সদাকাতুল ফিতরার বিধান

এ প্রবন্ধে যে সকল বিষয় আলোচিত হবে:

১) সদাকাতুল ফিতরা এর অর্থ কি?

২) ফিতরার বিধান।

৩) কাদের উপর ফিতরা ফরজ?

৪) ফিতরার ফজিলত সমূহ।

৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কি কি দ্বারা ফিতরা দেওয়া হত?

৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কি পরিমাণ ফিতরা দেওয়া হত?

৭) ‘সা’ এর পরিমান কতটুকু?

৮) ফিতরা আদায়ের উপযুক্ত সময় কখন?

৯) ফিতরা আদায়ের উপযুক্ত স্থান ও সময় কখন?

সদাকাতুল ফিতর এর অর্থ কি?

সদাকা এবং ফিতর দুটি আরবি শব্দ। সদাকাতুন (صدقةُ) আরবি শব্দ। যার বাংলা অর্থ হল দান।

আর এই দান প্রধানতঃ দুই প্রকার,

প্রথম প্রকার হলঃ ওয়াজিব দান (যা বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক)।

দ্বিতীয় প্রকার হলঃ দুই. নফল সদকা (যা বাধ্যতামূলক নয় তবে অনেক সাওয়াবের কাজ)। ওয়াজিব দান সমুহ হলঃ (ক) জাকাত দেওয়া। (নিসাবের মালিক হলে প্রতি বছর অর্থের জাকাত ও শস্যাদির ওশর প্রদান করা)।

(খ) রমজানে রোজার ফিতরা প্রদান করা

(গ) নজর বা মানত পূর্ণ করা।

(ঘ) সামর্থ্য থাকলে প্রতি বছর কোরবানী করা।

আরবিতে ফিতর বা ফাতূর বলা হয় সেই আহারকে যা দ্বারা রোযাদার রোযা ভঙ্গ করে। তাহলে সদাকাতুন ফিতর বলা হয় ঐ জরুরী দানকে যা, রোযাদারেরা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অভাবীদের দিয়ে থাকে। যেহেতু দীর্ঘ দিন রোযা অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকার পর ইফতার বা আহার শুরু করা হয়। সে কারণে এটাকে ফিতরের তথা আাহারের যাকাত বলা হয়। সদাকাতুন ফিতরকে ইসলামি শরিয়তে অনেকে যাকাতুল ফিতরও বলে থাকেন। আমদের সমাজে এটাকে রমজানের রোজার ফিতরা হিসাবে আদায় করা হয়ে থাকে।

ফিতরার বিধানঃ

সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা একটি ফরজ ইবাদত। ইহা নারী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে সকলকেই জন্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কোরআনে কিছু বর্ণিত হয় নি কিন্তু সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত একটি ফরজ ইবাদত। রাসূলের সকল আদেশ নিষেধ আমাদের জন্য বিনা বাক্যে মেনে নেয়া ফরজ। ফলে কোরআনে বর্ণনা না আসলেও রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এ আমলটি সম্পাদন করা আমাদের জন্য আবশ্যিক বা ফরজ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মুসলিমদের উপর আবশ্যক করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,

﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظٗا ٨٠﴾ [النساء: ٨٠

অর্থঃ যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি, (সুরা নিসা ৪:৮০)।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন:

﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء: ١١٥]

অর্থঃ যে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকে ফিরাব যে দিকে সে ফিরতে চায় এবং আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। তা নিকৃষ্টতম গন্তব্যস্থল। সুরা নিসা ৪: ১১৫)।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧﴾ [الحشر: ٧]

অর্থঃ ‘আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।’ (সুরা হাসর :৭)।

ফিতরার ব্যাপারে বোখারি শরিফের মূল্যবান একখানা হাদিস হলো,

আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমান গোলাম-স্বাধীন, পুরুষ-নারী এবং ছোট-বড় সকলের উপর এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব জাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ করেছেন। এবং আদেশ করেছেন, লোকজনের ঈদগাহে যাওয়ার আগেই যেন তা আদায় করা হয়। [ভাষ্য সহিহ বুখারী ১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৭, ১৫১১, ১৫১২, মুসলিম ৯৮৪, তিরমিযী ৬৭৫, ৬৭৬, নাসায়ী ২৫০০, ২৫০১, ২৫০২, ২৫০৩, ২৫০৪, ২৫০৫, ২৫১৬, আবূ দাউদ ১৬১১, ১৬১৩, ১৬১৪, আহমাদ ৪৪৭২, ৫১৫২, ৫২৮১, ৫৩১৭, ৫৭৪৭, ৫৯০৬, ৬১৭৯, মুয়াত্তা মালেক ৬২৯, দারেমী ১৬৬১, ১৬৬২ সুনানু ইবনে মাজাহ্ ১৮২৫, আবু দাউদ ১৪৩২]।

