সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : দ্বিতীয় কিস্তি

সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

৯। রউফুল ইয়াদাইন বিষয়েঃ

হাত বাঁধার মত সালাতের রুকুতে গমন বা রুকু থেকে উঠে হাত তোলার বিষয়টি উপমহাদেশের মুসলিমদের নিকট খুবই জটিল বিষয়। দু পক্ষের মাঝে দলীল, পাল্টা দলীল, যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলতে থাকে। আমি যদি বলি আমি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লষন কবর। এই কথাটিও অনেকে গ্রহন করবে না। কারন হাদিসের আলোকে রায় দিলেও যার বিপক্ষে যাবে সে মেনে নিবেনা। আর যার পক্ষে যাবে সে বাহবা দিবে। আসলে অন্ধ ভক্তের কারনে আমাদের এই অবস্থা। একটু ভাবুন আর বিবেক খাটান দেখুন সঠিক সিন্ধান্তে পৌছে যাবেনই। হাত বাঁধার মতই আমি আমদের দেশে অনুবাদীত বিখ্যাত ছয়টি গ্রন্থ সহিহ বুখারী, সহহি মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ এর সাহায্য নিয়ে আলোচনা করব। রুকুর আগে ও পরে হাত উঠান বা না উঠান সকল হাদিসই এখানে তুলে ধরব। এ সম্পর্কিত হাদিসগুলো হলঃ

সহিহ বুখারীঃ 

সালিম ইবনু আবদুল্লাহ্ (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত শুরু করতেন, তখন উভয় হাত তাঁর কাঁধ বরাবর উঠাতেন। আর যখন রুকূ‘তে যাওয়ার জন্য তাকবীর বলতেন এবং যখন রুকূ‘ হতে মাথা উঠাতেন তখনও একইভাবে দু’হাত উঠাতেন এবং سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ  বলতেন। কিন্তু সাজদাহর সময় এমন করতেন না। (সহিহ বুখারি ৬৯৯ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৬৯১)

নোটঃ সহিহ বুখারীর ইসলামি ফাউন্ডেশনের প্রকাশীত এর পরের ৭০০, ৭০১, ৭০২ এবং ৭০৩ নম্বর হাদিসে এই একই বিষয়ে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, মোট হাদিস ০৫ টি রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে না, এমন কোন হাদিস সহিহ বুখারীতে নেই।

সহিহ মুসলিমঃ

সালিম-এর পিতা ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি তিনি যখন সালাত আরম্ভ করতেন তখন উভয় হাত উঠাতেন। এমনকি তা একেবারে তাঁর উভয় কাঁধ বরাবর হয়ে যেত। আর রুকু করার পূর্বে এবং যখন রুকু থেকে উঠতেন (তখনো অনুরূপ ভাবে হাত উঠাতেন)। কিন্তু উভয় সিজদার মাঝখানে তিনি হাত উঠাতেন না। (সহিহ মুসলিম ৭৫৭ ইফাঃ)

নোটঃ সহিহ মুসলিম ইফাঃ এর পরের ৭৪৮, ৭৪৯, ৭৫০, ৭৫১, ৭৫২ এবং ৭৮১ নম্বর হাদিসে একই বিষয়ের উপর হাদিস বর্ণিত হয়েছে, মোট হাদিস ৭ টি রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে না, এমন কোন হাদিস সহিহ মুসলিমে নেই।

 

সুনানে আবু দাউদঃ

সালেম থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্নিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আরম্ভ করার সময় তার দুহাত স্বীয় কাঁধ পর্যন্ত উঠাতে দেখেছি। অনুরূপভাবে এবং রুকূ করার সময় এবং রুকূ হতে মাথা উঠানোর পরও তাকে হাত উঠাতে দেখেছি। কিন্তু তিনি দুই সিজদার মাঝে হাত উঠাতেন না। (সুনানে আবুদাউদ ৭২১ ইফাঃ)

নোটঃ সুনানে আবুদাউদ ইফাঃ এর পরের ৭২২, ৭২২৩, ৭২৪, ৭২৫, ৭২৬, ৭৩০, ৭৩৩, ৭৩৮, ৭৩৯, ৭৪১, ৭৪২, ৭৪৪, ৭৪৫, এবং ৭৪৭ নম্বর হাদিসে একই বিষয়ের উপর হাদিস বর্ণিত হয়েছে, মোট হদিস ১৫ টি

