সিয়াম কাদের উপর ফরজ আর কাদের উপর ফরজ নয়

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সিয়াম বা সাওম (الصوم বা الصيام) আরবি শব্দ যার  আভিধানিক অর্থ হলো সাধারণভাবে বিরত থাকা। অর্থাৎ- সহবাস, কথা বলা, খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা।  আল্লাহ তা‘আলা মারইয়াম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেনঃ

 فَكُلِى وَٱشۡرَبِى وَقَرِّى عَيۡنً۬ا‌ۖ فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ ٱلۡبَشَرِ أَحَدً۬ا فَقُولِىٓ إِنِّى نَذَرۡتُ لِلرَّحۡمَـٰنِ صَوۡمً۬ا فَلَنۡ أُڪَلِّمَ ٱلۡيَوۡمَ إِنسِيًّ۬ا (٢٦)

অর্থঃ তারপর তুমি খাও, পান করো এবং নিজের চোখ জুড়াও৷ তারপর যদি তুমি মানুষের দেখা পাও তাহলে তাকে বলে দাও, আমি করুণাময়ের জন্য সাওম এর (কথা বলা থেকে বিরত থাকার) মানত করেছি, তাই আজ আমি কারোর সাথে কথা বলবো না”৷  (সূরা মারইয়াম ১৯:২৬)

صيام ‘‘সিয়াম’’-এর পরিভাষায় ইমাম নাবাবী ও হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেনঃ নির্দিষ্ট শর্তের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজ থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিরত থাকাকে সিয়াম বলে। ইমাম ত্বীবী বলেনঃ এমন কিছু গুণ যা ইতিবাচক এবং যা ‘আমাল করা জায়িয তা ব্যতিরেকে সকল নিষিদ্ধ কাজ হারাম। আমীর ইয়ামানী বলেনঃ সিয়াম হল নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকা। আর তা হলো খাওয়া, পান করা ও সহবাস।

সিয়াম বা সাওম এর হুকুম

 সিয়াম শুরুর কথাঃ

ইসলামের শুরু দিকে সিয়াম ফরজ ছিলনা। তা সত্বেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এবং সাহাবিগণ সিয়াম পালন করতেন। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছেঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরাইশগণ জাহিলী যুগে আশূরার দিন সিয়াম পালন করত। রাসুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ দিন সাওম পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় হিজরত করলেন, তখনও তিনি আশূরার সাওম পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর যখন রমযানের সিয়ামকে ফরয করা হল, তখন যার ইচ্ছা সে আশূরার সাওম পালন করত আর যার ইচ্ছা সে তা ছেড়ে দিত। (সহীহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৫০৮ ইঃ ফাঃ)

অর্থাৎ রমজান মাসের সিয়াম ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এবং সাহাবিগণ (রাঃ) আশুরার সিয়াম পালন করতেন। কিন্ত তাদের সিয়াসের ধরন ছিল আলাদা। তখন সিয়ামের নিয়ম সম্বলিত কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল না। সাহাবিগন (রাঃ) সাওম থাকা কালিন সময়ে রাত্রে স্ত্রীদের সাথে রাত্রিবাস করাকে জায়েয মনে করত না। তারা রাত্রিকালে স্ত্রীর সাথে রাত্রিবাস করাকে অবৈধ মনে করতো। সুস্পষ্ট বিধান না থাকার কারনে, তারা এই কাজটিকে অবৈধ বা অপছন্দনীয় ধারনা করার পরও অনেক সময় নিজেদের স্ত্রীদের কাছে চলে যেতো। এটা যেন নিজের বিবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা মত। যার ফলে তাদের মধ্যে একটি অপরাধ ও পাপ মনোবৃত্তির লালনের আশংকা দেখা দিয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ প্রথম তাদেরকে বিবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্ক সতর্ক করে দিয়েছেন নাজিল করলেন কুরআনের আয়াত। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُواْ مَا كَتَبَ اللّهُ لَكُمْ وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

অর্থঃ রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্নপ্রতারণা করছিলে। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরন কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সুরা বাকারা ২:১৮৭)।

সহিহ বুখারীতে এ সম্পর্কে একটি হাদিস উল্লেখ আছে। হাদিসটি হলঃ

বারা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগন অবস্থা এই ছিল যে, যদি তাঁদের কেউ সাওম পালন করতেন, ইফতারের সময় হলে ইফতার না করে ঘুমিয়ে গেলে সে রাতে এবং পরের সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই খেতেন না। কায়স ইবনু সিরমা আনসারী (রাঃ) সাওম পালন করেছিলেন। ইফতারের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট কিছু খাবার আছে কি? তিনি বললেন, না, তবে আমি যাচ্ছি, দেখি আপনার জন্য কিছু তালাশ করে আনি। তিনি কাজে রত থাকতেন। তাই ঘুমে তাঁর চোখ ভিজে গেল। এরপর স্ত্রী এসে যখন তাকে দেখলেন, তখন তাঁকে বললেন, হায়, তুমি বঞ্ছিত হয়ে গেলে! পরদিন দুপুর হলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। এ ঘটনাটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উল্লেখ করা হলে এ আয়াতটি নাযিল হয়ঃ “সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীসম্ভোগ বৈধ হয়েছে”। (২:১৮৭)। সিয়ামের রাত্রে তোমাদের স্ত্রী সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে। এ হুকুম সমন্ধে অবহিত হয়ে সাহাবীগন খুবই আনন্দিত হলেন। এরপর নাযিল হলঃ তোমরা পানাহার কর যতক্ষন রাতের কাল রেখা হতে (ভোরের) সাদা রেখা স্পষ্ট তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়, (২:১৮৭)। (সহীহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৭৯৪; ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

সিয়ামের বিধান পর্যায়ক্রমে নাজিল হয়ঃ

অন্যান্য বিধানের মতো সিয়ামও পর্যায়ক্রমে ফরয হয়। শুরুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলামনদেরকে মাত্র প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ রোযা ফরয ছিল না। যেমনঃ মুসনাদে আহমদের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, সিয়ামের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে প্রত্যেক মাসে তিন দিন সওম পালন আরম্ভ করেন। এবং “তিনি নয় মাস তথা রবিউল আউয়াল থেকে রমযান পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে তিন দিন ও আশুরার সিয়াম পালন করেন। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীতে রমযান মাসের রোযার এই বিধান কুরআনে নাযিল হয়। তবে এতে এতটুকুন সুযোগ দেয়া হয়, রোযার কষ্ট বরদাশত করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যারা রোযা রাখবেন না তারা প্রত্যেক রোযার বদলে একজন মিসকিনকে আহার করাবে। তখন যার ইচ্ছা সিয়াম পালন করত, যার ইচ্ছা ইফতার করত ও প্রত্যেক দিনের বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্য দিত। তার প্রমান মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَن تَصُومُواْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

অর্থঃ গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। (সুরা বাকারা ২:১৮৪)।

অতপর, তৃতীয় ধাপের বিধানটি নাযীল হয়। এতে পূর্বে প্রদত্ত সাধারণ সুযোগ যান ইচ্ছা সিয়াম ভাঙ্গার সুযোগটি বাতিল করে দেয়া হয়। কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তি, মুসাফির, গর্ভবর্তী মহিলা, দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা এবং এমন সব বৃদ্ধ যাদের সিয়াম পালনের ক্ষমতা নেই তাদের জন্য এ সুযোগটি আগের মতোই বহাল রাখা হয়। অক্ষমতা দূর হয়ে গেলে রমযানের যে ক’টি সিয়াম আদায় করতে তারা অক্ষম ছিল সে কটি গুনে গুরে হিসাব করে পূরণ করে দেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশ সম্বলিত আয়াতটি নিম্মে দেয়া হল। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

আবু দাউদের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়। এরপর থেকে যে রমযান পায়, তার ওপর সওম ওয়াজিব হয়, মুসাফির সফর শেষে কাযা করবে, যারা বৃদ্ধ- সওম পালনে অক্ষম, তাদের ব্যাপারে ফিদিয়া তথা খাদ্য দান বহাল থাকে”। (আবু দাউদ: ৫০৭, আহমদ: ৫/২৪৬, তাবরানি ফিল কাবির: ২০/১৩২, হাদিস নং: (২৭০), হাকেম: ২/৩০১)। 

এভাবে মহান আল্লাহ তা‘আলা মুকিম ও সুস্থ ব্যক্তির উপর সিয়াম জরুরী করে দেন, অসুস্থ ও মুসাফিরকে তাতে শিথিলতা প্রদান করেন। আর যে সিয়াম পালনে অক্ষম, তার ব্যাপারে খাদ্যদান বহাল থাকে।

ইসলামি শরিয়তে সিয়ামের বিধান কি?

ইসলামি শরিয়তে সিয়ামের বিধান ফরজ। তার প্রমান মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

 يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡڪُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِڪُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ (١٨٣) 

অর্থঃ হে ইমানদারগন, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা ২:১৮৩)।

মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

 شَہۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدً۬ى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَـٰتٍ۬ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِ‌ۚ فَمَن شَہِدَ مِنكُمُ ٱلشَّہۡرَ فَلۡيَصُمۡهُ‌ۖ  (١٨٥) 

অর্থঃ রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। (সূরা বাকারা ২:১৮৫)।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ঘোসনা, “হে ইমানদারগন, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। এবং দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় রমজানের সিয়াম পালন করা ফরজ। সিয়াম ফরজ হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা একটি ঘোসনাই যথেষ্ট।

মহান আল্লাহ তায়ালা আদেশকৃত ফরজ ইবাদাত সিয়াম পালনের বিস্তারিত বিধীবিধাণ আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবন দশায় শিক্ষা প্রদান করে গেছেন। তার প্রদত্ত কথা দ্বারাও সিয়াম ফরজ হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়। এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস উল্লেখ করব যাতে যে কেউ সহজে বুঝতে পারে যে, সিয়াম ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন এবং সকল মুসলিমের উপর তা আদায় করা ফরজ। যেমনঃ

 ১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর রাখা হয়েছে, এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়েম করা। জাকাত প্রদান করা। রমজানের রোজা রাখা। এবং যে তার সামর্থ রাখে তার জন্য বাইতুল্লাহর হজ্জ করা।  (হাদিসের মান সহিহঃ বুখারি – ৮; মুসলিম – ১৬)।

২। তালহা ইবনু ‘উবায়দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, এলোমেলো চুলসহ একজন গ্রাম্য আরব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলেন। তারপর বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে বলুন, আল্লাহ তা’আলা আমার উপর কত সালাত ফরজ করেছেন? তিনি বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, তবে তুমি যদি কিছু নফল আদায় কর তা স্বতন্ত্র কথা। এরপর তিনি বললেন, বলুন, আমার উপর কত সিয়াম আল্লাহ তা’আলা ফরজ করেছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ রমযান মাসের সিয়াম তবে তুমি যদি কিছু নফল কর তবে তা স্বতন্ত্র কথা। এরপর তিনি বললেন, বলুন, আল্লাহ আমার উপর কি পরিমান যাকাত ফরয করেছেন? রাবী বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইসলামের বিধান জানিয়ে দিলেন। এরপর তিনি বললেন, ঐ সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আল্লাহ আমার উপর যা ফরয করেছেন, আমি এর মাঝে কিছু বাড়াব না এবং কমাবও না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সে সত্য বলে থাকলে সফলতা লাভ করল কিংবা বলেছেন, সে সত্য বলে থাকলে জান্নাত লাভ করল। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৭০; ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

৩। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের জন্য রমাযানের বারাকাতময় মাস এসেছে। এ মাসে সওম রাখা আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেন। এ মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের সব দরজা। এ মাসে বিদ্রোহী শয়তানগুলোকে কয়েদ করা হয়। এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো; সে অবশ্য অবশ্যই প্রত্যেক কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত রইল। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত -১৯৬২, নাসায়ী ২১০৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৮৬৭, আহমাদ ৭১৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ৯৯৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৫, শু‘আবূল ঈমান ৩৩২৮)।

৪।  ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার দিন সিয়াম পালন করেছেন এবং এ সিয়ামের জন্য আদেশও করেছেন। পরে যখন রমযানের সিয়াম ফরজ হল তখন তা ছেড়ে দেওয়া হয়। আবদুল্লাহ (রহঃ) এ সিয়াম পালন করতেন না, তবে মাসের যে দিনগুলোতে সাধারন সিয়াম পালন করতেন, তাঁর সাথে মিল হলে করতেন। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৭১; ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

৫। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, জাহিলী যুগে কুরায়শগন ‘আশূরার দিন সাওম পালন করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পরে এ সাওম পালনের নির্দেশ দেন। অবশেষে রমযানের সিয়াম ফরজ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যার ইচ্ছা ‘আশূরার সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে সাওম পালন করবে না। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৭২; ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

ইসলামি শরিয়তে সিয়ামের বিধান কাদের উপর ফরজ?

কুরাআন ও সহিহ সুন্নাহর আলোকে বলা যায় যে, সকল প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন,  মুকীম ও সমর্থবান নারী পূরুষের উপরই সিয়াম পালন করা ফরজ। নাবালেগ-অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর ওয়াজিব নয়। আর কিশোর বাচ্চা যে ভালো মন্দের বিচার করতে পারে, তার জন্য রোজা ওয়াজিব নয়। তবে সে রোজা রাখেলে তা নফল হবে। আর প্রতিটি অভিভাবকের উচিত রোজা রাখতে সক্ষম বাচ্চাকে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করা, নির্দেশ দেয়া। যাতে তার অভ্যাস গড়ে উঠে। পাগলের উপর রোজা রাখা ওয়াজিব নয়।

সকল মুসলমান এ বিষয়ে একমত যে, রমজানের রোজা ফরজ। যে অস্বীকার করবে সে কাফের ও মুরতাদ বলে গণ্য হবে। তাকে তাওবা করতে বলা হবে, যদি তাওবা করে ভাল, অন্যথায় হত্যা করা হবে।

তবে হ্যা, যারা অসুস্থ হবে কিংবা সফরে থাকবে তারা এই বিধান থেকে সাময়িকভাবে সিয়াম পালন থেকে অব্যাহতি পাবে কিস্তু  অসুস্থ থেকে সুস্থ হলে কিংবা সফর শেষ করলে তাকে অবশ্যই গনণা করে ঐ সময় কার সিয়ামগুলি আদায় করতে হবে। আর যদি অসুস্থা থেকে সুস্থ হোওয়ার সম্ভাবনা না থাকে সে ক্ষেত্রে ফিদিয়া আদায় করবে। যেমনঃ মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

أَيَّامً۬ا مَّعۡدُودَٲتٍ۬‌ۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٍ۬ فَعِدَّةٌ۬ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَ‌ۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُ ۥ فِدۡيَةٌ۬ طَعَامُ مِسۡكِينٍ۬‌ۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرً۬ا فَهُوَ خَيۡرٌ۬ لَّهُ ۥ‌ۚ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٌ۬ لَّڪُمۡ‌ۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ (١٨٤)

অর্থঃ নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া, একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। (সূরা বাকারা ২:১৮৪)।

 ইসলামি শরিয়তে সিয়ামের বিধান কাদের উপর ফরজ নয়?

কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান অর্জনকারি বিদ্যানগন মনে করেন, সিয়াম পালনের এই এই হুকুর মহান আল্লাহ তায়ালা কিছু লোকদের থেকে রহিত করেছেন।  যেমনঃ

১। অমুসলিম (কাফির/মুশরিক)

২। পাগল

৩। নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু কিশোর

৪। বার্ধক্যে উপনিত ব্যক্তি যার ভাল মন্দের জ্ঞান নেই।
৫।  দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা যা হতে  ভালো হওয়ার আশা করা যায় না এবং রোজা রাখা একে বারেই অসম্ভব, সে ফিদিয়া দিবে। 

১। অমুসলিমঃ

কোন অমুসলিম বা কাফির যারা এখনও ইসলামের মধ্য প্রবেশ করে নাই তাদের উপর ইসলামের কোন হুকুম আহকাম পালন করা ফরজ নয়। তাছাড়া কাফির ব্যক্তির কোন আমল মহান আল্লাহ দরবারে কবুল হবেনা। মহান আল্লাহ কাফির মুসরীকদের সলক আমল ধ্বংশ করে দিবেন। তাদের আমলের কোন লাভ ক্ষতি নেই। তাদের আমল করা আর না করা সমান কথা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 وَلَقَدۡ أُوحِيَ إِلَيۡكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكَ لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥ 

অর্থঃ আপনার ও আপনার  পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর সাথে শির্ক (কাফির হয়) করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন বলে গণ্য হবেন। (সুরা যুমার ৩৯৬৫)

মহান আল্লাহতায়ালা আরও বলেঃ

ذَٲلِكَ هُدَى ٱللَّهِ يَہۡدِى بِهِۦ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦ‌ۚ وَلَوۡ أَشۡرَكُواْ لَحَبِطَ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (٨٨)

অর্থঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর হেদায়াত, নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে তিনি যাকে চান তাকে এর সাহায্যে হেদায়াত দান করেন৷ কিন্তু যদি তারা কোন শির্ক করে থাকতো তাহলে তাদের সমস্ত কৃতকর্ম ধ্বংস হয়ে যেতো৷ (আনআম:৮৮)

মহান আল্লাহ’তায়ালা কাফির মুসরিকদের সম্পর্কে আরও বলেন,

 وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٍ۬ فَجَعَلۡنَـٰهُ هَبَآءً۬ مَّنثُورًا (٢٣)

অর্থঃ এবং তাদের সমস্ত কৃতকর্ম নিয়ে আমি ধূলোর মতো উড়িয়ে দেবো৷ (ফুরকান : ২৩)

কাফির ব্যক্তির নিকট সিয়াম পালন করা আর না করা সমান কথা। যদি কোন কাফির ব্যক্তি ইসলাম কবুল করে মুসলিম হয়, তবে তাকে সেই দিনগুলোর কাযা করতে আদেশ করা হবে না। এক জন অসুস্থ বা সফরকারী ব্যক্তির উপর যেমন কাযার হুকুম থাকে, ইসলাম কবুল করার পর একজন কাফিরের উপর ঠিক তেমনিভাবে কাযা করার হুকুম তাথে না। কারন কাফির অবস্থায় তার উপর সিয়াম ফরজ ছিলনা। আর একথার দলীল হল আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ

قُلۡ أَنفِقُواْ طَوۡعًا أَوۡ كَرۡهً۬ا لَّن يُتَقَبَّلَ مِنكُمۡ‌ۖ إِنَّكُمۡ ڪُنتُمۡ قَوۡمً۬ا فَـٰسِقِينَ (٥٣) وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡہُمۡ نَفَقَـٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ ڪَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ ڪُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمۡ كَـٰرِهُونَ (٥٤) 

অর্থঃ তাদের বলে দাও, “তোমরা নিজেদের ধন-সম্পদ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ব্যয় কর অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যয় কর, তা গৃহীত হবে না৷ কারণ তোমরা ফাসেক গোষ্ঠী”৷তাদের দেয়া সম্পদ গৃহীত না হবার এ ছাড়া আর কোন কারন নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে, নামাযের জন্য যখন আসে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলে তা করে অনিচ্ছাকৃতভাবে। (সুরা তাওবা ৯:৫৩-৫৪)।

যদি কুফরির কারনে তাদের দান-সাদকাহ কবুল হয় না, তাহলে বিশেষ ‘ইবাদাতসমূহ (যেমনঃ সালাত, সিয়াম, হজ্জ যার উপকার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ) সেগুলো আরও বেশি কবুল না হওয়ার যোগ্য। যদি কাফির ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ না করে, তবে তাকে সমস্ত ফরজ বা ওয়াজিবসমূহ ত্যাগ করার জন্যও শাস্তি পেতে হবে। এমন কি তাকে সিয়াম পালন না করাও শান্তি পেতে হবে। কারণ, আল্লাহর প্রতি অনুগত শারীয়াতের বিধান পালনকারী, একজন মুসলিম যদি শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, তবে একজন অহংকারী (কাফির) শাস্তি পাওয়ার আরও বেশি যোগ্য। একজন মুসলিক কে যদি আল্লাহর অনুগ্রহসমূহ যেমন-খাবার, পানীয় ও পোশাক ইত্যাদি উপভোগ করার জন্য হিসাব দিতে হয় তবে একজন কাফিরকে কেন হারাম কাজ করা ও ওয়াজিবসমূহ ত্যাগ করার জন্য শাস্তি পেতে হবে না? বরং সে শান্তি পাওয়ার আরও বেশি উপযুক্ত। একথার দলীল হল, মহান আল্লাহ তা‘আলা সুরা মুদাস্সিরে ডানপাশে অবস্থানকারীদের সম্পর্কে বলেছেন যে তারা অপরাধীদেরকে (কাফিরদের) বলবেনঃ

مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣ وَلَمۡ نَكُ نُطۡعِمُ ٱلۡمِسۡكِينَ ٤٤ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ ٱلۡخَآئِضِينَ ٤٥ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤٦ 

অর্থঃ কিসে তোমাদেরকে সাক্বারে (একটি জাহান্নামের নাম) প্রবেশ করিয়েছে? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারী ছিলাম না, আর আমরা মিসকীনদের খাবার খাওয়াতাম না, আর আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম, আর আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম।”  (সুরা মাদাস্সির ৭৪:৪২- ৪৬)।

সুতরাং সালাম, যাকাত, সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করা এবং প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করার কারনে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। ইহাই মহান আল্লাহ ঘোষনা।

অপর পক্ষে যদি কোন কাফির ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। তার  ব্যক্তিগত আমল (সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত) পালন করা আর না করা সমান ছিল। কাজেই তার কাযা সিয়াম সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন করা হবে না। ইসলাম গ্রহনের সাথে সাথে সব ক্ষমা হয়ে যাবে। এ কথার দলীল হল মহান আল্লাহর বানী। তিনি এরশাদ করেন,

 قُل لِّلَّذِينَ ڪَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ وَإِن يَعُودُواْ فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ (٣٨) 

অর্থঃ তুমি বলে দাও, কাফেরদেরকে যে, তারা যদি বিরত হয়ে যায়, তবে যা কিছু ঘটে গেছে ক্ষমা হবে যাবে। পক্ষান্তরে আবারও যদি তাই করে, তবে পুর্ববর্তীদের পথ নির্ধারিত হয়ে গেছে। (আল-আনফাল ৮:৩৮)।

মুলকথা হল এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। রাসূল থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি তাকে ছুটে যাওয়া ওয়াজিবসমূহের কাযা করতে আদেশ করতেন না। কাজেই কোন কাফিরের উপর রমজান মাসের সিয়াম ফরজ নয়।

২। পাগলঃ

ইসলামি শরীয়তের আর একটি নীতিমালা হল, পাগল ব্যক্তির উপর ইসলামের কোন ফরজ হুকম কার্যকর হবে না। ইবাদত বাস্তবায়ন করা যদি তার মধ্যে সে যোগ্যতা ও ক্ষমতা থাকে তবে মহান আল্লাহ্‌ তা‘আলা মানুষের উপর তা ফরজ করেন না। যদি কেই বিবেক সম্পন্ন না হয় বা সবকিছু বুঝতে না পারে তার উপর ইসলামি শরীয়ত কোন ইবাদাত চাপিয়ে দেন নাই। মহান আল্লাহ বলেন,

*فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ *

অর্থঃ তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় করে চলো। (তাগাবুন ৬৪:১৬)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

*لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ    *

অর্থঃ সাধ্যের বাইরে কোনকিছু আল্লাহ কারোর উপর চাপিয়ে দেন না। (বাকারাহ ২:২৮৬)

হাদিসের আলোকেও দেখতে পাওয়া যায় পাগলের উপর ইমলামের কোন বীধিবিধাণ প্রযোয্য হয় না। যেমনঃ একটি সহিহ হাদিসে এসেছেঃ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা যেনার অপরাধে জনৈকা উম্মাদিনীকে ধরে এনে উমার (রাঃ)-এর নিকট হাযির করা হয়। তিনি এ ব্যাপারে লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এ সময় আলী (রাঃ) তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন এর কি হয়েছে? উপস্থিত লোকেরা বললো, সে অমুক গোত্রের উম্মাদিনী (পাগল মহিলা), সে যেনা করেছে। উমার (রাঃ) তাকে পাথর মেরে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি বললেন, তোমরা তাকে নিয়ে ফিরে যাও। অতঃপর তিনি উমারের নিকট এসে বললে, হে আমীরুল মু‘মিনীন! আপনি কি জানেন না, তিন ধরণের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছেঃ (১) পাগল, যতক্ষণ না সুস্থ হয়, (২) নিদ্রিত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয় এবং (৩) নাবালেগ শিশু, যতক্ষণ না বালেগ হবে। তিনি বললেন, হ্যাঁ। আলী (রাঃ) বলেন, তাহলে তাকে পাথর মারা হবে কেন? তিনি বলেন, কোনো কারণ নেই। আলী (রাঃ) বলেন, তবে তাকে ছেড়ে দিন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন এবং ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। (হাদিসের মান সহীহ সুনান আবূ দাউদ ৪৩৯৯ (তাহকিককৃত) আরও দেখুন, ইবনু হিববান, ইবনু খুযাইমাহ, হাকিম, দারাকুতনী)।

হাদিসে ষ্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে পগলের উপর থেকে মহান আল্লাহ কলম উঠিয়ে নিয়েছন। আর্থাৎ তার কর্মের কোন হিসাব দিতে হবে না। কাজেই আমরা বলতে পারি পাগলের উপর ফরজ সিয়াম আদায়ের হুকুর জারি হবে না।

৩। নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু কিশোরঃ

ইসলামি শরীয়তের একটি নীতিমালা হল, ইসলামের কোন ফরজ কাজ আয়াদ করতে হলে তাকে অবশ্য প্রাপ্ত বয়স্ক লোক হতে হবে। কাজেই নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু কিশোরদের উপর রমজানের সিয়াম ফরজ নয়। পূর্বে যে হাদিসে পাগলের উপর শরীয়তের বিধীবিধান রহিত করা হয়েছে, সেখানে ষ্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে নাবালেগ শিশু, যতক্ষণ না বালেগ হবে তার উপর থেকে মহান আল্লাহ কলম উঠিয়ে নিয়েছন। আর্থাৎ তার কর্মের কোন হিসাব দিতে হবে না। কাজেই আমরা বলতে পারি অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা নাবালেগ শিশু যতক্ষন পর্যান্ত প্রাপ্ত বয়স্ক না হবে তার উপর ফরজ সিয়াম আদায়ের হুকুর জারি হবে না।

তবে সে সকল কিশোরের বয়স পনেরো বছর পর্যন্ত পৌছেনি এখনও অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাদেরও সিয়াম পালনের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। যেমন তাকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে। কারণ সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাদের সন্তানদেরকে সিয়াম পালনের নির্দেশ দিতেন।

রুবায়্যি‘ বিনত মু’আব্বিয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আশূরার সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেনঃ যে ব্যাক্তি সিয়ামপালন করেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যার সিয়াম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন সিয়াম পূর্ণ করে। তিনি (রুবায়্যি) (রাঃ) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন রোযা রাখতাম এবং আমাদের শিশুদের রোযা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরী করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁধলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ইফতার পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতাম। (সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৩৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

এই জন্য আলেমগণ মনে করেন অভিভাবক তার অধীনস্থ সকল অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সিয়াম আদায়ের নির্দেশ দিবেন। যাতে তারা শিশুকাল থেকে ইসলামী আচার-আকীদায় অভ্যস্ত হয়ে যায় ও এর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। তবে মনে রাখতে হবে সিয়াম পালন যদি তাদের কষ্টের কারণ হয় তবে জোর- জবরদস্তি করবে না। অনেক পিতা-মাতা স্নেহ ও আদরের বশবতী হয়ে তাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের সিয়াম থেকে বারণ করেন। এটা মোটেই উচিত নয়। কারণ এটা সাহাবায়ে কেরামের আমলের খেলাফ। সন্তানদের ইসলামী শরীয়তের অনুশীলন ও তাতে অভ্যস্ত করাই মূলত তাদের সত্যিকার স্নেহ ভালোবাসার দাবি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিবার বর্গের জিম্মাদার ও তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”। তাই পরিবারের কর্তার উচিত পরিবারের সকলকে আল্লাহকে ভয় ও তার হুকুম আহকাম পালনের নির্দেশ দেয়া। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত।

৪। বার্ধক্যে উপনিত ব্যক্তিঃ

অতি বৃদ্ধ, অচল ও চিররোগী যাদের সিয়াম পালন তার জন্য খুবই কষ্টকর। তাদের উপর সিয়াম পালন জরুরী নয়। তবে এ ব্যক্তি অন্য কাউকে দিয়ে কাযা আদায় করাবে অথবা ফিদইয়া দিবে। প্রতি একটি সিয়ামের জন্য একজন মিসকিনকে এক বেলা খাবার খাওয়াবে। ফিদইয়ার পরিমাণ ৫১০ গ্রাম পরিমাণ ভাল খাবার। মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

أَيَّامً۬ا مَّعۡدُودَٲتٍ۬‌ۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٍ۬ فَعِدَّةٌ۬ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَ‌ۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُ ۥ فِدۡيَةٌ۬ طَعَامُ مِسۡكِينٍ۬‌ۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرً۬ا فَهُوَ خَيۡرٌ۬ لَّهُ ۥ‌ۚ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٌ۬ لَّڪُمۡ‌ۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ (١٨٤)

অর্থঃ নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া, একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। (সূরা বাকারা ২:১৮৪)।

৫।  দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতাঃ

দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা যা হতে  ভালো হওয়ার আশা করা যায় না এবং রোজা রাখা একে বারেই অসম্ভব। এমন অসুস্থ ব্যক্তিদের রোজা রাখা জরুরি নয়। যদি সিয়াম পালনে তার ক্ষতি হয়, তার জন্য সিয়াম পালন জায়েয নয়। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا 

অর্থঃ তোমরা নিজেদের হত্যা করনা। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের প্রতি দয়াশীল। (সূরা নিসা ৪:২৯)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেনঃ

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ

অর্থঃ তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা। (সূরা বাকারা ২:১৯৫)

তাই যে বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য সিয়াম ক্ষতিকর তার জন্য সিয়াম পালন জায়েয নয়। এর সাথে ভবিষ্যতে সিয়াম পালনের সামর্থ্যবান হওয়ার সম্ভাবনা যদি না থাকে তাহলে, প্রতিটি রোজার পরিবর্তে প্রতিদিন একজন করে মিসকিনকে খানা খাওয়াবে। তাদেরকে রোজার কাজা করতে হবে না। এতেই সে সিয়ামের দায় থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত।

অপর পক্ষ কিছু লোকদের উপর সিয়াম পালন করা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছেন।

১। অসুস্থ ব্যক্তি 
২। সফরে থাকা ব্যক্তি বা মুসাফির
৩। হায়েজ-নেফাস আক্রান্ত নারী

 গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী  

৫। দুর্ঘটনায় পতিত বা বিপদগ্রস্ত লোককে উদ্ধারকাজে নিয়োজিক ব্যক্তি।

৬। আল্লাহ্‌র পথে জিহাদে থাকার সময়ঃ

১। অসুস্থ ব্যক্তিঃ

রোজার কারণে যদি অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষতি, আরোগ্য লাভ বিলম্বিত কিংবা অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে তার জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। কারণ, আল্লাহ তায়ালা পরম দয়ালু। তিনি তার বান্দাদের কোন কষ্ট দিতে চান না। তাদের  কস্টের প্রতি লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ তাদের সিয়াম না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং নিজ বান্দাদের যে সুযোগ তিনি দিয়েছেন তাকে গণিমত মনে অসুস্থ ব্যক্তি সিয়াম ভেঙ্গে ফেলবে। অবশ্য পরে এটা কাযা করে নেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

অর্থঃ কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (বাকারা ২:১৮৫)

সিয়াম পালনে অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার এবং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবু পরহেজগারী মনে করে সিয়াম পালন করে যাওয়া মোটেই  পরহেজগারী কাজ নয়। বরং এ অবস্থায় সিয়াম পালন করা নিষেধ এবং সওম ভঙ্গ করা জরুরী। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا 

অর্থঃ তোমরা নিজেদের হত্যা করনা। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের প্রতি দয়াশীল। (সূরা নিসা ৪:২৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমার উপর তোমার আত্মার হক রয়েছে।’’ (আবূ দাঊদ : ১৩৬৯ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

কী পরিমাণ অসুস্থ হলে সিয়াম ভঙ্গ করতে হবে?

রোগের কারণে যদি স্বাভাবিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে, ডাক্তার যদি বলে যে, এ সিয়ামের কারণে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, বা রোগীর ক্ষতি হতে পারে বা সুস্থতা বিলম্বিত হতে পারে তবেই রোযা ভাঙ্গবে। কিন্তু সামান্য অসুখ যেমন মাথা ব্যাথা, শর্দি, কাশি অনুরূপ কোন সাধারণ রোগ বালাইয়ের কারণে সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয হবে না। অসুস্থ হলেও সিয়াম পালনে খুব কষ্ট হচ্ছে না এবং কোনরূপ ক্ষতির আশঙ্কাও নেই এমতাবস্থায় সিয়াম পালন করবে। এমন হলে ভঙ্গ করা জায়েয হবে না। মনে রাখতে হবে যে, রোগের কারণে যেসব সিয়াম ভঙ্গ হবে ঠিক অনুরূপ সংখ্যক সিয়াম পরে কাযা করতে হবে। অপর পক্ষে অসুস্থ ব্যক্তি যদি কষ্ট করে সিয়াম পালন সঠিক নয়, বরং মাকরূহ। কারণ সে আল্লাহর দেয়া সুবিধা গ্রহণ না করে বরং নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“আল্লাহর অবাধ্য হওয়াকে মাবুদ যেমন অপছন্দ করেন, তার দেয়া সুবিধাদি গ্রহণ করাকেও তিনি তেমন পছন্দ করেন। (আহমাদঃ ২/১০৮)

যারা কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করে তারাও রমযানের ফরয সিয়াম ভাঙ্গতে পারবে না। পরীক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যয়নের চাপের কারণে রোযা কি ভাঙ্গতে পারবে না। অধ্যয়ন রোযা ভঙ্গের উযর হিসেবে গণ্য হবে না। অসুস্থ ব্যক্তির কাযা রোযা সুস্থ হওয়ার পর কাযা করতে হবে তার সিয়ামের জন্য কোর প্রকার ফিদইয়া দিয়া চলবে। তবে এমন অসুস্থ যা কখনও ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই কেবল সেই ফিদইয়া দিতে পারবে। কোন অসুস্থ ব্যক্তি  সুস্থ হওয়ার পর কাযা আদায় করার আগেই মৃত্যুবরণ করলে তাকে তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে প্রতি একদিনের রোযার বদলে একজন মিসকিনকে একবেলা খানা খাওয়াবে। অথবা তার কোন আত্মীয় যদি তারপক্ষ থেকে কাযা আদায় করে তবে মাইয়্যেতের জন্য তা আদায় হয়ে যাবে।

 ২। সফরে থাকা ব্যক্তি  বা মুসাফিরঃ
 সফর অবস্থায় রমজান এসে গেলে অথবা রমজানের মধ্যে সে কোথাও সফরে গেলে, তার জন্য উত্তম হলো রোজা না রাখা। রোজা রাখা তার জন্য কষ্ট হোক বা না হোক। আল্লাহ যেহেতু সুযোগ দিয়েছেন, সুযোগকে কাজে লাগাবে এটিই তার জন্য উত্তম। মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

অর্থঃ কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। (বাকারা ২:১৮৫)

যে ব্যক্তি ভ্রমণ বা সফর করে তাকে সফররত অবস্থায় মুসাফির বলে। আবার যখন নিজ বাড়ী বা বাসভবনে চলে আসে তখন শরীয়াতের পরিভাষায় তাকে বলে মুকীম। মুকীম অর্থ হলো নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তি অর্থাৎ মুসাফির নন। হানাফী মাযহাবে কমপক্ষে ৪৮ মাইল বা ৮০ কিলোমিটার। অন্যান্য মাযহাবে সফরের নিম্নতম দূরত্ব আরো কম। সফরের কারণ হজ্জ, উমরা, জিহাদ, পড়াশুনা, ব্যবসা, বেড়ানো, পর্যটন ইত্যাদি হতে পারে। অধিকাংশ সত্যনিষ্ঠ আলেমদের মতে অন্যায় ও অবৈধ কাজের সফরে সিয়াম ভঙ্গ করা হারাম। মুসাফিরের জন্য যেটা সহজ সেটাই উত্তম। সফররত অবস্থায় সিয়াম পালন যদি কষ্টকর হয়ে যায় তাহলে ভেঙ্গে ফেলাই উত্তম। অতি বেশি কষ্টকরে সিয়াম পালন করা ঠিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ١٨٥  

অর্থঃ ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না। (বাকারা ২:১৮৫)

মাক্কাহ বিজয়ের বৎসর মাক্কার উদ্দেশ্যে কুরা আলগামীম নামক স্থানে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সামনে আসর বাদ সিয়াম ভঙ্গ করে পানি পান করলেন। (মুসলিম : ১১১৪)

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সফরে কষ্ট হওয়ার পর ও একদল লোক সিয়াম পালন করেই যাচ্ছে। বিষয়টি জানার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তারা পাপী তারা পাপী।’’ (মুসলিম : ১১১৪)

উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সফররত অবস্থায়- অতিমাত্রায় কষ্ট করে সিয়াম পালন করা পরহেজগারীর কাজ নয়, বরং এটা পাপের কাজ।

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজায়গায় কিছু মানুষের ভীড় দেখে এগিয়ে দেখলেন যে, এক লোককে ছায়া দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেলেন, সে কে? লোকেরা বলল, এ ব্যক্তি রোযাদার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘সফরে সিয়াম পালন করা ভালকাজ নয়। (বুখারী : ১৯৪৬; মুসলিম : ১১১৫)

এসব দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, সফর কষ্টকর হলে রোযা না রাখাই শ্রেয়। আর ভ্রমণ যদি খুব বেশি কষ্টের না হয় তাহলে সিয়াম পালন করাই উত্তম।


৩। হায়েজ-নেফাস আক্রান্ত নারীঃ

হায়েজ ও নিফাছ অবস্থায় মেয়েদের জন্য ওয়াজিব হল সিয়াম বর্জন করা। এ অবস্থায় সালাত ও সিয়াম কোনটাই আদায় করা জায়েয হবে না। সুস্থতার পর তাদের সিয়াম কাজা আদায় করতে হবে। সালাতের কাজা আদায় করতে হবে না।হাদীসে এসেছে

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত যে, তাকে জিজ্ঞেস করা হল হায়েজ থেকে পবিত্রতার পর মহিলারা কি সালাত ও সাওমের কাজা আদায় করবে?

তিনি বললেন : “এ অবস্থায় আমাদের সিয়ামের কাজা আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সালাতের নয়।” বুখারী ও মুসলিম

সিয়াম কাজা করা আর সালাত কাজা না করা সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) যা বলেছেন সমস্ত উলামায়ে কেরাম তার সাথে একমত পোষণ করেছেন অর্থাৎ ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এ বিধানে আল্লাহর এক অনুগ্রহের প্রকাশ ঘটেছে। সিয়াম বছরের একবার আসে বলে তা কাজা করা কষ্টকর হয় না। কিন্তু সালাত কাজা করার হুকুম হলে তা কষ্টকর হয়ে যেত।

যদি শরয়ী ওজর (সংগত কারণ) ব্যতীত কেহ এক রমজানের সিয়ামের কাজা অন্য আরেক রমজানের পর পর্যন্ত বিলম্বিত করে তাহলে সে এ কাজের জন্য তাওবা করবে। কাজা আদায় করবে এবং প্রত্যেকটি সাওমের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। এমনিভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ও মুসাফির যার উপর সিয়ামের কাজা আদায় করা সহ কাফ্‌ফারা দিতে হবে অর্থাৎ প্রতিটি সাওমের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করতে হবে এবং তওবা করবে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত এবং মুসলমানদের ইজমা হল মহিলাদের ঋতুস্রাব রোজার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং হায়েজ বা নিফাস অবস্থায় রোজা রাখা জায়েয নয়। কেউ রোজা রাখলে তার রোজ সহিহ হবে না। তিনি বলেন, এটিই যুক্তি সঙ্গত। প্রতিটি বিধানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সমতা বিধান করাই হলো শরিয়তের উদ্দেশ্য। রক্তস্রাবের সময় রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হলে শরীরের ক্ষতি হবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। এবং তার রোজা সামঞ্জস্যতার স্তর হতে ছিটকে পড়বে। এ কারণে তাকে রক্তস্রাবহীন সাভাবিক সময়ে যখন শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি বিদ্যমান থাকে ছুটে যাওয়া রোজার কাজা করতে বলা হয়েছে। আর সে সময়ের রোজা হবে  সামঞ্জস্যপূর্ণ। বমি রোজার পরিপন্থী নয়। কারণ বমির কোন নির্দিষ্ট সময় নেই যা থেকে সে নিরাপদ থাকতে পারে। 

 

৪। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীঃ

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীণী সিয়াম পালন করলে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় তাদের সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েজ আছে এবং পরে তা কাযা করে নেবে। ইচ্ছা করলে তারা সিয়াম পালনও করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

‘‘আল্লাহ রববুল ‘আলামীন মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন। (তিরমিযী : ৭১৫)

তাদের বিষয়টি সাধারণ রোগী ও মুসাফিরের সিয়ামের মাসআলার অনুরূপ। তাছাড়া মহিলা শারীরিকভবে যদি শক্তিশালী হয় এবং সন্তানের কোন ক্ষতির আশঙ্কা না করে তাহলে সিয়াম পালন করতে পারে। আর যদি সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সিয়াম ভেঙ্গে ফেলা ওয়াজিব।

গর্ভবতী মহিলার দু অবস্থার যে কোন এক অবস্থা থাকবে। হয়তো সে শক্তিশালী হবে। সিয়ামের কারণে তার কষ্ট হবে না ও গর্ভস্থিত বাচ্চার উপর তার প্রভাব পড়বে না। এমতাবস্থায় তার সিয়াম পালন করতে হবে। আর যদি সে দুর্বল হয়। সিয়াম সে বরদাশত করতে পারবে না বলে মনে হয় তা হলে সে সিয়াম আদায় করবে না। বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সিয়াম বর্জন করা তার জন্য ওয়াজিব হবে। বাচ্চা প্রসবের পর সে কাজা আদায় করবে। সিয়াম পালন করলে অনেক সময় বাচ্চাকে দুধ পান করানোর সমস্যা দেখা দেয়। কেননা দুগ্ধ দানকারী মায়ের খাবার দাবার গ্রহণের প্রয়োজন। বিশেষ করে গ্রীষ্ম কালে যখন দিন বড় হয়ে থাকে। তখন সে সিয়াম বর্জন করতে বাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যথায় তার বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আমরা সে সিয়াম থেকে বিরত থাকবে। যখন সে সমস্যা- মুক্ত হবেন তখন কাজা আদায় করবে।

কোন কোন আলেম বলেছেন গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী মহিলা সিয়াম থেকে বিরত থাকতে পারেন যখন সিয়ামের কারণে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা হয়, নিজের ক্ষতির কারণে নয়। তাই তার জন্য ওয়াজিব হবে কাজা আদায় করা ও কাফ্‌ফারা। তবে কাফ্‌ফারা ঐ ব্যক্তি আদায় করবেন যার দায়িত্বে রয়েছে এ সন্তানের ভরন-পোষণ। কিন্তু বিশুদ্ধ মত হল কাফ্‌ফারা আদায়ের প্রয়োজন হবে না।

৫। দুর্ঘটনায় পতিত বা বিপদগ্রস্ত লোককে উদ্ধারকাজে নিয়োজিক ব্যক্তিঃ

কোন সিয়ামরত ব্যক্তি যদি অন্য কাউকে পানি বা আগুন থেকে উদ্ধার করার জন্য সাওম ভঙ্গ করেছে তার হুকুমও ঐ মহিলার মত যে তার বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কায় সিয়াম থেকে বিরত থাকল অর্থাৎ সে সাওম থেকে বিরত থাকবে ও পরে কাজা আদায় করবে। যেমনঃ  আপনি দেখলেন একটি ঘরে আগুন লেগেছে। সে ঘরের ভিতর মুসলমানগন আছেন তখন তাদের উদ্ধার করার জন্য সাওম ভঙ্গ করে খাবার গ্রহণ করে শক্তি অর্জন করত তাদের উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। এটা শুধু জায়েয নয় বরং ওয়াজিব।

 ৬। আল্লাহ্‌র পথে জিহাদে থাকার সময়ঃ

আল্লাহ্‌র পথে জিহাদে থাকার সময় শরীরে শক্তি বজায় রাখার জন্য রোযা ভঙ্গ করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন,

إِنَّكُمْ مُصَبِّحُو عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَأَفْطِرُوا 

অর্থঃ আগামীকাল তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করবে, রোযা ভঙ্গ করলে তোমরা অধিক শক্তিশালী থাকবে, তাই তোমরা রোযা ভঙ্গ কর। (সহিহ মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সিয়াম কাদের উপর ফরজ আর কাদের উপর ফরজ নয়

Leave a comment