মসজিদে নব্বীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মসজিদে নব্বীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

পবিত্র মদিনা মুসলিম উম্মাহর কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ শহর। মুসলিম হৃদয়ে এই নগরীর প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা। কেননা এখানেই শুয়ে আছেন প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পবিত্র এই ভূমিতেই ইসলামের উত্থান হয়েছিল এবং এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় সাহাবী আবু বকর (রাঃ) কে নিয়ে মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। উমর (রাঃ) এর খিলাফতকালে সে স্মৃতির উপর ভিত্তি করে ইসলামি বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠিত হয় যা হিজরী সাল নামে পরিচিতি লাভ করে। ঐতিহাসিকভাবে মদিনা একটু গুরুত্বপূর্ণ নগরী কারণ রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পরে মদিনায় বসবাস করেছেন। রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শেষ ১০ বছর এই নগরীতেই কাটিয়েছেন। মূলত আল্লাহ এই নগরীকে ইসলামের জন্য কবুল করেছিলেন বিধায় এই নগরীটি মুনলিমদের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধার।  

মদিনা সৌদি আরবের হেজাজ অঞ্চলের একটি শহর এবং মদিনা প্রদেশের রাজধানী। এটি ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র শহর, যেখানে মুসলমানদের শেষ নবী মুহাম্মাদের কবর নানান ঐতিহাসিক কারণে মদিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের প্রাচীনতম ও ঐতিহাসিক তিনটি মসজিদ যেমন মসজিদে নববী, কুবা মসজিদ (যেটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ) এবং মসজিদ আল কিবলাতাইন (যে মসজিদে মুসলমানদের কিবলা পরিবর্তন হয়েছিল) অবস্থিত।

ইসলামের ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থে মদিনার অনেক নাম পাওয়া যায়, যা তার সম্মান ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। মদিনা কে সরকারী ভাবে (المدينة المنورة) আল-মদিনা আল-মুনাওয়ারাহ‎‎ বলা হয়। তবে পৃথিবীর সকলের নিকট মদিনা হিসেবে পরিচিত। অনারবগন আল-মদিনা আল-মুনাওয়ারাহ‎‎ কে মদিনা হিসাবেই উল্লেখ করে থাকে। আল্লামা সামহুদি মদিনার ৯৪ টি নাম উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ‘মদিনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে মদিনা শব্দটি কমপক্ষে ১৩ বার এসেছে, যার মধ্যে সরাসরি চারটি স্থানে মদিনা নগরীর কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ সুরা তাওবা ৯:১০১ ও ৯:১২০, সুরা আহজাব ৩৩:৬০ এবং সুরা মুনাফিকুন ৬৩:৮। ইহা ছাড়া বাকি সকল স্থানে মদিনা শব্দের অর্ত শহর বা নগর হিসাবের ব্যবহৃত হয়েছে। তবে অসংখ্যা হাদিসে মদিনা শহরের নামটি বার বার ব্যবহার হয়েছে। মদিনার আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম ‘তাইবাহ”।

যাইদ ইবনু সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ “তোমাদের কি হল যে, মুনাফিক্বদের প্রসঙ্গে তোমরা দুই দল হয়ে গেলে…..”। (সূরা নিসা:৮৮) আয়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উহূদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীদের (মুসলিম বাহিনীর) মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) ফিরে আসে। তাদের প্রসঙ্গে সাহাবীগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে যান। এক দলের বক্তব্য ছিল, তাদেরকে হত্যা কর। অন্য দলের মত ছিল, তাদেরকে হত্যার প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় (অনুবাদ) : “তোমাদের কি হল যে, মুনাফিক্বদের ব্যাপারে তোমরা দুই দল হয়ে গেলে….। (সুরা নিসা ৪:৮৮)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মাদীনা হল তাইবাহ-পবিত্র নগরী। তা ময়লা আবর্জনা (অপবিত্রতা মুনাফিক্বী) এমনভাবে দূর করে দেয় যেভাবে আগুন লোহার ময়লা দূর করে দেয়। (সহিহ বুখারি ৪৫৮৯, তিরমিজি ৩০২৮)

মদিনার উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি নাম হলো আদ-দার, আল-হাবিবা, দারুল হিজরা, দারুল ফাতহ ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার আগে এ নগরীর নাম ছিল ইয়াসরিব। নুহ আলাইহিস সালাম এর এক ছেলের নাম ছিল ইয়াসরিব। তাঁর বংশধরদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তিনি মদিনায় এসে বসবাস করেন। তাঁর নামানুসারে এ শহরের নাম ইয়াসরিব রাখা হয়। ইয়াসরিব অর্থ অভিযুক্ত করা বা ধমক দেওয়া। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের পর এ নগরীর নাম রাখা হয় মদিনা। আগেই উল্লেখ করেছি, মদিনা শব্দের অর্থ শহর। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইয়াসরিবে আগমনে স্থানীয় সব ধর্মবিশ্বাসের এবং সব গোত্রের সব অধিবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে শান্তির দূত ও অভিভাবক হিসেবে সানন্দে মেনে নেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে আনন্দে উদ্বেলিত জনতা নিজ শহরের নাম বদলে ফেলে রাখলেন মাদিনাতুন নবী, অর্থাৎ নবীর শহর। তখন থেকেই ইয়াসরিব হয়ে যায় মদিনা।

হিজরত করে মদিনা পৌছানোর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রথম কাজ হল মসজিদে নাবাবীর নির্মাণ। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসের শেষ অংশে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, ইবনু শিহাব (রহ.) বলেন, ‘উরওয়াহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) আমাকে বলেছেন, পথিমধ্যে যুবায়রের সাথে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাত হয়। তিনি মুসলমানদের একটি বণিক কাফেলার সাথে সিরিয়া হতে ফিরছিলেন। তখন যুবায়র (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বাকর (রাঃ)-কে সাদা রঙ্গের পোশাক দান করলেন। এদিকে মদিনায় মুসলিমগণ শুনলেন যে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা হতে মদিনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। তাই তাঁরা প্রতিদিন সকালে মদিনার হার্রা পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতেন থাকেন, দুপুরে রোদ প্রখর হলে তারা ঘরে ফিরে আসতেন। একদিন তারা পূর্বাপেক্ষা বেশি সময় প্রতীক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় এক ইয়াহূদী একটি টিলায় আরোহণ করে এদিক ওদিক কি যেন দেখছিল। তখন সে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথীসঙ্গীদেরকে সাদা পোশাক পরা অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভূমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল। ইয়াহূদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চস্বরে চীৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এইতো সে ভাগ্যবান ব্যক্তি- যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলিমগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে মদিনার হাররার উপকন্ঠে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনি সকলকে নিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে বনু ‘আমর ইবনু ‘আউফ গোত্রে অবতরণ করলেন। এদিনটি ছিল রবি‘উল আউয়াল মাসের সোমবার। আবূ বাকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। আনসারদের মধ্য হতে যাঁরা এ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেননি তাঁরা আবূ বাকর (রাঃ)-কে সালাম করতে লাগলেন, তারপর যখন রৌদ্রের উত্তাপ নাবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর পড়তে লাগল এবং আবূ বাকর (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তাঁর চাদর দিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপর ছায়া করে দিলেন তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে চিনতে পারল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু ‘আমার ইবনু ‘আউফ গোত্রে দশদিনের চেয়ে কিছু বেশি সময় কাটালেন এবং সে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা তাক্ওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত! রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে সালাত আদায় করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উঁনীতে আরোহণ করে রওয়ানা হলেন। লোকেরাও তাঁর সঙ্গে চলতে লাগলেন। মদিনায় মসজিদে নাবাবীর স্থানে পৌঁছে উটনীটি বসে পড়ল। সে সময় ঐ স্থানে কতিপয় মুসলিম সালাত আদায় করতেন। এ জায়গাটি ছিল আসআদ ইবনু যুরারাহ এর আশ্রয়ে পালিত সাহল ও সুহায়েল নামক দু’জন ইয়াতীম বালকের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে উটনীটি যখন এ স্থানে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ্, এ স্থানটিই হবে আবাসস্থল। তারপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বালক দু’টিকে ডেকে পাঠালেন এবং মাসজিদ তৈরির জন্য তাদের কাছে জায়গাটি মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয়ের আলোচনা করলেন। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! বরং এটি আমরা আপনার জন্য বিনামূল্যে দিচ্ছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছ হতে বিনামূল্যে গ্রহণে অসম্মতি জানালেন এবং অবশেষে স্থানটি তাদের হতে খরীদ করে নিলেন। তারপর সেই স্থানে তিনি মাসজিদ তৈরি করলেন। রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসজিদ নির্মাণকালে সহাবা কেরামের সঙ্গে ইট বহন করছিলেন এবং ইট বহনের সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেনঃ

এ বোঝা খায়বারের বোঝা বহন নয়।          

ইয়া রব, এর ভোঝা অত্যন্ত পুণ্যময় ও অতি পবিত্র।

তিনি আরো বলছিলেন, হে আল্লাহ্! পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান।              

সুতরাং আনসার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।

এক মুসলিম কবির কবিতা আবৃত্তি করেন, যার নাম আমাকে বলা হয়নি। ইবনু শিহাব (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এছাড়া অপর কোন পূর্ণ কবিতা পাঠ করছেন বলে, কোন কথা আমার কাছে পৌঁছেনি। (সহিহ বুখারি ৩৯০৫)

সহিহ হাদিসের মাধ্যমে জানা যায় যে, মদিনা মসজিদের নির্মাণের জন্য নাজ্জার গোত্রের সাহল ও সোহাইল নামক দু’জন বালকের নিকট হতে জমি ক্রয় করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন। অতঃপর তার আশপাশের কবরগুলি এবং বাড়ী-ঘরের ভগ্নস্তূপসহ স্থানটি সমতল করলেন। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলি উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়। ঐ সময় ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা ছিল মদীনা হতে উত্তর দিকে। তিনটি দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলি পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলি খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর ডালপাতার এবং বালু ও ছোট কাঁকর বিছানো মেঝে-এই নিয়ে তৈরী হল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৭ হাত আয়তন বিশিষ্ট। পরবর্তীতে মদিনা মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন প্রতিটি কোণ হতে তীর নিক্ষেপ করে যে পরিমাণ জায়গা পাওয়া গেল তা হলো একটি ক্ষেত্র। বর্গের প্রতিটি বাহুর পরিমাণ হয় ১০০ হাত বা ৫৬ গজ। অর্থাত্ মদিনা মসজিদের আয়তন হল ১০০X১০০ হাত বা ৫৬X৫৬ গজ। ইবনে সাদ ও দিয়ার বকরী বলেন, মসজিদের ভিটি ও দেয়ালের নিম্নভাগ ৩ হাত পর্যন্ত প্রস্তর নির্মিত ছিল। প্রথম পর্যায়ে মদিনা মসজিদ রৌদ্র শুষ্ক ইট দ্বারা নির্মিত হয়। এই রৌদ্র শুষ্ক ইট বাকী আল-খাবখাবা উপত্যকা হতে আনিত কাদা দ্বারা তৈরি হয়েছিল। তখন মদিনা মসজিদের দেয়াল ছিল ৭ হাত উঁচু। ছাদকে শক্তিশালী ও মজবুত রাখার জন্য মদিনা মসজিদের ৩৬টি খেজুর গাছকে স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। মসজিদের ছাদ নির্মিত হয়েছিল খেজুর পাতা দিয়ে। ছাদকে সুন্দর করার জন্য, রৌদ্র ও বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য খেজুর পাতার ওপর কাঁদামাটির আস্তরণ দেয়া হয়েছিল। ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হলে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। কেননা মক্কা হল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে। এ সময় উত্তর দেওয়ালের বাইরে একটা খেজুর পাতার ছাপড়া দেওয়া হয়। আরবীতে বারান্দা বা চাতালকে ‘ছুফফাহ’ বলা হয়। উক্ত ছুফফাহ’তে নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় মুসলমানদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া হত। পরবর্তীতে তাদের কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা চলে যেতেন। বারান্দায় বা চাতালে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আছহাবে ছুফফাহ’ (أصحاب الصفة) নামে খ্যাতি লাভ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর আবু বক্কর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এর সময় এই মসজদি আর সংস্কার হয়নি। পরবর্তিতে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এবং ওসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর এর যুগে মসজিদের সম্প্রসারণ ঘটে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পর হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদে নব্বীর সম্প্রসারণ করেন। তিনি মসজিদটি উত্তর দিকে ৩০ হাত, দক্ষিণ দিকে ১০ হাত, পশ্চিম দিকে ২০ হাত সম্প্রসারণ করেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এর সময় মসজিদের পরিমাণ দাঁড়ায় উত্তর-দক্ষিণে ১৪০ হাত, পূর্ব-পশ্চিমে ১২০ হাত। হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর এর সময় ৬৪৬-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে খেজুরপাতার পরিবর্তে ছাদে সেগুণ কাঠ ব্যবহার করা হয়। ছাদের আকার দাঁড়ায় ১৬০X১৩০ হাত। এ সময় সম্প্রসারিত হয়ে মসজিদের আকার দাঁড়ায় উত্তর দক্ষিণে ১৬০ হাত এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫০ হাত।

উমর ইবনে আবদুল আজীজ ৮৭ হিজরীতে তিনি মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল মসজিদে নববী পুনঃনির্মাণ ও ইহার সৌন্দর্য বৃদ্ধি। এ বিরাট কীর্তি তিনি মদীনায় শুভাগমন করার এক বছর পর অর্থাৎ ৮৮ হিজরীর সফর মাসে শুরু করেন এবং ৮৯ হিজরীতে শেষ করেন। তবে অনেকের মতে ইহা শেষ হয়েছিল ৯১ হিজরীতে।। ঐতিহাসিকগণ খলিফা ওয়ালীদকে মসজিদের নির্মাতা বলে উল্লেখ করেছেন, তা যথার্থই করেছেন। খলিফা ওয়ালীগ এ হিসেবেই এর নির্মাতা যেহেতু, তিনি এ মহান কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি স্বর্ণ-রৌপ্য গাড়ী বোঝাই করে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট প্রেরণ করেছিলেন।

পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন মুসলিম শাসকের আমলে মসজিদের উন্নয়ন ও সম্প্রসারন ঘটে। খলিফা আল ওয়ালিদের সময় মদিনা মসজিদটি আধুনিক ইমারতে পরিণত হয়। ওয়ালিদ ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে মসজিদে নববীকে সাজিয়ে তোলেন। তাঁর সময় মসজিদে নববীর পরিমাপ দাঁড়ায় ২০০X২০০ হাত। ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সর্ব প্রথম মদিনা মসজিদের চারকোণে ৪টি মিনার নির্মাণ করেন আল ওয়ালিদ। তখন প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ছিল ৫০ হাত এবং প্রস্থে ছিল ৮ হাত।

খলিফা মাহদী ৭৭৫-৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি সম্প্রসারণ করেন ৩০০ X ৩০০ হাত। আর মামলুক সুলতান কয়েত-বে মসজিদে নববীতে গম্বুজ প্রতিষ্ঠিত করেন। এতে গম্বুজ করা হয় ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে। গম্বুজ সবুজ রং-এর আস্তরণ দিয়েছিলেন ওসমানী সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে।

বিশালকার মসজিদে নববীর সমস্ত রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব সৌদি রাজ পরিবারের। তাই বর্তমান আধুনিকায়নে মসজিদ-এ নববীর রূপদান করেন সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ। তিনি এর পরিকল্পনা করেন  ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দে।  সৌদি সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মসজিদের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। ১৯৫১ ইং সালে বাদশাহ আব্দুল আযীয মসজিদের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম দিকের আশেপাশের ঘর-বাড়ি খরিদ করে ভেঙে ফেলেন। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১২৮ মিটার ও প্রস্থ ৯১ মিটার করা হয় এবং আয়তন ৬২৪৬ বর্গ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১৬৩২৬ বর্গমিটার করা হয়। মসজিদের মেঝেতে ঠান্ডা মার্বেল পাথর লাগানো হয়। মসজিদের চার কোনায় ৭২ মিটার উচুঁ চারটি মিনার তৈরি করা হয়। এ সম্প্রসারণে ৫ কোটি রিয়াল খরচ হয় ও কাজ শেষ হয় ১৯৫৫ সালে।

বাদশাহ ফয়সাল এর আমলে ক্রমবর্ধমান হাজীদের জায়গার সংকুলান করার জন্য পশ্চিম দিকের জায়গা বৃদ্ধি করা হয় যার আয়তন ছিল ৩৫০০০ বর্গমিটার।

সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে বাদশাহ ফাহাদ ইবন আব্দুল আযীয কর্তৃক মসজিদের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন ও বিস্তার সাধিত হয়। পূর্ববর্তী মসজিদের আয়তনের তুলনায় নয় গুণ আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। মসজিদকে এত সুন্দর করা হয় যা মুসলিমদের অন্তর জয় করে। মসজিদের ছাদ এমনভাবে বানানো হয়েছে যে প্রয়োজনে দ্বিতল বানানো সম্ভব হবে। মূল গ্রাউণ্ড ফ্লোরের আয়তন ৮২০০০ বর্গমিটার হয়। মসজিদের চারপাশে ২৩৫০০০ বর্গমিটার খোলা চত্বরে সাদা শীতল মার্বেল পাথর বসানো হয়। এর ফলে মসজিদের ভিতরে ২৬৮০০০ মুসল্লি এবং মসজিদের বাইরের চত্বরে ৪৩০০০০ মুসল্লির সালাত আদায়ের জায়গা হয়। সম্পূর্ণ মসজিদে এসি, আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াশরুম ও কার পার্কিং এর ব্যবস্থা করা হয়। মসজিদের কাজ শুরু হয় ১৯৮৫ সালে আর শেষ হয় ১৯৯৪ সালে।

মন্তব্যঃ হজ্জ পরিসমাপ্তির পর প্রত্যকে হাজ্জিকে মদীনা যেতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা ইসলামি শরীয়তে নাই। হজ্জের সাথে মদীনা শরীফ যিয়ারত করাও অপরিহার্য নয়। মদীনার যিয়ারত করা একটি স্বতন্ত্র সুন্নত। অধিকাংশ হাজ্জি মক্কা মনীদার বাহির থেকে হজ্জ আদায়ের জন্য আসেন। তাদের জন্য এই সময় মদীনা সফর করা একটি সুযোগ আসে। আলাদা আলাদাভাবে দুজায়গা সফরের লক্ষ্যে দুবার আসা খুবই কষ্টকর। কষ্ট হলেও অনেকের আবার আর্থিকভাবেও সমর্থবান নয়। বিধায় হজ্জের সফরের কারনে এক সঙ্গেই তারা দুজায়গায় সফর করেন। তাই বিষয়টি অন্যভাবে বিবেচনা না করে, হজ্জ পরিসমাপ্তির পর মদীনা জিয়ারত করা যেতে পারে। তাহলে এতটুকু ষ্পষ্ট যে, হজ্জের সফর হোক আর অন্য সময়ে হোক মদীনা যিয়ারত করা যেতেই পাবে।

কোন নিয়তে মদীনা যাবেন?

এই সম্পর্কে দুটি প্রশিদ্ধ মত পাওয়া যায়। এক দল বলেছেন, মদীনা সফর মানে মসজিদে নব্বী সফরের নিয়ত করতে হবে। আরেক দল বলেছেন না, কবর বা রওজা মোবারক যিয়ারতের নিয়তে সফর করতে হবে। যারা কবর বা রওজা মোবারক যিয়ারতের নিয়তে মদীনা যাবার পক্ষে তারা শুধু ব্রেলভী বা রিজভী নয়, তারা আমাদের দেওবন্দী আলেমও। এই মাসায়েলে তারা দুটি দলই এতটাই অগ্রগন্য যে এ সম্পর্কে দলিল দ্বারা প্রমান করার দরকার নাই। তাদের আলেমদের জিজ্ঞাসা করলেই এর পক্ষে মতমত প্রদান করে। তারপরও পাঠদের বুঝাতে দুটি রেফারেন্স দিলাম।

দেওবন্দীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারত ওয়াজিব বা এর কাছাকাছি মনে করে।

ক। ‘আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ এ বর্ণিত মক্কা-মদিনার আলমগন প্রশ্ন করে ছিল। (১ম প্রশ্ন) “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সম্পর্কে আপনাদের মত কি?

উত্তরে তারা লিখেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে জিয়ারত আমরা ও আমাদের পূবর্সূরীহনের মতে আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভ, অতিশয় পূণ্য লাভ উন্নত স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মাধ্যম। বরং উম্মতের জন্য তা ওয়াজিব না হলেও তার কাছা কাছি বিষয়।

রওদ্বায়ে পাক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও এ উদ্দেশ্যে ব্যয় করা সৌভাগ্যের বিষয়। কেউ যদি রওজা পাক যিয়ারতের নিয়তের সাথে সাথে মসজিদে নব্বীও তত্সংশ্লষ্ট মুবারক জাযগা সমুহের নিয়ত কর তাতে কোন আপত্তি নেই। (‘আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ খলিল আহম্মদ সাহরনাপুলী, ভারত, পৃষ্ঠা নম্বর ২৪)।

খ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারতে যাওয়ার ব্যপারে দেওবন্দ আলেদের অরস্থান একেবারে স্পষ্ট। “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” বইটিতে একটা অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন “রওযায়ে আতহার যিয়ারতে যাওয়ার নিয়ত প্রসঙ্গে”।  লেখক এখানে সালাফি আলেম ইবনে তাইমিয়া (র) এর আনিত অভিযোগ খন্ডন করার নিমিত্তে তার (ইবনে তাইমিয়া) উল্লেখিত হাদিসের (তিনটি স্থান ব্যতিত নেকির উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না) ব্যাখ্যা ও  কয়েক জন বিসিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদের মতামত তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারত জন্য সফর করা নেকির কাজ। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, পৃষ্ঠা – ৪৬৭)।

পক্ষান্তরে সালাফিরা কবর জিয়ারত কে সুন্নাত মনে করে কিন্তু কবর জিয়ারত উদ্দেশ্যে সফর করা কে নাজায়িয মনে করে থাকে।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন, যদি হাজীসাহেব হজ্জের আগে অথবা পরে মসজিদে নববি যিয়ারত করতে চান তাহলে তিনি মসজিদে নববি যিয়ারত করার নিয়ত করবেন, কবর নয়। কারণ নেকি হাছিল করার জন্য কোন কবরকে উদ্দেশ্য করে সফর করা জায়েয নয়। বরং সফর করা যায় তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে। সেগুলো হচ্ছে- মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদে আকসা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে তিনি বলেন, “তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করে সফর করা যাবে না, মসজিদে হারাম, আমার মসজিদ ও মসজিদে আকসা। (সহিহ বুখারি ১১৮৯ ও সহিহ মুসলিম ১৩৯৭)

সালাফি আলেমদের মতে, মসজিদে নববী যিয়ারত করা সুন্নত ওয়াজিব নয়। হজ্জের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটি হজ্জকে পূর্ণ করবে এমন কিছু নয়। মসজিদে নববীর যিয়ারতকে হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত করে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে এর সবগুলো মাওজু (বানোয়াট) ও মিথ্যা। যে ব্যক্তি তাঁর মদিনার সফরের মাধ্যমে মসজিদে নববী যিয়ারত ও মসজিদে নববীতে নামায পড়ার উদ্দেশ্য করবে তার উদ্দেশ্য পূণ্যময়, তাঁর আমল সওয়াবসম্ভাব্য। আর যে ব্যক্তির সফরের উদ্দেশ্য কবর যিয়ারত ও কবর-ওয়ালাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা ছাড়া অন্য কিছু নয় তার উদ্দেশ্য হারাম, তার কর্ম মন্দ।

দলিলঃ

১. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন গন্তব্যে সফর করা যাবে না। মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ ও মসজিদে আকসা।”(সহিহ বুখারী ১১৮৯ ও সহিহ মুসলিম ১৩৯৭, আবু দাইদ ২০৩৩)

২. জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “সফর করার সবচেয়ে উত্তম গন্তব্য হচ্ছে- আমার এ মসজিদ ও বাইতুল আতিক (কাবা)”। (মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৫০, আলবানী তাঁর ‘আল-সিলসিলাতুস সহিহা’ গ্রন্থে ১৬৪৮) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)

মন্তব্যঃ ইমামগণ এবং অধিকাংশ শরীয়ত বিশেষজ্ঞ একমত পোষণ করেছেন যে, সফরকারির সফরের উদ্দেশ্য যদি শুধু নবীর কবর যিয়ারত হয়, তাঁর মসজিদে সালাত আদায় করা না হয় তবে তা  শরীয়ত সম্মত নয়। (ইবন তাইমিয়া, আল-ফাতাওয়াল কুবরা : ৫/১৪৯)

ইবন তাইমিয়া রহ. আরো বলেন, ‘জেনে রাখো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারত বহু ইবাদত থেকে মর্যাদাপূর্ণ, অনেক নফল কর্ম থেকে উত্তম। কিন্তু সফরকারীর জন্য শ্রেয় হচ্ছে, সে মসজিদে নববী যিয়ারতের নিয়ত করবে। অতপর সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারত করবে এবং তাঁর ওপর সালাত ও সালাম পেশ করবে। (আল-ফুরকান বাইনা আউলিয়াইর রহমান ওয়া আউলিয়ায়িশ শয়তান : ১/৩০৭)

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘জাহেলী যুগের মানুষেরা তাদের ধারণামত মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহকে উদ্দেশ্য করে তা যিয়ারত করত এবং তার মাধ্যমে (তাদের ধারণামত) বরকত লাভ করত। এতে রয়েছে সত্যচ্যুতি, বিকৃতি ও ফাসাদ যা কারো অজানা নয়। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ফাসাদ চিরতরে বন্ধ করে দেন, যাতে শা‘আয়ের (আল্লাহর নিদর্শন এবং তাঁর ইবাদতের স্থানসমূহ) নয় এমন বিষয়গুলো শা‘আয়ের-এর অন্তর্ভুক্ত না হয় এবং যাতে এটা গায়রুল্লাহর ইবাদতের মাধ্যম না হয়। আমার মতে সঠিক কথা হচ্ছে, কবর ও আল্লাহর যে কোন ওলীর ইবাদতের স্থান, তূর পাহাড় ইত্যাদি সবকিছু উপরোক্ত হাদীসের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ : ১/৪০৮)

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘হ্যাঁ, সফকারির জন্য মুস্তাহাব হচ্ছে, মসজিদে নববী যিয়ারতের নিয়তে সফর করা। আর এটা নৈকট্য লাভের অন্যতম বড় উপায়। অতপর সে যখন মদীনা পৌঁছবে, তার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবর যিয়ারত করাও মুস্তাহাব। কেননা তখন সে মদীনা নগরীতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর তখন নগরীতে অবস্থিত কবরগুলো যিয়ারত করা অবস্থানকারীর ক্ষেত্রে মুস্তাহাব। (ফায়যুল বারী : ৪/৪৩।

সুতরাং মসজিদে নববী যিয়ারতের নিয়তে মদীনা যিয়ারত করতে হবে। কবর যিয়ারতের নিয়তে মদীনা যিয়ারত হলে, তা সহীহ হবে না। মনে রাখবেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর কেন্দ্রিক সকল উৎসব জোরালোভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর আমার কবরকে তোমরা উৎসবের উপলক্ষ্য বানিও না। (আবূ দাউদ : ১৭৪৬)

অর্থাৎ আমার কবর-কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করো না।’ এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাও শামিল।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “মসজিদে নব্বীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Leave a comment