এই হাদিস ইমাম মুসলিমের ভাষ্যতে ইবনে উমার (রা) থেকে বর্নিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমান দাস-দাসি ও স্বাধীন পুরুষ ও মিহিলা সকলের উপর এক সা হিসেবে খেজুর বা সব রমজান মাসে সদকায়ে ফিতর নির্ধারন করেছেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৪৯, ২১৫০ ও ২১৫১)।

এই হাদিসের টীকায় বলা হয়েছে, এখানে ‘নির্ধারন করেছেন’ এর মূলে ‘ফরয’ শব্দ রয়েছে। এর অর্থ অবশ্য পালনীয় ও করনীয়।

ইমাম মালেক এর ভাষ্যতে, আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে সাদকা-ই-ফিতর হিসাবে নরনারী, আযাদ গোলাম প্রতিটি মুসলমানের উপর ছা’ করিয়া খেজুর কিংবা যব ধার্য করিয়াছিলেন।মুয়াত্তা মালেক ৬২৯)।

কায়েস ইবনু সা‘দ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে সদাকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন। পরে যাকাতের হুকুম নাযিল হলে এ ব্যাপারে আমাদেরকে নির্দেশও দেননি এবং নিষেধও করেননি। তবে আমরা পূর্বোক্ত নির্দেশ পালন করে যাচ্ছি। সহীহ তা’লীক ইবনু মাজাহ্, সুনানু ইবনে মাজাহ্ যাকাত অধ্যায় হাদিস নং ১৮২৮, নাসায়ী ২৫০৭, আহমাদ ২৩৩২৮)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অর্নথক কথা, অশ্লীল ব্যবহার হতে রোজাদারকে পবিত্র করা এবং মিসকিনদেরকে খাদ্য দানের জন্য সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। (সুনান আবি দাউদ)

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাদাকাতুল ফিতর প্রদানঃ

আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু বলেছেন, আমরা জাকাতুল ফিরত আদায় করতাম এক সা’ করে খাদ্য অথবা যব অথবা খেজুর অথবা পনীর কিংবা আঙ্গুর থেকে। (সহিহ বোখারি) উপরের হাদিস সমূহ থেকে বুঝা যায় সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা একটি ফরজ ইবাদত।

অবশ্য সেই ব্যক্তি এই আদেশের বাইরে যার নিকট এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু নেই। [সউদী ফাতাওয়া বোর্ড, ৯/৩৮৭]

কাদের উপর ফিতরা ফরজ?

ইয়াহিয়া ইবন ইয়াহিয়া (র-)……ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, নবী (সা) (সা) রমযানের সাদাকা (সাদাকাতুল ফিতর) বাবদ স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও মহিলা সকলের উপর এক সা খেজুর অথবা এক সা যব নির্ধারিত করেন। রাবী বলেন, এর পর লোকেরা অর্ধ সা গমকে এক সার সমান করে নিয়েছে। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৫২)।

মুহাম্মাদ ইবন রাফি- (র)……আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত য়ে, রাসুলুল্লাহ (সা) স্বাধীন ও ক্রীত দাস, নর ও নারী, ছেটি ও বড় প্রত্যেক মুসলমানের উপর রমযানের সাদাকাতুল ফিতর বাবদ এক সা- খেজুর অথবা এক সা” যব নির্ধারণ করে দিয়েছেন ।সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৫৪)।

উপরের সহিহ হাদিসের আলোকে বলা যায় স্বাধীন ও ক্রীত দাস, নারী, পুরুষ, শিশু, ছেটি ও বড় প্রত্যেক মুসলমানের উপর রমযানের সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ। তাই প্রত্যেক মুসলমান তার নিজের, স্বীয় স্ত্রীর এবং যাদের ভরন পোষণের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত তাদের পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করবে, যদি তারা অক্ষম হয়। ঈদের দিন ও রাতের খরচের অতিরিক্ত সম্পদ যে ব্যক্তির কাছে থাকবে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব।

ঈদের দিন সূর্যোদয়ের আগে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তার ফিত্‌রা দেয়া লাগবে। সেদিন সূর্যোদয়ের পর ভূমিষ্ট হলে ফিত্‌রা দেয়া লাগবে না। তবে দিয়ে দিলে সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ ইন্তেকাল করলে তার ফিত্‌রা দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন সূর্যাস্তের পর মারা গেলে তার পক্ষে ফিত্‌রা দিতে হবে। কারণ ফিত্‌রা প্রদানের ফরয সময় শুরু হয় ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।

নোটঃ তবে ইমাম আবূ হানীফার (রহ.) মতে ঈদের দিন যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অর্থাৎ ঐদিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে যার ঘরে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমপরিমাণ নগদ অর্থ থাকবে শুধু ঐ পরিবারের উপর ফিত্‌রা দেয়া ফরয হবে। সূত্র হানাফি মাযহাবের ফিকহি কিতাব।

ফিতরার ফজিলত সমূহঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য ও মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা সদাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গন্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

ইবনু ‘আববাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযাদারের অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণের কাফ্ফারাস্বরূপ এবং গরীব-মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য সদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের সলাতের পূর্বে তা পরিশোধ করে (আল্লাহর নিকট)- তা গ্রহণীয় দান। আর যে ব্যক্তি ঈদের সলাতের পর তা পরিশোধ করে, তাও দানসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি দান। (সুনানু ইবনে মাজাহ্ যাকাত অধ্যায় হাদিস নং ১৮২৭ হাসান,সহীহ আবী দাউদ ১৪২৭)।

একজন সাধারন মুসলিম হিসাবে যে উপকার পরিলক্ষিত হয় তা হলঃ

সদাকাতুর ফিতরার মাধ্যমে ঈদের দিনে দরিদ্র ব্যক্তিরা ধনীদের ন্যায় ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। ইসলাম ধর্মের চিরয়িত রূপ দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে। তা ছাড়া ইহার মাধ্যমে সিয়াম অবস্থায় ঘটে যাওয়া ক্রটিগুলোর কাফ্ফারা আদায় হয়ে যাওয়া মহান আল্লাহর এক অফুরান্ত নিয়ামতই বটে যা হাদিস দ্বারা প্রমানিত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কি কি দ্বারা ফিতরা দেওয়া হত?

বুখারী শরীফে ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর রাসূল যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক সা খেজুর কিংবা এক সা যব ফরয করেছেন মুসলিম দাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড়র প্রতি। আর তা লোকদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন’’। [বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩/ মুসলিম নং ২২৭৫]

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন, “আমরা-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ।” [ বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১]

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিগত হওয়ার পরে মুআবীয়া (রাযিঃ) এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরাদিতেন। [ বুখারী হাদীস নং ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১ ]

‘ইয়ায ইবন আব্দুল্লাহ ইবন সা’দ ইবন আবি সারহ আমিরী (রঃ) বলেন : তিনি আবু সাঈদ খুদরী (রঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছেন, আমরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ছা’র মাপে এক ছা’ গম বা যব বা খেজুর বা পনীর বা মুনাক্কা সাদকা-ই-ফিতর হিসাবে আদায় করিতাম। (মুয়াত্তা মালিক, যাকাত অধ্যায়, হাদিস নং ৬৩০)।

উক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা কয়েকটি খাদ্য দ্রব্যের নাম পাওয়া গেল যা, দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ফিতরা দেওয়া হত। আর তা হল খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। সুতরং প্রমাণিত হল যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে সাধারনত খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেওয়া হয়েছিল।

যেহেতু হাদিসে “এক সা খাদ্য দ্রব্য’’ কথাটি উল্লেখ আছে তাই, খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর এর পাশাপাশি মুসলিমগন নিজ অঞ্চলের খাবার দ্বারা ফিতরা আদায় করতে পারবেন। যদি হাদিসে “এক সা খাদ্য দ্রব্য’’ কথাটি উল্লেখ না করতের তবে তো আমাদের প্রতি খেজুর, যব, কিশমিশ এবং পনীর দ্বারাই ফিতরা দেওয়া নির্ধারিত হত। কিন্তু আমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত দেখুন এবং ইসলামের বিশ্বজনীনতা লক্ষ্য করুন যে খাদ্য দ্রব্য শব্দটি উল্লেখ হয়েছে বলেই উপরোল্লিখিত দ্রব্যাদি যাদের খাবার নয় তারাও নিজ খাবার দ্বারা ফিতরা আদায় করতে পারবেন।

