বিদআত উৎপত্তির কারনসমূহ দ্বিতীয় কিস্তি

বিদআত উৎপত্তির কারনসমূহ দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

বিদ’আত উৎপত্তির কারণ কি?

আমাদের উপমহাদেশে বিদআত বাদ দিলে মনে হয় আর ধর্ম খুজে পাওয়া যাবেনা। আমরা কেন এত বিদআতে মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছি যা বলে বা লিখে শেষ করা যাবে। আমাদের ধর্মের নামে আমল করছি অথচ এটি একটি বিদআন। তাই বিদআত চিনা আমাদের জন্য খুই জরুরী, তারও আগে জানা দরকার কিভাবে আমাদের ধর্মে এই বিদআদ চালু হল বা বিদআতের উত্সই বা কোথায়। যে উত্স থেকে বিদআত আমাদের মাঝে ঢুকেছে তা নির্ণয় করতে পারলে, উৎসের মুখ বন্ধ করে দিতে পাবর। আর বিদআত থেকে সহজে বাচতে পাবর। যে সমস্ত কারণে মুসলিম জাতির ভিতরে বিদআতের উৎপত্তি হয়েছে, সে কারণগুলো সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

০১। মহান আল্লাহকে বেশী খুসি করার নিমিত্তেঃ

০২। জান্নাত লাভের আশায় বিদআত আমল করেঃ

০৩। জাহান্নামের ভয়ে মরনপন ইবাদাত করার জন্য বিদআত করাঃ

০৪। দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতাঃ

০৫। বাপ দাদার অন্ধ অনুসরণঃ

০৫। সুফি দর্শণ গ্রহনের জন্যঃ

০৭। অজ্ঞ লোক কর্তৃক বিদআত মিশ্রিত দ্বীন প্রচারঃ

০৮।  বিদআত মিশ্রিত দ্বীনি কিতাব প্রচারঃ

০৯। বিদআত মিশ্রিত কিচ্ছা কাহিনীর মাধ্যমে ওয়াজ নসিয়ত করাঃ

১০। প্রবৃত্তি পূজা ও আত্মকেন্দ্রিকতা কারনে বিদআতঃ

১১। আধুনিক মিডিয়ার অপপ্রচারঃ

১২। শ্বাসক শ্রেণির দ্বারা শির্কি কাজ করতে বাধ্য করাঃ

১৩। পীরের আস্তানা বা খানকা মাধ্যমে শির্কঃ

১৪। আলেমদের অন্ধ অনুসরণঃ

১৫। কাফির-মুশরিকদের সাদৃশ্য করাঃ

১৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ির মাধ্যমে বিদআতঃ

১৭। মতবিরোধ পূর্ণ মাসায়েল সুযোগে বিদাআত প্রচন করেঃ

১৮। রাজনৈতিক কারনে বিদআতে প্রসারঃ

১৯। সন্দেহমূলক বস্তুর সাথে জড়িত থাকা ।

২০।  মন্দ লোকদের সংস্পর্শে থাকা ও চলা ।

২১। সহীহ সুন্নাহকে অজ্ঞতা করে মনগড়া বিদআতি আমল করাঃ

 

৬। সুফি দর্শণ গ্রহনের জন্যঃ

বর্তমানে মুসলিমরা যে সকল বিদআতি আমলে জড়িত তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সুফীবাদের বিভ্রান্তি। এই পঁচা মতবাদের কারণেই মুসলিম জাতি শির্ক ও বিদআতের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই মতবাদের কারণে হাজারও মানুষ আজ বিদআতকে ইবাদাত মনে করছে। হাজারও মানুষ ইবাদাতের জন্য কঠোর সাধনা করছে অথচ বিদআতি আমলে জন্য পন্ডশ্রম হচ্ছে। তাদের বিদআতি আমলগুলোর মধ্যে অন্যতাম হলঃ মাজারে ওরস করাকে ইবাদাত মনে করে, মাজারে মান্নত করে, মাজারে জবেহ করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত ও জম্ম দিন কে তৃতীয় ঈদ মনে করে, কবরে সিজদাহ করে, মাধ্যম ছাড়া আল্লাহ পর্যান্ত পৌছান যায় না, মিলাদ কিয়াম করে, অলি আওলিয়াদের কবরের নিকট বরকতের জন্য দোয়া করা, অলি আওলিয়াদের কবরের নিকট গিয়ে কোন কিছু চাওয়া,  নবী বা অলি আওলিয়াদের সৃতি বিজড়িত স্থান থেকে বরকত লাভ করা, তাক্কলিদে শাকসিতে বিশ্বাসি, তাবিজ কবজে বিশ্বাসি, দোয়ায় মৃত নবী, পীর ও অলি আওলিয়াদের অছিলা দেওয়া, স্বন্পকে শরিয়তের দলিল মনে করেনা কিন্তু প্রমান হিসাবে ব্যবহার করে, কলবের তাওয়াজ্জু দানে বা নেক নজরে বিশ্বাসি, পীর ধরা ওয়াজিব মনে করে। পীর ও অলি আওলিয়াদের ছাড়া এছলা সংশোধন হয় না, পীর বা শায়েকের ধ্যান করে, বিপদে পীর বা শায়েকদের আহবান করে, গাউস, কুতুব, আবদাল, নকিব ইত্যাদিতে বিশ্বাসি, এছলা সংশোধন জন্য যে কোন একটা তরিকা ধরতে হবে। সুফিদের মাধ্যমে এমনিভাবে হাজার হাজার বিদআতি  আকিদা আমল প্রচার ও প্রসার ঘটছে।