৯। রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে নাঃ

আলকামা (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ্‌ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামায সম্পর্কে শিক্ষা দেব না? রাবী বলেন, অতঃপর তিনি নামায আদায়কালে মাত্র একবার হাত উত্তোলন করেন। (ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, এটা একটি দীর্ঘ হাদীছের সংক্ষিপ্তসার। উপরোক্ত শব্দে হাদীছটি সঠিক নয়। (সুনানে আবুদাউদ ৭৪৮ ইফাঃ)

সুফিয়ান (রহঃ) হতে পূর্বোক্ত হাদীছটি এই সনদে বর্ণিত। রাবী বলেন, অতঃপর তিনি কেবলমাত্র প্রথম বার (তাকবীরে তাহরীমা পাঠের সময়) হাত উত্তোলন করেন। কতক রাবী বলেন, তিনি শুধুমাত্র একবার হাত উঠান। (সুনানে আবুদাউদ ৭৪৯ ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

বারাআ ইবনু আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নামায আরম্ভের সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবলমাত্র একবার কানের নিকট পর্যন্ত হাত উঠাতেন। অতঃপর তিনি আর হাত উঠাতেন না। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫০ ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

বারাআ আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় তার হস্তদ্বয় উত্তোলন করতে দেখেছি। অতঃপর তিনি নামাযের শেষ পর্যন্ত আর কখনও স্বীয় হস্তদ্বয় (একবারের অধিক) উত্তোলন করেননি। ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ সহীহ নয়। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫২ ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

আবূ জুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আলী (রাঃ) বলেন, নামাযে রত অবস্থায় নাভির নীচে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের তালু রাখা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫৬ ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

ইবনু জুরাইজ থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি আলী (রাঃ)-কে নামাযে নাভির উপরে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি ধরে রাখতে দেখেছি। ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে “নাভির উপরে” বর্ণিত আছে। আর আবূ মিজলায বলেছেন, “নাভির নীচে”। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে, কিন্তু তা তেমন শক্তিশালী নয়। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫৭ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

আবূ ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, আমি নামাযে নাভির নীচে (বাম) হাতের উপর (ডান) হাত রাখি। আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) ইসহাক আল-কূফীকে দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করতে শুনেছি। (সুনানে আবুদাউদ ৭৫৮ ইফাঃ, হাদিসের মান যঈফ)

রুকুর আগে পরে হাত না উঠান সম্পর্কে এখান মোট সাতটি যঈফ হাসিদ উল্লেখ করা হল।

সুনানে তিরমিজিঃ

সালিম তাঁর পিতা ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত শুরু করতেন এবং রুকূতে যেতেন; রুকূ থেকে মাথা তুলতেন তখন কাঁধ বরাবর হাত উঠাতেন। ইবনু আবী উমর তাঁর রিওয়ায়াতে আরো উল্লেখ করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই সিজদার মাঝে হাত উঠাতেন না। (সুনানে তিরমিজি ২৫৫ ইফাঃ)

নোটঃ সুনানে তিরমিজি ইফাঃ এর পরের ২৫৬, ৩৪২৩ নম্বর হাদিসে একই বিষয়ের উপর হাদিস বর্ণিত হয়েছে, মোট হদিস ০৩ টি

 

১০। রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে নাঃ

আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি একদিন উপস্থিত লোকদের বললেন আমি কি তোমাদের নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাতের মত সালাত পড়ব? এরপর তিনি সালাত পড়লেন এবং তাতে প্রথমবার অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য কোন সময় হাত তুললেন না। (সুনানে তিরমিজী হাদিস নম্বর ২৫৭ হাদিসেন মান হাসান সহিহ)

 

সুনানে নাসাঈঃ

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন তখন দু’কাঁধ পর্যন্ত তার দু হাত তুলতেন। আর যখন রুকু করতেন এবং রুকু থেকে মাথা তুলতেন তখনো দু’ হাত এভাবে তুলতেন এবং বলতেন- سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ আর তিনি সিজদার সময় এরূপ করতেন না। (সুনানে নাসাঈ ৮৮১ ইফাঃ)

নোটঃ সুনানে নাসাঈ ইফাঃ এর পরের ৮৭৯, ৮৮০, ৮৮২, ৮৮৩, ৮৮৪, ৮৯২, ১০২৭.১০২৮, ১০৫৮, ১০৫৯, ১০৬০ এবং ১০৬২ নম্বর হাদিসে এই একই বিষয়ে মোট ১৩ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে না, এমন কোন হাদিস সুনানে নাসাঈতে নেই।

 