কিন্তু খাদ্য দ্রব্য নয় এমন বস্তু দ্বারা কি ফিতরা আদায় করা যাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর খাদ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় হবে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফরজ করেছেন মিসকিনদের খাদ্যের অভাব পূরণ করার জন্য, কোন প্রাণীর খাদ্যাভাব পুরণের জন্য নয়। এমনকি কাপড়, বিছানা, পান পাত্র ইত্যাদি দ্বারাও আদায় হবে না। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকায়ে ফিতর খাদ্যের মাধ্যমে আদায় করা ফরজ করেছেন।

খাদ্যমূল্য দ্বারা আদায় করলেও আদায় হবে না। যেহেতু এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বিপরীত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই, তা পরিত্যাজ্য।’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যে আমাদের ধর্মে এমন জিনিস সৃষ্টি করল, যা আমাদের ধর্মে নেই, তা পরিত্যাজ্য।’ (সহিহ মুসলিম)।

তাছাড়া খাদ্যমূল্য প্রদান করা সাহাবাদের আমলের পরিপন্থী। কারণ, তারা খাদ্যজাতীয় বস্তু দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমার সুন্নত এবং আমার পরবর্তীতে সঠিক পথে পরিচালিত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আকড়ে ধর। সদকাতুল ফিতর নির্দিষ্ট একটি এবাদত, তাই অনির্দিষ্ট বস্ত্ত দ্বারা আদায় করলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যেমন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আদায় করলে আদায় হয় না।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। আর প্রত্যেক খাদ্য দ্রব্যের মূল্য সমান নয়। সুতরাং মূল্যই যদি ধর্তব্য হয়, তাহলে নির্দিষ্ট কোন এক প্রকারের এক সা’ হত এবং তার বিপরীত বস্ত্ত দ্বারা ভিন্ন মূল্যের হত। দ্বিতীয়ত মূল্য প্রদানের দ্বারা সদকাতুল ফিতর প্রকাশ্য এবাদতের রূপ হারিয়ে গোপন এবাদতের রূপ পরিগ্রহণ করে, তাই এটা পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। এক সা’ খাদ্য সবার দৃষ্টি গোচর হয়, কিন্তু মূল্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না। (সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব লেখক : শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ)।

তাছাড়া আমরা জানি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দীনার এবং দিরহামের প্রচলন ছিল। কিন্তু তিনি মুদ্রা দ্বারা ফিতরা নির্ধারণ না করে খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। তাই উপরে হাদীসে বর্ণিত খাদ্য বস্তু দ্বারাই ফিতরা আদায় করা সুন্নত। আর এটাই জমহুর (অধিকাংশ) উলামায়ে কেরামের মত।

যারা মূল্য দ্বারা ফিতরা দেয় তাদের সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ হওয়ার কারণে আমার আশংকা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৪/২৯৫]

যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের মূল্য ভিন্ন ভিন্ন, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনার বা দিরহাম থাকা সত্বেও সদকাতুল ফিতর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। এবং একক ভাবে নির্দিষ্ট দিনার বা দিরহাম নির্ধারণ করেনি। সুতরং খাদ্য দ্রব্যের পরিবর্তে মূল্য তথা টাকা-পয়সা দ্বারা ফিতরা দিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরন হবে না।

এই জন্য মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বালী এ তিন মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন, যেহেতু হাদীসে খাদ্যদ্রব্য দান করতে বলা হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্‌রা দিলে তা জায়েয হবে না। কিন্তু কিয়াসের আলোকে উপমহাদেশের হানাফি মাজহাবের অনুসারি আলেম ওলামাদের মতে খাদ্য দ্রব্যের পরিবর্তে মূল্য (টাকা) দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করলে, আদায় হয়ে যাবে। তাদের যুক্তি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দীনার এবং দিরহামের চালু থাকলেও খাদ্য দ্রব্যের যথেষ্ট কমতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে খাদ্য দ্রব্যের কোন কমতি নেই। এবং যে কেউ ইচ্ছা করলে টাকা-পয়সা দ্বারা অনায়াসে খাদ্য দ্রব্যে কিনতে পারবে। বিবেকের বিশ্লষণে আপনি যে কোন একটা মত গ্রহণ করতে পারেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কি পরিমাণ ফিতরা দেওয়া হত?

ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-পরাধীন (দাস) এবং পুরুষ ও নারীর উপর সদাকাতুল ফিতরা হিসাবে এক সা‘ যব অথবা এক সা‘ খেজুর নির্ধারণ করেছেন। সুনানু ইবনে মাজাহ্ যাকাত অধ্যায়, হাদিস নং ১৮২৬ হাদিসের মান সহীহ, সহীহ আবী দাউদ ১৪২৮-১৪৩২, ইরওয়াহ ৮৩২ সনদ সহিত, সহীহুল বুখারী ১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৭, ১৫১১, ১৫১২, মুসলিম ৯৮৪, তিরমিযী ৬৭৫, ৬৭৬, নাসায়ী ২৫০০, ২৫০১, ২৫০২, ২৫০৩, ২৫০৪, ২৫০৫, ২৫১৬, আবূ দাউদ ১৬১১, ১৬১৩, ১৬১৪, আহমাদ ৪৪৭২, ৫১৫২, ৫২৮১, ৫৩১৭, ৫৭৪৭, ৫৯০৬, ৬১৭৯, মুয়াত্তা মালেক ৬২৯, দারেমী ১৬৬১, ১৬৬২০।

আবূ সাঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু তায়ালা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সাদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা‘ খাদ্য (গম) বা এক সা‘ খেজুর বা এক সা‘ যব বা এক সা‘ পনির অথবা এক সা‘ কিসমিস দান করতাম। আমরা অব্যাহতভাবে এ নিয়মই পালন করে আসছিলাম। অবশেষে মুয়াবিয়া (রাঃ) মাদীনা আমাদের নিকট আসেন এবং লোকেদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, আমি শাম দেশের উত্তম গমের দু’ মুদ্দ পরিমাণকে এখানকার এক সা‘র সমান মনে করি। তখন থেকে লোকেরা এ কথাটিকেই গ্রহণ করে নিলো। আবূ সাঈদ (রাঃ)বলেন, আমি কিন্তু সারা জীবন ঐ হিসাবেই সদকাতুল ফিতর পরিশোধ করে যাবো, যে হিসাবে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে তা পরিশোধ করতাম। সুনানু ইবনে মাজাহ্ যাকাত অধ্যায়, হাদিস নং১৮২৯, সহীহ আবী দাউদ ১৪৩৩, ইরওয়াহ ৩/৩৩৭ সনদ সহীহ্। সহীহুল বুখারী ১৫০৫, ১৫০৬, ১৫০৮, ১৫১০, মুসলিম ৯৮৫, তিরমিযী ৬৭৩, নাসায়ী ২৫১১, ২৫১২, ২৫১৩, ২৫১৪, ২৫১৭, ২৫১৮, আবূ দাউদ ১৬১৬, ১৬১৮, আহমাদ ১০৭৯৮, ১১৩০১, ১১৫২২, দারেমী ১৬৬৩, ১৬৬৪)।

ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লার ভাষ্যতে, ইয়াহিয়া ইবন ইয়াহিয়া (র)……আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা সাদাকাতুল ফিতর বা বদ এক সা খাদ্য (গম) অথবা এক সা” যব অথবা এক সা খেজুর অথবা এক সা পনির কিংবা এক সা কিশমিশ প্রদান করতাম। আব্দুল্লাহ ইবন মাসলামা ইবন কানাব (র)……আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা) যখন আমাদের মধ্যে ছিলেন, তখন আমরা ছোট ও বড় স্বাধীন ও ক্রীতদাস প্রত্যেকের পক্ষ হতে সাদাকাতুল ফিতর বাবদ এক সা” পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা পনির অথবা এক সা যব অথবা এক সা” খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ প্রদান করতাম। এভাবেই আমরা তা আদায় করতে থাকি। পরে মুআবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রাঃ) হজ্জ অথবা উমরার উদ্দেশ্যে যখন আমাদের নিকট আসলেন তখন তিনি মিম্বরে আরোহণ করে উপস্থিত লোকদের সাথে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন । আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, আমার মতে সিরিয়ার দু-মুদ গম এক সা- খেজুরের সামান। লোকেরা তা গ্রহণ করে নিলেন । আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, আমি তো যত দিন জীবিত থাকব ঐ ভাবেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করব, যে ভাবে আমি সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে আসছিলাম।সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৫৫)।