 

৭। অজ্ঞ লোক কর্তৃক বিদআত মিশ্রিত দ্বীন প্রচারঃ

উপমহাদেশে সাধারনত মুঘোলদের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটে। যদিও তাদের আগে ছিটাফোটা ইসলাম বিদ্ধমান ছিল। মুঘোলদের সময়ে সুফিদের মাধ্যমে ও দ্বীন প্রচার প্রসার লাভকরে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু  অধিকাংশ সুফিগন অজ্ঞ ছিল। সুফিদের দ্বীনের প্রতি খুবই মহব্বত ছিল ইবাদাত বন্দেগিতে তারা খুবই একনিষ্ঠ ছিল। ইবাদাতের জন্য কঠোর সাধনায় জীবন দানেও কুন্ঠাবোধ করতনা কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান বা ইলম কম থাকার কারণে সঠিকভাবে সুন্নাহ মাফিক ইবাদাতটি সম্পন্ন করতে পারতনা। সেই সময়কার সুফিদের প্রচারিত ইসলামে হাজার বিদআতি কাজ দেখা যায়। তাদের আবিস্কৃত শির্কি ও বিদাতি আমল আজও মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। ইবাদতের নামে গান করা, মাযার তৈরি করা, পীর বা অলীদের জম্ম ও মৃত্যু বার্ষিকিতে মাযারে ঊরশ পালন করা। এখানে তিনি দ্বীন প্রচারকারি আল্লাহ পথের দায়ীদের প্রথম গুন হল দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। সকলেই জানে তথ্য, থাকলে আদান প্রদান করা যায়। প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে উত্তর দেওয়া যায়। আর অজানা তথ্য কিভাবে দিবে? ইসলামের মুল প্রতিপাদ্য বিষয় হল কুরআন হাদিসের জ্ঞান একজন দায়ী কি প্রচার করবে তার সিলেভাস কি ইসলাম তা নির্ধানর করেছে।মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

* يَـٰٓأَيُّہَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَ‌ۖ وَإِن لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهُ ۥ‌ۚ *

অর্থঃ হে রসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর, যদি না কর তাহলে তুমি তাঁর বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করলে না। (সূরা মায়িদা ৫:৬৭)।

কাজেই পৌছাতে হবে, ‘ওহী’ যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে। আর এ দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথম শর্ত হলো কুরআন হাদিসের সহিহ জ্ঞান থাকা। আমি যে কাজ করার বা বর্জন করার দাওয়াত দিচ্ছি তা সত্যিই ইসলামের নির্দেশ কিনা তা জানতে হবে। সাধারন বিবেক ও জ্ঞান দ্বারা সকল মানুষ বুঝতে পারে কোনটি ন্যায়, কোনটি অন্যায়, কোনটি ভাল কোনটি মন্দ। যেমন: অন্যের সম্পদ জোর করে দখল করা। কাউকে বিনা কারণে খুন করা। চুরি করা, ডাকাতি করা, মারামারি করা, নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করা, মাদকা দ্রব্য গ্রহন করা অন্যায় কে না জানে। এরুপ অগণিত অন্যায় কাজকে অন্যায় বলে জানতে বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। অনুরূপভাবে মানুষকে বিপদে সাহায্য করা, সান্ত্বনা দেওয়া, অন্যের অধিকারে হস্থক্ষেপ না করা, সৃষ্টির সেবা করা, দরিদ্রকে দান করা, রাস্তা-ঘাট, স্কুল কলেজ নির্মান করা ইত্যাদি ভাল কাজ বলে সবাই বুঝি। কিন্তু ইসলামি ধর্মে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে মানুষ কে সত্যিকার মুসলিম হিসাবে তৈরি করতে পারবনা।

যেমন: তাওহীদের জ্ঞান, শির্কের জ্ঞান, আকিদার জ্ঞার, ফিকহের জ্ঞান, বিদআতের জ্ঞান ইত্যাদি। এ স্পষ্ট জ্ঞান হলো ওহীনির্ভর জ্ঞান বা কোরআন ও হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 قُلۡ إِنَّمَآ أُنذِرُڪُم بِٱلۡوَحۡىِ‌ۚ وَلَا يَسۡمَعُ ٱلصُّمُّ ٱلدُّعَآءَ إِذَا مَا يُنذَرُونَ (٤٥) 

অর্থঃ তাদেরকে বলে দাও, আমি তো অহীর ভিত্তিতে তোমাদেরকে জানাচ্ছি”-কিন্তু বধিররা ডাক শুনতে পায় না, যখন তাদেরকে সতর্ক করা হয়৷ (সূরা আম্বিয়া ২১:৪৫)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنۡ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰٓ إِلَىَّ وَمَآ أَنَا۟ إِلَّا نَذِيرٌ۬ مُّبِينٌ۬ (٩)

আমি তো কেবল সেই অহীর অনুসরণ করি যা আমার কাছে পাঠানো হয় এবং আমি সুস্পষ্ট সাবধানকারী ছাড়া আর কিছুই নই৷ (সুরা আহকাফ-৪৬:৯)।

 এজন্য দাওয়াতের দায়িত্ব পালনকারীকে কোরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্টরূপে জানতে হবে, যে কাজ করতে বা বর্জন করতে তিনি দাওয়াত দিচ্ছেন তার শরয়ি বিধান কি এবং তা পালন-বর্জনের দাওয়াতের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শেখানো পদ্ধতি কি? কাজটি সৎকর্ম হলে তা ফরজ, ওয়াজিব, মুসতাহাব ইত্যাদি কোন পর্যায়ের ইত্যাদি স্পষ্ট কোরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে হবে। ওহীর স্পষ্ট নির্দেশনা ব্যতীত সাধারণ ধারণা, আবেগ আন্দাজ ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম বলতে কোরআনুল কারিমে নিষেধ করা হয়েছে। পরিস্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হালাল ও হারাম করার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। এরশাদ করা হয়েছে:

وَلَا تَقُولُواْ لِمَا تَصِفُ أَلۡسِنَتُڪُمُ ٱلۡكَذِبَ هَـٰذَا حَلَـٰلٌ۬ وَهَـٰذَا حَرَامٌ۬ لِّتَفۡتَرُواْ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ‌ۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ لَا يُفۡلِحُونَ (١١٦)

অর্থঃ আর এই যে, তোমাদের কণ্ঠ ভুয়া হুকুম জারী করে বলতে থাকে এটি হালাল এবং ওটি হারাম, এভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না৷ যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবে না৷ (সূরা নাহল: ১১৬)।

মন্তব্যঃ দায়ী ও মুবাল্লিগকে অবশ্যই সর্বদা বেশি বেশি কোরআন ও হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, ও অন্যান্য ইসলামি গ্রন্থ অধ্যায়ন করতে হবে। কোরআন-হাদিস বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আলেমদের রচিত গ্রন্থদি পড়ে দীনকে জানার চেষ্টা করা কঠিন অন্যায় এবং কোরআন হাদিসের প্রতি  অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন।

মহান আল্লাহ কোরআনকে  সকল মানুষের হেদায়েতরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি তা বুঝা সহজ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য তাঁর মহান সুন্নাত ও হাদিস রেখে গিয়েছেন। এগুলির সার্বক্ষণিক অধ্যায়ন মুমিনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত, শ্রেষ্ঠতম জিকর ও দাওয়াতের প্রধান হাতিয়ার। বর্তমান বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা সহজেই দেখতে পাই, আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে যারা ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছে তারা নিজেরাই ইসলাম সম্পর্কে ভীষন অজ্ঞ। জাহেল বা অজ্ঞ লোকেরা মনে করছে দিন প্রচার করছে অথচ তারাই দ্বীনের বারটা বাজাচ্ছে। তাই বিদআদ থেকে বাচতে হলে বিদআত বর্জিত দ্বীন প্রচার করতে হবে।

 

৮।  বিদআত মিশ্রিত দ্বীনি কিতাব প্রচারঃ

বাংল ভাষায় দ্বীনি কিতার রচনার ক্ষেত্রে আমরা চরম অবহেলা লক্ষ করি। অনেক পরে যে সকল কিতাব লেখা হয় তাও আবার সঠিক ছিল না। একটু লক্ষ করলেই ব্যাপাটি ষ্পষ্ট হয়ে যাবে। ইসলাম পৃথিবীতে আগমন করে সপ্তম শতকের (৬২২ সালে) প্রথম দিকে। আর আমরা বাংলা ভাষাভাষি, বাংলায় কুরআন হাদিস পাই প্রায় এগার শত বছর পর ঊনিষ শতকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া ১৮০৮ সালে প্রথম আমপারার তরজমা প্রকাশ করেন। রাজেন্দ্রনাথ মিত্র কুরআনের অনুবাদ করেন ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ। তার অনুবাদ পূর্ণাঙ্গ ছিল না, কয়েক খণ্ড ছিল।  গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। টাঙ্গাইলের করটিয়া থেকে মৌলভি নঈমুদ্দিন ১৮৮৩ সালে ‘আকবারে ইসলামিয়া’ নামে মাসিক পত্রিকার মাধ্যমে আল-কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ করতে থাকেন এবং ১০ পারা পর্যন্ত অনুবাদ সমাপ্ত করে তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯০৮ সালের ২৩ নভেম্বর। সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বুখারির অণুবাদ করেন সাইখুল হাদিস আজিজুল হক সাহেব (রহ:)। তিনি ১৯৫৭ সালে অনুবাদের কাজ শুরু করেন ৩৫ বছর পর ১৯৯২ সালে হাদীসের ব্যাখ্যাও পেশ করেছেন পূর্ণাঙ্গ বুখারির। এর আগে আশির দশকেও খন্ড খন্ড প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামি ফাইন্ডেশন প্রকাশ করে ১৯৯১ সালে। এভাবে সহিহ মুসলিম প্রকাশ হয় ১৯৯৯ সালে, আবু দাউদ হয় ১৯৯০ সালে। অবশ্য এর আগে আগে আশির দশকে তাফসিরে ইবনে কাসির, মারেফুল কুরআন ও তাফহিমুল কুরআনসহ বেশ কিছু তাফসির প্রকাশিত হয়।

ইসলাম আগমনের পর প্রায় এগার শত বছর পর্যান্ত ইসলাম ছিল শুধু মানুষের মুখে মুখে। শুনা কথা যদি বছরের পর বছর চলতে থাকে, তবে তার আসল নকল খুজে পাওযা ভার। কুরআনের অনুবাদ টুকু বাদ দিলে, সহিহ ইসলাম প্রকাশিত হয় আশির দশকে। তবে কিছু আলেম ছিলেন, যারা ইংরেজ আমল (১৭৫৭-১৯৪৭) নানা মুখি তত্পরতার মাধ্যমে সহিহ ইসলামের বানী প্রচার করছেন। কিন্তু তারা ইসলাম ধর্মের আকিদা আমল সম্পের্কে কোন বাংলায় কিতার প্রকাশ করেনি। ঠিক তখন মৌলভি মোঃ গোলাম রহমান ‘মকছুদুল মুমিনীন’ নামে একটি বই প্রকাশ করে, ইতোমধ্যে বইটির অর্ধশতাধিক সংস্করণ প্রকাশিত ও নিঃশেষিত হয়েছে। উপহার হিসেবে বিয়েতে পাওয়ায় কিংবা ক্রয় সুবাদে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ অল্পশিক্ষিত মুসলিম দম্পতির ভাণ্ডারেই এই গ্রন্থটি সংরক্ষিত আছে। যারা নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন করে না, তারাও এটির অধ্যয়ন ও চর্চা করে থাকে। ব্যবহারিক ইসলামের অন্যতম প্রামাণিক সংকলন হিসেবে এটি তাদের কাছে গৃহীত। অথচ বর্তমান আলম সমাজ ‘মকছূদুল মুমিনীন’ বইটি সম্পর্কে বলেন, বইটি মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। এ বইটি ক্রয় করা যাবে না, পড়াও যাবে না। কারণ বইটি জাল, যঈফ, মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনীতে ভরপুর। শরিয়ত বিরোধী অনেক মাসায়েল আছে। আলেম সমাজ যদি সেই সময় কোন সহিহ কিতাব রচরা করত, তবে কি আমরা এই সকল ভুলে ভরা বই পড়ে বিভ্রান্ত হতাম। মৌলভি মোঃ গোলাম রহমান ‘মকছুদুল মুমিনীন’ লিখে হয়ত ভুল আমলের শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু আলেম সমাজ কি দিল? তাই আমরা ‘মকছূদুল মুমিনীন’ বইটি বর্জন করি, আর মৌলভি মোঃ গোলাম রহমানের জন্য দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন তার ভুল ত্রুটি মাপ করে, তার চেষ্টাটুকু কবুল করেন।

এভাবে নিয়ামুল কুরআন, তাসকেরাতুল আওলীয়া, তাসকেরাতুল আম্বিয়া, বিশ্ব নবী (গোলাম মস্তফা), বিষাদ সিন্ধুসহ (মীর মোসারফহোসেন) আরও কিছু বই প্রকাশিত হয় যা কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তক ছিলা না। আবার আমাদের দেশে সহিহ হাদিস গ্রন্থগুলি অনুবাদের আগে ইমাম গাজ্জালী (রহ) এর অনেক বই অনুবাদ হয়েছে। অধিকাংশের ধারনা ইমাম গাজ্জালী (রহ) সকল লেখা শতভাগ বিশুদ্ধ। আসলে ব্যপারটি এমন নয়, উনি গ্রন্থ লেখার ক্ষেত্রে সহিহ জঈফ যাচাই বাচাই করেন নি। তাই ওনার লেখা বই থেকে হাদিস সম্ভলিত কোন কিছু গ্রহন করতে হলে তাহকিক (খোজ খবর) করে গ্রহন করতে হবে।

মন্তব্যঃ মুল কথা হল, আশির দশকের আগে কোন সহিহ কিতার বাংলায় প্রকাশ হয়নি। তাইতো, বর্তমানে যদি কাউকে শির্কি বা বিদাতি আমল করতে দেখেন, আর যদি বলেন আপনার আমলটি কিন্তু ভুল, সে অমনি রেগে গিয়ে বলবেন এতদিন তাহলে ভুল করলাম, বাপ দাদা সকলেই ভুল ছিল, অমুক হুজুর কি কম বুঝে, তুমি বাবা একটু আধটু ইলম নিয়ে বেশী ফটফট করছ। এখন নতুন ইসলাম দেখলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিদআত বিস্তারে এই সকল ভুলে ভরা কিতাবের অনেক অবদান আছে।

 

৯। বিদআত মিশ্রিত কিচ্ছা কাহিনীর মাধ্যমে ওয়াজ নসিয়ত করাঃ

যুগ যুগ ধরে ইসলাম প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হল ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন। প্রতি বছর বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি, ক্লাব, মসজিদ কমিটি, মদ্রাসা কমিটি এবং ব্যক্তি উদ্দ্যগেও বিভিন্ন সময় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দেশের নামি দামি সুরেলা কন্ঠের অধিকারি বক্তাগন, সে সব মাহফিল মুল্যবান ওয়াজ করে থাকেন। তাদের ওয়াজের বিষয় বস্তু খুজে পাওয়া ভার। মাঠ গরম করার জন্য অনেক সময় কল্পিত গল্পের অবতারনা করে। তবে বিষয় বস্তু সম্বলিত আলোচনা আজ আর দুর্লভ নয়, যা আগের দিনে ভাবাও যেত না। এখনও প্রতিযোগিতা আছে কার কন্ঠ কত সুরেলা, কত মিষ্ট কন্ঠে শ্রতাদের মন জয় করতে পারে। শ্রতাদের দোষ কম নয়, তারাও চায় তাদের কে কত কাদাতে বা হাসাতে পারে। শ্রতাদের মন জয় করতে গিয়ে অনেক সময় অনুমান ভিত্তিক মিথ্যা কথার প্রচার করে। আলেম হওয়া সত্বেও আল্লাহর বানী ভুলে যান। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

 إِنَّمَا يَفۡتَرِى ٱلۡكَذِبَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِـَٔايَـٰتِ ٱللَّهِ‌ۖ وَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمُ ٱلۡڪَـٰذِبُونَ (١٠٥) 

অর্থঃ ‘মিথ্যা তো তারাই বানায় যারা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যুক। (সূরা নাহাল ১৬:১০৫)

হাফস বিন আসেম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেনে, ‘ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনবে তাই বলবে।’( সহহি মুসলিম)

অনেকে ভাবেন লোকদের ইসলামের দিকে আহবান করলে মিথ্যা বলায দোষ নেই। তাই তারা দানের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের স্পষ্ট নির্দেষনা থাকা সত্বেও মিথ্যা কল্পিত হাদিস বর্ননা করে। শবে কদর, শবে মিরাজ সম্পর্কে হাদিস তৈরি করছে। আবার অলীদের নামে এমন সব মিথ্যা আজগোবি কিরামত তৈরি করে যা শির্কে আকবর। অনেক আধা আলেম যাদের জাল জঈফ সম্পর্কে জ্ঞান নেই, তারা যা শুনেছে, যা পড়েছে, যেখান থেকে হোক পড়েছে অথবা যা দেখেছে, কোন বাচ বিচার না করে সুন্দর কন্ঠে বর্ননা করছেন, বাহ্‌বা নিচ্ছেন। উদাহরনের জন্য কয়েকটার শিরোনাম দিলাম:

এই সব মতলববাজ বক্তারা সুন্দর দরদী কণ্ঠ দিয়ে মিথ্যা হাদিস, নবীদের নামে মিথ্যা রটনা, অলীদের নামে কিচ্ছা কাহিনী ও কিরামতি শুনিয়ে মানুষকে কাঁদান। এখানে আরো লক্ষণীয় বিষয় হল, ইসলাম সম্পর্কে জানার ও ইসলামী শরী‘আতের উৎস হল, কুরআন ও হাদিস। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে ইসলাম সম্পর্কে জানার আর কোন মাধ্যম বা অবকাশ নাই। কিন্তু মুসলিমরা এ দুটি বিষয়কে বাদ দিয়ে এক শ্রেণীর নাম-ধারী আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদ যারা তাদের মনগড়া, মিথ্যা, বানোয়াট ও কল্পকাহিনীকে ইসলামের নামে চালিয়ে যায়, তাদের থেকে ইসলাম শিখে। তাদের খপ্পরে পড়ে একশ্রেণীর মুসলিম প্রতিনিয়ত বিদআতে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে তারা না জেনে না বুঝে মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং ইসলামের সত্যিকার জ্ঞান লাভ হতে বঞ্চিত হয়।

 

১০। প্রবৃত্তি পূজা ও আত্মকেন্দ্রিকতা কারনে বিদআতঃ

প্রবৃত্তির অনুসরণ তাকে বিদআতের দিকে ধাবিত করে। বিদআতি কাজে সব সময় মজা বা আনন্দ থাকে। যেমনঃ উরস, মিলাদ, জম্ম দিন, মৃত্যু বার্ষিকী ইত্যাদিতে প্রচুর লোকের সমাগম হয় আর প্রবৃত্তি এ থেকে প্রচুর মজা নেয়।  প্রবৃত্তি তাকে মন চাহে জীবন যাপন করতে উৎসাহিত করে। প্রবৃত্তির প্রধান চাহিদা টাকা পয়সা, পদমর্যাদা ও ক্ষমতার লোভ এতই প্রকট, তারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে ইসলামের অনুশ্বাসন বিকিয়ে দিতে বিন্দু পরিমাণও কুণ্ঠাবোধ করে না। বিদআতি কাজের মাধ্যমে আয় রোজগার ভাল হয়। যার ফলে মনের কামনা-বাসনা পুরন করতে সহজ হয়। তাই বিদআতি কাজ বুঝতে পারলেও প্রবৃত্তির চাহিদার নিকট মাথানত করে বিদআতি কাজে লিপ্ত থাকে। প্রবৃত্তি তার মন্দ আমলগুলিকে চাকচিক্যময় করে দেয় তখন থেকে ভাবতে থাকে দুনিয়ার জীবনই আসল জীবন। আর তখন থেকে তার সাথে আল্লাহর সম্পর্কে অবক্ষয় ঘটে। সে সালাত সাওম ছেড়ে দেয়। আল্লাহর স্মরণ থেকে মন গাফেল হয়ে যেতে থাকে। তার গাফলতি যতই বাড়তে তাকে ততই তার প্রবৃত্তির বেড়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্র ও ব্যবহারিক জীবনের সকল ক্ষেত্র আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে নিজের মনগড়া পদ্ধতির অনুসারী হয়ে বিদআতি লিপ্ত হয়। আর তখন সে ইসলামের পরিবর্তে প্রবৃত্তির পূজাকে বেচে নেয়। তাছাড়া শয়তার বিদআতি কাজে সুন্দর ও চাকচিক্যময় করে তুলে ধরে যার ফলে বিদআতি তার কাজে খুবই মজা পায় এবং প্রবৃত্তিয় কামনার কাছে হার মেনে বিদআতে লিপ্ত থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعً۬ا قَبۡضَتُهُ ۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَـٰمَةِ وَٱلسَّمَـٰوَٲتُ مَطۡوِيَّـٰتُۢ بِيَمِينِهِۦ‌ۚ سُبۡحَـٰنَهُ ۥ وَتَعَـٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ (٦٧) 

অর্থঃ যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে আগত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত সে কি তার মত, যার মন্দ আমল তার জন্য চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে এবং যারা তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে? (সূরা যুমার ৩৯:৬৭)।

প্রবৃত্তি পুজারী বিদআতি লোক এক সময তাদের মন্দ কাজকে এত ভালবাসে যে নিজের প্রবৃত্তির কামনাকে প্রভু রূপে গ্রহণ করে, ফলে সে আর কখন বিদআত ছেড়ে সঠিক পথে আসতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

 وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٍ۬ فَجَعَلۡنَـٰهُ هَبَآءً۬ مَّنثُورًا (٢٣)

অর্থঃ কখনো কি তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছো, যে তার নিজের প্রবৃত্তির কামনাকে প্রভু রূপে গ্রহণ করেছে?  তুমি কি এহেন ব্যক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে পার?  (সুরা ফুরকান -২৩)।

বিদআতি ব্যক্তি যখন তার প্রবৃত্তির কামনাকে মাবুদে পরিণত করে তখন তার প্রবৃত্তির কামনা আর বিদআতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তখন তার বিদআত শির্কে পরিনত হয় এবং এই কাজ ঠিক মূর্তি পূজা করার মত পাপ হতে থাকে।

আবু উমামাহ রেওয়ায়াত করেছেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ আকাশের নীচে যতগুলো উপাস্যের উপাসনা করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপাস্য হচ্ছে এমন প্রবৃত্তির কামনা করা যার অনুসরণ করা হয়। (তাবরানী)

 

প্রবৃত্তির পুজার কারণেই মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবেঃ

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ যখন জান্নাত সৃষ্টি করেছেন জিবরিলকে বলেছেন, যাও তা দেখ। সে গেল ও তা দেখল অতঃপর এসে বলল: হে আমার রব, আপনার ইজ্জতের কসম তার ব্যাপারে কেউ শুনে তাতে প্রবেশ ব্যতীত থাকবে না। অতঃপর তা কষ্ট দ্বারা ঢেকে দিলেন। অতঃপর বললেন, হে জিবরিল যাও তা দেখ, সে গেল ও তা দেখল অতঃপর এসে বলল, হে আমার রব, আপনার ইজ্জতের কসম আমি আশঙ্কা করছি তাতে কেউ প্রবেশ করবে না। তিনি বলেন, আল্লাহ যখন জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন বলেছেন, হে জিবরিল যাও তা দেখ, সে গেল ও তা দেখল অতঃপর এসে বলল, হে আমার রব, আপনার ইজ্জতের কসম, তার ব্যাপারে কেউ শুনে তাতে কখনো প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি তা প্রবৃত্তি দ্বারা ঢেকে দিলেন অতঃপর বললেন, হে জিবরিল যাও তা দেখ, সে গেল ও তা দেখল অতঃপর এসে বলল: হে আমার রব, আপনার ইজ্জতের কসম আমি আশঙ্কা করছি তাতে প্রবেশ ব্যতীত কেউ বাকি থাকবে না”। [আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ি ও আহমদ] হাদিসটি হাসান।

এক সময় মুসলিমদের অবস্থা এমন ছিল, সারা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ দিয়েও তাদের ঈমানকে খরিদ করা যেত না। বর্তমানে তাদের প্রবৃত্তির কাছে ঈমান এতই দুর্বল যে, বিদআত থেকে বাচার মত কোন কোন ক্ষমতা নাই।

 

১১। আধুনিক মিডিয়ার অপপ্রচারঃ

বর্তমানে শির্ক বিস্তারে মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাপক। প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ভাবে মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য তাকে মিডিয়ায় কাজ করতে হবে না। যে লোকটা ইন্টার নেট কি, বুঝেনা। পেপার পত্রিকা পড়তে জানেনা, সে প্রতিদিন ২/১ ঘন্টা টিবি সেটের সামনে বসে থাকে। কাজেই ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মিডিয়ার ভুমিকা অপরিসিম। এখন প্রশ্ন হল মিডিয়া কিভাবে বিদআত বিস্তার করে? মিডিয়ার কাজই হল ভালমন্দ সমানভাবে প্রচার করা। পূর্বে বিদআতি আমল বা কাজগুলি অনেকটা গোপনে করা হত, এত প্রচার পেত না। এখন মিডিয়ার কল্যানে সে সকল বিদআতি আমল বা কাজ আমরা সরাসরি দেখি। মিডিয়ার কল্যারে আজে বিদআতিদের বড় বিদআতি অনুষ্ঠান ঈদে মিলাদুন নবী সরাসরি লাইফ দেখছি। বিদআতি এই সকল অনুষ্ঠান দেখার ফলে নতুন প্রজম্ম মনে করে এই সবই আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা দেশপ্রেমের অংশ। আরও কয়েকটা উদাহরন দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যাবে আশা করছি।

প্রথম উদাহরনঃ  বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ এতে কোন সন্ধেহ নেই। যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে বিষেশ করে হিন্দুদের মধ্যে এর প্রভার ছিল লক্ষণীয়। এ উপলক্ষে ঢাকা চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই অনুষ্ঠানের এত বেশী কল্পিত মুর্তি বা রাহুর প্রতিকৃতি (বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, কুমির) থাকে যে, আপনি আগে ভাগে অনুষ্ঠান সম্পর্কে না জানলে হয়ত ভাববেন, ইহা হিন্দুদের কোন অনুষ্ঠান। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙ্গালী সংস্কৃতির কোন অংশ নয়। কিন্তু আধুনিক মিডিয়ার প্রচার ফলে আমরা ইহাকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ মনে করছি।  ইদানিং মিডিয়ার কল্যানে এত লোকের সমাবেশ ঘটে যা কয়েক বছর আগেও ছিল কল্পনাতীত। ছেলে মেয়েদের নাচগান দেখলে মনে হবে ইউরোপ আমেরিকান প্রভাবপুষ্ট কনসার্ট প্রোগ্রাম। বাঙ্গালী সংস্কৃতি উদযাপনের নামে অশালীন কাজে ডুবে যাচ্ছি বা শির্ক  ও বিদআতের মত  ভয়াবহ  কোন পাপে লিপ্ত হচ্ছি। 

দ্বিতীয় উদাহরনঃ  ইসলামি রিতী অনুসারে কেউ মারা গেলে তাকে জানাজার সালাতের মাধ্যমে দোয়া করতে হয়।  কিভাবে করতে হবে, কখন করতে হবে এর ও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বর্তমানে মিডিয়ার কল্যানে দেখতে পাই, কোন নামকরা বিখ্যাত ব্যক্তি মারা গেলে তাকে কয়েক বার জানাযা দিতে হয়। তার মৃত দেহ শহীদ মিনারে বা অন্য কোন স্থানে রেখে ফুলের শুভেচ্ছা জানাতে হবে। সমাজের তার অনুসরি ব্যক্তি, দল বা সংগঠন ফুলেল তোড়া নিয়ে আসবেন আর তার মৃত দেহের উপর রেখে শুভ কামনা করবেন। এখানে হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ বা মুসলিমের হিসাবে কোন জাতীভেদ নাই। নতুন প্রজম্ম যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান নেই মিডিয়ার কল্যানে লাইভ দেখে ভাববে এটাই ইসলাম, এটাই আমদের সংস্কৃতি, এটাই নিয়ম। কোন সহিহ, জঈফ বা জাল হাদিসেও নেই, কেই মারা গেলে ফুলের শুভেচ্ছা দিতে হয়। সহিহ বুখারির এক বর্নণায় এসেছে, একজন সাহাবি রাতে মারা গেলন আর অন্য সাহাবিগন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে অবহিত না করে রাতেই তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলেন। আর আমরা মৃত্যুর পর তিন চার দিন পর্যান্ত দেরি করছি।

 ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মারা গেল । যার অসুস্থতার সময় রাসূলুল্লাহ্(সাঃ) খোঁজ-খবর নিতেন । তাঁর মৃত্যু হয় এবং রাতেই তাঁকে দাফন করেন । সকাল হলে তাঁরা (এ বিষয়ে) রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে অবহিত করেন । তিনি বললেনঃ আমাকে সংবাদ দিতে তোমাদের কিসে বাধা দিল? তারা বলল, তখন ছিল রাত এবং ঘোর অন্ধকার । তাই আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমরা পছন্দ করিনি । তিনি ঐ ব্যক্তির কবরের কাছে গেলেন এবং তাঁর উপর সালাতে জানাযা আদায় করলেন ।(সহিহ বুখারী, খন্ড:২, হাদিস:৩৩৯)।

তৃতীয় উদাহরণঃ যাদের ইসলাম সম্পর্কে গভির জ্ঞান নেই তারাও জানেন ইসলামে তাবিজ, কবজ, পাথরের ব্যবহার নিষিদ্ধ। অথচ ইদানিং বিভন্ন টিবি চ্যানেলে পৈন্যের বিজ্ঞাপনের মত তাবিজ, কবজ, পাথরের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। সমাজের নাম করা কিছু ভন্ড প্রতারক মিথ্যুক শ্রেণীর আলেম ‌ইসলামের নামে এই প্রতারনা মুলক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞ মানুষেরা এদের ফাদে পা দেন বেশী। মিডিয়ার প্রচার না থাকলে হয়তো অনেকে জানতোই না। ইসলামে গনক বা জ্যাতীষির কাছে যাওয়া হারাম, তার কথা বিশ্বাস করা শির্ক। বিভিন্ন টিবি চ্যানেলে রাশিফল নামে প্রতিদিন অনুষ্ঠার করার পাশাপাশি জ্যাতীষির নামে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষেরা মিডিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন পেয়েই না বুঝে শির্ক বিদআতে লিপ্ত হচ্ছে।

চতুর্থ উদাহরনঃ বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাশন চলছে। ডিন এন্টিনার সুবাধে আজ কাল ঘরে বসেই পৃথিবীর যে কোন দেশ আর তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি লাভ করছি। কোন সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি লাভ করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাদের শির্ক বিদআত মিশ্রিত সংস্কৃতি গ্রহন করা ইসলামের দৃষ্টিতে মহা অন্যায়, মহা পাপ। যেমন: ইন্দিয়ান টিবি চ্যানেলে সিলিয়ার দেখে, তাদের বিবাহের নিয়ম চালু করা, ঘরে সন্ধ্যা বাতি দেওয়া, চলার পথে শুভ অশুভ ভাবা, সকাল সন্ধ্যায় মঙ্গল কামনায় ধুপের ধোয়া দেওয়া, ভূত ফেতনিতে বিশ্বাস করা। মিডিয়ার অবাধ প্রচার না থাকলে হয়তো এই বিদআতি কাজ থেকে বাচতে পারতাম।

পঞ্চম উদাহরনঃ  আজ কার বিভিন্ন চ্যানেলে ইসলামি অনুষ্ঠান হয়। দেশের স্বনাম ধন্য অনেক আলেম এই সকল অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অনের সাধারন মানুষ দৈনন্দিন আনেক সমস্যার সমাধান এখান থেকে পেয়ে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হল ভন্ড প্রকৃতির আলেম সমাজ, তারাও বিভিন্ন চ্যানেলে ইসলামি অনুষ্ঠানের নামে বিদআতি আমল প্রচার করছে। সাধারন মুসলিম যাদের বিদআত সম্পর্ক জ্ঞান নেই তারাই সবচেয়ে বেশী প্রতারিত হচ্ছে। আর আগের থেকে আরো বেশী বিদআতী আমলে লিপ্ত হচ্ছে।

 

১২। শ্বাসক শ্রেণির দ্বারা শির্কি কাজ করতে বাধ্য করাঃ

মুসলিম প্রদান দেশে ইসলামি আইন না থাকলে, মানব রচিত আইনের কাছে অসহায় হয়ে অনেক সময় বিদআত করতে বাধ্য হতে হয়। আবার অনেক সময় রাষ্ট্রের আনুগত্তের কারণেও বিদআতি কাজে লিপ্ত হতে হয়। একটা উদাহরন দিলে ব্যপারটি পরিস্কার হবে।

১৫৭০ সালের দিকে বাদশাহ আকবর এক নতুন ধর্মচিন্তায় নিয়া হাজির হন ভারতীয় উপমহদেশের মঞ্চে। তিনি  মুসলিম হিন্দু, ইয়াহুদি, নাসারা, জৈন, বৌদ্ধসহ সলক ধর্মের সমন্বয়ে এক নতুন ধর্ম সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। সর্বশেষ বিকৃতি ও বিভ্রান্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৫৮২ সালে ইসলামের মূলভিত্তিকে কুঠারাঘাত করে দ্বীন-ই-ইলাহী নামক নতুন ধর্মমতের প্রবর্তন করেন। তার এই ধর্মে সকল ধর্মের মূল সত্যগুলোকে সমন্বিত করে একটি সার্বজনীন পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি প্রণয়ন করা। এ পদ্ধতির নামই হল দ্বীনে-ই-ইলাহী। এই ধর্মের কয়েকটি আপত্তিকর নিয়মনীতি হল, ইসলামী বিশ্বাসের প্রধান বাণী কলেমার পরিবর্তন, মদ সুদকে হালাল ঘোষণ, আরবী শিক্ষা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা, অগ্নি, বৃক্ষ, সূর্য ইত্যাদির রাজদরবারেই পূজা করার বৈধতা, দাঁড়ি কামিয়ে ফেলার নির্দেশ, গরু, মহিষ ও উট যবাই নিষিদ্ধ করা, অনেক মসজিদকে মন্দিরে পরিবর্তনের হুকুম। রোযা পালন, হজ্বে গমন বে-আইনী ঘোষণা, শুকর ও বাঘের মাংস ভক্ষণ বৈধ ঘোষণা ইত্যাদি। যা ছিল ইসলামের সাথে একেবারেই সাংঘশিক। তাই প্রকৃত কোন মুসলমানই এই শির্ক বিদআত মিশ্রিত ধর্মমত মেনে নিতে পারেনি। অনেক ভারতীয় আলেম ওলামা আকবরের এই ধর্মনীতিতে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। তারা তার শ্বাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ক্ষমতার বলে বাদশাহ আকবর এই বিদ্রোহ নিবারণে সমর্থ হন। অনেক নামধারী মুসলিম রাষ্ট্রিয় আনুগত্যের কারণে হোক আর অজ্ঞতার কারণে হোক আকবরের দ্বীনে-ই-ইলাহী মেনে নিয়ে ছিল।

আজও আমরা রাষ্ট্রে বা দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে অনেক শির্কি ও বিদআতি কাজে লিপ্ত হচ্ছি। রাষ্ট্রের কেউ মারা গেলে শোক প্রকাশার্থে সংসদে দাড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করছি। বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় দিবসে   মিলাদ বা দোয়া মাহফিলে অংশ গ্রহন করছি। বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় দিবসে মাযারে বা প্রতিকৃতির সামনে নিরবে দাড়িয়ে থাকি, ফুল দিয়ে সম্মান জানাই। হয়ত আমরা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের কারণে শির্কি বা বিদআতি কাজটি করছি। তাহলে সাধারন অজ্ঞ লোক কিভাবে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া বিদআত থেকে বাচবে?

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

 

Leave a comment