬৪-৬৪৬৭, সহিহ মুসলিম ৭৪১, ৭৮২, ৭৮৩, ৭৮৫, ১২৫৬, ৭৮২, ১৮১৮, নাসায়ী ৭৬২, ১৬১৬, ১৬৪২, ১৬৫২, ২১৭৭, ২৩৪৭, ২৩৪৯, ২৩৫১, ৫০৩৫, আবূ দাউদ ১৩১৭, ১৩৬৮, ১৩৭০, ২৪৩৪, ইবনু মাজাহ ১৭১০, ৪২৩৮, আহমাদ ২৩৫২৩, ২৩৬০৪, ২৩৬৪২, ২৩৬০৪, ২৩৬৬৯, ২৪০১৯, ২৪১০৭, মুওয়াত্তা মালিক ৪২২, ৬৮৮)।

আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (নফল) সওম রাখা শুরু করতেন, এমনকি আমরা বলতাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি এখন সওম বন্ধ করবেন না। আবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সওম রাখা ছেড়ে দিতেন আমরা বলতাম, এখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি আর সওম রাখবেন না। রমাযান (রমজান) ছাড়া অন্য কোন মাসে তাঁকে পূর্ণ মাস সওম রাখতে দেখিনি। আর শা‘বান ছাড়া অন্য কোন মাসে তাঁকে আমি এত বেশী সওম রাখতে দেখিনি। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে তিনি [‘আয়িশাহ্ (রাঃ)] বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু দিন ছাড়া শা‘বানের গোটা মাস সওম পালন করতেন।

(হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৩৬, বুখারী ১৮৪৫ ইঃ ফা, মুসলিম ১১৫৬, আবূ দাঊদ ২৪৩৪, নাসায়ী ২১৭৭, মুয়াত্ত্বা মালিক ১০৯৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৮৬১, আহমাদ ২৪৭৫৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪২৭, সহীহ ইবনু হিববান ৩৬৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ১০২৪।

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চেয়ে বেশী (নাফল) সিয়াম কোন মাসে পালন করতেন না। তিনি (প্রায়) পুরা শা’বান মাসই সাওম সিয়াম পালন করতেন এবং বলতেনঃ তোমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকু (নফল) আমল কর, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) ক্লান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা (সওয়াব দান) বন্ধ করেন না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় সালাতই ছিল তাই যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হত। যদিও তা পরিমানে কম হত এবং তিনি যখন কোন (নফল) সালাত আদায় করতেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন।(সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৪৫ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।  

ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইমরানকে অথবা অন্য কোন লোককে জিজ্ঞেস করেছেন, আর ‘ইমরান তা শুনছিলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে অমুক ব্যক্তির পিতা! তুমি কী শা‘বান মাসের শেষ দিনগুলো সওম রাখো না? তখন তিনি বললেন, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি (রমাযানের শেষে শা‘বান মাসের) দু’টি সওম পালন করে নিবে। [হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৩৮, বুখারী ১৯৮৩, মুসলিম ১১৬১, আহমাদ ১৯৯৪৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৫৮৮।

৯। দাঊদ আলাইহিস সালাম এর সিয়ামঃ

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ সংবাদ পৌছে যে, আমি একটানা সিয়াম পালন করি এবং রাতভর সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করি। এরপর হয়ত তিনি আমার কাছে লোক পাঠালেন অথবা আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেনঃ আমি কি এ কথা ঠিক শুনি নাই যে, তুমি  সিয়াম পালন করতে থাক আর ছাড় না এবং তুমি (রাতভর) সালাত আদায় করতে থাক আর ঘুমাও না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ  সিয়াম পালন কর এবং মাঝে মাঝে তা ছেড়েও দাও। রাতে সালাত আদায় কর এবং নিদ্রাও যাও। কেননা তোমার উপর তোমার চোখের হক রয়েছে এবং তোমার নিজের শরীরের ও তোমার পরিবারের হক তোমার উপর আছে।

‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেন, আমি এর চেয়ে বেশী শক্তি রাখি। তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তাহলে তুমি দাঊদ (আলাইহিস সালাম) এর সিয়াম পালন কর। রাবী বলেন, ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেন, তা কিভাবে? তিনি বললেনঃ দাঊদ (আলাইহিস সালাম) একদিন  সিয়াম পালন করতেন , একদিন ছেড়ে দিতেন এবং তিনি (শত্রুর) সম্মুখীন হলে পলায়ন করতেন না। ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নাবী! আমাকে এ শক্তি কে যোগাবে? বর্ণনাকারী ‘আতা (রহঃ) বলেন, (এই হাদীসে) কিভাবে সব সময়ের সিয়ামের প্রসঙ্গ আসে সে কথাটুকু আমার মনে নেই (অবশ্য) এতটুকু মনে আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’বার এ কথাটি বলেছেন, সব সময়ের সাওম  সিয়াম কোন  সিয়াম নয়। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৫৩)।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কি সব সময় সিয়াম পালন কর এবং রাতভর সালাত আদায় করে থাক? আমি বললাম, জী হাঁ। তিনি বললেন তুমি এরূপ করলে চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। যে সারা বছর সিয়াম পালন করে সে যেন সিয়াম পালন করে না। মাসে তিন দিন করে সিয়াম পালন করা সারা বছর সিয়াম পালনের সমতূল্য। আমি বললাম আমি এর চেয়ে বেশী করার সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর সিয়াম পালন কর, তিনি একদিন সিয়াম পালন করতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন এবং যখন শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৫৫)।

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আমার সিয়াম এর আলোচনা করায় তিনি আমার এখানে আগমন করেন। আমি তাঁর জন্য খেজুরের ছালে পরিপূর্ণ চামড়ার বালিশ (হেলান দিয়ে বসার জন্য) পেশ করলাম। তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। বালিশটি তাঁর ও আমার মাঝে পড়ে থাকল। তিনি বললেনঃ প্রতি মাসে তুমি তিন দিন রোযা রাখলে হয়না? ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (আরো)। তিনি বললেন সাতদিন। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (আরো)। তিনি বললেনঃ নয় দিন। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (আরো)। তিনি বললেনঃ এগারো দিন। এরপর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দাঊদ (আলাইহিস সালাম) এর সিয়াম এর চেয়ে উত্তম সিয়াম আর হয় না। অর্ধেক বছর, একদিন সিয়াম পালন কর ও একদিন ছেড়ে দাও। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৫৬)।

১০। বিবাহে অসামর্থ ব্যক্তিদের সিয়ামঃ

বিবাহে অসামর্থ ব্যক্তিদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম পালনের মাধ্যমে তার প্রবৃত্তিকে দমন করতে বলেছেন।

আলকামা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সঙ্গে চলতে ছিলাম তখন তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি বললেনঃ যে ব্যাক্তির সামর্থ্য আছে, সে যেন বিবাহ করে নেয়। কেননা বিবাহ চোখকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষন করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সিয়াম পালন করে। সিয়াম তাঁর প্রবৃত্তিকে দমন করে। (সহীহ বুখারী হদিস নম্বর ১৭৮৪ ইঃ ফাঃ)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে যুবকেরা, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি যৌন মিলন ও পরিবারের ভরণ পোষণের ক্ষমতা রাখে সে যেন বিবাহ করে, কেননা এতে দৃষ্টি অবনমিত হয় এবং যৌনাঙ্গের হেফাযাত করা হয়। আর যে যুবক (স্ত্রীর ব্যয়ভার বহনের) ক্ষমতা রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম পালন যৌন স্পৃহা দমিয়ে রাখে। (বুখারী-৫০৬৬ ও মুসলিম-১৪০০)

১১। আল্লাহর পথে সিয়ামঃ

আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ)  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে (অর্থাৎ- জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ-এর সময় খালিসভাবে আল্লাহর জন্য) সিয়াম রাখে, আল্লাহ তা‘আলা তার মুখমন্ডলকে (তাকে) জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখবেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৫৩, বুখারী ২৮৪০, মুসলিম ১১৫৮, নাসায়ী ২২৪৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৯৬৮৪, আহমাদ ১১৪০৬, দারিমী ২৪৪৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৮৫৭৬, সহীহ আল জামি‘ ৬৩২৯)।

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন সিয়াম রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ও জাহান্নামের মধ্যে এমন একটা পরিখা আড় হিসেবে বানিয়ে দেবেন যা আসমান ও জমিনের মধ্যে দূরত্বের সমান হবে। (হাদিসের মান হাসান সহিহ: মিশকাত-২০৬৪, তিরমিযী ১৬২৪, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৭৯২১, সহীহাহ্ ৫৬৩, সহীহ আত্ তারগীব ৯৯১, সহীহ আল জামি‘ ৬৩৩৩)।

১২। মৃত্যুর পক্ষ থেকে সিয়ামঃ

‘আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সওমের কায যিম্মায় রেখে যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তার অভিভাবক তার পক্ষ হতে সিয়াম আদায় করবে।

(বুলুগুল মারাম ৬৭৯, বুখারী ১৯৫২, মুসলিম ১১৪৭, আবূ দাউদ ২৪০০, ২৩১১, আহমাদ ২৩৮৮০। সতর্কবানী: উক্ত হাদীসে যে রোযা রাখার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র মানতের রোযা)।

নফল সিয়াম দাওয়াত পেলে ভাঙ্গা যায়ঃ

আবূ জুহায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান (রাঃ) ও আবূদ দারদা (রাঃ) এর মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন করে দেন। (একবার) সালমান (রাঃ) আবূদ দারদা (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করতে এসে উম্মুদ দারদা (রাঃ) কে মলিন কাপড় পরিহিত দেখতে পান। তিনি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উম্মুদ দারদা (রাঃ) বললেন, আপনার ভাই আবূদ দারদার পার্থিব কোন কিছুর প্রতি মোহ নেই। কিছুক্ষণ পরে আবূদ দারদা (রাঃ) এলন। তারপর তিনি সালমান (রাঃ) এর জন্য আহার্য প্রস্তুত করান এবং বলেন, আপনি খেয়ে নিন, আমি  সিয়াম পালন করছি। সালমান (রাঃ) বললেন, আপনি না খেলে আমি খাব না।

এরপর আবূদ দারদা (রাঃ) সালমান (রাঃ) এর সঙ্গে খেলেন। রাত হলে আবূদ দারদা (রাঃ) সালাত আদায়ে দাঁড়াতে গেলেন। সালমান (রাঃ) বললেন, এখন ঘুমিয়ে যান। আবূদ দারদা (রাঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে আবূদ দারদা (রাঃ) আবার সালাতে দাঁড়াতে উদ্যত হলেন, সালমান (রাঃ) বললেন, ঘুমিয়ে যান। যখন রাতের শেষভাগ হল, সালমান (রাঃ) আবূদ দারদা (রাঃ) কে বললেন, এখন দাঁড়ান। এরপর তারা দুজনে সালাত আদায় করলেন।

পরে সালমান (রাঃ) তাঁকে বললেন, আপনার প্রতিপালকের হক আপনার উপর আছে। আপনার নিজেরও হক আপনার উপর রয়েছে। আবার আপনার পরিবারেরও হক রয়েছে। প্রত্যেক হকদারকে তার হক প্রদান করুন। এরপর আবূদ দারদা (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। (সব শুনে) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সালমান ঠিকই বলেছে। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হাদিস নম্বর ১৮৪৪)।

 সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment