সাঈ বা সাফা মারওয়া মাঝে দৌড়ানোর বিধান

সাঈ বা সাফা মারওয়া মাঝে দৌড়ানোর বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

সাঈ বা সাফা মারওয়া মাঝে দৌড়ানো

সাঈ অর্থ দৌড়ানো। কাবার অতি নিকটেই দু’টো ছোট্ট পাহাড় আছে যার একটি ‘সাফা’ ও অপরটির নাম ‘মারওয়া’। এ দু’ পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে মা হাজেরা শিশুপুত্র ইসমাঈলের পানির জন্য ছোটাছুটি করেছিলেন। ঠিক এ জায়গাতেই হজ্জ ও উমরা পালনকারীদেরকে দৌড়াতে হয়। শাব্দিক অর্থে দৌড়ানো হলেও পারিভাষিক অর্থে স্বাভাবিক গতিতে চলা। শুধুমাত্র দুই সবুজ পিলার দ্বারা চিহ্নিত মধ্যবর্তী স্থানে সামান্য একটু দৌড়ের গতিতে চলতে হয়। তবে মেয়েরা দৌড়াবে না।

উরওয়াহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্জেস করলাম যে, মহান আল্লাহর এ বাণী সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

*إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ *

নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। (সুরা বাকারা ২:১৫৮)

(আমার ধারণা যে,) সাফা-মারওয়ার মাঝে কেউ সা‘ঈ না করলে তার কোন দোষ নেই। তখন তিনি [‘আয়িশাহ (রাযি.)] বললেন, ওহে বোনপো! তুমি যা বললে, তা ঠিক নয়। কেননা, যা তুমি তাফসীর করলে, যদি আয়াতের মর্ম তাই হতো, তাহলে আয়াতের শব্দ বিন্যাস এভাবে হতো।

 (لاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا ) 

‘‘দু’টোর মাঝে সা‘ঈ না করায় কোন দোষ নেই।’’

কিন্তু আয়াতটি আনসারদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুশাল্লাল নামক স্থানে স্থাপিত মানাত নামের মূর্তির পূজা করত, তার নামেই তারা ইহরাম বাঁধত। সে মূর্তির নামে যারা ইহরাম বাঁধত তারা সাফা-মারওয়া সা‘ঈ করাকে দোষাবহ মনে করত। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! পূর্বে আমরা সাফা ও মারওয়া সা‘ঈ করাকে দোষা মনে করতাম। (এখন কী করবো?) এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা‘আলা

 (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ ) 

অবতীর্ণ করেন। ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) বলেন, (সাফা ও মারওয়ার মাঝে) উভয় পাহাড়ের মাঝে সা‘ঈ করা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিধান দিয়েছেন। কাজেই কারো পক্ষে এ দুয়ের সাঈ পরিত্যাগ করা ঠিক নয়। (রাবী বলেন) এ বছর আবূ বাকার ইবনু ‘আবদুর রাহমান (রাঃ) কে ঘটনাটি জানালাম। তখন তিনি বললেন, আমি তো এ কথা শুনিনি, তবে ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) ব্যতীত বহু ‘আলিমকে উল্লেখ করতে শুনেছি যে, মানাতের নামে যারা ইহরাম বাঁধত তারা সকলেই সাফা ও মারওয়া সায়ী করত, যখন আল্লাহ কুরআনে বাইতুল্লাহ তাওয়াফের কথা উল্লেখ করলেন, কিন্তু সাফা ও মারওয়ার আলোচনা তাতে হলো না, তখন সাহাবাগণ বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সাফা ও মারওয়া সা‘ঈ করতাম, এখন দেখি আল্লাহ কেবল বাইতুল্লাহ তাওয়াফের কথা অবতীর্ণ করেছেন, সাফার উল্লেখ করেননি। কাজেই সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে আমাদের দোষ হবে কি? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন,

 ( إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ ) 

আবূ বাকার (রাঃ) আরো বলেন, আমি শুনতে পেয়েছি, আয়াতটি দু’ প্রকার লোকদের উভয়ের প্রতি লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে, অর্থাৎ যারা জাহিলী যুগে সাফা ও মারওয়া সা‘ঈ করা হতে বিরত থাকতেন, আর যারা তৎকালে সা‘য়ী করত বটে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর সা‘য়ী করার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের দ্বিধার কারণ ছিল আল্লাহ বাইতুল্লাহ তাওয়াফের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সাফা ও মারওয়ার কথা উল্লেখ করেননি? অবশেষে বাইতুল্লাহ তাওয়াফের কথা আলোচনা করার পর আল্লাহ সাফা ও মারওয়া সা‘ঈ করার কথা উল্লেখ করেন। (সহিহ বুখারী ১৬৪৩)

আমর ইব্‌নু দীনার (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ)-এর নিকট জিজ্জেস করলাম, কোন ব্যক্তি ‘উমরাহ করতে গিয়ে শুধু বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে, আর সাফা ও মারওয়া সা’ঈ না করে, তার পক্ষে কি স্ত্রী সহবাস বৈধ হবে? তখন তিনি বললেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মক্কায়) উপনীত হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ সাত চক্করে সমাধা করে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’ রাক’আত সালাত আদায় করলেন, এরপর সাত চক্করে সাফা ও মারওয়া সা’য়ী করলেন। [এতটুকু বলে ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) বলেন] “তোমাদের জন্য রসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ”(আল-আহযাবঃ ২১)। (সহিহ বুখারি ১৬৪৫)

জাবির ইব্‌নু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমরা জাবির ইব্‌নু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে উক্ত বিষয়ে জিজ্জেস করলাম। তখন তিনি বললেন, সাফা ও মারয়ার সা’ঈ করার পূর্বে কারো পক্ষে স্ত্রী সহবাস মোটেই বৈধ হবে না। (সহিহ বুখারি ১৬৪৬)

আসিম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি আনাস ইব্‌নু মালিক (রাঃ) কে বললাম, আপনারা কি সাফা ও মারওয়া সা’ঈ করতে অপছন্দ করতেন? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। কেননা তা ছিল জাহিলী যুগের নিদর্শন। অবশেষে মহান আল্লাহ অবতীর্ণ করেনঃ “নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন। কাজেই হজ্জ বা ‘উমরাকারীদের জন্য এ দুইয়ের মধ্যে সা’ঈ করায় কোন দোষ নেই”। (সু্রা বাকারা-১৫৮)। (সহিহ বুখারি ১৬৪৮)

সাঈ না করলে হজ্জ ও উমরা আদায় হবে নাঃ

হিশাম ইবনু উরওয়াহ্ (রহঃ) থেকে তার পিতা সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়িশাহ্ (রাযিঃ) কে বললাম, আমি মনে করি কোন ব্যক্তি সাফা-মারওয়াহ পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ না করলে তার কোন ক্ষতি হবে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেন? আমি বললাম, কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ ‘সাফা-মারওয়াহ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম ……… “— (সূরা আল বাকারাহ ২ঃ ১৫৮)। তখন আয়িশাহ (রাযিঃ) বললেন, কোন ব্যক্তি সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ না করলে আল্লাহ তার হাজ্জ ও উমরাহ পূর্ণ করেন না। তুমি যা বলেছ যদি তাই হতো তবে আয়াতটি এভাবে হতো, “ঐ দুই পাহাড়ের মাঝে না দৌড়ালে কোন অসুবিধা নেই।” তুমি কি জান ব্যাপারটি কী ছিল? ব্যাপার তো ছিল এই যে, আনসারগণ জাহিলী যুগে দু’টি প্রতিমার নামে সমুদ্রের তীরে ইহরাম বাঁধত। একটির নাম ইনসাফ, অপরটির নাম নায়িলাহ। তারা এসে সাফা-মারওয়াহ সাঈ করত। অতঃপর মাথা কামাতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর তারা জাহিলী যুগে যা করত, সে কারণে সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করা খারাপ মনে করল। তাই আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেনঃ “সাফা-মারওয়াহ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম ………।” অতঃপর লোকেরা সাঈ করে।(সহিহ মুসলিম ২৯৬৯ হাদিস ফাউন্ডেশন)

সাঈ এর ধারাবাহিক কাজগুলো নিম্ম রুপঃ

ক) তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত সালাত আদায় করে কিছু জমজমের পানি পান করেই ‘সাফা’ পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দেবেন।

খ) সা‘ঈ করতে যাচ্ছেন এ মর্মে মনে মনে নিয়ত বা ইচ্ছা পোষণ করুন। সা‘ঈ করতে যাবার পূর্বে হাজরে আসওয়াদ পাথর ‘ইস্তিলাম’ (চুম্বন-স্পর্শ) করা উত্তম। তবে ভিড়ের কারণে সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই, সরাসরি সাফা পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে পড়ুন। তবে এ সময় হাজরে আসওয়াদ পাথরের দিকে হাত তুলে ইশারা করা বা তাকবীর বলার কোনো বিধান নেই। সাফা পাহাড়ে যতটুকু সম্ভব উঠে বা কাছাকাছি পৌছে এ দো‘আটি শুধুমাত্র এখন একবারই পড়ুন। দোয়াটি হলোঃ

«إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللَّهُ بِهِ»

(উচ্চারণঃ‘‘ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শা‘আয়িরিল্লাহ, আবদাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি’’।)

অর্থঃ ‘‘অবশ্যই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম।’’ আল্লাহ যেভাবে শুরু করেছেন আমিও সেভাবে শুরু করছি।

এ দোয়াটি এখানে ছাড়া আর কোথাও পড়বেন না। সাঈর প্রথম চক্রের শুরুতেই শুধুমাত্র পড়বেন। প্রতি চক্রে বারবার এটা পুনরাবৃত্তি করবেন না।

গ) অতঃপর,যতটুকু সম্ভব সাফা পাহাড়ে উঠুন। একেবারে চূড়ায় আরোহণ করা জরুরী নয়। তারপর কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে হাত তুলে নীচের দোয়াটি পড়ুনঃ

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَه لاَ شَرِيكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَه لاَ شَرِيكَ لَـه، أَنْجَزَ وَعْدَه، وَنَصَرَ عَبْدَه، وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَه.

(উচ্চারণঃ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওআহদাহু লা শারিকালাহ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদ্, ইয়ুহয়ী ওয়া ইয়ুমিতু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শায়য়িন ক্বদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওআহদাহু লা শারিকালাহু, আনজাযা ওয়া‘দাহু ওয়ানাসারা আবদাহু ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহু’’।)

অর্থঃ আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও একক, তাঁর কোন শরীক নেই। আসমান যমীনের সার্বভৌম আধিপত্য একমাত্র তাঁরই। সকল প্রশংসা শুধু তাঁরই প্রাপ্য। তিনিই প্রাণ দেন এবং তিনিই আবার মৃত্যুবরণ করান। সবকিছুর উপরই তিনি অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। যত ওয়াদা তাঁর আছে তা সবই তিনি পূরণ করেছেন। স্বীয় বান্দাকে তিনি সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুদলকে পরাস্ত করেছেন। (আবূ দাউদঃ ১৯০৫)

এ দোয়াটি তিনবার পড়ার পর দু’হাত উঠিয়ে যত পারেন দোয়া করুন, আরবীতে বা নিজের ভাষায় দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্যকল্যাণ চাইতে থাকুন ।

অথবা উক্ত দো‘আটি প্রথমে একবার পাঠ করে তারপর আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য দো‘আ পড়বেন। ফের উক্ত দো‘আটি পড়ে আবার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য দো‘আ পড়বেন। শেষ আর একবার এমনভাবে দো‘আ পড়বেন। অর্থাৎ তিন বার এভাবে করবেন। (সহিহ মুসলিম ২১৩৭)

ঘ) দোয়া শেষ করে মারওয়া পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করুন। এখানে কাবাকে উদ্দেশ্য করে হাতের উঠানো বা তাকবীর বলা কিংবা তালুতে চুম্বন করার কোনো নিয়ম নেই। তাওয়াফের মত এখানেও আপনি ইচ্ছে করলে কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, জিকির, ইস্তিগফার করতে পারেন। মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করতে থাকুন নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য এবং মুসলিম মিল্লাতের সবার জন্য। তবে আওয়াজ করে, জোরে শব্দ করে বা দলবদ্ধ হয়ে কোনো জিকির বা দোয়া করা সুন্নাহ সম্মত নয়। অথচ লক্ষ্য করে দেখবেন এখানে অনেকেই এ ভুল কাজটি করছেন।

ঙ) স্বাভবিকভাবে হেঁটে সাফা থেকে মারওয়া পাহাড় এসে পৌছলে ১ চক্কর সম্পন্ন হল। মারওয়া পাহাড়ে উঠে বা যতটুকু সম্ভব মারওয়া পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আবার কা‘বার দিকে মুখ করে দুই হাত উঠিয়ে উপরোক্ত বড় দো‘আটি আবার ৩বার পড়ুন। ঠিক একই পদ্ধতিতে যেমন সাফা পাহাড়ে করেছিলেন।

চ) চলতে চলতে সাফা পাহাড় থেকে কিছু দূর এগুলেই উপরে ও ডানে-বামে সবুজ আলোর বাতি আপনার নজরে আসবে।  এ সবুজ আলোর জায়গাটুকুতে শুধু পুরুষরা আস্তে আস্তে জগিং করার মতো দৌঁড়াবেন (রমল এর মতো)। সবুজ আলো অতিক্রম করার পর আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন। সা‘ঈ করার সময় যতবারই এ সবুজ আলোর জায়গার মধ্য দিয়ে যাবেন ততবারই জগিং করার মতো দৌড়াবেন। কিন্তু মহিলারা এখানে দৌড়াবেন না, স্বাভাবিকভাবেই হাঁটবেন। এবং নিম্মের দোয়াটি পাঠ করতে থাকবে। দোয়াটি হলোঃ

«رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ، إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ»

(উচ্চারণঃ রাবিবগফির ওয়ারহাম ইন্নাকা আনতাল আ‘আযযুল আকরাম)

অর্থঃ ‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন রহম করুন। নিশ্চয় আপনি সমধিক শক্তিশালী ও সম্মানিত।’

ছ) যখনই সবুজ চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করে ফেলবেন তখনি আবার সাধারণ গতিতে হাঁটতে থাকবেন। ‘সাফা’ পাহাড়ে পৌঁছে প্রথমবার যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন এবারও তা এখানে পড়বেন ও করবেন। আবার মারওয়ায় গিয়েও তাই করবেন। এভাবে প্রত্যেক চক্রেই এ নিয়ম পালন করে যাবেন। মারওয়া থেকে হেঁটে সাফা পাহাড়ে পৌঁছলে ২ চক্কর সম্পন্ন হল।

জ) যাদের সাঈ সম্পর্কে জ্ঞান কম তারা মনে করে থাকেন সাফা থেকে মারওয়া গিয়ে আবার সাফায় আসলে এক চক্কর হবে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। সাফা থেকে মারওয়ায় গেলেই এক চক্কর আবার মারওয়া থেকে সাফায় আসলেই এক চক্কর। এমনিভাবে মোট সাতবার যাওয়া আসা করলেই সাত চক্কর সম্পন্ন হয়ে যাবে।

ঝ) মারওয়া’য় গিয়ে যখন সাত চক্কর সম্পূর্ণ হবে তখন চুল কেটে আপনি হালাল হয়ে যেতে পারেন যদি আপনার হাদি কুরবানী হয়ে থাকে। আর যদি হাদি কুরবাণী না হয়ে থাকে তবে অপেক্ষ করুন। এই জন্য অনেক হাদী কুরবানীর পরই তাওয়াফ ও সাঈ করে থাকে। যারা কুরবানীর পর সাঈ করেছেন তারা (পুরুষেরা) মাথা মুন্ডন করবে অথবা সমগ্র মাথা থেকে চুল কেটে ছোট করে নেবে। আর মহিলারা আঙ্গুলের উপরের গিরার সমপরিমাণ চুল কেটে হালাল হয়ে যাবেন। অর্থাৎ ইহরামের কাপড় খুলে অন্য কাপড় পরবেন। ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ আপনার জন্য নিষিদ্ধ ছিল এগুলো এখন বৈধ হয়ে গেল।

ঞ) সাঈ করার সময় কোনো সালাতের ইকামত হলে সঙ্গে সঙ্গে সালাত আদায় করে নিবেন এবং যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকে ফের শুরু করবেন।

ট) সা‘ঈ করার সময় এদিক ওদিক তাকানো ও ঘুরাঘুরি না করে একাগ্রচিত্তে বিনয়ের সাথে সা‘ঈ করাই উত্তম। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া সাঈ করার সময় কথা না বলাই ভালো। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত দোয়াগুলো মুখস্ত করে অর্থ জেনে সাঈ করার সময় পড়তে পারেন।

ঠ) সাঈ করার সময় দলবদ্ধ হয়ে সাঈ করা সহজ্জ। কারণ বেজমেন্ট/প্রথম তলা/দ্বিতীয় তলা/ছাদের উপরও প্রয়োজনে সা‘ঈ করা যায়, তাই সা‘ঈ করার সময় লোকের ভিড় ও চাপ তাওয়াফের তুলনায় কিছুটা কম হয়।

মন্তব্যঃ ঋতুবতী নারীগন বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের অন্য সকল কার্য সম্পাদন করতে পারে বিধায় তারাও এই অবস্থায় সাফা ও মারওয়ার মাঝে সা’ঈ করবে। দলিল হিসাবে কয়েকটি সহিহ হাদিস উল্লেখ করছি।

১. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি মক্কা-য় আসার পর ঋতুবতী হওয়ার কারণে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ও সাফা সা’ঈ করতে পারিনি। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এ অসুবিধার কথা জানালে তিনি বললেনঃ পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ব্যতীত অন্য সকল কাজ অপর হাজীদের ন্যায় সম্পন্ন করে নাও। (সহিহ বুখার ১৬৫০)

২. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে হজ্জ আদায় করে কুরবানীর দিন তাওয়াফে যিয়ারত করলাম। এ সময় সাফিয়্যাহ (রাঃ)-এর ঋতু দেখা দিল। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সঙ্গে তা ইচ্ছা করছিলেন যা একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে ইচ্ছা করে থাকে। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি তো ঋতুবতী। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তবে তো সে আমাদের আটকিয়ে ফেলবে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সাফিয়্যাহ (রাঃ) তো কুরবানীর দিন তাওয়াফে যিয়ারত করে নিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তবে রওয়ানা হও। কাসিম, ‘উরওয়া ও আসাদ (রহঃ) সূত্রে ‘আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, সাফিয়্যা কুরবানীর দিন তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করেছেন। (সহিহ বুখারি ১৭৩৩)

৩. ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, লোকদের আদেশ দেয়া হয় যে, তাদের শেষ কাজ যেন বায়তুল্লাহ তাওয়াফ। তবে এ হুকুম ঋতুবর্তী মহিলাদের জন্য শিতিল করা হয়েছে। (সহিহ বুখার ১৭৫৫)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সাঈ বা সাফা মারওয়া মাঝে দৌড়ানোর বিধান

Leave a comment