মুহাম্মাদ ইবন রাফি (র)……সাঈদ (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) যখন-আমাদের মধ্যে ছিলেন, তখন আমরা ছোট ও বড়, স্বাধীন ও ক্রীতদাস প্রত্যেকের পক্ষ হতে তিন প্রকার বস্তু থেকে সাদাকাতুল ফিতর বাবদ এক সা খেজুর, এক সা পনির অথবা এক সা। যব প্রদান করতাম। এভাবে আমরা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করছিলাম। অতঃপর মুআবিয়া (রাঃ)-এর সময় আসল । তখন তিনি দু-মুদ গম এক সা- খেজুরের সমান ধার্য করেন । আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি তো সর্বদা পূর্বের ন্যায়ই আদায় করতে থাকব । (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৫৬)।

আমরুন নাকিদ (র)……আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, মুআবিয়া (রা-) যখন অর্ধ সা- গমকে এক সা খেজুরের সমপরিমাণ নির্ধারণ করলেন, তখন আবু সাঈদ (রাঃ) তা মেনে নিলেন না এবং বললেন, আমি সাদাকাতুল ফিতর রাসুলুল্লাহ (সা) -এর সময়ে যা আদায় করতাম এখনও তাই আদায় করব-এক সা খেজুর অথবা এক সা” কিশমিশ অথবা এক সা যব কিংবা এক সা- পনির। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৫৮)।

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেছেন, “আমরা খাদ্য দ্রব্যের মধ্য হতে এক সা যাকাতুল ফিতর বের করতাম। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী আরও বলেন: ‘‘সে কালে আমাদের খাদ্য দ্রব্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনীর এবং খেজুর”। [ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত নং ১৫১০]

উপরে বর্ণিত হাদিসগুলি দ্বারা এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন দসায় সকলে এক সা পরিমাণ ফিতরা আদায় করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং চার খলীফাগনসহ সকল সাহাবি (রাঃ) এ আমল করতের কিন্তু চার খলীফার ইন্তেকালের পর যখন মুআবিয়া (রাযিঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা হতে দামেস্ক স্থানান্তরিত হয়, তখন তারা গমের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। সে কালে সিরিয়ার এই গমের মূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলীফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বলেন: আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। আবার আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মত সাহাবি এ মত মেনে নেননি। কাজেই এই অর্ধ সা ফিতরার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা হয় নি। তার পরও মুআবিয়া (রাযিঃ) যুগ থেকে মুসলিম উম্মতের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়।

সাহাবী মুয়াবিয়া (রাযিঃ) একজন মুজতাহীদ সাহাবী ছিলেন ইজতেহাদ করার ক্ষমতা তার ছিল। অপর পক্ষে শ্বাষক হিসাবে তার দেওয়া নির্দেষ অনেকে মান্য করেছেন। তার পরও অনেক সাহাবি (রাঃ) তার ইজতেহাদ মান্য না করায় বলা যায় অর্ধ সা–এর ব্যাপারে উম্মতের ইজমা হয় নি। এবং আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মত সাহাবি বলেন: আমি তো সারা জীবন সেই পরিমাণেই ফিতরা বের করবো, যেই পরিমাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে বের করতাম। (মুসলিম) কাজেই নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত এক সা ফিতরার পরিমাণ সাহাবী মুয়াবিয়া (রাযিঃ) এর রায়ের কারণে রহিত হয়ে যাবে না। কিংবা নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত কোন সাহাবীর সিদ্ধান্তের কারণে ছেড়ে দিতে হবে না। কাজেই সকল কে সুন্নতের প্রতি প্রতিষ্ঠিত থাকার আহ্বান জানাই কারণ সব প্রকারের কল্যাণ নবীজীর সুন্নতের মধ্যে রয়েছে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সেই যুগে গমের মূল্য যবের দ্বিগুণ ছিল তাই কেউ গম দ্বারা ফিতরা দিলে অর্ধ সা দিলেই হবে বলে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে খেজুরের তুলনায় গম অনেক সস্তা। বর্তমানে এক কেজি গমের দাম ৩০/৩৫ টাকা অপর পক্ষে এক কেজি খেজুরের দাম ১৫০/৫০০ টাকা। এ হিসাবে দেখা যায় এক সা খেজুরের দামে বর্তমানে প্রায় ৫ সা গম পাওয়া যায়। কাজেই গম দ্বারা ফিতরা দিলে ৫ সা’ দেয়ার দরকার। অথচ দেখা যায় বর্তমানে গম ৫ সা এর পরিবর্তে অর্ধ সাই দিচ্ছে। কি সুন্দর ফয়সালা, তাই তো বলা যায় যে, সমস্ত কল্যাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের অনুসরণে নিহিত। মানুষের রায়, অনুমান ও কিয়াসে নয়।

তাছাড়া স্বয়ং সাহাবী মুয়াবিয়া (রাযিঃ) বলেনঃ ‘‘আমি মনে করি এই অর্ধ সা গম এক সা খেজুরের বরাবর। (সহিহ মুসলিম -২২৮১]

তিনি বলেননি, যে এটা নবীজীর আমল বা তোমরা অর্ধ সা দাও।

কাজেই এটাই সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী ফিতরা এক সা দ্বারাই আদায় করতে হবে।

‘সা’ এর পরিমান কতটুকু?

সা কি?

ফিতরার সাথে ‘সা’ শব্দটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ফিতরার সম্বন্ধে আলোচনা হলেই একটি শব্দ উঠে আসে আর তা হল, সা। তা হলে প্রশ্ন হল এই ‘সা’ কি? আসলে সা হচ্ছে ওজন করার বা মাপার একটি পাত্র। আধুনিক কালে আমরা দাড়ি পাল্লার মাধ্যমে পরিমাপ করি আর নবী এর জামানায় পাত্রের মাধ্যমে পরিমাপ করা হত। অর্থাৎ একে অপরের সাথে পাত্রের মাধ্যমে পরিমাপ করে খাদ্য আদান প্রদান করত এবং একক হিসাবে যে পাত্রটি ব্যবহার করত তাকে সা বলা হত। যেমন আধুনিক কালে আমরা পরিমাপের একক হিসাবে কেজি ব্যবহার করি।

এক সা-তে কত কেজি হবে?

আধুনিক কালে ‘সা’ এর দ্বারা পরিমাপের কোন প্রচলন না থাকলেও মক্কা মদীনায় ঈদের প্রাক্কালে ফিতরার চাল বিক্রয়কারীদের কাছে এই সা’ দেখা যায়। আমরা যেহেতু ব্যপক হারে একক হিসাবে কেজি ব্যবহার করি। কাজেই এক সা-কে কেজির সাথে তুলনা করে, সা এর পরিমান নির্ধারণ করতে পারলে, ফিতরা আদায় করতে অনেক সহজ হবে। যদিও সা’ এর পরিমাণকে সূক্ষ্ম কিলোগ্রামের ওজনে নির্ধারণ করা অসম্ভব। কারণ এটি একটি পরিমাপ পাত্র, কোন ওজনের নাম নয়।

সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ‘সা’ এর একটি পরিমান এভাবে নির্ধারণ করছে আর তা হলঃ একজন সাধারণ শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা। [ফাতাওয়া মাসায়েল/ ১৭২-১৭৩, সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫ ]

এই রকম পূর্ণ চার অঞ্জলি খেজুর ভরে ওজন করলে আড়াই কিলো থেকে সামান্য বেশী হয়। আর তাতে চাল ভরে ওজন করলে প্রায় তিন কিলো হয়। দ্রব্য যত ভারী হবে সা’ তে তার ওজনও ভিন্ন হবে।

সৌদিআরবের এ সময়কার প্রখ্যাত আলেম শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উসাইমীন বলেন, সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের এক সা’। যার ওজন চার শত আশি মিসকাল গম। ইংরেজী ওজনে যা দুই কেজি ৪০ গ্রাম গম। যেহেতু এক মিসকাল সমান চার গ্রাম ও এক চতুর্থাংশ হয়। সুতরাং ৪৮০ মিসকাল সমান ২০৪০ গ্রাম হয়। অতএব রাসূলের যুগের সা’ জানতে ইচ্ছা করলে, তাকে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম গম ওজন করে এমন পাত্রে রাখতে হবে, যা মুখ পর্যন্ত ভরে যাবে। অতঃপর তা পরিমাপ করতে হবে।

মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আত তুআইজিরি তার লিখিত “কুরআন সুন্নার আলোকে ইসলামি ফিকাহ ২ম খন্ড লিখেন এক সা হল ২.৪০ কেজির সমান। তবে কেউ আড়াই কেজি আবার কেই পোনে তির কেজি হিসাবেও উল্লেখ করেছেন। (পৃষ্ঠা নম্বর ১৫৬)।

আলোচনায় বুঝা গেল সা এর পরিমান কেজিতে নির্ধারণ করা খুই কষ্ট সাধ্য, তবে এতটুকু বুঝা গেল যে, আড়াই থেকে তিন কেজি পরিমান খাদ্য দ্রব্য দান করলেই আশা করা যায এক সা পরিমান আদায় করা হয়েছে।

ফিতরা আদায়ের উপযুক্ত সময় কখন?

ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্নিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা) লোকদের (ঈদের) সালাতে গমনের পূর্বেই সাদাকাতূল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং২১৫৯ সহিহ বুখারি হাদিস নং ১৫০৯)।

ইবনু আববাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাস কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্রকরণ এবং গরীব মিসকীনদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিতরা প্রদান করাকে ফরয করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা ফিত্‌রা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের সালাতের পর দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবূ দাউদ : ১৬০৯; ইবনে মাজাহ : ১৮২৭)।

উপরের হাদিস থেকে বুঝা যায় ফিতরা আদায়ের উত্তম সময় হল ঈদের দিন ঈদের সালাত আদায় করার পূর্বে পর্যান্ত। আর ঈদের সালাতের পরে দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান।

আর জায়েয সময় হল ঈদের দু’এক দিন আগেই ফিত্‌রা প্রদান করে ফেলা। ইবনু ‘উমার বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাজে বেরোবার পূর্বেই ফিতরা আদায় করার আদেশ প্রদান করেন। এ কারণে ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু বিলম্বে পড়া মোস্তাহাব। ঈদের এক বা দু’ দিন পূর্বে আদায় করা জায়েজ। যেমনটি করেছেন ইবনে উমর রা.। (সহি বোখারি)

ফিতরা আদায়ের উপযুক্ত স্থান ও সময় কখন?

সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ঐ এলাকার গরীবরাই বেশী হকদার। উক্ত এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোন হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে। একজন দরিদ্রকে একাধিক লোকের ফিতরা দেয়া যেতে পারে। আবার একাধিক দরিদ্র লোকের মাঝেও একভাগ ফিতরা বণ্টন করা যেতে পারে। দরিদ্র ব্যক্তি অন্য লোকের কাছ থেকে গ্রহণ করে নিজের ফিতরা আদায় করতে পারবে।

ফিতরা পাবার যোগ্য কারা বা ফিতরার হকদার কোন্ কোন্ প্রকারের লোকেরা?

এ বিষয়ে ইসলামী বিদ্বানগণের মতভেদ রয়েছে। একদল বিদ্বান মনে করেন, যারা সাধারণ সম্পদের যাকাতের হকদার তারাই ফিতরের যাকাতের (ফিতরার) হকদার। অন্য এক দল বিদ্বান মনে করেন সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা কেবল ফকীর মিসকিনদের হক, অন্যদের নয়।

কারন ইবনে আব্বাস (রাযি:) এর হাদীস, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ফিতরের যাকাত (ফিতরা) ফরয করেছেন রোজাদারের অশ্লীলতা ও বাজে কথা-বার্তা হতে পবিত্রতা এবং মিসকিনদের আহার স্বরূপ .. ’’ [আবু দাউদ, যাকাতুল ফিতর নং ১৬০৬/ হাদীস হাসান, ইরওয়াউল গালীল নং ৮৪৩] এই মতকে সমর্থন জানিয়েছেন ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যূম, শাওকানী, আযীমাবাদী, ইবনু উসাইমীন সহ আরও অনেকে। [ দেখুন: মাজমুউ ফাতাওয়া ২৫/৭৩,যাদুল মাআদ ২/২২, নায়লুল আউত্বার ৩-৪/৬৫৭, আওনুল মা’বূদ ৫-৬/৩, শারহুল মুমতি ৬/১৮৪]

ফিতরাকে যাকাত বলা হলেও উভয়ের মধ্যে আছে অনেক পার্থক্য। ফিতরা এমন ব্যক্তির উপরও জরুরী যার বাড়িতে সামান্য দুই বেলার খাবারের চেয়ে বেশী খাদ্য আছে, যা দ্বারা ফিতরা আদায় করা সম্ভব। কিন্তু যাকাত কেবল তার উপর জরুরী যার নিসাব পরিমান অর্থ আছে এবং এক বছর কাল অতিবাহিত হতে হবে। যাকাত ধন-সম্পদের কারণে জরুরী হয় কিন্তু ফিতরা ইফতারের কারণে দিতে হয়। এসব কারণে ফিতরা ও যাকাত আদায়ের খাত কিয়াস করে এক মনে করা সমীচীন নয়।

Leave a comment