সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ প্রথম কিস্তি

সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ প্রথম কিস্তি

সালাতের কসর করা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সফরের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ইসলাম সফর বা ভ্রমণকারীর জন্য ইসলামী বিধানে কিছুটা রুখসত বা ছাড় দিয়েছে। সালাত মহান আল্লাহ এমন এক আদেশ যাকে কোন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবে না, তাই সে সফরে থাকুক আর বাড়িতে থাকুন। কিন্তু মহান আল্লাহ সফরের সময় সালাতের ব্যাপারে আমাদের প্রতি কিছুটা সহনশীলতা প্রদর্শণ করেছেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হওয়া সত্বেও সফর বা ভ্রমণকরীর জন্য চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে বা কমিয়ে দুই রাকআত করেছেন। শুধু সালাত নয় সফরে আরও কয়েকটি হুকুমের ব্যাপারে মহান আল্লাহ কিছুটা ছাড় বা রুখসত প্রদান করেছেন। সফরে থাকা কালিন সময়ে সফরকারিকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফির ব্যক্তি সব সময় চারটি রুখসত বা ছাড়ের অধিকারী হবে। সে চারটি রুখসত হলঃ

১। সালাতকে কসর করে আদায়

২। সালাতকে জমা করা।

৩। সফরে তিন দিন ও তিন রাত্রি পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করা

৪। সফর অবস্থায় রমযানের সিয়াম ভঙ্গ করা

সালাতের কসর করাঃ

কসর একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হলো কম করা, কমানো। কোন মুসলিম যখন সফরে থাকে তখন তিনি চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে বা কমিয়ে দুই রাকআত আদায় করে। সালাত কমিয়ে আদায় করাকেই সালাতে কসর বলা হয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যে ব্যক্তি ভ্রমণ বা সফর করে তাকে সফররত অবস্থায় মুসাফির বলে। আবার যখন নিজ বাড়ী বা বাসভবনে চলে আসে তখন শরিয়তের পরিভাষায় তাকে বলে মুকিম। মুকিম অর্থ হল, নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী। অর্থাৎ শুধু মুসাফির ব্যক্তিই সালাতের কসর আদায় করবে। মুকিম কখনও সালাতের কসর আদায় করবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

 وَإِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِى ٱلۡأَرۡضِ فَلَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٌ أَن تَقۡصُرُواْ مِنَ ٱلصَّلَوٰةِ إِنۡ خِفۡتُمۡ أَن يَفۡتِنَكُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ‌ۚ إِنَّ ٱلۡكَـٰفِرِينَ كَانُواْ لَكُمۡ عَدُوًّ۬ا مُّبِينً۬ا (١٠١) 

অর্থঃ আর যখন তোমরা সফরে বের হও তখন নামায সংক্ষেপ করে নিলে কোন ক্ষতি নেই৷ (বিশেষ করে) যখন তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফেররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে৷ কারণ তারা প্রকাশ্য তোমাদের শত্রুতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷  (সুরা নিসা ৪:১০১)।

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা সফরত অবস্থায় সালাত কসর করতে বলেছেন। আয়াতটি সরল অনুবাদ দেখলে মনে হয় কসর কেবল যুদ্ধাবস্থার  আদায় করেত হবে শান্তির অবস্থায় নয়। এই সরল অনুবাদ করে ‘যাহেরী’ ও ‘খারেজী’ ফিকাহর অনুসারীরা বলে থাকে কসর কেবল যুদ্ধাবস্থার জন্য আর শান্তির অবস্থায় যে সফর করা হয় তাতে কসর করা কুরআন বিরোধী। কিন্তু নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতের মাধ্যমে হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত উমর (রা) এই একই সন্দেহটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সামনে পেশ করলে তিনি এর জবাবে বলেন আল্লাহ পক্ষ থেকে সাদাকা বলেছে। হাদিসটি হলঃ

ইয়ালা ইবনু উমায়্যা (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কে বললাম, (আল্লাহ তা’আলা বলেছেন) “যদি তোমরা ভয় পাও যে, কাফিররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে, তরে সালাত সংক্ষেপ করে পড়াতে কোন দোষ নেই” কিন্তু এখন তো লোকেরা নিরাপদ। উমর (রাঃ) বললেন, বিষয়টি আমাকেও বিস্মিত করেছে, যা তোমাকে বিস্মিত করেছিল। তারপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম ও এর জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এটি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি একটি সাদাকা। তোমরা তাঁর সাদাকাটি গ্রহণ কর। (সহিহ মুসলিম হাদিস ১৪৪৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

ইয়া‘লা ইবনু উমাইয়্যাহ্ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘উমারের কাছে নিবেদন করলাম, আল্লাহ তা‘আলার বাণী হলো, ‘‘তোমরা সলাত কম আদায় করো, অর্থাৎ ক্বসর করো, যদি অমুসলিমরা তোমাদেরকে বিপদে ফেলবে বলে আশংকা করো’’- (সূরাহ্ আন্ নিসা ৪: ১০১)। এখন তো লোকেরা নিরাপদ। তাহলে ক্বসরের সালাত আদায়ের প্রয়োজনটা কি? ‘উমার (রাঃ) বললেন, তুমি এ ব্যাপারে যেমন বিস্মিত হচ্ছো, আমিও এরূপ আশ্চর্য হয়েছিলাম। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ব্যাপারটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সলাতে কসর করাটা আল্লাহর একটা সাদাকা বা দান, যা তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন। অতএব তোমরা তাঁর এ দান গ্রহণ করো। (মিসকাত ১৩৩৫ থেকে নেয়া, আরও আছে সহীহ মুসলিম ৬৮৬, আবূ দাঊদ ১১৯৯, আত্ তিরমিযী ৩০৩৪, নাসায়ী ১৪৩৩, ইবনু মাজাহ্ ১০৬৫, আহমাদ ১৭৪, দারিমী ১৫৪৬, ইবনু খুযায়মাহ্ ৯৪৫, ইবনু হিব্বান ২৭৩৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৫৩৭৯, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১০২৪)।

হারিসা ইবনু ওয়াহব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদ অবস্থায় আমাদেরকে নিয়ে মিনায় দু’ রাকা’আত সালাত আদায় করেন। (সহীহ বুখারী – ১০২২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

মহানবী (সাঃ) প্রত্যেক সফরেই কসর করে নামায পড়েছেন এবং কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত দ্বারা এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি কোন সফরে নামায পূর্ণ করে পড়েছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ), আবূ বাক্‌র, উমার ও উসমান (রাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। কিন্তু কখনো দেখি নি যে, তাঁরা ২ রাকআতের বেশী নামায পড়েছেন।’ ( মিশকাত ১৩৩৮, বুখারী ১১০২, মুসলিম ৬৮৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৫৫০৭, আবূ দাঊদ ১২২৩)

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মদিনা থেকে মক্কার দিকে রওনা দিলাম। সেই সফরে তিনি মদিনায় ফিরে আসা পর্যন্ত দু’ রাক’আত দু’ রাক’আত করে সালাত আদায় করেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি মক্কায় কতদিন ছিলেন? তিনি বললেন দশ দিন।(সহিহ মুসলিম হাদিস ১৪৫৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ এই সকল সফর ছিল স্বাভাবিক, কোন যুদ্ধের জন্য সফর ছিল না। তাই সাধারনত যে কোন মুসাফিরই সালাতের কসর করতে পারবে যদি সে সফরের শর্থের মাঝে থাকে।

সফরের দুরত্ব কতটুকু?

আল্লাহ্‌ তা’আলা নির্দিষ্টভাবে সফরের কোন দুরত্ব নির্ধারণ করেননি। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও সফরের দুরত্ব নির্ধারণের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা পাওয়া যায় না। কুরআন সুন্নাহে নির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা না পাওয়ার কারনে মুজতাহীদ আলেমদের মাঝে এ সম্পর্কে বিশাল মতভেদ আছে। উলামাগণের মাঝে অনেক মত পার্থক্য রয়েছে। ইবনুল মুনযির ও অন্যান্যদের বর্ণনায় প্রায় ২০টি মত রয়েছে।

তবে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় যুহরের সালাত চার রাক্‘আত আদায় করেছেন। তবে যুল হুলায়ফায় ‘আসরের সলাত দু’ রাক্‘আত আদায় করেছেন। (মিসকাত ১৩৩৩, সহীহ  বুখারী ১৫৪৭, মুসলিম ৬৯০, নাসায়ী ৪৭৭, আহমাদ ১২৯৩৪, ইবনু হিব্বান ২৭৪৭, ইরওয়া ৫৭০, আবূ দাঊদ ১২০২।

এই হাদিসের আলোকে ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ক্বসরের সর্বনিম্ন সীমা হলো ৩ মাইল। তিনি দলিল পেশ করেছেন এই সহিহ হাদিস থেকে। হাফিয আসক্বালানী (রহঃ) বলেনঃ এ বিষয়ে এটাই অধিক বিশুদ্ধ হাদীস।

আর যারা এ মতের বিরোধী তারা বলেন যে, আলোচ্য হাদীস দ্বারা ক্বসর শুরু উদ্দেশ্য, সফরের শেষ গন্তব্য নয়। অর্থাৎ যখন সে দীর্ঘ সফরের ইচ্ছা করবে এবং তিন মাইল দূরত্বে পৌঁছার পর থেকে সে কসর করবে। যেমন হাদিসের অর্থের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় চার রাকআত সলাত আদায় করলেন এবং যুল হুলায়ফায় দু’ রাকআত সলাত আদায় করলেন। অর্থাৎ সফর শুরু করে তিন মাইল অথবা তিন ফারসাখ পরিমাণ দূরত্বে গেলেই সালাত কসর করতে হবে।

সহিহ মুসলিমে এসেছেঃ আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ) … ইয়াহিয়া ইবনু ইযায়ীদ আল হুনাঈ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) এর নিকট সালাত কসর করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে তিন মাইল অথবা (রাবী শুবার সন্দেহ) তিনি তিন ফারসাখ পথ অতিক্রম করতেন, তখন দু’রাকআত পড়তেন।(সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৪৫৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

সহিহ মুসলিমে আরও এসেছেঃ যুহায়র ইবনু নুফায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি শুরাহবিল ইবনুল সিম্‌ত (রহঃ) এর সঙ্গে একটি গ্রামের দিকে রওনা দিলাম, যা সতের বা আঠার মাইলের মাথায় অবস্থিত। তারপর তিনি দু’ রাক’আত সালাত পড়লেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি উমর (রাঃ) কে দেখেছি, তিনি যুল হুলায়ফায় দু’ রাক’আত পড়েছেন। এ বিষয়ে তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যেরূপ করতে দেখেছি, সেরূপই করছি। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৪৫৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

ইমাম শাফি‘ঈ রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম মালিকরাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ ও অন্যান্য ফিকহবিদের মত, পূর্ণ একদিন সফরের দূরত্বের কমে সলাত ক্বসর করা যাবে না। আর তা হলো চার বারদ, আর চার বারদ হলো ১৬ ফারসাখ অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা ৮০ কিলোমিটার। কারণ এক বারদ হলো চার ফারসাখ, আর এক ফারসাখ সমান তিন মাইল। (মিসকাতের সফর অধ্যায়)

কোন কোন মুজতাহীদ ৮০ কিলোমিটার এর মত নির্ধিষ্ট পরিমাণ দুরত্ব উল্লেখ না করে বলেছেনঃ সমাজে প্রচলিত রীতিনীতিতে বা দেশীয় প্রথায় যাকে সফর বলা হয় তাতেই নামায কসর করবে। যদিও তা ৮০ কিলোমিটার না হয়। আর মানুষ যদি তাকে সফর না বলে, তবে তা সফর নয়, যদিও তা ১০০ কিলোমিটার হয়। এটাই শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ এর মত। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম)।

মন্তব্যঃ প্রচলিত রীতিনীতিতে মতভেদ দেখা দিলে ইমামদের যে কোন একটি মত গ্রহণ করলেও কোন অসুবিধা নেই। কেননা ইমামগণ সবাই মুজতাহিদ বা গবেষক। এক্ষেত্রে কোন দোষ হবে না ইনশাআল্লাহ্‌। কিন্তু বর্তমানে মানুষের প্রচলিত রীতিনীতি যেহেতু সুনির্দিষ্ট তাই ইহা গ্রহণ করাই অধিক সঠিক। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম)।

সফরে কত দিন পর্যান্ত কসর সালাত আদায় করা যাবে?

মুসাফির যখন সফরের গন্তব্যে পৌঁছে যাবে, তখন কতদিন অবস্থান করলে সে সালাত কসর করবে এ ব্যাপারে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। সাহাবিদের যুগ থেকেই এ ব্যাপারে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। যার ফরে আমরা হাদিসের মধ্যও দিনের সংখ্যা নিয়ে পার্থক্য দেখতে পাই। তাই যখন কোন মুজতাহীদ হাদিসের আলোকে বায় প্রদান করেন, তখন তিনি যেটা অধিক সঠিক মনে করছেন তার উপর রায় প্রদান করেন। অন্য মুজতাহীদ হয়ত অন্য হাদিসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই সাহিবী নয় মুজতাহীদ আলেমদের মাঝেও দিনের সংখ্যা নিয়ে মতদেভ আছে। প্রথমে এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস লক্ষ করিঃ

১. ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সফরে উনিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং সালাত কসর করেন। কাজেই (কোথাও) আমরা উনিশ দিনের সফরে থাকলে কসর করি এবং এর চাইতে বেশী হলে পুরোপুরি সালাত আদায় করি। (সহীহ বুখারী  ১০১৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

২. আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ভ্রমণে গিয়ে ঊনিশ দিন অবস্থান করেন। এ সময় তিনি দু’ রাক্‘আত করে ফরয সালাত আদায় করেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমরাও মক্কা মাদীনার মধ্যে কোথাও গেলে সেখানে ঊনিশ দিন অবস্থান করলে, আমরা দু’ রাক্‘আত করে সলাত আদায় করতাম। এর চেয়ে বেশী দিন অবস্থান করলে চার রাক্‘আত করে সলাত ক্বায়িম করতাম। (মিসকাত ১৩৩৭ হাদিসের মান সহিহ। আত্ তিরমিযী ৫৪৯, ইবনু মাজাহ্ ১০৭৫)

৩. আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মক্কা থেকে মদিনায় গমণ করি, আমরা মদিনা ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি দু’রাকা’আত, দু’রাকা’আত সালাত আদায় করেছেন। (রাবী বলেন) আমি (আনাস (রাঃ) কে বললাম, আপনারা মক্কায় কত দিন ছিলেন তিনি বললেন, আমরা সেখানে দশ দিন ছিলাম (সহীহ বুখারী ১০২০ এবং সহিহ মুসলিম ১৪৫৯, ইসলামি ফাউন্ডেশনের প্রকাশনায়)

এক বছরের হাদিস, ছয় মাসের হাদিস

উপরের হাদিসগুলিতে ১৯ দিন, ১০দিন, ছয়মাস ও একবছর দেখতে পাই। আসলে সবগুরি হাদিসই সঠিক। উম্মাতের মাঝে এ সম্পর্কি ভুল বুঝাবুঝি দুর করার জন্য এক এক মুজতাহীদ আলেম এক একটি মতামত প্রদান করেছেন। তাদের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ চারটি মতামত বা রায় তুলে ধরছি।

প্রথম মতামতঃ শাফি‘ঈ ও মালিকী রাহিমাহুল্লাহ এর মতামত হলো, যখন চার দিনের অতিরিক্ত অবস্থান করবে তখন সলাত পূর্ণ করবে।

দ্বিতীয় মতামতঃ আবূ হানীফাহ রাহিমাহুল্লাহ এর মতামত হলো, যখন ১৫ দিনের বেশী অবস্থান করবে, তখন পূর্ণ সলাত আদায় করবে।

তৃতীয় মতামতঃ ইমাম আহমাদ ও দাঊদ রাহিমাহুল্লাহ এর মতামত অনুযায়ী যখন চার দিনের অধিক অবস্থান করবে তখন পূর্ণ সলাত আদায় করবে।

চতুর্থ মতামতঃ ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইয়াহ্ রাহিমাহুল্লাহ এর মতামত অনুযায়ী যখন ১৯ দিনের অধিক অবস্থান করবে তখন পূর্ণ সলাত আদায় করবে।

ইমাম শাফি‘ঈ ও মালিক রাহিমাহুল্লাহ এর মতে সলাত কসরের সীমা হলো গন্তব্যে প্রবেশ এবং গন্তব্য থেকে বের হওয়ার দিন ব্যতীত তিন দিন। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ)-এর নিকট ১৪ দিন, ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর নিকট ৪ দিন, ইসহাক (রহঃ)-এর নিকট ১৯ দিন। মির্‘আত প্রণেতা বলেনঃ আমার নিকট অগ্রগণ্য বা প্রাধান্য মত হলো ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর মত। (মিসাতের সফর অধ্যায়ের টিকা থেকে নেয়া হয়েছে)।

মন্তব্যঃ উপরের মতামত গুলি সবই হাদিসের আলোকে প্রদান করা হয়েছে। কোন মুজতাহীদ আলেমই হাদিসের বাহিরে কিয়াস করেনি। প্রচলিত রীতিনীতিতে মতভেদ দেখা দিলে ইমামদের যে কোন একটি মত গ্রহণ করলেও কোন অসুবিধা নেই। কাজেই এটা ঠিক, ওটা ভুল এমন বলে বলে উম্মতের মাঝে ঐক্য নষ্ট করা হারাম।

সফরের সময় সুন্নাত ও নফল পড়ার বিধানঃ

ঈসা ইবনু হাফস ইবনু আসিম ইবনু উমর ইবনুল খাত্তাব তাঁর পিতা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কার রাস্তায় আমি ইবনু উমরের সহচর হলাম। তিনি আমাদের যুহরের সালাত দু’ রাক’আত পড়ালেন। এরপর তিনি সামনে অগ্রসর হলেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে অগ্রসর হলাম। তারপর তিনি তাঁর মনযিলে এসে বসলেন এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে বসলাম। এরপর যে স্থানে তিনি সালাত আদায় করেছিলেন, সে স্থানের প্রতি দৃষ্টি পড়লে তিনি দেখলেন, কিছু লোক দাঁড়ানো। তিনি বললেন, তারা সেখানে কি করছে? আমি বললাম, তারা নফল সালাত আদায় করছে তিনি বললেন, আমি যদি নফল আদায় করতাম তাহলে আমি আমার সালাত (ফরয) কেই পূর্ণ করতাম।

হে ভ্রাতুষ্পুত্র! আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সফরে থেকেছি। কিন্তু ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি দু’ রাক’আতের অতিরিক্ত আদায় করেননি। আমি আবূ বকর (রাঃ) এর সঙ্গেও থেকেছি, তিনিও তাঁর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত দু’ রাক’আতের অতিরিক্ত আদায় করেননি। আমি উমর (রা) এর সঙ্গেও ছিলাম। তিনিও ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত দু’ রাক’আতের অতিরিক্ত পড়েননি। আমি উসমান (রাঃ) এরও সঙ্গে ছিলাম। তিনিও ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত দু’ রাক’আতের অতিরিক্ত আদায় করেননি। আর আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন, “নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। (সহিহ মুসলিম হাদিস ১৪৫২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

হাফস ইবনু ‘আসিম (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার মক্কা-মাদীনার পথে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমারের সাথে থাকার আমার সৌভাগ্য ঘটেছে। (যুহরের সলাতের সময় হলে) তিনি আমাদেরকে দু’ রাক্‘আত সলাত (জামা‘আতে) আদায় করালেন। এখান থেকে তাঁবুতে ফিরে গিয়ে তিনি দেখলেন, লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা এটা কি করছে? আমি বললাম, তারা নফল সলাত আদায় করছে। তিনি বললেন, আমাকে যদি নফল সলাতই আদায় করতে হয়, তাহলে ফরয সলাতই তো পরিপূর্ণভাবে আদায় করা বেশী ভাল ছিল। কিন্তু যখন সহজ্জ করার জন্য ফরয সালাত কসর আদায়ের হুকুম হয়েছে, তখন তো নফল সলাত ছেড়ে দেয়াই উত্তম। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকার সৌভাগ্যও পেয়েছি। তিনি সফরের অবস্থায় দু’ রাক্‘আতের বেশী (ফরয) সলাত আদায় করতেন না। আবূ বাকর, ‘উমার, ‘উসমান (রাঃ)-এর সাথে চলারও সুযোগ আমার হয়েছে। তারাও এভাবে দু’ রাক্‘আতের বেশী আদায় করতেন না। (মিসকাত ১৩৩৮, সহীহ বুখারী ১১০২, সহিহ মুসলিম ৬৮৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৫৫০৭, আবূ দাঊদ ১২২৩।

অবশ্য সাধারণ নফল, তাহাজ্জুদ, চাশত, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ প্রভৃতি নামায সফরে পড়া চলে। যেমনঃ ফরয নামাযের আগে-পরেও নফলের নিয়তে নামায পড়া দূষণীয় নয়।

মক্কা বিজয়ের দিন উম্মেহানীর ঘরে তিনি চাশতের নামায পড়েছেন। উম্মে হানী (রাঃ) ব্যতিত অন্য কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাতুয যুহা (পূর্বাহ্ন এর সালাত) আদায় করতে দেখেছেন বলে আমাদের জানাননি।

উম্মে হানী (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর ঘরে গোসল করার পর আট রাকা’আত সালাত আদায় করেছেন। আমি তাঁকে এর চাইতে সংক্ষিপ্ত কোন সালাত আদায় করতে দেখিনি, তবে তিনি রুকূ’ ও সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করেছিলেন। লায়স (রহঃ) আমির ইবনু রাবীআ’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের বেলা বাহনের পিঠে বাহনের গতিমুখী হয়ে নফল সালাত আদায় করতে দেখেছেন। (সহিহ বুখারী ১০৪০ ইফাঃ)।

 এ ছাড়া তিনি সফরে উটের পিঠে নফল ও বিতের নামায পড়তেন। 

আমীর ইবনু রাবী’আ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি, তিনি সাওয়ারীর উপর উপবিষ্ট অবস্থায় মাথা দিয়ে ইশারা করে সে দিকেই সালাত আদায় করতেন যে দিকে সাওয়ারী ফিরত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয সালাতে এরূপ করতেন না। সালিম (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ (রাঃ) সফরকালে রাতের বেলায় সাওয়ারীর উপর থাকা অবস্থায় সালাত আদায় করতেন, কোন্ দিকে তাঁর মুখ রয়েছে সে দিকে লক্ষ্য করতেন না এবং ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ারীর উপর নফল সালাত আদায় করেছেন, সাওয়ারী যে দিকে মুখ ফিরিয়েছে সেদিকেই এবং তার বিত্‌র ও আদায় করেছেন। কিন্তু সাওয়রীর উপর ফরয সালাত আদায় করতেন না। (সহিহ বুখারী ১০৩৫ ইফাঃ)।

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ার থাকাবস্থায় কিবলা ছাড়া অন্য দিকে মুখ করে নফল সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করেছেন।(সহিহ বুখারী ১০৩২ ইফাঃ)।

মন্তব্যঃ অনেক আলেম বলে থাকের সফর অবস্থায় নফল সুন্নাহ সালাত ছেড়ে দিবে শুধে ফজরের দুই রাকআত সুন্নাহ ব্যাতিত। সফর অবস্থায় যদি কোথাও হোটেলে বা বাড়িতে অবস্থান করে তার কোন প্রকার সফরের ক্লান্তি না তাকে তবে সে নফল সুন্নাহ সালাত আদায় করতে পারে।

সফর শুরুর পর কত দুর পর মুসাফিরের হুকুম হয়ঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মদিনায় যুহরের সালাত চার রাকা’আত আদায় করেছি এবং যুল-হুলাইফায় আসরের সালাত দু’রাকা’আত আদায় করেছি। (সহীহ বুখারী ১০২৮ ও সহিহ মুসলিম ১৪৫৫ ইসলামি ফাউন্ডেশন সহিহ আবু দাউদ ১০৮৫, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৫৪৬)

যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ও মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার রহঃ যুহায়র ইবনু নুফায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি শুরাহবিল ইবনুল সিম্‌ত (রহঃ) এর সঙ্গে একটি গ্রামের দিকে রওনা দিলাম, যা সতের বা আঠার মাইলের মাথায় অবস্থিত। তারপর তিনি দু’ রাক’আত সালাত পড়লেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি উমর (রাঃ) কে দেখেছি, তিনি যুল হুলায়ফায় দু’ রাক’আত পড়েছেন। এ বিষয়ে তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যেরূপ করতে দেখেছি, সেরূপই করছি। (সহিহ মুসলিম ১৪৫৭ ইফাঃ)।

ইয়াহিয়া ইবনু ইযায়ীদ আল হুনাঈ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) এর নিকট সালাত কসর করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে তিন মাইল অথবা (রাবী শুবার সন্দেহ) তিনি তিন ফারসাখ পথ অতিক্রম করতেন, তখন দু’রাকআত পড়তেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৪৫৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ সফল শুরু করার পর নিজ এলাকা ত্যাগ করার সাথে সাথেই সফরকারির উপর মুসাফিরের হুকুম কার্যকর হবে। হাদিসের আলোকে বুঝা যায়  নিজ এলাকা ত্যাগ প্রায় তিন মাইল বা ছয় কিলোমিটারের মত দুরে গেলেই সালাত কসর করতে পারবে।

মিনায় সালাত কসর করাঃ

ক। হজ্জের সময় প্রথম দফায় মিনায় সালাত কসর করাঃ

প্রথম দফায় ইহরাম বাঁধার পর হাজিগণ মিনার দিকে রওয়ানা হয়ে যাওয়াই হলো সুন্নাত তরিকা। সূর্য ঢলার পূর্বে হোক আর পরে হোক ৮ জিলহজ্জ মিনায় পৌছাইতে চেষ্টা করা। মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অর্থাৎ ৮ জিলহজ্জ ‘জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা এবং ৯ জিলহজ্জ সকালের ফজর নামাজসহ এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব। মিনায় থাকাকালীন সময়ে মক্কার অবস্থানকারী বা বহিরাগত সকলকে প্রত্যেক নামাজ সুন্নাত মোতাবেক পড়ার নিয়ম হলো, প্রত্যেক ওয়াক্ত (জোহর, আসর ও ইশা) নামাজ উহার নির্দিষ্ট সময়ে কসর পড়া। মাগরিব ও ফজর নামাজ ব্যতিত, কেননা এ দুই নামাজে কসর নেই।

দলিলঃ

১. ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় যুহর ও ফজরের নামায (অর্থাৎ যুহর হতে পরবর্তী ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্তের নামায) আদায় করলেন। তারপর ভোরেই আরাফাতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। (সুনানে তিরমিজি ৮৮০, হাদিসের মান সহিহ)

২. ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমাদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিনায় যুহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামায আদায় করলেন, তারপর ভোরে যাত্রা শুরু করেন আরাফাতের দিকে। (সুনানে তিরমিজি ৮৭৯ হাদিসের মান সহিহ)

খ। দ্বিতীয় দফায় মিনায় সালাত কসর করার যৌক্তিকতাঃ

দ্বিতীয় দফায় ১০ জিলহজ্জ সকালের ফজর সালাত আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় আসা হয়। এ সময় একটাকা ৪/৫ দিন মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। এই সময়ও সালাতের কসর আদায় করেত হবে। তবে অনেকে পূর্ণ সালাতও আদায় করে থাকে। তাদেরও দলিল আছে। দুটি দলিল পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে মিনার সকল সালাত কসরই হবে বলে মনে হবে। সে যা হোক আপনি অধিক যৌক্তিক ও হাদিস সম্মত কসরই আদায় করবেন তবে যদি কেউ কোন দলিলের আলোকে এখানে সালাত কসর না করে তবে তাকে ভতসনা করা যাবে না। তার সাথে বিবাদে জড়ান যাবে না।

দলিলঃ

১. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় দু’রাক’আত সালাত আদায় করেছেন এবং আবূ বকর, ‘উমর (রাঃ) -ও। আর ‘উসমান (রাঃ) তাঁর খিলাফতের প্রথম ভাগেও দু’রাক’আত আদায় করেছেন। (সহিহ বুখারি ১৬৫৫)

২. হারিসা ইব্‌নু ওয়াহব খুযা’য় (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিয়ে মিনাতে দু’ রাক’আত সালাত আদায় করেছেন। এ সময় আমরা আগের তুলনায় সংখ্যায় বেশি ছিলাম এবং অতি নিরাপদে ছিলাম। (সহিহ বুখারি ১৬৫৬)

৩. হারিসা ইবনু ওয়াহব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, পূর্ণ নিরাপত্তা বজায় থাকা অবস্থায় আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সর্বাধিক সংখ্যক লোকসহ মিনায় (চার রাক’আত ফরযের স্থলে) দুই রাক’আত নামায আদায় করেছি। (তিরমিজ ৮৮২, আবূ দাউদ ১৭১৪)

৪. হারিছা ইব্‌ন ওয়াহ্‌ব খুযায়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি একদা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে মিনায় দু’রাকআত সালাত আদায় করলাম অথচ মানুষ তখন অধিক নিরাপদ ছিল। (নাসাঈ ১৪৪৫)

গ। মিনায় মতভেদ করে পুর্ণ সালাত আদায়ঃ

১. আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (মিনায়) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দু’ রাক’আত সালাত আদায় করেছি। আবূ বকর (রাঃ)-এর সাথে দু’ রাক’আত এবং ‘উমর (রাঃ)-এর সাথেও দু’ রাক’আত আদায় করেছি। এরপর তোমাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে [অর্থাৎ ‘উসমান (রাঃ)-এর সময় থেকে চার রাক’আত সালাত আদায় করা শুরু হয়েছে] হায়! যদি চার রাক’আতের পরিবর্তে মকবূল দু’ রাক’আতেই আমর ভাগ্যে জুটত! (সহিহ বুখারী ১৫৫৪ ইফাঃ)

২. আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি (মিনায়) নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে দু’ রাক’আত সালাত আদায় করেছি। আবূ বকর এর সাথে দু’ রাক’আত এবং ‘উমর-এর সাথেও দু’ রাক’আত আদায় করেছি। এরপর তোমাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে (অর্থাৎ ‘উসমান (রাঃ) -এর সময় হতে চার রাক’আত সালাত আদায় করা শুরু হয়েছে) আহা! যদি চার রাক’আতের পরিবর্তে মকবূল দু’ রাক’আতই আমার ভাগ্যে জুটত! (সহিহ বুখারি ১৬৫৭)

৩. উসমান (রাঃ) এই চার রাকআত পুরো আদায় করার বিরোধীতা করে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ)। সহিহ বুখারীতে এসেছেঃ

ইবরাহীম (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবনু ইয়াযীদ (রহঃ) কে বলতে শুনেছি, উসমান ইবনু আফফান (রাঃ) আমাদেরকে নিয়ে মিনায় চার রাকা’আত সালাত আদায় করেছেন। তারপর এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) কে বলা হল, তিনি প্রথমে ‘ইন্না লিল্লাহ্’ পড়লেন। এবপর বললেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মিনায় দু’ রাকা’আত পড়েছি, আবূ বকর (রাঃ) এর সঙ্গে মিনায় দু’রাকা’আত পড়েছি এবং উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এর সঙ্গে মিনায় দু’রাকা’আত পড়েছি। কতই না ভাল হতো যদি চার রাকা’আতের পরিবর্তে দু’রাকা’আত মাকবূল সালাত হতো। (সহীহ বুখারী ১০২৩ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

মন্তব্যঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবাসী ও অন্যান্য স্থানের অধিবাসীদের নিয়ে মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় কসর নামাজ পড়েছিলেন। মক্কাবাসীদের সম্পূর্ণ নামাজ পড়তে নির্দেশ দেন নাই। চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাযগুলো দু’রাকআত করে পড়তে হবে। সে নামাযগুলো হলো যুহর, আসর ও এশা। হজ্জের সময় মিনা, আরাফা ও মুয্দালিফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ভিতরের ও বাইরের সকল লোককে নিয়ে এ সালাতগুলো কসর করে পড়েছিলেন, এটা সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে তিনি মুকীম বা মুসাফিরের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। অর্থাৎ মক্কার লোকদেরকেও চার রাকআত করে পড়তে বলেননি। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ও ফাতাওয়া ইবনে বায)

তবে মনে রাখতে হবে যে, ফজর ও মাগরিবের ফরয নামায অর্থাৎ দুই এবং তিন রাকআত বিশিষ্ট নামায কখনো কসর হয় না। মিনাতে প্রত্যেক সালাত ওয়াক্ত মত আদায় করবেন, জমা করবেন না। অর্থাৎ যুহর-আসর একত্রে এবং মাগরিব-এশা একত্রে পড়বেন না। এমনকি মুসাফির হলেও না। (প্রশ্নোত্তরে হজ্জ ও উমরা, অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম)

কাজেই সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত মিনায় সালাত চার নয় দুই বাকআতই আদায় করা উত্তম। কিন্তু কেউ পূর্ণ সালাত আদায় করলে তাদের গবেষণার উপর ছেড়ে দিতে হবে। তাদের সামনে সহিহ হাদিসগুলি তুলে ধরে বুঝাতে হবে। এ নিয়ে ফতোয়াবাজী করে উম্মতের ঐক্য নষ্ট করা যাবেনা। কারন আমাদের অনুকরনী তৃতীয় খলীফা ওসমান (রাঃ) শেষের দিকে পূর্ণ সালাত আদায় করেছেন বলে প্রমানিত যদিও আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) তার বিরোধীতা করেছেন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ প্রথম কিস্তি

Leave a comment