সুনানে ইবনে মাজাহঃ

ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি যে, তিনি সালাত শুরু করতে তাঁর দু হাত তাঁর দু কাঁধ পর্যন্ত উত্তোলন করতেন, তিনি রুকূতে যেতে এবং রুকূ থেকে মাথা তুলতেও তাই করতেন, কিন্তু দু সাজদাহর মাঝখানে হাত উত্তোলন করতেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নম্বর ৮৫৮)

নোটঃ সুনানে ইবনে মাজাহ এর পরের ৮৫৯, ৮৬০, ৮৬১, ৮৬২, ৮৬৩, ৮৬৪, ৮৬৫, ৮৬৬, ৮৬৭ এবং ৮৬৮, নম্বর হাদিসে এই একই বিষয়ে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, মোট হাদিসের সংখ্যা ১১ টিরুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে না, এমন কোন হাদিস সুনানে ইবনে মাজাহতে নেই।

 

মন্তব্যঃ সিয়া সিত্তার হাদিসের গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে পাই রুকুর আগে পরে হাত উঠাতে হবে এই মর্মে প্রায় ৫৪ টি সহিহ হাসিদ বর্নিত হয়েছে। এর বিপরীতে পক্ষে মাত্র একটি সহিহ ও সাতটি যঈফ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কাজেই রুকুর আগে পরে হাত উঠানোর পক্ষে মতামতটি বেশী শক্তিশালী এ কথার বলতে আর কোন দীধা নেই। কিন্তু রুকুর আগে পরে হাতে উঠাতে হবে না এই মর্মে যেহেতু সহিহ হাদিস আছে। কাজেই যারা হাত তুলেন না তাদের সালাত পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ হয় এমনটি বলার কোন সুযোগ নেই।

দুরাকআত আদায়ের পর দাঁড়ানোর সময়ও হাত তোলাঃ

নাফি‘ (রহ.) বর্ণিত যে, ইবনু ‘উমার (রাযি.) যখন সালাত শুরু করতেন তখন তাক্বীর বলতেন এবং দু’ হাত উঠাতেন আর যখন রুকূ‘ করতেন তখনও দু’ হাত উঠাতেন। অতঃপর যখন سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ  বলতেন তখনও দু’ হাত উঠাতেন এবং দুরাকআত আদায়ের পর যখন দাঁড়াতেন তখনও দুহাত উঠাতেন। এ সমস্ত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত বলে ইবনু ‘উমার (রাযি.) বলেছেন। এ হাদীসটি হাম্মাদ ইবনু সালাম ইবনু ‘উমার (রাযি.) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনু তাহমান, আইয়ূব ও মূসা ইবনু ‘উক্বাহ (রহ.) হতে এ হাদীসটি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।(সহিহ বুখারি ৭০৩ ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

আমাদের দেশের নাম সম্পর্কে আর

 

১১সিজদার স্থানে দৃষ্টিপাত না করাঃ

সালাত আদায়ের সময় দৃষ্টি কোথায় থাকবে বিষয়টি একেবারে হেলাফেলার নয়। সালাতে দৃষ্টি এদিক সেদিক দিলে বা আকাশের দিকে দিলে সালাত ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দৃষ্টি ঠিক না থাকলে মনের মাঝে বিভিন্ন চিন্তার উম্মেস ঘটবে। সালাতের সময় দৃষ্টি যে বস্তুর উপর পড়ে মনে তার চিন্তা উদয় হয়।  তাই আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দৃষ্টিকে সংযোত রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকদের কি হল যে, তারা সালাতে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়? এ ব্যাপারে তিনি কঠোর বক্তব্য রাখলেন। এমনকি তিনি বললেন, যেন তারা অবশ্যই এ থেকে বিরত থাকে, অন্যথায় অবশ্যই তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেওয়া হবে। (সহিহ বুখারী ৭১৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাতে এদিক সেদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এটা এক ধরণের ছিনতাই, যার মাধ্যমে শয়তান বান্দার সালাত থেকে অংশ বিশেষ কেড়ে নেয়। (সহিহ বুখারী ৭১৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

জাবির বিন সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, লোকেরা যেন আকাশের দিকে তাদের চোখ তোলা থেকে অবশ্যই বিরত থাকে, অন্যথায় তারা তাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না। (ইবনে মাজাহ ১০৪৫, সহিহ মুসলিম ৪২৮, আবূ দাঊদ ৯১২, আহমাদ ২০৩২৬, ২০৩৬৩, ২০৪৫৭, ২০৫৩৭, দারিমী ১৩০১, তাহক্বীক্ব আলবানী মান সহিহ)।

আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোকই সালাতে তাদের দৃষ্টির গুরুত্ব বুঝে না। সালাতে দৃষ্টি রাখা সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞানও নাই। ফলে অনেক মুসলিম আলেমদের নিকট সালাতের দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে থাকে যে, সালাতে দৃষ্টি কোথায় রাখবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, সালাতে সময় দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে, রুকু অবস্থায় থাকবে দু’পায়ের মাঝখানে, বসা অবস্থায় থাকবে কোলের দিকে, সিজদা অবস্থায় থাকবে নাকের দিকে। তাদের দলীণ হলোঃ

ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, সালাতের সময় দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে, রুকু অবস্থায় থাকবে দু’পায়ের মাঝখানে, বসা অবস্থায় থাকবে কোলের দিকে, সিজদা অবস্থায় থাকবে নাকের দিকে। (কিতাবুল মাবসূত ১/২৮)

পক্ষান্তরে হাদিসে এসেছে, সম্পুর্ণ সালাতেই দৃষ্টি থাকবে সিজদার স্থানে রখতে হবে, কেবল তাশাহুদের বৈঠক ছাড়া।  কারন তাশাহুদের বৈঠকে দৃষ্টি থাকবে ডান হাতের শাহাদাত (তর্জনী) অঙ্গুলীর দিকে রাখার বিষয়টি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রতমানিত। সালাতের দৃষ্টি কোথায থাকরে বিষয়টি বুঝার জন্য নিম্মের হাদিসগুলির প্রতি একটু লক্ষ করি।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে দাঁড়াতেন, তখন মাথাটা নিচু করে ঝুঁকিয়ে রাখতেন এবং দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন জমিনের দিকে।

(মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস নং ১/৪৭৯। তিনি বলেন, হাদিসটি শাইখাইনের শর্ত অনুযায়ী বিশুদ্ধ।  আল্লামা আলবানী (রহঃ) হাদিসটির বিশুদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সহমত পোষণ করেন)।

এই কারনে আলেমগন সিজদা বা তার এরিয়ার মধ্যে দৃষ্টি রাখতে বলে থাকেন। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৭৬১; বায়হাক্বী, সনানুল কুবরা হা/১০০০৮; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ৮৯; সনদ ছহীহ)

নবী (সাঃ) এর সালাত সম্পাদনের পদ্ধতি নামক গ্রন্থে আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দিন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ লিখেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত অবস্থায় মাথা নীচু করে যমীনের দিকে দৃষ্টি রাখতেন। তিনি যখন কা’বা ঘরে প্রবেশ করেন তখন থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টি সাজদার স্থানচ্যুত হয়নি।

তিনি রেফারেন্স হিসাবে উল্লেখ করেনঃ বাইহাকী, হাকিম এবং তিনি একে ছহীহ বলেছেন আর তা যথার্থই। প্রথম হাদীছের পক্ষে দশজন ছাহাবীর হাদীছ সাক্ষ্য বহন করে যা ইবনু আসাকির বর্ণনা করেছেন (১৭/২০২/) আরো দেখুন ইরওয়া কিতাবে (৩৫৪)জ্ঞাতব্যঃ এই হাদীছদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, যমীনে সাজদার স্থানে দৃষ্টি রাখা সুন্নাত। অতএব কিছু সংখ্যক মুছল্লী যারা চক্ষু বন্ধ করে ছলাত পড়ে, এ হচ্ছে ঠাণ্ডা পরহেযগারী। বস্তুতঃ মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর আদর্শই হচ্ছে সর্বোত্তম আদর্শ।

 তাশাহুদে বসে তাশাহুদ আঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করা এবং সে দিকে নিদৃষ্টি নিবন্ধ রাখা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমানিত।

আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে বসতেন, বাম পা-খানি বিছিয়ে দিতেন। এবং বাম হাত বাম উরুর উপর ও ডান হাত খানি ডান উরুর উপর রাখতেন, আর আঙ্গুল (তর্জনী) দ্বারা ইশারা করতেন। (সহিহ মুসলিম ১১৮৫ ইফাঃ)

আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুআ করার জন্য বসতেন, তখন ডান হাত ডান উরুর উপর রাখতেন এবং বাম হাত বাম উরুর উপর। শাহাদাত আংগুলি (তর্জনী) দ্বারা ইশারা করতেন এবং অঙ্গুদুষ্ঠকে মধ্যমার উপর রাখতেন। আর বামহাতের তালূ দ্বারা বাম হাঁটু আকড়িয়ে ধরতেন। (সহিহ মুসলিম ১১৮৬ ইফাঃ)

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে বসতেন, তখন দুই হাত দুই হাঁটুর উপর রাখতেন এবং ডান হাতের বৃদ্ধাংগুলির পাশের (শাহাদত) আঙ্গুলি উঠিয়ে তা দ্বারা (ইংগিতে) দু’আ করতেন। আর বাম হাত খানি বাম হাঁটুর উপর বিছিয়ে রাখতেন। (সহিহ মুসলিম ১১৮৭ ইফাঃ)

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্নিত যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাশাহুদ পড়ার জন্য বসতেন, তখন তার বাম হাত বাম হাঁটুর উপর এবং ডান হাত ডান হাঁটুর উপর রাখতেন। আর (ডান হাতের আঙ্গুল দ্বারা) তেপ্পান্ন বানিয়ে শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করতেন। (সহিহ মুসলিম ১১৮৮ ইফাঃ)

ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, দু’আর আদব (শিষ্টতা) হল, উভয় কাঁধ বা তার সম-পরিমাণ পর্যন্ত উত্তোলন করা এবং ইস্তেগফারের (গোনাহ মাফের জন্য দু’আ করার) আদব হল, দুআর সময় শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা। ইবতিহালের (অর্থাৎ দু’আর সময় রোনাজারি, কান্নাকাটি করা) আদব হল-দুআর সময় উভয় হস্তকে এত  উপরে উঠানো যাতে হাতের বগলের সাদা অংশ দৃষ্টিগোচর হয়। (আবু দাউদ ১৪৮৯ ইফাঃ)

অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করলেন এবং মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা গোলাকার বৃত্ত বানানঃ

ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি (মনে মনে) বললাম, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাতের প্রতি লক্ষ্য রাখব যে, তিনি কীভাবে সালাত আদায় করেন। একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দাঁড়ালেন এবং কিবলার দিকে মুখ করে তাঁর হস্তদ্বয় উঠালেন এমনভাবে যে, তা তাঁর কর্ণদ্বয়ের বরাবর হয়ে গেল, তারপর তিনি তাঁর ডান হাত দ্বারা বাম হাত ধরলেন, যখন তিনি রুকু করার ইচ্ছা করলেন তখন হস্তদ্বয় পূর্বের ন্যায় উঠালেন এবং হাতদ্বয় তাঁর হাটুর উপর রাখলেন, যখন তিনি তাঁর মাথা রুকু হতে উঠালেন হস্তদ্বয়কে পূর্বের ন্যায় উঠালেন। তারপর যখন তিনি সিজদা করলেন, তার মাথা হস্তদ্বয়ের মধ্যস্থলে রাখলেন। পরে বসে তার বাম পা বিছালেন ও বাম হাত বাম উরুর ওপর রাখলেন। আর তার ডান কনুই ডান উরুর ওপর রাখলেন এবং দু’আঙ্গুল দ্বারা গোলাকার বৃত্ত বানালেন। তাকে এরূপই করতে দেখেছি। (সুনানে নাসাঈ ১২৬৮ ইফাঃ)

নাফি‘ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, ইবনু উমার (রাঃ) যখন সলাতে বসতেন, নিজের দু হাত নিজের দু রানের উপর রাখতেন। আর শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন এবং তার চোখের দৃষ্টি থাকত আঙ্গুলের প্রতি।। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লা, আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ এ শাহাদাত আঙ্গুল শায়ত্বনের কাছে লোহার চেয়ে বেশী শক্ত। অর্থাৎ শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে তাওহীদের ইশারা করা শায়ত্বনের উপর নেযা নিক্ষেপ করার চেয়েও কঠিন। (মিসকাত ৯১৭, আহমাদ ৫৯৬৪, হাদিসের মান হাসান)।

মন্তব্যঃ উপরের হাদিসের আলোকে বলা যায়ঃ ডান হাত ৫৩ এর ন্যায় মুষ্টিবদ্ধ থাকবে। যার অর্থ কনিষ্ঠা, অনামিকা মধ্যমা অঙ্গুলী মুষ্টিবদ্ধ করা বৃদ্ধাঙ্গুলীকে তাদের সাথে মিলানো এবং শাহাদাত অঙ্গুলীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে এবং শাহাদাত অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করবে। বৈঠকের শুরু থেকে সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ইশারা করতে থাকবে। ইশারার সময় আঙ্গুল দ্রুত নাড়ানো যাবে না, যা পাশের মুছল্লীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। আমাদের সমাজে প্রচলিত সালাতে সময় দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে, রুকু অবস্থায় থাকবে দু’পায়ের মাঝখানে, বসা অবস্থায় থাকবে কোলের দিকে, সিজদা অবস্থায় থাকবে নাকের দিকে। এ সকল কথার কোন ভিত্তি নাই। তাই এই সকল আমল সহিহ সুন্নাহর পরিপন্থী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইসলাম  শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রাহুমাহুল্লার একটি লেখা “ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম” নামক গ্রন্থ থেকে একটি ফাতওয়া নকল করছে। (সিরিয়াল নম্বর ২৫৪)

**** তাশাহুদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তর্জনী আঙ্গুল নড়ানোর বিধান কি?

তর্জনী আঙ্গুল নাড়ানো শুধুমাত্র দু’আর সময় হবে। পূরা তাশাহুদে নয়। যেমনটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছেঃ “তিনি উহা নাড়াতেন ও দু’আ করতেন।” এর কারণ হচ্ছেঃ দু’আ আল্লাহ্‌র কাছেই করা হয়। আর আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আসমানে আছেন। তাই তাঁকে আহবান করার সময় উপরে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করবে। আল্লাহ্‌ বলেন,

*أَأَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ الأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ، أَمْ أَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ*

“তোমরা কি নিরাপদে আছ সেই সত্বা থেকে যিনি আসমানে আছেন যে, তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন না? তখন আকস্মিকভাবে যমীন থরথর করে কাঁপতে থাকবে। অথবা নাকি তোমরা নিরাপদ আছ সেই সত্বার ব্যাপারে যিনি আসমানের অধিপতি তোমাদের উপর কঙ্করবর্ষী ঝঞ্ঝা প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে, আমার সকর্ত করণ কিরূপ ছিল।” (সূরা মুলকঃ ১৬-১৭)

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমারা কি আমাকে আমানতদার মনে করো না? অথচ আমি যিনি আসমানে আছেন তার আমানতদার।” সুতরাং আল্লাহ্‌ আসমানে তথা সবকিছুর উপরে আছেন। যখন আপনি দু’আ করবেন উপরের দিকে ইঙ্গিত করবেন। একারণে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জে খুতবা প্রদান করে বললেন, “আমি কি পৌঁছিয়েছি?” তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি আসমানের দিকে আঙ্গুল উঠালেন

এবং লোকদের দিকে আঙ্গুলটিকে ঘুরাতে থাকলেন বললেন, “হে আল্লাহ্‌ তুমি সাক্ষী থেকো। হে আল্লাহ্‌ তুমি সাক্ষী থেকো। হে আল্লাহ্‌ তুমি সাক্ষী থেকো।” এদ্বারা প্রমাণিত হয় আল্লাহ্‌ তা’আলা সকল বস্তর উপরে অবস্থান করেন। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সুপ্রমাণিত ফিতরাতী ভাবে, বিবেক যুক্তি ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এই ভিত্তিতে যখনই আপনি আল্লাহ্‌ তা’আলাকে ডাকবেন তাঁর কাছে দু’আ করবেন, তখনই আসমানের দিকে তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা ইঙ্গিত করবেন এবং তা নাড়াবেন। আর অন্য অবস্থায় তা স্থির রাখবেন।

এখন আমরা অনুসন্ধান করি তাশাহুদে দু’আর স্থানগুলোঃ
১) আস্‌সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
২) আস্‌সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিছ্‌ ছালিহীন।
৩) আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলি মুহাম্মাদ
৪) আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ
৫) আঊযুবিল্লাহি মিন আযাবি জাহান্নাম
৬) ওয়া মিন আযাবিল ক্বাবরি।
৭) ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহ্‌ইয়া ওয়াল মামাত।
৮) ওয়ামিন ফিতনাতল মাসীহিদ্দাজ্জাল।

এই আটটি স্থানে আঙ্গুল নাড়াবে এবং তা আকশের দিকে উত্থিত করবে। এগুলো ছাড়া অন্য কোন দু’আ পাঠ করলেও আঙ্গুল উপরে উঠাবে। কেননা দু’আ করলেই আঙ্গুল উপরে উঠাবে।

 

১২। সালাতে চোখ বন্ধ রাখাঃ

কোন কোন নামাজিকে দেখা যায়, সালাতে চোখ বন্ধ করে সালাত আদায় করে। হাদিসের আলোকে তাদের এই কাজ সঠিক নয়। কেননা উপরোক্ত হাদিস সমূহে আমরা দেখলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণভাবে সেজদার স্থানে আর তাশাহুদ অবস্থায় ডান হাতের তর্জনী আগুলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। এখান থেকে প্রতিয়মান হয় যে, চোখ বন্ধ করে সালাত আদায় করা সুন্নত পরিপন্থী কাজ। কিন্ত কারন বসত চোখ বন্ধ করে সালাত আদায় করা যায়। মুসল্লির সামনে যদি এমন কিছু থাকে বা নড়াচড়া করে যার কারণে সালাতে মনোযোগ বিঘ্নিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করা জায়েয আছে।

যেমনঃ সামনে কারুকার্য, নক্সা, ফুল বা এমন কোন জিনিস থাকে, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অথবা মনোযোগ কেড়ে নেয় অথবা ক্বিরাআত ভুলিয়ে দেয় এবং তা দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে নামায পড়ায় কোন দোষ নেই। বরং এই ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করেই নামায পড়া উত্তম হওয়া শরীয়ত এবং তার উদ্দেশ্য ও নীতির অধিক নিকটবর্তী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/২৯৩-২৯৪, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৮, ৫২, ৩১৬, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯-২৯০, মুত্বাসা ১৩০-১৩১পৃ:)

১৩। সালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করাঃ 

ইমামের পিছনে সালাত আদায় করার সময় সুরা ফাতিহা পড়া, না পড়া নিয়ে সমাজে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। এ সম্পর্কে মুজতহীদ আলেমগনের মাঝেও মতভেদ দেখা যায়। তাই বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য ভিন্নমতের হাদিস কে সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করব। যাতে খুব সহজে দলীলের আলোকে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন। কুরআন সুন্নাহর আলোকে এ সম্পর্কে মুজতাহীদ আলেমগন চারটি প্রসিদ্ধ মত পাওয়া যায়ঃ

১। নামাযে কখনই সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব নয়

২। একাকী সালাতে ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হলেও ইমামের পিছনে পাঠ করা ওয়াজিব নয়

৩। স্বরব সালাতে ফাতিহা শুনবে আর নীরব সালাতে ফাতিহা পড়বে

৪। স্বরব এবং নীরব সকল সালাতে ফাতিহা পড়া ওয়াজিব

 

১৪। নামাযে কখনই সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব নয়ঃ

স্বরব বা নীরব কোন সালাতেই ইমাম, মুক্তাদী, একাকী- কারো জন্য পাঠ করা ওয়াজিব নয়। ওয়াজিব হচ্ছে কুরআন থেকে সহজ যে কোন কিছু পাঠ করা। তাদের দলীল হচ্ছেঃ আল্লাহ্‌ বলেন,

فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْ الْقُرْآنِ**

অর্থঃ অতএব তোমরা কুরআন থেকে সহজ কোন কিছু পাঠ কর। (সূরা মুযাম্মিল- ২০)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি প্রসিদ্ধ হাদিস থেকেও এ বিষয়টি প্রমানিত।

হাদিসটি হলোঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন একটি লোক প্রবেশ করল। সে সালাত আদায় করল। তারপর এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম করল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন , ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কারণ তোমার সালাত হয়নি। লোকটি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করল। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে সালাম করল। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়ে বললেন, ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কারণ তোমার সালাত হয়নি। এই রূপ তিনবার করলেন।

অতঃপর লোকটি বলল, আপনাকে সত্য নাবী করে পাঠিয়েছেন সেই সত্তার কসম! সালাত আদায়ের এর চেয়ে ভাল কোন পন্থা থাকলে আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, যখন তুমি সালাতের জন্য দাঁড়াবে তখন তাকবীর বলবে। তারপর তুমি কুরআনের যতটুকু জানো তা থেকে যা সহজ হয় তাই পাঠ করবে তারপর রুকু করবে। এমন কি নিবিষ্টভাবে (কিছুক্ষণ) রুকু করতে থাকবে। তারপর (রুকু থেকে) উঠবে, সোজা ভাবে (কিছুক্ষণ) দণ্ডায়মান থাকবে। তারপর সিজদা করবে। (কিছুক্ষণ) নিবিষ্টভাবে সিজদারত থাকবে। তারপর উঠে বসবে। এবং (কিছুক্ষণ) সোজাভাবে বসে থাকবে। তোমার গোটা সালাতই এরূপ করবে। (সহিহ মুসলিম ৭৭০ ইফাঃ, )

অন্য হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কুরআন শিক্ষা করতে সক্ষম নই। এমতাবস্থায় আমার নামাযে কোন জিনিস যথেষ্ট হবে? তিনি বলেনঃ তুমি বলো, “সুবহানাল্লাহ ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। সে বলল, এটা তো আল্লাহর জন্য, আমার জন্য কি? তিনি বলেনঃ তুমি বলো, “আল্লাহুম্মাগফির লী ওয়ারহামনী ওয়ারযুকনী ওয়াহদিনী ওয়া আফিনী”। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি তার দুই হাত কল্যাণে পরিপূর্ণ করেছে এবং সে তার হস্তদ্বয় বন্ধ করেছে। (সুনান আদ দারাকুতনী ১১৬৯, ১১৭০ ও ১১৭১)

মন্তব্যঃ কুরআন হাদিসের আলোক বুঝা যায় যা সহজ তাই তিলওয়াতের মাধ্যমেও সালাত শুদ্ধ হবে। আর যার কুনআন মুখস্ত নাই তাই জন্যও ছাড় আছে।

১৫। একাকী সালাতে ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হলেও ইমামের পিছনে পাঠ করা ওয়াজিব নয়ঃ

সালাতে ফাতিহা পাড়ার সম্পর্কে এরা একমত যে এটি সালাতে পাড় ওয়াজিব কিন্তু তাদের দাবি, মুক্তাদীর কোন কিরাতই পড়তে হবে না। কারণ ইমামের কিরাতই মুক্তাদীর কিরাত। ইমাম সূরা ফাতিহার পর বাকি সূরা মিলালে যেমন তা মুক্তাদীর পক্ষ থেকে হয়ে যায়, তেমনি সূরা ফাতিহা পড়লেও তা মুক্তাদীর পক্ষ থেকে হয়ে যাবে। মুক্তাদীর আলাদাভাবে সূরা ফাতিহা ও পড়তে হবে না, সেই সাথে অতিরিক্ত সূরাও মিলাতে হবে না। কারণ তিলাওয়াত করলে পিছনে চুপ থাকার নির্দেশ পবিত্র কুরআনে যেমন এসেছে, তেমনি সহীহ হাদীসেও এসেছে। সেই সাথে ইমামের সকল কিরাতই মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট হয় মর্মে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আবু নুয়ায়ম ওহ্‌ব ইবন কায়সান (রহঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি এমন এক রাকাআত নামায পড়িয়াছে যাহাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে নাই তাহার নামায হয় নাই, অবশ্য যদি সেই ব্যক্তি ইমামের পশ্চাতে (নামায পড়িয়া) থাকে (তবে তাহার নামায শুদ্ধ হইয়াছে)। (মুয়াত্তা মালিক পরিচ্ছেদ ৮, রেওয়াত ৩৮)

জাবির ইবনু আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ কেউ যদি সালাতে উম্মুল কুরআন (সুরা ফাতিহা) না পড়ে, তবে তার সালাত হবে না। কিন্তু ইমামের পিছনে হলে ভিন্ন কথা। (তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৩১৩ ইফাঃ, ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, এই হাদীসটি হাসান-সহীহ)।

জাবের (রাঃ) সনদে আরেটি বর্ণানা এসেছে।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যার ইমাম রয়েছে, তার ইমামের কিরাত মানেই হল তার কিরাত। (মুসনাদে আহমাদ ১৪৬৪৩, সুনানে ইবনে মাজাহ ৮৫০, মুসন্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ২৭৯৭, মুসন্নাফ ইবনে আবীশাইবা ৩৭৭৯, মুসনাদে আবী হানীফা ২৫)।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যাদের ইমাম আছে ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত। (ইবনে মাযাহ ৮৫০ হাদিসের মান হাসান)

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, জোরে কিরাআত করতে হয় এমন এক সালাত সমাপ্ত করে একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে ফিরলেন, বললেনঃ তোমাদের কি কেউ আমাদের সঙ্গে এখন কিরাআত করেছিলে? জনৈক ব্যক্তি বললেনঃ হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে কুরআন নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া হচ্ছে কেন? আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহ বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা শোনার পর যে সমস্ত সালাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরে কিরাআত করতেন সে সমস্ত সালাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কিরাআত করা থেকে সাহবীগণ বিরত হয়ে গেলেন। (তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৩১২ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ এই হাদিস সমুহের আলোকে বুঝা যায় ইমামের কিরআতি মুত্তাদির কিরআত। কাজেই যারা এমনটি আমল করেন তাদের দাবিকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment