তৃতীয় পর্বঃ বিদআত প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

তৃতীয় পর্বঃ বিদআত প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

  ৭। সুফিবাদ এড়িয়ে চলাঃ

আমাদের সমাজের প্রচলিত বিদআদের সিংহভাগই সুফিদের দ্বারা সৃষ্ট। বিদআত সম্পর্ক যাদের ইলম কম তাদের কর্তব্য হলো সুফিবাদ এড়িয়ে চলা। সুফিদের সুন্দর সুন্দর কথা আর জান্নাহ প্রাপ্তির ঘোষনা সকলকে আকৃষ্ট করে থাকে। কাজেই কাজে মুরিদ হওয়ার পর তাদের কথায় বাহিরে কাজ করার কোন প্রশ্ন উঠে না। তাদের নিকট বাইয়াতে অর্থ হলো আপনার ইহকাল ও পরকালের সকল বিষয় তার হাতে তুলে দেয়া। এর পরই তার দেখানো পথে আমল করার পালা। অর্থাৎ আপনি যার মুরিদ হয়েছেন তার কাছে যত প্রকার শির্ক বিদআত আছে সবটাই আপনার দখলে চলে আসবে। আর যারা পীরের মুরিদ হন, তাদের সাধারণত লোক যাদের ইলম কম থাকে। ইমল কম থাকার কারনে তারা কোনটি শির্ক আর কোনটি বিদআত তা বুঝে না। পীর সাহের যা বলেন তাই তার নিকট দ্বীন হিসাবে পরিগনিত হয়। যার ফলে মুরিদ যে তরীকার উপর বায়াত হয়েছেন, সেই তরীকার সকল বিদআত তার কপালে জুটে যায়। এই জন্য যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কম তাদের উচিত সুফিবাদ এড়িয়ে চলা।

পীরের হাতে বায়াত মানে আপনার বিশ্বাস হবে, আল্লাহ নিরাকার, সর্বত্র বিরাজমান ও সকল জীবের ও বস্তুর অন্তরে বাস করেন। সুফিবাদ মানে আপনাকে যে কোন এক তরিকার উপর বায়াত হতে হবে। তারা মারিফাত বা গুপ্ত স্বর্গীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিশ্বাস করে।  সুফিদের দাবি, তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধি  জন্য নির্দিষ্ট কোন পীর বা শাইখ সাহচার্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। তারা কুরআন হাদিস বহির্ভূত লতিফার বিশ্বাস করে। তাদের নিকট সকল প্রকার ভাল আমলই ইসলাম বিদআত বলে কিছু নাই। তাই তারা বিদআত মিশ্রিত জিকিরের অনুষ্ঠান করে। পীর বা শাইখকে বান্দা ও আল্লাহ মধ্যস্থতাকারী মনে করে এবং তারা মৃত্যুর পরও মানুষকে সাহায্য করে থাকে। তার মৃত্যু ব্যক্তির উসীলায় বিশ্বাস করে। তাদের বিশ্বাস পুন্যবান লোক/ পীর/ সুফি সাধকের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া পৌছাতে হবে। কবর মাজার কেন্দ্রিক শির্ক বিদআতের সাথে জড়িত। তারা নিয়মিত মিলাদ কিয়াম করে, উরসা বা তাদের অনুসরনীয় সুফি সাধকদের মৃত্যুবার্ষিকীর ভোজের মাধ্যমে স্মরণ করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী বা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিন পালন করে। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তাদের বাড়াবাড়ি শির্কি পর্যায়। তারা মনে করে আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েব জানেন, তিনি হাজির নাজির, মানুষের ভাল মন্দ করা ক্ষমতা রাখেন, তিনি মারা যান নাই, তিনি নুরের তৈরি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মন্তব্যঃ সুফিবাদ এড়িয়ে না চললে, এই সকল বিদআতী আকিদা এবং আমল থেকে ইলমহীন একজন অজ্ঞলোক কোনভাবেই পরিত্রান পাবে না। কাজেই সুফিদের সৃষ্ট বিদআত প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার হলো, ইলমহীন অজ্ঞলোকদের এ সম্পর্কে সতর্ক করে সুফিবাদ এড়িয়ে চলতে বলা।

৮। সঠিক উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করাঃ

বিদআত সৃষ্টির অন্যতাম কারন হলে ভুল উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করা। আমরা যদি সঠিক উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করতে পারি তবে বিদআতকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে পারব।  একজন সাধারণ মুসলিম সাধারন কিতার ও আলেম এই দুটি উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করে থাকে। আধুনিক যুগে অবশ্য ইন্টার নেট থেকে দ্বীনি ইলম অর্জন করেছেন। এই তিনটি (কিতাব, আলেম, ইন্টার নেট) উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করার আগেই নির্বাচন করতে হবে। আমি কিতার হিসাবে কি কি পড়ব, আলেম হিসাবে কাকে কাকে প্রধান্য দিব আর এই কিতার ও আলেমদের আলোকেই ইন্টার নেট ব্যবহার করব।

কিতাব নির্বাচনঃ কিতাব হিসার আল কুরআনের অর্থসহ তাফসির থাকে। সাথে সাথে বাংলায় অনুদিত সহিহ হাদিসের গ্রন্থগুলো তালিকার এক নম্বরে রাখতে হবে। হাসির গ্রন্থ নির্বাচলে হাদিসের নামে জালিয়াত নামক গ্রন্থ থেকে একটি উদৃতি তুলে ধরছি।

দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি/ ১৭৬২খৃ) হাদীসের গ্রন্থগুলোকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তিনটি গ্রন্থ: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এ গ্রন্থগুলোর সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত।

দ্বিতীয় পর্যায়ের গ্রন্থগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলো প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এ পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থ: সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এ পর্যায়ের।

তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এসকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এ পর্যায়ে রয়েছে : মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবন হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (সুনানে কুবরা, দালাইলুন নুবুওয়াত, শুয়াবুল ঈমান,… ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (শার্হ মায়ানীল আসার, শার্হ মুশকিলিল আসার,… ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ (আল-মু’জামুল কবীর, আল-মু’জামুল আওসাত, আল-মু’জামুস সাগীর,… ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেন নি।

চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলো হলো সে সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন : (১). যে সকল ‘হাদীস’ পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারণে পূর্ববতী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, (২). যে সকল হাদীস কোনো অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, (৩). লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচারিত বিভিন্ন কথা, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায় নি, (৪). বিভিন্ন দুর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, (৫). যে সকল ‘হাদীস’ মূলত সাহাবী বা তাবিয়ীদের কথা, ইহুদিদের গল্প বা পূর্ববতী যামানার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা, যেগুলোকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোনো বর্ণনাকারী হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৬). কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতীয় কথা যা ভুলক্রমে কোনো সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৭). হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূবক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, অথবা (৮). বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইবন হিববানের আদ-দুয়াফা, ইবন আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল-আসফাহানী, ইবন আসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদ ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এ পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল অথবা বানোয়াট।

পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐসকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গন্থে পাওয়া যায় না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যুত ভাষাজ্ঞানী পন্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্রুটি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের ভাষাও এরূপ সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূর প্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সূত্রের (সনদের) তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ বলেন: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের গ্রন্থের উপরেই মুহাদ্দিসগণ নির্ভর করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের গ্রন্থসমূহ থেকে হাদীস শাস্ত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী রিজাল ও ইলাল শাস্ত্রে পন্ডিত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ছাড়া কেউ উপকৃত হতে পারেন না, কারণ এ সকল গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্য থেকে মিথ্যা হাদীস ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের পার্থক্য শুধু তাঁরাই করতে পারেন। আর চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ সংকলন করা বা পাঠ করা এক ধরনের জ্ঞান বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। সত্য বলতে, রাফেযী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সকল বিদ‘আতী ও বাতিল মতের মানুষেরা খুব সহজেই এসকল গ্রন্থ থেকে তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বের করে নিতে পারবেন। কাজেই, এ সকল গ্রন্থের হাদীস দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করা বা কোনো মতের পক্ষে দলীল দেয়া আলিমদের কাছে বাতুলতা ও অগ্রহণযোগ্য। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালগা ১/৩৮৫-৩৯১, অনুবাদ হাদিসের নামে জালিয়াত, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিঃ)

উপরের বক্তব্যের সার কথা হলোঃ বাংলায় অনুদিত সর্বাধিক বিশুদ্ধ ছয়টি হাদীস গ্রন্হ আছে। এই ছয়টি গ্রন্থকে অনেকে “সিহা সিত্তাহ” বা “ছয়টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ” বলে থাকেন। কিন্তু, আমাদের উপমহাদেশে এ রকম বলা হলেও আরব বিশ্বে এগুলোকে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়না, কুতুবে সিত্তাহ বা “ছয়টি কিতাব” বলা হয়। সমস্ত আলেমরা এই ব্যাপারে একমত যে এই ছয়টি মধ্যে শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমই সহিহ হাদিস গ্রন্থ। এই দুইটি গ্রন্থের সবগুলো হাদীস “সহীহ”। এই জন্য এই দুইটি গ্রন্থকে একত্রে “সহীহাইন” বা “দুইটি সহীহ গ্রন্থ” বলা হয়। আর বাকী চারটি, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে জাল ও জয়ীফ হাদীস থাকার কারণে সেগুলো সহীহ না বলে “সুনানে আরবা” বা “চারটি সুন্নাহর কিতাব” বলা হয়। অনেক সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, অনেক আলেমকেও দেখা যায় “সিহাহ সিত্তাহর” সবগুলো হাদীস সহীহ বলে দাবী করতে। অথচ বাকি চারটি সুনানে এর মধ্যে শুধু জয়ীফ নয় অনেক মুনকার (বাতিল) ও মওদু (জাল) হাদিস আছে। সুনানে নাসায়ীতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা প্রায় ৪৪০ টি, সুনানে আবু দাইদে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ১১২৭, সুনানে তিরমিজিতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৮২৯ টি।  সুনান ইবনে মাজাতে যঈফ হাদিস আছে ৯৪৮ টি আর জাল হাদিসে আছে ৪০ টিরও বেশী। তাই হাদিসে গ্রন্থ হিসাবে এইগুল ইলম অর্জনের উৎস হিসাবে গ্রহন করা যায়। ইহা ছাড়া অনেক আমদের বিষয় ভিত্তিক লেখা অনেক কিবাব এখন বাংলা ভাষাতে পাওয়া যায়।  সেখান থেকে সঠিক আলেমদের লেখা যাচাই বাচাই করে তাদের কিতাবকে ইলম অর্জনের উৎস হিসাবে গ্রহন করা যায়।

মনে রাখতে হবে বিদআতি আলেমের কিতাব কোনভাবেই পড়া যাবে না। কারন ইলম কম থাকার কারনে তাদের যু্ক্তিকে যুক্তি যুক্ত মনে হতে পারে। তখন আর বিদআত থেকে বাহিরে আসা সম্বব হবে না। ইহা ছাড়া বাজারে বহুল প্রচলিত মকুসুদুল মুমিনীন, নেয়ামত কুরআন, বিষাদ সিন্ধ, তাজকেরা তুল আওলিয়াসহ বিদআতি কিতার পরিহার করতে হবে। এমনিভাবে সঠিক কিতাব নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক উৎস থেকে ইলম অর্জন করতে পারব। আর সঠিক ইলম অর্জন করলে বিদআত প্রতিরোধ করা সহজ হবে।

সঠিক আলেম নির্বচানঃ

বর্তমানে আলেম সমাজের প্রায় অধিকাংশ একে অপরের গিবতে ব্যস্ত। নিজের ভুল না ধরে অন্যের ভুল ধরায় ব্যস্ত। তবে হ্যা, বিদআতি আলেম সম্পর্কে সতর্ক করা ওয়াজিব। এই দায়িত্ব বোধ থেকে সমালোচনা করলে গিবত হবে না। কাজেই ইলম গ্রহণের আগে আপনাক আলেমদের দুটি দলে ভাগ করতে হবে। প্রথম দল যাদের নিকট থেকে ইলম নিয়া যাবে। অর্থাৎ যারা সব সময় কুরআন হাদিস তোমকাবেগ কথা কলে। তাদের কথার দলীল খুজে পাওয়া যায়। তারা বেহুদা কথা বলে সময় নষ্ট করে না। বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করে মানুষকে  দ্বীনের প্রতি আহবান করছে। তাদের দু চারটি বক্তব্য শুনলেই বুঝবেন তারা শির্কি বিদআতের বিরুদ্ধে কতটা শক্ত অবস্থানে আছে।

আর দ্বিতীয় দলের আলেমদেরও একটি তালিকা করতে হবে। যারা নানা করম কিচ্ছা কাহিনীর মাধ্যম সালারণ জনগনকে শির্কি বিদআতের দিকে আহবান করছে। দুই/তিন ঘন্টা বক্তব্য দিচ্ছ তার মাঝে কুরআন ও সহিহ হাদিসের সংখ্যা দু একটি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। এই ভাবে আলেম নির্বাচণের মাধ্যমে আমরা সঠিক উত্স থেকে দ্বীন গ্রহন করতে পারি। সঠিক আলেম নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা বিদআত প্রতিরোধ করতে পারি।

ইন্টার নেটঃ

ইন্টার নেট মানে ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, সার্স ইজ্ঞিল, লিংকইন, ওয়েব পেইজ ইত্যাদি। বর্তমান যুগে ইন্টার নেট ছাড়া চলার কোন প্রশ্ন উঠেনা। ছাত্র শিক্ষক থেকে শুরু করে বড় বড় কোম্পালী কেউ আর ইন্টার ছাড়া একদিন চলার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু আমাদের অধিকাংশই প্রয়োজন ছাড়া বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে ইন্টার নেট ব্যবহার করছি। যারা বিনোদনর জন্য ব্যবহার করছি তাদের প্রায় সকলেই অশ্লীলাত প্রতি ঝুকে আছি। তাই বলা যায়, এই মাধ্যমগুলিতে ভালর চেয়ে খারাবের পরিমান বেশী। কিন্তু প্রয়োজনটা এত বেশী যে ইহা ছাড়া আর চলা যাবে না। যেহেতু ইন্টার নেটে ভালোর চেয়ে অশ্লীলাত বেশী তাই এই উৎস থেকে কি দ্বীন শিক্ষা গ্রহন করা যাবে। এই ক্ষেত্রে বিদ্ধানদের অভিমত হলো, হ্যা জায়েয। ইন্টার নেট থেকে দ্বীন শিক্ষা করা শর্ত সাপেক্ষে জায়েয। যারা ইন্টারের অশ্লীলত থেকে বাচতে পাবরে না, তাদের ইন্টার নেট থেকে দ্বীন শিক্ষা জায়েয নাই। আপনি ইন্টার নেটের যে কোন মাধ্যম দ্বীন শিক্ষার জন্য ওপেল করলেই দেখবেন একটি অশ্লীল ছবি আপনার সামনে। যদি এই সকল অশ্লীল ছবি থেকে নিজেকে বাচাতে না পারেন তবে, ইন্টার নেট থেকে দ্বীন শিক্ষা জায়েয নাই। আর যদি মনে করেন আমি এই সকল অশ্লীলাত থেকে বেচে দ্বীন শিখতে পারব, তবে আপনার জন্য ইন্টার নেট থেকে দ্বীন শিক্ষা জায়েয।

ইন্টার নেটে দুই প্রকার ইলমেরই বিশার সমাহার। আগেই ইমল অর্জনের দুটি উৎসের কথা উল্লেখ করেছি। সাধারনত কিতাবে হিসাবে যা উল্লখে করছি সেই দিকে লক্ষ রেখে পড়াশুনা করা আর আলেম হিসাবে যাদের নাম তালিকা ভু্ক্ত করেছি, শুধু তাদেরই বক্তব্য শুনতে থাকি। যখন শির্ক বিদআত সম্পর্কে ষ্পষ্ঠ ধারনা হয়ে যাবে কেমন তখনই দুই একজন বিদআত আলেম ওয়াজ শুনা যাবে। সঠিক ইলম অর্জনে আগে বিদআতি আলেমদের কথা শুলনে তাদের দলীল নয় যুক্তিতে বিশ্বাস করে বিদআতে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই ইন্টার নেটের মাধ্যমে সঠিক দ্বীন শিখেও বিদআত প্রতিরোধ করা সম্বব।

ইন্টার নেটের (ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, সার্স ইজ্ঞিল, লিংকইন, ওয়েব পেইজ) ব্যবহার করে সঠিক ইলম পৌছান খুবই সহজ। এই জন্য যার যতটুকু ক্ষমতা আছে তাই প্রয়োগ করে বিদআত বিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। যারা বিনোদনের জন্য ইন্টার নেট ব্যবহার করে তাদের জন্য পরিকল্পনা গ্রহন করে সঠিক দ্বীন প্রচার করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। প্রয়োজনে ইসলামের নামে আলাদা আদালা ওয়বে পেজ তৈরি করতে হবে, ভাল ভাল আলেমদের লেখুনি ও বক্তব্য প্রাচার করতে হবে। ইউটিউবে ইসলামি চ্যানেল খুল বিদআত বিরোধী প্রচারণা চালাত হবে। এই ভাবে আমরা ইন্টার নেই ব্যবহার করে সঠিক দ্বীন গ্রহন ও প্রচারের মাধ্যমে বিদআতকে প্রতিরোধ করতে পারি।

৯। আধুনিক মিডিয়ার সম্পর্কে সচেতান থাকাঃ

আধুনিক মিডিয়ার বলেত বিভিন্ন সংবাদ পত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টার নেট ইত্যাদি বুঝে থাকি। এই সকল মিডিয়ার সাহায্য আমরা খুব সহজে দেশ বিদেশের সকল প্রকার খবর পেয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে ইন্টার নেট ব্যবহার করে। সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। তাই খুব সহজে চারপাশে, দেশে-বিদেশে কী ঘটছে, সেগুলো ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগলসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছে সবাই। এমনও কিছু আছে যা ভাইরাল হওয়ার নয় তাও ভাইরাল হচ্ছে। টাইমলাইন, নিউজফিড ভরে যায় প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, ছবি ও ঘটনায়। এ সুযোগটি করে দিচ্ছে ইন্টারনেট।

যারা এই সকল আধুনিক মিডিয়া থেকে ইলম গ্রহন করে থাকে, তারা বেশী বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। কেননা যারা আধুনিক মিডিয়া থেকে ইলম গ্রহন করে তাদের অধিকাংশেই। ইসলাম সম্পর্কেই সঠিক জ্ঞান নাই, বিদআত সম্পর্কে জ্ঞান থাকাতো দুরের কথা। আধুনিক মিডিয়ার সম্পর্কে সচেতান না থাকলে বিদআত প্রতিরোদ করা সম্বব নয়। জ্ঞানের অভাবে বিদআতকেই ইবাদত মনে করে আমল করা হবে।

১০। বিজাতীদের সাদৃশ্য না করাঃ

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ একটি দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান রয়েছে ইসলামে। ইসলাম মুসলমানদের দিয়েছে ন্যায্য অধিকার, দিয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। মুসলমানদের রয়েছে ঐতিহ্য। ইসলামের দেয়া এসব থাকতে বিজাতীয় সংস্কৃতি ধার করার কী প্রয়োজন? আফসোস মুসলিম উম্মাহর জন্য! বিজাতীদের সাদৃশ্য অবলম্ভন করে নানা উৎসব উদযাপন  করে থাকে। যেমনঃ খৃষ্টানদের বড় দিনের আদতে বিদআতি মুসলিমগন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিন কে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসাবে উৎযাপন করছে। এমনিভাবে তাদের পালিত ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ এর আদলে আমরা বাংলা নববর্ষ পালন করছি। মুসলিম হয়ে আমরা আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে, চিন্তা-ভাবনা, আকিদা ও আমলে বিজাতীয়দের অনুকরণ করাছি। বিজাতীদের সাদৃশ্য এখন এমন পর্যায় পৌছেছে যে, আমরা মুললিম হলেও আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদে, কৃষ্টি-কালচারে, আচার-অনুষ্ঠানে আকিদা-আমল বিধর্মীদের মত।

বিজাতীয় সংস্কৃতি সাথে কুরআন ও হাদিসের কোন মিল থাকার কথা নয়। তাদের থেকে যে সকল ইবাদতের রীতিনীত শিখব তার পুরোটাই বিদআত হবে। তাই বিজাতীদের সাদৃশ্য না করা বিদআত প্রতিরোধ করা সম্বব। তা ছাড়া মহান আল্লাহ ও তাদের রীতিনীত গ্রহন করতে  নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থঃ যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া (ইসলামি রীতিনীতি) অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে কখনো তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে তিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা আল ইমরান ৩:৮৫)।

বিজাতিদের যে জাহেলী উৎসব প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করতে নিষেধ করছেন। আমরা যেন সেই  উৎসবকেই আকড়ে ধরছি। অথচ বিজাতিদের অনুসরণ করা সহিহ হাদিসের আলোকে নিষেধ।

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি (কিয়ামতের পূর্বে) তরবারিসহ প্রেরিত হয়েছি, যাতে শরীকবিহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত হয়। আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে। অপমান ও লাঞ্ছনা রাখা হয়েছে আমার আদেশের বিরোধীদের জন্য। আর যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।” (হাদিস সম্ভার ১৯০০, আহমাদ)

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,  “যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করল সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (সুনানে আবূ দাউদ ৪০৩১ ইফাঃ, সনদ সহিহ আলবানী, ৫১১৪, শুআবুল মান ৯৮)

মন্তব্যঃ বিজাতীদের সাদৃশ্য অবলম্ভন না করলে তাদের দ্বারা সৃষ্ট বিদআত আমাদের ইসলামে প্রবেশ করতে পাবরেন। যার ফলে বিজাতীদের দ্বারা সংঘটিত বিদআতকে আমরা প্রতিরোধে সক্ষম হব।

১১। দেশীয় সংস্কৃতি ও ইসলামি পার্থক্য বুঝতে হবেঃ

বিদআত প্রতিরোধে আমাদের দেশীয়  সংস্কৃতি ও ইসলামি সংস্কৃতির পার্থক্য বুঝতে হবে। প্রথমে আসি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি দিকে। বাঙালী সংস্কৃতিকেই দেশীয় সংস্কৃতি বলা হয়। সংস্কৃত বলেতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিত কলা, ক্রিড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ, পোশাক আশাক ইত্যাদি। ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিসমূহ।

কাজেই পৃথিবীর এক এক অঞ্চলের সংস্কৃতি এক এক ধরনের। স্থান থেকে স্থানে, জাতী থেকে জাতীতে, ধর্ম থেকে ধর্মে সংস্কৃতু আলাদা হয়। যেমনঃ হিন্দ ধর্মের প্রার্থনা বা পুজার ধরন, ইসলাম ধর্মের ইবাদাত সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই দুটি ধর্মের অনুসারীদের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, পোশাক আশাক ইত্যাদি আলাদা হবে এটাই সাভাবিক। বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা-গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন দ্বারা। ইসলাম আগমনের পূর্বে বাংলার অধিকাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। বাঙালী সংস্কৃতিতে হিন্দু সংস্কৃতির একটি প্রভার বিদ্যমান।

ইসলাম আগমের সাথে বাঙালী সংস্কৃতি আস্তে আস্তে ইসলামি সংস্কৃতি রুপান্তরিত হয়। ইসলাম ধর্মের প্রতিটি কাজই ইবাদাত। তাদের ইবাদতে ও পোশাকের সুনির্দিষ্ট মাপ কাঠি আছে। যেমনঃ পর্দা করা ইসলামি শরীয়তে ফরজ কিন্তু হিন্দুদের পর্দার বালাই নেই। তাই হিন্দু থেকে মুসলীম হওয়ার সাথে সাথে তার সংস্কৃতিও বাঙালী সংস্কৃতি থেকে ইসলামি সংস্কৃতিতে রুপান্তরিত হয়।

উপরের আলোচনা থেকে এ কথা ষ্পষ্ট যে, বাঙালী সংস্কৃতি এবং ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে বিশাল পার্থক্য। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মুসলাম ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেনা। তারা বাঙালী সংস্কৃতি ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্য পার্থক্য করে না। যার কারনে অনেক বাঙালী মুসলিম বাংলা নববর্ষে নিজেদের সংস্কৃতি মনে করে পালন করে। একবারের জন্যও চিন্তা করে না যে, এটির আকিদা বিশ্বাস ও উদযাপনের হিন্দু সংস্কৃতি প্রতিচ্ছবি। মুসলিদের ইসলামি জ্ঞারের সল্পতার কারনে খুব সহজে দেশীয় শির্ক ও বিদআতি সংস্কৃতি কে ইসলামি সংস্কৃতি মনে করে পালন করছে। তাই যদি প্রতিটি মুসলিম দায়িত্ব হলো ইসলামি সংস্কৃতি ও দেশীয় সংস্কৃতির সম্পর্কে জানা। যদি সে সঠিকভাবে দুটি সংস্কৃতি পার্কথ্য বুঝথে পারে তবে এই দেশীয় বিদআত সংস্কৃতি থেকে বাচতে পারবে।

১২। আবেগী হয়ে বেশী ইবাদত করাঃ

ইবাদতে অবশ্য আবেগ তাকবে। কিন্তু আবেগী হয়ে সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত কে বাড়ান বা কোমান যাবে না। মহান আল্লাহকে রাজি খুসি করার জন্য যতগুলি পথ ও পদ্ধতি আছে তার প্রতিটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি কোন প্রকার ইবাদত করার পদ্ধতিই গোপন করেন নাই। তাই যদি কেই মনে করে, ইসলামের প্রচলতি ইবাদতকে যথেষ্ট নয়। তবে সে মারাত্বক ভুল করবে। এই আবেগী ভুল থেকে ইবাদতের পদ্ধতি ঠিক রেখে পরিমান বৃদ্ধি করতে থাকে। অনেক আবেদতো জাহান্নামের ভয়ে দুনিয়া ছেড়ে দিয়ে মনগড়া পন্থায় আল্লাহকে সন্তষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

*وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاء رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا *

অর্থঃ আর বৈরাগ্য, সে তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে; আমি এটা তাদের উপর ফরজ করিনি। কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এটা অবলম্বন করেছে। অতঃপর তারা যথাযথভাবে তা পালন করেনি। (সুরা হাদীদ ৫৭:২৭)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদা তিন ব্যক্তি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ‘ইবাদাতের অবস্থা জানার জন্য তাঁর স্ত্রীগণের নিকট এলে। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ‘ইবাদাতের খবর শুনে তারা যেন তাঁর ইবাদাতকে কম মনে করলেন এবং পরস্পর আলাপ করলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে আমাদের তুলনা কোথায়, আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর আগের-পরের (গোটা জীবনের) সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের একজন বললেন, আমি কিন্তু সারা রাত সলাত আদায় করবো। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি দিনে সিয়াম পালন করবো, আর কখনো তা ত্যাগ করব না। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারী থেকে দূরে থাকব, কখনো বিয়ে করবো না। তাদের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার সময় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে পড়লেন এবং বললেন, তোমরা কী ধরনের কথাবর্তা বলছিলে? আল্লাহ্‌র কসম! আমি আল্লাহ্‌কে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি, তোমাদের চেয়ে বেশী পরহেয করি। কিন্তু এরপরও আমি কোন দিন সিয়াম পালন করি আবার কোন দিন সিয়াম পালন করা ছেড়ে দেই। রাতে সলাত আদায় করি আবার ঘুমিয়েও থাকে। আমি বিয়েও করি। সুতরাং এটাই আমার সুন্নাত (পথ), যে ব্যক্তি আমার পথ থেকে বিমূখ হবে সে আমার (উম্মাতের) মধ্যে গণ হবে না। (সহিহ বুখারী ৫০৬৩, সহিহ মুসলিম ১৪০১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩১৭)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন। সে সময় জনৈক মহিলা আমার কাছে বসা ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ মহিলাটি কে? আমি বললাম, সে অমুক। সে সারা রাত বিনিদ্র অবস্থায় কাটায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমল করা উচিত। আল্লাহর কসম! তিনি নেকী দান করতে কখনো কুণ্ঠিত হন না, যতক্ষণ না তোমরা আমলে কুণ্ঠিত হও। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কাজ করতেই পছন্দ করেন, যা লোকেরা সর্বদা করতে সামর্থ্য রাখে। (ইবনে মাজাহ, ৪২৩৮; সহীহ ইবনে খুযাইমা ১২৮২; আবু ইয়ালা ৪৬৫১; বায়হাকী ৪৫১৪)

মন্তব্যঃ এই কারনে আবেগী হয়ে বেশী ইবাদত করা যাবে না। সুন্নাহ সম্মত ইবাদত অল্প হলেও মহান আল্লাহকে খুসি করার জন্য যথেষ্ট। যদি সুন্নাহ সম্মত পরিমান মত ইবাদাত করি তবে অনেক বিদআত কে প্রিতরোধ করেত পারব।

১৩। প্রবৃত্তির অনুসরণ না করাঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

*أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ*

আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশী কে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? (সুরা যাসিয়া ৪৫:২৩)

এই আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ অন্তরের উপর সীলমোহরের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর এই সীল মোহরের প্রভাব ও ছাপ অন্তরের পর্দায় অবরণ তৈরি করতে থাকে এবং পরিণামে তা শরীরের সকল অংশে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে সুন্নাহ সম্মত ইবাদাতের পরিবর্তে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ইবাদাত আবিস্কার করে। প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ফলে সঠিক আমল তার কাছে ভাল লাগে না। মন চাহে আমর করতে থাকে। রাতে সালাত তার ভার লাগে না, তার ভাল লাগে জোরে জোরে মানুষের ঘুমের অসুবিধা করে জিকর করতে। তার ভাল লাগে পীরের উরসে নাচ গান করে সময় কাটান। তার ভাল লাগে জটা চুলে রেখে দারে দারে ঘুরে বেড়ান। অর্থাৎ প্রবৃত্তির তাড়নায় সে শরীয়ত বিরোধী কাজের মাধ্যমে মজা পেয়ে যায়।

প্রবৃত্তির অনুসরণ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাদের সতর্ক করেছেন।

আবু বারযাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর যা আশংকা করছি তা হচ্ছে, পেটের ব্যাপারে এবং যৌনাঙ্গের বিষয়ে লোভে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়া এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিভ্রান্ত হওয়া। (সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব ৫২. আহমদ, ত্বাবরানী ও বাযযার)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিনটি কাজ মানুষকে রক্ষা করে এবং তিনটি কাজ মানুষকে ধ্বংস করে। রক্ষাকারী কাজ তিনটি হচ্ছেঃ (১) প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করা (২) সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে হক কথা বলা এবং (৩) সচ্ছলতায় ও অসচ্ছলতায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী কাজ তিনটি হচ্ছে- (১) প্রবৃত্তির অনুসরণ করা (২) কৃপণতাকে মেনে নেওয়া এবং (৩) আত্ম-অহংকার করা। আর এটিই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন (মিশকাত ৫১২২, রিয়াদুস সালেহীন ৬৭, হাদিসের মান হাসান)।

মন্তব্যঃ গোমরাহীর কারনে অনেকে সুন্নাহ সম্মত ইবাদতে অনেক জমা পায়না। বিদআতিগন প্রবৃত্তির অনুসরনে খুবই মজা পেয়ে থাকে। ইবাদাত পক্ষে দলীল প্রমান আবশ্যক হয়ে থাকে। এমন কোন ইবাদাত নাই যার দলীল হাদিসে বিদ্যমান নাই। কিন্তু যে সকল আমল দলীলহীন তাই বিদআত। আর এই বিদআতি আমল সৃষ্টির পিছনে কারো না কারো প্রবৃত্তি কাজ করেছে। কারন কোন সুন্নাহের অনুসরী মুমিন মনে চাহে আমল তৈরি করতে পারেন। সে আল্লহর বাণী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস সম্পর্কে সতর্ক। প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব হলো প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে সুন্নাহ সম্মত আমল করে যাওয়া। যদি সকলে দলীল প্রমানের ভিত্তিতে, সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত করে, তবে বিদআদ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

১৪। রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রতিহত করাঃ

প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের উচিত রাষ্ট্রিয়ভাবে বিদআত প্রতিহত করা। যে সকর দেশ সম্পুর্ণ কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচারিত তাদের ফরজ দায়িত্ব হল রাষ্ট্রিয়ভাবে বিদআত প্রতিহত করা। আলেম সমাজ এবং শাসকদের উচিৎ শক্তি প্রয়োগ করে বিদআত প্রতিহত করা ও বিদআতীদেরকে শাস্তি দেয়া। আমাদের মত পৃথিবীর বহু সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম দেশে ইসলামি শরীয়ত পুরাপুরিভাবে কায়েম নাই। তারা সাধারনত রাষ্ট্রিয়ভাবে বিদআত প্রতিহত করে না। এই ক্ষেত্র রাষ্ট্র উদারতার পরিচয় দেয়। তারপরও যদি এই সকল রাষ্ট্রে দ্বারা শক্তি প্রয়োগ করার সুযোগ থাকলে তবে শক্তি প্রয়োজ করে বিদআত প্রতিরোধ করতে হবে। আর যদি রাষ্ট্র বিদআত প্রতিরোধে অনিহা প্রকাশ করে, তবে মুসলিম সমাজের উচিত তাদের সাধ্য মত বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করা। কেননা বিদআত ইসলামের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জেনে রাখা উচিৎ যে, কুফরী রাষ্টসমূহ বিদআতীদেরকে তাদের বিদআত প্রচারে উৎসাহ এবং বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করে থাকে। তারা এটাকে ইসলাম ধ্বংসের অন্যতম মাধ্যম মনে করে।  আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁর দ্বীনকে বিজয় দেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে অপমানিত করেন। কাজেই রাষ্ট্রিয়ভাবে যাতে বিদআত প্রতিহত করা যায় তার জন্য সকল মুসলিমদের চেষ্টা করা উচিত। আমাদের রাষ্ট্র যখন বিদআত প্রতিরোধে  কাজ করবে তখন বিদআত প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে।

১৫। বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করাঃ

বিদআতীদেরকে শক্তি প্রয়োগ করে ঠেকানো সম্ভব না হলে বিদআতী এবং তাদের অনিষ্টতা হতে মানুষকে সতর্ক করা আবশ্যক। বিদআত সম্পর্কে নিজের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং সর্বপরি দেশের সকল মুসলমান ভাইদেরকে সতর্ক করতে হবে। প্রতিটি বিদআত সম্পর্কে সাবধান করি। সমাজে যেখানে বিদআত দেখবে সেখানেই সাধ্যমত বাধা দিতে চেষ্টা করা। প্রথমে হাত দ্বারা। তা না হলে, মুখ দ্বারা। তাও যদি সম্ভব না হয়, অন্তরে অবশ্যই ঘৃনা করবে, যদি এটা ইমানে সর্বনিম্ম স্থর। আধুনিক যুগে সবাই কম বেশী কিছু না কিছু সময় সোস্যাল মিডিয়াতে সময় কাটাই। বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করার ক্ষেত্র আমরা এই সকর সোস্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিতে পারি। যে ফেসবুক ব্যবহার করে সে সপ্তাহে অন্তত একটি বিদআত বিরোধী পোষ্ট দিতে পারি। যাদের ইউটিউপর চ্যানেল আছে তারা মাঝে মাঝে বিদআত বিরধী দুই একটি ভিডিও পোষ্ট করে সমাজকে সতর্ক করেত পারি। এমনকি বিদআত বিরোধী ওয়েব পেজ তৈরি করে  নিয়মতি ইন্টার নেট ব্যবহারকারীদের সতর্ক করেত পারি। এমনিভাবে যে কোন মাধ্যমে বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করে একে প্রতিরোধ করেত পারি।

১৬। অপরের সতর্ক কে গুরুত্ব দেয়াঃ

আমার আমলেও বিদআত থাকতে পারে। তাই যদি কেউ আমার আমলটি বিদআত বলে কেউ সতর্ক করে, তবে গুরুত্ব দিয়ে আমলটি সম্পর্কে জানা। নিজেরই উচিত দলিল খুজে বের করা। যদি আমলের স্বপক্ষে কোন দলিল না থাকে তবে বিদআত মনে করে আমলটি পরিহার করা উচিত। আর যদি নিজে দলিল খুজতে অপরাগ হই, তরে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক কথা বলে এমন অনেক আলেম আছে, তাদের নিকট বিষয়টি বলি। তারাই আপনাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দিবেন। এক জন না হয় দুই চার জন আলেমকে জিজ্ঞাসা করুন। যখনই জানতে পারব আমলটি বিদআত সাথে সাথে আমলটি পরিহার করে নেব।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment