আকিদার বিদআতসমূহ দ্বাদশ কিন্তি :  পীরের হাতে বইয়াত করা ওয়াজিব দ্বিতীয় পর্ব

3.11

আকিদার বিদআতসমূহ : দ্বাদশ কিন্তি 

পীরের হাতে বইয়াত করা ওয়াজিব দ্বিতীয় পর্ব

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

কুরআন হাদিসের আলোকে বাইয়াত চারটি ক্ষেত্রের বাইয়াতঃ

৫। মুসলিম হওয়ার বাইয়াতঃ

নতুন কোন কেউ মুসলিম হলে তাকে ইসলামের প্রতি বাইয়াত প্রদান করা হত। তাকে কলেমায়ে শাহাদা পড়ান হত এবং ইসলামি জীবন বিধানে উপর পথ চলার বাইয়াত নিতেন।

আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আল্লাহ (দয়াপরবশ হয়ে) আমার অন্তরে ইসলাম (ইসলামের সাহায্য) ঢেলে দেন, তখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে বাইয়াত গ্রহণের জন্য আগমন করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আমি বললাম, যতক্ষণ আমার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা না হবে ততক্ষন আমি বাইয়াত করবো না।

তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে ‘আমর তুমি কি জান না যে, হিজরত পূর্ববর্তী যাবতীয় গুনাহ বিলীন করে দেয়। হে ‘আমর তুমি কি জান না, ইসলাম পূর্ববর্তী যাবতীয় গুনাহ বিলীন করে দেয়। (মুসলিম ও সাঈদ ইবনু মানসুর)

 

৬। রাষ্ট্র প্রধানেন নিকট বাইয়াতঃ

রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর সাহাবাগন হযরত আবুবকরের (রাঃ) নিকট আবার বাইয়াত গ্রহন করেন। খলিফায়ে মুসলিমিনদের নিকট বাইয়াত নিতে হয় এ ধারা মুসলিমদের প্রধান চার খলিফার পরেও বহু দিন চালু ছিল। ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানগন তাদের নির্বাচিত খলিফান নিকট বাইয়াত গ্রহন করেছেন। বর্তমানে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের কোন সম্মিলত খেলাফত কায়েম নেই।

 সমগ্র উম্মতের কোন একজন নেতা বা আমীর নেই। তাই রাষ্ট্র প্রধানেন নিকট বাইয়াত গ্রহনের ধারা আর দেখা যায়। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এখনও রাষ্ট্র প্রধানেন নিকট বাইয়াত গ্রহন করে। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রনায়কের হাতে বায়াত করল এবং এতে তাকে নিজ প্রতিশ্রুতি ও অন্তস্তল থেকে অঙ্গীকার প্রদান করল তার উচিত, যথাসাধ্য তার (সেই নায়কের সৎবিষয়ে) আনুগত্য করা। এরপর যদি অন্য এক (নায়ক) তার ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাহলে ঐ দ্বিতীয় নায়কের গর্দান উড়িয়ে দাও।’’ (মুসলিম ৪৮৮২)

 

৭। বাইয়াতে রিযওয়ানঃ

হুদাইবিয়ায় চুক্তির প্রাককালে উসমান (রাঃ) কে চুক্তির বিষয় আলোচনার জন্য কুরাইশদের নিকট দূত হিসাবে প্রেরণ করা হয়। এমন সময় খবর আসে যে উসমান (রাঃ) হত্যা করা হয়েছে। এ সংবাদে নবী করীম (সাঃ) খুবই মর্মাহত হয় এবং উসমান (রাঃ)-এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ করেন, যদিও তাঁরা ছিলেন নিরস্ত্র। তাঁরা হুদাইবিয়ায় এক গাছের নীচে শপথ গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁরা মক্কার কুরাইশদের সাথে লড়বেন এবং পলায়নের পথ অবলম্বন করবেন না। এই বইয়াতে আন্তরিকতা মহান আল্লাহর নিকট এতই পছন্দ হল যে তিনি তার সন্তুষ্ট প্রকাশ করে আয়াত নাজিল করলেন এবং সাহাবিদের পাকা ও খাঁটি মু’মিন হওয়ার সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অর্থঃ আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষতলে তোমার নিকট বায়আত গ্রহণ করল তখন। তাদের অন্তরে যা ছিল, তা তিনি অবগত ছিলেন। তাদের প্রতি তিনি অবতীর্ণ করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়। [সুরা ফাতাহ ৪৮:১৮]।

মন্তব্যঃ হুদাইবিয়ায় চুক্তির প্রাককালে উসমান (রাঃ) এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ করা কে বাইয়াতে রিযওয়ান বলে।

 

৮। আমলে সলেহা করার বাইয়াতঃ

রাসুর সাঃ অনেক সময় সাহাবিদের নিকট থেকে আমলের উপর বাইয়াত গ্রহণ করছেন। নিম্মের হাদিসটি লক্ষ করুন। ‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘিরে একদল সহাবা (সাহাবা) বসেছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি তাদেরকে উদ্দেশ করে বললেন, আমার হাতে এ কথার বায়‘আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার (যিনা) করবে না, নিজেদের সন্তানাদি (অভাবের দরুন) হত্যা করবে না।

 কারো প্রতি (যিনার) মিথ্যা অপবাদ দিবে না। শারী‘আতসম্মত কোন বিষয়ে অবাধ্য হবে না। তোমাদের মধ্যে যারা এ সকল অঙ্গীকার পূর্ণ করতে পারবে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার রয়েছে। অপরদিকে যে লোক (শির্ক ব্যতীত) অন্য কোন অপরাধ করবে এবং এজন্য দুনিয়ায় শাস্তি পেয়ে যাবে, তাহলে এ শাস্তি তার গুনাহ মাফ হবার কাফফারাহ্ হয়ে যাবে। আর যদি কোন গুনাহের কাজ করে, অথচ আল্লাহ তা ঢেকে রাখেন (বা ধরা না পড়ে), এজন্য দুনিয়ায় এর কোন বিচার না হয়ে থাকে, তাহলে এ কাজ আল্লাহর মর্যীর উপর নির্ভর করবে। তিনি ইচ্ছা করলে আখিরাতে তাকে ক্ষমা করে দিবেন অথবা শাস্তিও দিতে পারেন। বর্ণনাকারী (‘উবাদাহ্) বলেন, আমরা এ সকল শর্তানুযায়ী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বায়‘আত করলাম। [সহীহ: বুখারী ১৮, মুসলিম ১৭০৯, নাসায়ী ৪১৬১, আহমাদ ২২৭৩৩, দারিমী ২৪৯৭, সহীহাহ্ ২৯৯৯, সহীহ আল জামি‘ ২৯৫৫; শব্দ বুখারীর]। 

মন্তব্যঃ মুসলিম হওয়ার বাইয়াত গ্রহন করা,  রাষ্ট্র প্রধানেন নিকট বাইয়াত গ্রহন করা, বাইয়াতে রিযওয়ান যা রাসুল সাঃ নিটক করে ছিলেন এই তিনটি ক্ষেত্রে বাইয়াতের ব্যাপারে উম্মতের মাঝে কোন মতভেদ নেই। কিন্তু আমলে সলেহায় বাইয়াত করার ব্যাপারে শুধু মতভেদ নেই মতবিরোধ আছে। যারা এর পক্ষে মত দেন তাদের দাবি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবিদের আমলের উপর বাইয়াত গ্রহন করছেন।

যারা এর বিরোধীতা করেন তারা বলেন, আমাদের সমাজে পীর মুরীদির নামে যে বাইয়াত হচ্ছে এটা আমলের উপর বাইয়াত হলেও বিভিন্ন তরিকার এবং ঐ সকল তরিকার দ্বারা সৃষ্ট বিদআতি আমলের উপর বাইয়াত। তাই এই ধরনের কোন বাইয়াত সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী যুগে ছিলনা। তাদের যুগে মুসলিম খলিফা ছাড়া অন্য কেউ কারও নিকট থেকে বাইয়াত নিয়েছেন বলে প্রমান পাওয়া যায়না। অথচ তারাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনিত দ্বীন ভাল বুঝেছেন ও আমল করেছেন। তাই পীরের বাইয়াতের যারা বিরোধীতা করে, তারা আমল ও ইসলামের পক্ষে বাইয়াত জায়েয বললেও বিভিন্ন তরিকার উপর বইয়াত কে হারাম মনে করে।

তবে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত ও পরবর্তী কারো নিকট বাইয়াতের মধ্যে আনুগত্তের ব্যাপারে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অবশ্য সর্বাবস্থায় বিনা শর্তে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনুগত্য করতে হয়, কিন্তু রাসুল ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য অন্ধভাবে করা চলেবনা, কুরআন সুন্নাহর অধীনে তাদের আনুগত্য করতে হয়। রাসুলের আনুগত্য নিরুঙ্কুস ও নিঃশর্ত অন্যের বেলায় তা শর্তাধীন।

 

৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট সাহাবিগন যে বাইয়াত করেছিলঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট সাহাবিগন কিসের উপর বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। উপরের আয়াতগুলি এবং সহিহ হাদিসগুলি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট সাহবিদের বাইয়াত গ্রহনে করার পক্ষে দলিল। তিনি কি কি ক্ষেত্রে সাহাবিদের বাইয়াত করিয়েছেন তার একটি ধারনা পাওয়া গেল উক্ত কুরআন ও হাদিসের আলোকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারনত নিম্মে বর্ণিত বাইয়াত সমূহ সাহাবিদের করিয়েছেন।

১। ইসলাম গ্রহনের বাইয়াত। (ঈমান আনার জন্য বাইয়াত)

২। শির্কি কাজ ত্যাগ করার বাইয়াত।

৩। সালাত আদায়, যাকাত প্রদান করার বাইয়াত।

৪। মুসলমানকে নসীহত করার বাইয়াত। (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ)

৫। জিহাদের বাইয়াত।

৬। রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার বাইয়াত। (যতক্ষণ না প্রকাশ্য কুফরী লিপ্ত হয়)

৭। সর্বদা সত্য কথা বলার বাইয়াত গ্রহণ করা।

৮। শর্তহীনভাবে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যের বাইয়াত।

৯। খারাপ কাজ না করার বাইয়াত। (চুরি, ব্যভিচার, সন্তানদেরকে হত্যা করবে না)।

১০। আমীরের আনুগত্যের বাইয়াত।

১১। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইয়াত।

মন্তব্যঃ হয়ত কুরআন ও হাদিসে আরও বিভিন্ন বিষয়ের উপর বাইয়াত গ্রহনের কথা উল্লেখ থাকতে পারে। 

 

১০। কার নিকট বাইয়াত হতে হবেঃ

কুরআন ও হাদিসসমূহের ষ্পষ্টভাষ্য অনুসারে সাহাবিগণ (রাঃ) সকল প্রকারের বাইয়াত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে গ্রহন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর সর্ব প্রথম সাহাবিগণ মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে আবু বক্কর বাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট আনুগত্যের জন্য বাইয়াত করেন। এর পর তার পরবর্তী তিনজন খলিফার নিকট সাহাবিগন রাঃ একইভাবে অনুগত্যের বাইয়াত গ্রহন করছেন। প্রধান কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত গ্রহনের দলীল কুরআন সুন্নায় বিদ্যমান। এবং খেলাফতের দায়িত্বে থাকা খলিফাদের নিকট বাইয়াতের প্রমানও সহিহ হাদিসে বিদ্যমান। তাইতো আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনার ১০ বছর ও চার খলিফার ৩০ বছর এই ৪০ রছর ইসলাম ধর্মের নেত্রিত্ব দান কারি কেন্দ্রিয় চরিত্র বা রাষ্ট্র প্রধান ছাড়া অন্য কারো নিকট অনুগত্যের বাইয়াত গ্রহন করেনি। তাই কুরআন-সুন্নাহের কোন বক্তব্যই একাকী বাইয়াতকে সমর্থন করে না। বরং বাইয়াত সংক্রান্ত সকল হাদীস এবং আয়াতে কারীমা কোন নেতা বা আমীরের নিকট বাইয়াত করাকে ইঙ্গিত করে। যেমন বাইয়াতে রিদওয়ানের ব্যাপারে মহান আল্লাহর বাণী, “যারা আপনার কাছে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করে, তারা তো আল্লাহর কাছে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে”, (৪৮:১০)। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত করার কথাই বলা হয়েছে। যেহেতু নবী করিম (সঃ) আমাদের মাঝে নেই সেহেতু তাঁর আদর্শের ধারক-বাহক কোন আমীরের নিকট বাইয়াত হওয়াটাই যুক্তিবহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জীবিত নেই একভাবে কোন ইসলামি খেলাফতও নেই তাহলে কি আমাদের বাইয়াত গ্রহণ শেষ হয়ে গেছে। ইসলামে বাইয়াত এমন এক জরুরি নিয়ম যা রাসুলের পরও চালু রাখতে হবে এবং উম্মতের মধ্যে এ নিয়ম চিরদিনই চালু থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম সমাজ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তাদের মাঝে একতার বড় অভাব। আকিদায়, আমলে, কাজে কর্মে সমাজের প্রতিটি ক্ষেতে সর্বত্র মতবিরোধ আর গোলযোগে ভরপুর। এ হেন অবস্থায় একক ইমাম বা নেতা পাওয় আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র।

খোলাফায়ে রাসাদাগনের পরবর্তী আমিরে মুয়াবিয়া বাদিয়াল্লাহু আনহুর এর পার যত দিন ইসলামের নামে উমাইয়া ও আব্বাসীরা শ্বাসন পরিচালনা করে তারাও এই বাইয়াত প্রথা চালু রাখেন। সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশের বাদশাহগণ সরকারী দায়িত্ব গ্রহণের অংশ হিসেবে দেশের নাগরিকদের বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ বাইয়াত দ্বারা বাদশাহর নেতৃত্ব পরিচালিত সরকারের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য প্রকাশ করাই আসল উদ্দেশ্য।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে যে উদ্দেশ্যে বাইয়াত প্রচলন হয়েছিল বর্তমানে ঐ মহান উদ্দেশ্য চালু না থাকলেও বইয়াত এর পরিভাষা ব্যবহার করে আমাদের সমাজে এখনো দুটি ধারার বাইয়াত প্রচিলত আছে। সাধারনত দু্টি প্রেক্ষাপটে এই বাইয়াত দুটি গ্রহন করা হয়।

১। কোন ইসলামি সংগঠনের দ্বারা বাইয়াত গ্রহণ।

২। কোন পীর সাহেবান দ্বারা তার মুরিদদের বাইয়াত গ্রহণ।

 

কোন সংগঠন বা পীরের নিকট বাইয়াত কতটুকু সহিহ ও যুক্তি যুক্ত।

১১। কোন ইসলামি সংগঠনের দ্বারা বাইয়াত গ্রহণঃ

যারা ইসলামি সংগঠনের সাথে কাজ করে তাদের দাবিঃ মুসলমানদের জামায়াতে বা অন্য সংগঠনের দায়িত্বশীলদের নিকট বাইয়াত হতে হয়। যতদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি নিজে ইসলামি জামায়াতের দায়িত্বশীল ছিলেন। সকলে তারই নিকট বা তার নিযুক্ত কোন ব্যক্তির নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। দুনিয়া থেকে তার বিদায় হবার পর ঐ জামায়াতের দায়িত্ব যার উপর পরেছে তারই নিকট বাইয়াত হতে হয়েছে। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকেই এ বিরাট শিক্ষা চলে এসেছে যে, মুসলমানদেরকে জামায়াতবদ্ধহয়ে থাকতে হবে এবং যিনিই ঐ জামায়াতের নেতা নির্বাচিত হন তাঁরই কাছে বাইয়াত হতে হবে। জামায়াতবিহীন অবস্থায় থাকা মুসলমানদের উচিত নয় এবং জামায়াতবদ্ধ হবার প্রমাণই হল জামায়াতের আমিরের নিকট বাইয়াত হওয়া।

১২। কোন পীর সাহেবান দ্বারা তার মুরিদদের বাইয়াত গ্রহণঃ

যারা পীর মুরিদে বিশ্বাসি তাদের দাবিঃ পীর শব্দটি ফার্সি। আরবীতে বলা হয় মুরশীদ। মুরশীদ শব্দের অর্থ হল পথপ্রদর্শক। যিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তার নাম মুরশীদ বা পথপ্রদর্শক। যাকে ফার্সীতে বলে পীর। “মুরীদ” শব্দটিও আরবী। যার অর্থ হল ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন বুযুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করে  সে ব্যক্তির নাম হল “মুরীদ”। এ ব্যাখ্যা থেকে একথা স্পষ্ট হল যে, পীর হবেন শরীয়তের আদেশ নিষেধ পালন করার প্রশিক্ষণদাতা। আর যিনি সে প্রশিক্ষণ নিতে চায় সে শিক্ষার্থীর নাম হল “মুরীদ” কাজেই ইসলামের শরীয়তকে সঠিকভাবে মেনে চলার জন্য এমনিভাবে কোন পীরের হাতে বাইয়াত হওয়া দোষের কিছু নয়। বরং তার আধ্যাতির আমলের জন্য তাকে বাইয়াত হতেই হবে।

মন্তব্যঃ ইসলামি শরীয়তে বাইয়াতের বিধান বিদ্যমান। এবং গ্রহন জায়েযতো বটেই কখনও কখনএ ওয়াজিবও হয়ে যায়। কিন্ত কুরআন সুন্নাহর সঠিক অনুসরণ না হলে বাইয়াত কিছুতেই জায়েয হবেনা। তাই সেটা ইসলামি সংগঠনের বাইয়াত হোক, আর পীর মুরিদদের বাইয়াত হোন। যদি কুরআন সুন্নাহর আলোকে বাইয়াত হয় তবে ঠিক আছে। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে হলে পরিত্যাজ্য।

এই দুটি বাইয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর  নিকট বাইয়াতের মধ্যে আনুগত্যের ব্যাপারে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সর্বাবস্থায় বিনা শর্তে আল্লাহ রাসুলের আনুগত্য করতে হয়, কিন্তু রাসুল ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য অন্ধভাবে বা বিনা শর্তে করা চলবে না।  কুরআন সুন্নাহ্ আলোকে অন্যদের আনুগত্য করতে হবে। রাসুলের আনুগত্য নিরুঙ্কুস ও নিঃশর্ত, অন্যের বেলায় তা শর্তাধীন। বাইয়াত প্রমানের জন্য বাইয়াতকারীগন যে আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করে সেই আয়াতের শেষাংসেই এ কথার প্রমান লুকিয়ে আছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা আমির (নির্দেশ দাতা/বিচারক/আলেম) তাদের। যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। [ সুরা নিসা ৪:৫৯ ]

এখানে আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুগত্যের জন্য কোন শর্তারোপ করা হয়নি। কিন্ত এই আয়াতের ‘উলুল আমর’ যার  দ্বারা সংগঠনের কর্মীরা আমির বা নেতাকে এবং সুফিরা তাদের পীরদের বুঝিয়ে থাকেন।

তার অনুগত্যের ব্যাপারে শর্তারোপ করা হইয়াছে। লক্ষ করুন, আয়াতে কারিমায়ে বলা হয়েছেঃ তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর। ষ্পষ্ট করে বলা হয়েছে সংগঠনের আমির বা পীরদের মাঝে বিরোধ হলে কুরআন সুন্নাহের ফয়সালা দিকে ফিরে আসতে হবে। তাই তাদের অনুগত্যের ব্যাপ্যারে আয়াতের ব্যাখ্যায় বলতে পারি গাইরুল্লাহ বা উলামা, শাসনকর্তা, ওলী, আউলিয়া, দরবেশ, পীরদের আনুগত্যে করা যাবে কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে। মোট কথা রাসূল ছাড়া অন্যদের শর্ত সাপেক্ষে আনুগত্য করা জায়েয আর অন্ধ আনুগত্য হারাম।

 

১৩। একক ব্যাক্তির নিকট যে বাইয়াত করা জায়েজঃ

ইসলাম গ্রহনের বাইয়াতঃ যদি কোন অমুসলিম ইমান এনে মুসলিম হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রবেশ করে তবে সে যে কারো নিকট কলেমায়ে শাহাদা পড়ে মুসলিম হবে পারে। একে অনেকে ঈমান আনার জন্য বাইয়াত বলে থাকে।

আমলের সালেহার বাইয়াতঃ যদি কোন ব্যক্তি কারো নিকট বাইয়াত গ্রহন করে যে ইসলামি শরীয়তের যাবতীয় বিধান যেমনঃ সালাম, সাওম, হজ্জ, জাকাত, পর্দা, জিহাদ, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ  ইত্যাদি পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তবে তার এ বাইয়াত শুদ্ধ হবে।

অসৎ কাজ পরিত্যাগ করার বাইয়াতঃ যদি কোন ব্যক্তি কারো নিকট বাইয়াত গ্রহন করে যে ইসলামি শরিয়ত বিরোধী কোন কাজ যেমনঃ শির্ক, কুফর, নেফাক, নেসা, যে কোন করিবা গুনাহ ইত্যাদির কোন অবস্থাই কবর না এমন কি এ ধারে কাছেও যাবনা। যদি কখনও এমন কাজ হয়ে যায় সাথে সাথে তাওবা করে নিব ইনশা আল্লাহ। তবে তার এ বাইয়াত শুদ্ধ হবে।

ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইয়াতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফতের পর সকল সাহাবি রাঃ আবু বক্করের নিকট বাইয়াত করে তার অনুগন্য স্বীকার করে এবং তাকে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার সাহায্য করা হয়। পরবর্তীকে অন্য খলিফাগনও এই ধারা অব্যহত রাখেন। তাই যখনই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে তখন সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ করে ইজমার ভিত্তিতে ওয়াজিব।

 

১৪। একক ব্যাক্তির নিকট যে বাইয়াত করা জায়েজ নয়

বিভন্ন ইসলামি সংঠনের আমিরের বাইয়াতঃ বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ টি দেশে একশ পঁচিশ কোটি মুসলমান এক জামায়াতবদ্ধ অবস্থায় নেই। তাই গোতা উম্মতের কোন একজন নেতা বা আমীর নেই। এমনকি কোন এক দেশের সব মুসলমানও এক জামায়াতবদ্ধ নয়। কোন দেশে মুসলিমদের একক কোন দল না থাকলে কি করবে? একক কোন দল না থাকলে, যে দল কুরআন সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী তাদের আমিরের বাইয়াত নিতে হবে। ফিকহি মাসয়ালা মাসায়েলের কথা বলে বা মতভেদ পুর্ন বিষয়ের কথা বলে নিজেই একটি দল বা ফির্কার জম্ম দেয়া যাবে না। এতে ইসলাম টুকরা টুকরা হবে যা ইসলামে সম্পুর্ণ হারাম করা হয়েছে।

কাজেই ঐক্যের স্বার্থে মুসলিমদের সম্মিত সংগঠর বা দলের অনুগত্য করতে হবে। সেই দলে নেতার নিকট ইসলামি শরিয়ত মানা বা প্রতিষ্ঠার করার বাইয়াত নেয়া যেতে পারে, তবে যদি তার কোন কথা বা কাজ কুরআন সুন্নাহর পরিপন্থি হয় তবে তার বাইয়াত ত্যাগ করতে হবে। এখানেই সাধারণ আমির ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাইয়াতে মধ্যে পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাইয়াতে কোন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবেনা কিন্তু সাধারণ কোন আমিরের অনুগত্য নির্ধারণ হবে কুরআন সুন্নাহর মাপকাঠিতে এবং এ মানদন্ডে উত্তির্ন না হলে সে বাইয়াত ত্যাগ করা ওয়াজির হয়ে যায়।

মন্তব্যঃ কাজেই শর্ত সাপেক্ষে ইসলামি সংগঠের আমিরের বাইয়াত গ্রহন জায়েয। ইসলাম বিরোধী কাজ পরিলক্ষিত হলে তার বাইয়াত জায়েয নয়।

১৫। পীর বা সুফিদের বাইয়াত

আমাদের সমাজে যে বাইয়াত সবচেয়ে বেশী প্রচলিত তা হল, পীর মুরীদের বাইয়াত। এই বাইয়াতের পক্ষে বিপক্ষে অনেক লেখা লেখি বিদ্যমান আছে। কেউ এই বাইয়াতের পক্ষ কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমান পেশ করে আবার কেউ এর বিপক্ষে কুরআন হাদিস দ্বারা তাদের বাইয়াত খন্ডন করে। আসল সত্য কোথায়? পূর্বের আলোচনায় দেখেছি পীর, শায়েখ, আমির, বাষ্ট্র প্রধান, সংগঠনের আমির, এমনকি সাধারন কোন মানুষের নিকট বাইয়াত হওয় যায় কিন্তু শর্ত সাপেক্ষ।

যারা পীর মুরিদদের বাইয়াতের ক্ষেত্রে এমন অনেক কাজ কর্ম আছে যা ইসলামি বাইয়াতের শর্ত কে ভঙ্গ করে। আর শর্ত ভঙ্গকারী বাইয়াত জায়েয নেই। যারা পীরের বাইয়াতে পক্ষে বলে বা লিখের তারা বাইয়াত ভঙ্গকারী শর্তের কথা বলেন না। শুধু বাইয়াত গ্রহনের পক্ষের কুরাআর হাদিসের উদৃতি প্রদান করেন। তাদের লেখায় আসল সত্য গোপন থাকে বলে ইসলাম সম্পর্কে যাদের জ্ঞান একটু কম তারা ধোকা খেয়ে বসে। অপর পক্ষে যারা এদের বিপক্ষে লিখের বা বলেন, তারা লেখার সময় বা বলায় সময় বাইয়াতে এদের শর্ত ভঙ্গসহ উল্লখ করেন বলে, পাঠক পীর মুরিদী জায়েয মনে করেন না। তাই এ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারনা না থাকলে যে যা লিখবে তাকেই সত্য বলে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কি?

১৬। একক ব্যক্তির নিকট বাইয়াত জায়েয হলেও চারটি কারনে প্রচলিত পীর মুরিদী জায়েয নয়

তরিকার বাইয়াতঃ পীর মুরিদের বাইয়াত মানে তাকে যে কোন এক তরিকার বাইয়াত গ্রহন করতে হয়। আমরা আগেই জেনেছি পীরদের বহু তরিরা আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে হাজার হাজার তরিকা বিদ্যামান একক হিসার নেই বলে সংখ্যা উল্লেখ করা গেলনা। তবে অনেক লক্ষাধীকও বলে থাকেন। চরমোনাইয়ের পীর ইসহাক সাহের ভেদে মারেফাত নামক বইয়ে ১২৬ তরিকার কথা বলছেন। এমন কি আমাদের আলেম সমাজ (দেওবন্দী) চার তরিকার উপর বাইয়াত প্রদান করে থাকেন। এই সকল তরিকার শতকরা ৯৯ ভাগই শির্ক বিদআতি কর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। যাদের অধিকাংশই শির্কি বিশ্বাস পোষন করে। যার উৎকৃষ্ট প্রমান আপনার হাতে এই গ্রন্থখানা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনিত ইসমালের বাইয়াত না করে ঐ সকল শির্ক, কুফরি ও বিদআত মিশ্রিত তরিকার বাইয়াত গ্রহন জায়েয হবে কি করে।

 

এই বাইয়াতে ইসলামের বিভক্তি হয়ঃ পীরদের তরিকা ভিন্ন বলে তাদের আমল আকিদাও ভিন্ন। একটু লক্ষ করলে দেখবের এক এক পীরে পাগড়ী, টুপি ও জামার ধরন ও কালার আলাদা। আপনি তাদের পোশাক দেখলেই বলতে পারবে উমুক পীরের মুরিদ।এই জন্যই পীরের মুরিদের মাঝে কথার কাটাকাটির সাথে মারামারিও হয়। যদি সবাই তরিকার বাইয়াত না হয়ে ইসলামের বাইয়াত হত তাহলে বিভক্তি হত না। অথচ ইসলামে বিভক্তি হারাম করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে বারবার বিভক্তি, ফিরকাবাজি বা দলাদলি থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থঃ তোমরা আল্লাহ্র রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (আল-ইমরান ৩:১০৩)।

অন্যত্র আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু বলেনঃ

وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿31﴾ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ﴿الروم32﴾

অর্থ: তোমরা ঐ মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না, যারা দ্বীনকে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে এবং যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা ছিল তাই নিয়েই খুশি (সূরা রূম, ৩০: ৩১ ও ৩২ আয়াত)

 অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু আরও বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
অর্থ: যারা তাদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আন‘আম-: ১৫৯)

আমাদের একমাত্র অনুসরণীয় প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা জেনে রাখ! তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এদের মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে এবং একটি দলই জান্নাতে। তারা জামা‘আত।”

(আবূ দাউদ ৪/১৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী বলেছের হাদিস সহিহ ১/৪০৪-৪১৪)
অন্য হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একমাত্র আমি এবং আমার সাহাবিদের মতের অনুসারী দল ব্যতীত সকলেই জাহান্নামে যাবে। (তিরমিযি হদিসের মান হাসান)।

ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত- আমাদের জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দাগ টানলেন। তারপর বললেন, এটা আল্লাহর সোজা (সঠিক) রাস্তা।তারপর তার ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন। তারপর বললেন, এ রাস্তাগুলোর সবকটিতে শয়তান বসে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে। এরপর কুরআন থেকে পাঠ করলেন: আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (হাদিসটি সহিহ আহমদ, নাসাঈ, হাকিম উল্লেখ করেছেন)।

মন্তব্যঃ যে বাইয়াত ইসলামে বিভক্তি করে তা জায়েয নয়। হ্যা, যদি কেউ প্রমান করতে পারে তাদের বাইয়াতে বিভক্তির সৃষ্টি হয় না তবে তারা এ শর্তের উর্ধে থাকবেন।

গ। শির্কি মিশ্রতি আকিদার বাইয়াত করেঃ আমাদের সমাজে প্রচলিত সুফিদের তরিগুলোর আকিদা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তারা শির্কি আকিদা প্রষণ করে যা তাদের ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। তাই যদি কেউ ঐ সকল শির্কি আকিদায় বিশ্বাসি তরিকার বাইয়াত গ্রহণ করে, সে ও ঐ তরিকার অনুসারী হিসাবে বিবেচিত হবে এবং ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।

তাদের শির্কি আকিদার কিছু উদাহরণ হলঃ

আল্লাহতায়ালার মতই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পীর মাসায়েক, অলী আওলীয়াগন অদৃশ্যের খবর রাখেন বলে বিশ্বাস করে।  শাইখ বা অলীগন পৃথিবীর যে কোন স্থানে হাজির নাজির থাকেন এবং মুরিদদের আহবানে সাড়া দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। গুনাহ মাপের জন্য পীরকে মাধ্যম মনে করে, তার দরবারে ধরনা দেয়। তাদের আকিদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পীর, অলী আওলিয়া কবরে আমাদের মতই জীবিত আছেন। নবী, রাসূল, অলি, আওলীয়া, পীর বুজুর্গ, সকলেই মানুষের ভাল মন্দ করার ক্ষমতা রাখেন। আল্লাহর মত গাউস, কুতুব, আবদাল, নকিব ইত্যাদি পদবির অলীদের ‌নিজেস্ব ক্ষমতা আছে। এ ছাড়া এই সুফিবাদ বইটি তাদের আকিদা সম্পর্কে বহু শির্কি আকিদা উল্লেখ করেছি।

মন্তব্যঃ এই শির্ক আকিদা পোশষকারী সুফি বা পীরদের বাইয়াত গ্রহনতো অনেক দুরের কথা এদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা প্রত্যেক মুসলিমদের উপর ফরজ। এখন যদি কোন পীর দাবি করা আমরা এসকল শির্কি আকিদা প্রশন করিনা। তবেতো খুব ভাল কথা, এই শর্তে তিনি পাশ করলেন, বাকি শর্তে পাশ করলে তার নিকট বাইয়াত হবে কোন বাধা খাকবে না।

 

এই বাইয়াতে বিদআতি আমলের বাইয়াত করেঃ পীরদের তরিকায় বাইয়াত গ্রহনের সাথে সাথে  তারা তাদের তরিকার আমলেরও বাইয়াত করান। তারা সকাল সন্ধ্যা তাদের তৈরি কৃত বিভিন্ন বিদআতি তরিকার আমল শিক্ষা প্রদান করেন।

যেমনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জম্ম দিনকে ঈদে মিলাদুন নব্বী  হিসবে পালন করে। ইবাদাত মনে করে কবরের নিকট মিলাদ পড়ে, ফাতিহা আদায় করে, কবর পাকা করে, কবরের উপর গম্বুজ নির্মান করে, কবর চাদর চড়ায়, মুমবাতি ও আগর বাতি জ্বালায়। নেকির কাজ মনে করে মাজারে মান্নত করে, টাকা পয়সা দান করন, সিন্নি দেয়, তরিতরকারি দান করে, ফলমুল দান করে এবং মাজারে গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি জবেহ করে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কুলখানি, চল্লিসা ও বিভিন্ন খতম আদায় করে। জিকিরে তারা তাদের পীর বা শায়েকের ধ্যান করে। তারা লতিফার জিকিরের শিক্ষা প্রদার করেন যার অস্তিত্ব কুরআন হাদিসের কোথাও খুজে পাওয়া যাবেন। তারা মোরাকারা শিক্ষা প্রদার করে থাকেন যা সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, সলফে সালেহীনদের সময় ছিলনা। তারা “হু হু” “আল্লাহু, আল্লাহু” “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” ইত্যাদি জিকির প্রদান করে থাকে। যার সাথে ইসলামের কোন মিল নেই। অনেক পীর তার মুরিদদের জোরে জোরে জিকির করা নির্দেশ প্রদার করে। আর একটা জাল হাদিস প্রমান হিসাবে উল্লেখ করেন যে, এমন ভাবে জিকির কর যেন লোকে তোমাকে পাগল বলে।

 অথচ কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعاً وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ وَلاَ تَكُن مِّنَ الْغَافِلِينَ

অর্থঃ আর তোমার রবকে স্মারণ করো সকাল-সাঁঝে মনে মনে কান্নাজড়িত স্বরে ও ভীতি বিহ্বল চিত্তে এবং অনুচ্চ কণ্ঠে৷ তুমি তাদের অন্তরভুক্ত হয়ো না যারা গাফলতির মধ্যে ডুবে আছে৷ [ সুরা আরাফ ৭:২০৫ ]

মন্তব্যঃ ইসলামি শরিয়ত বহির্ভুত এ সকল বিদআতি আমল এর বাইয়াত গ্রহন না জায়েয হবে। হ্যা, যদি ইসলামি কোন বিধি বিধান মান্য করার জন্য পীরের কাছ বাইয়াত হয় তবে যা জায়েয হবে। এখন প্রশ্ন হল সমাজে প্রচলিত পীরেরা তো সবই ভাল কাজের বাইয়াত গ্রহন করে সাথে উপরে উল্লেখিত বিদাতি কাজরেও বাইয়াত নেয়।

তাহলে কি তাদের নিকট বাইয়াত নেয়া জায়েয? না, কস্টিম কালেও ভাল আমলের সাথে সামান্য পরিমানের শির্ক বা বিদআদ মিশ্রিত আমলের বাইয়াত নেয়া চলবেনা। কারন ঐ সামান্য আমল আপনার সকল আমল বরবাদ করে দিবে। মহান আল্লাহ তায়ালা শির্কিকারিদের সম্পর্কে বলেনঃ

 وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٍ۬ فَجَعَلۡنَـٰهُ هَبَآءً۬ مَّنثُورًا (٢٣)

এবং তাদের সমস্ত কৃতকর্ম নিয়ে আমি ধূলোর মতো উড়িয়ে দেবো৷ (সুরা ফুরকান :২৩)।

 

১৭। যে বাইয়াত করা হারামঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এক ব্যাক্তি- যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আছে, অথচ সে মুসাফিরকে তা দিতে অস্বীকার করে। অন্য একজন ব্যাক্তি, যে ইমামের হাতে একমাত্র দুনিয়ার স্বার্থে বায়আত হয়। যদি ইমাম তাকে কিছু দুনিয়ারী সুযোগ দেন, তা হলে সে খুশী হয়। আর যদি না দেন তবে সে অসন্তুষ্ট হয়।

অন্য একজন সে ব্যাক্তি, যে আসরের সালাত আদায়ের পর তার জিনিসপত্র (বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে) তুলে ধরে আর বলে যে, আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া অন্য কোনো মাবূদ নেই, আমার এই দ্রব্যের মূল্য এতো এতো দিতে আগ্রহ করা হয়েছে। (কিন্তু আমি বিক্রি করিনি) এতে এক ব্যাক্তি তাকে বিশ্বাস করে (তা ক্রয় করে নেয়)। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেনঃ যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রয় করে (৩:৭৭)। (সহিহ বুখারি হাদিস ২২০৩ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ দুনিয়াত স্বার্থে বাইয়াত করা হারাম। ইহা ছাড়া ইসলামি শরীয়ত যে সকল কাজ করা হারাম বলে ঘোষনা করেছে। সেই সকল কাজ করার বাইয়াত বা অঙ্গীকার করা হারাম।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment