সিয়ামরত অবস্থায় আমলসমূহ (পঞ্চম পর্ব)

গ. যে আমলগুলি দ্বারা কুরআনের হক আদায় হবে।

রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। এই মাসের অন্যান্য সকল মাসের উপর মর্জাদাসম্পন্ন হওয়ার এক মাত্র কারন হলো, এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়। মহান এ মাসের সঙ্গে কুরআনুল কারিমের গভীর সর্ম্পক রয়েছে। এই মাসেই পবিত্র কুরআন লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়। এই জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে কুরআনকে আলাদাভাবে মর্জাদা প্রদাণ করেছেন। তিনি এই মাসে জিব্রাঈল আলাহিস সালামকে তিনি কুরআন শুনাতেন আবার জিব্রাঈল আলাহিস সালামও তাকে কুরআন শুনাতেন। বছরে তারা দুজনে এক অপরকে সম্পূর্ণ শুনাতেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রতিবছর একবার কুরআন পাঠ পেশ করতেন। আর যে বছর তিনি মারা যান সে বছর দুইবার পেশ করেন। (সহিহ বুখারি ৪৬১৪)।

এমনকি রমজান মাসের প্রত্যেক রাতেই নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে কুরআন মাজিদ শুনাতেন এবং তিনিও নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাতেন। হাদিস শরিফে আছে, জিবরাইল আমিন রমজানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন এবং  তাকে কুরআন শরিফ পড়ে শুনাতেন। ( সহিহ বুখারি ১৯০২)।

ইবনে কাছির (রহঃ) বলেনঃ জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়া সাল্লামকে যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছে ততটুকু পাঠ করে শুনাতেন। (আল-জামে ফি গারিবিল হাদিস’ গ্রন্থে (৪/৬৪)

যে কারণে রমজান মাস অন্যান্য মাসের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ ষ্পষ্ট করে রমজান মাসের তিনটি মহান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।

* কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়েত জন্য

* কুরআন ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য

* সম্পূর্ণ রমজান ব্যাপিয়া সিয়াম পালন করা।

ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হল আল কুরআন। আল আল কুরআনের মূল বিষয় বস্তু হল, আদম সন্তারকে এমন জ্ঞান দান করা যা সে জানত না। তাইতো অহীর সুচনায় মহান আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন,

ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ (١) خَلَقَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مِنۡ عَلَقٍ (٢) ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ (٣) ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ (٤) عَلَّمَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مَا لَمۡ يَعۡلَمۡ (٥)

অর্থ: পড়ো (হে নবী), তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন৷ জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন৷ পড়ো, এবং তোমার রব বড় মেহেরবান, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন৷ মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না৷ 

আল্লাহ তা‘আলার নিজ করুনায় মানুষ জাতীর হেদায়েতের জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের এমন একটি কিতাব দিলেন, যার মধ্যে আছে ইহাকাল ও পরকালের মুক্তির পাথেয়। তাই রমজানে কুরআন কেন্দ্রিক আমল করে এর যথাযথ হক আদায় করতে হবে। বিদ্বানগন মনে করেন আল কুরআনের মাধ্যমে সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা পেতে হলে, আল্লাহর বান্দাকে কুরআন মাফিক আমলকে বিভিন্ন পর্যায় ভাগ করে শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। কুরআনের যথাযথ হক আদায় করতে হলে আমাদের নিম্মের আমলগুলি করতে হবে।

১। কুরআনের উপর ঈমান আনাঃ

২। বিশুদ্ধভাবে কুরআনের শিক্ষা করাঃ

৩। অপরকে কুরআন পড়া শিক্ষা দেয়াঃ

৪। কুরআন শিক্ষার পর নিয়মিত তিলাওয়াত করাঃ

৫। সহিহ হাদিসে বর্ণিত সুরা বা আয়াত মুখস্থ করে নিয়মিত তেলওয়াত করা

৬। কুরআন তেলওয়াত শ্রবন করা

৭। কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা

৮। অর্থ বুঝে বুঝে কুরআন পড়া,সম্ভব হলে বিশুদ্ধ তাফসিরের আলোকে পড়া

৯। কুরআন অনুসারে জীবন যাপর করা

১০। কুরআন অন্যেনর নিকট পৌছান

৬। কুরআন তিলওয়াত শ্রবন করাঃ

 কুরআন শুনা একটি ইবাদাত। নামাজ ও খুতবা চলাকালে কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা ওয়াজিব। তবে এই দুই জায়গার বাইরেও কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা ওয়াজিব কি না এ ব্যাপারে ফকিহগণের মতামত হলো, যেখানে কোরআন শোনানোর জন্যই তিলাওয়াত করা হয়ে থাকে, সেখানে মনোযোগ দিয়ে কোরআন তিলাওয়াত শোনা ওয়াজিব। আর যেখানে কেউ নিজেই তিলাওয়াত করছে বা অনেকেই নিজ নিজ তিলাওয়াত করছে, সেখানে চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনা ওয়াজিব নয়। তবে এরূপ ক্ষেত্রে কুরআন শোনাও ভাল কাজ। কেননা মহান আল্লাহ কুরআন তিলওয়াত মনযোগ সহকারে কুরআন তেলওয়াত শ্রবন করতে বলেছেন। তাই যিনি উচ্চ স্বরে কুরআন তিলওয়াত করবেন তাকে স্থান ও সময় বিবেচনা করে তিলওয়াত করা উচিত। কুরআন তিলওয়াত শুনতে পেলে, বিনা কারনে না শুনলে গুনাহ হবে।  মহান আল্লাহ বলেনঃ

*وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ*

আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। (সুরা আরাফ ৭:২০৪)।

এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পটভুমি নিয়ে তাফসির কারকদের থেকে একাধীক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কোন কোন তাফসির কারকের মতে এই বিধান নামাজে কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই এই বিধান নামাজের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। কারো কারো বর্ণনা মতে, এই বিধান খুতবা চলাকালে কুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। তবে অধিকাংশ তাফসির বিশারদের মতে, আয়াতটি কিছু বিশেষ অবস্থা ব্যতীত সর্বাবস্থার জন্যই প্রযোজ্য, চাই নামাজে তিলাওয়াত শ্রবণের ব্যাপারে হোক বা খুতবা চলাকালীন হোক বা এর বাইরেই হোক সর্বাস্থায় জন্যই এই বিধান প্রযোজ্য।

মনোযোগসহ কোরআন শোনার ফজিলতঃ

১. আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে  বর্নিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে কোরআন তিলাওয়াত শুনবে, তাকে কয়েক গুণ বেশি সওয়াব প্রদান করা হবে, আর যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করবে, তা তার জন্য কেয়ামতের দিন আলো হয়ে উদ্ভাসিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর ৮৪৯৪)।

আবদুল্লাহ‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “আমার সামনে কুরআন পাঠ কর”। আবদুল্লাহ বললেন, আমি আপনার সামনে কুরআন পাঠ করব; অথচ আপনার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে। তিনি বললেন, আমি অন্যের নিকট থেকে শুনতে ভালবাসি। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ৪৬৮০ ইঃফাঃ)।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি কুরআন পাঠ কর। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার সামনে কুরআন পাঠ করব? অথচ তা তো আপনার ওপরই নাযিল হয়েছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর আমি “সূরা নিসা” পাঠ করলাম। যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত আসলাম “চিন্তা করো আমি যখন প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে থেকে একজন করে স্বাক্ষী উপস্থিত করব এবং সকলের ওপরে তোমাকে স্বাক্ষী হিসাবে হাযির করব তখন তারা কি করবে”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আপাতত এটুকুই যথেষ্ট। আমি তাঁর চেহারা মুবারকের দিকে তাকালাম, দেখলাম, তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরছে।(সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ৪৬৮১ ইঃফাঃ)।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর বাণীঃ “হে নাবী! আপনার জিহ্বাকে তাড়াতাড়ি মুখস্ত করার জন্য নাড়াবেন না”। আল্লাহর এই কালাম সম্পর্কে তিনি বলেন, যখনই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ওহী নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসতেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব তাড়াতাড়ি জিহবা এবং ঠোঁট নাড়াতেন এবং তার জন্য খুব কষ্টের ব্যাপার হত। আর এ অবস্থা সহজেই অন্য একজন অনুমান করতে পারত। সুতরাং এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এই আয়াত নাযলি করেন। “আমি কিয়ামত দিবসের কসম করছি, হে নাবী! তাড়াতাড়ি ওহী মুখস্থ করার জন্য আপনি আপনার জিহ্বা নাড়াবেন না। এ মুখস্থ করিয়ে দেয়া ও ফাঠ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমারই। যখন আমি তা পাঠ করিতে থাকি, তখন আপনি সে পাঠকে মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকুন। পরে এর অর্থ বুঝিয়ে দেয়াও আমার দায়িত্ব”। সুতরাং যখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) পাঠ করেন আপনি তার অনুসরণ করুন। এরপর থেকে যখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বলে যেতেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নীরবে শুনতেন। যখন তিনি চলে যেতেন, আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী তিনি তা পাঠ করতেন। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ৪৬৭৫ ইঃফাঃ)।

মন্তব্যঃ সুরা আরাফ ২০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যখন কোরআন পড়া হয় তখন তা চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত হয়। কুরআনে কারিমের আদব ও শিষ্টাচারসমূহ থেকে একটি আদব হলো, কুরআন পাঠ চলাকালীন চুপ থেকে তা মনোযোগ দিয়ে শোনা। এর বিপরীত এ কথা স্পষ্ট যে যারা এর পরিপন্থী কাজ করবে, তারা সে রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। এ জন্যই যেসব জায়গায় লোকজন ঘুমাচ্ছে বা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, সেখানে উচ্চ স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত নয়। কেননা এতে লোকজন তিলাওয়াত না শোনার কারণে প্রকারান্তরে কোরআন অবমাননা হয়ে থাকে।

** বর্তমানে যারা বাজারে-ঘাটে, যেখানে-সেখানে কোরআন তিলাওয়াত চালু করে দেয়, যেখানে কোনো শ্রবণকারী থাকে না, তারা অনুচিত কাজ করছে। অনুরূপ যারা রাতে মানুষের ঘুমের সময় মসজিদে লাউড স্পিকারে কোরআন তিলাওয়াত করে, যা শ্রবণ করার মতো কেউই থাকে না এবং তাতে ঘুমন্ত ব্যক্তিদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এগুলো পরিহার করা অপরিহার্য। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে অন্যরা মনোযোগ দিয়ে কোরআন তিলাওয়াত না শোনায় তার গুনাহ তিলাওয়াতকারীর ওপরই বর্তাবে।

** অনেক মানুষকে দেখা যায় ক্যাসেট বা কম্পিউটারে কুরআন তিলাওয়াত চালু করে অন্য কাজ করতে থাকে। তিলাওয়াত একেবারেই শুনছে না বা কাজের কারণে তিলাওয়াতের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছে না। বা একটা কিছু শুনতে শুনতে কাজ করার অভ্যাস তাই তিলাওয়াত ছেড়ে রেখেছে। শোনা উদ্দেশ্য নয়। এ কাজটি ঠিক নয়। কুরআন তিলাওয়াত শোনা একটি স্বতন্ত্র আমল। আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত হচ্ছে আর আমি অন্যদিকে মনোযোগ দিব তা হয় না। সুতরাং তিলাওয়াত যখন শুনব তো মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াত শুনব।

৭। কুরআন মুখস্থ বা হিফয করাঃ

মহান আল্লাহ যত মহান তার কালাম তথা কুরআনও তত মহান। এই মহান গ্রন্থ কুরআন সংরক্ষনের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিজে নিয়েছেন।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

*إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ*

অর্থঃ নিশ্চয় আমি এই কোরআনকে অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষক। (সুরা হিজর ১৫:৯)

মহান আল্লাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর এ ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তাই কুরআন আজ সমহিমায় অবিকৃতভাবে আমাদের সামনে দৃ্শ্যমান। কুরআনের প্রতিটি শব্দ আজ লিখিত আছে। যখন ব্যাপক হারে কুরআন লিখে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না, তখন কুরআনের জন্য নিবেদীত এক দল মানুষ কুরআন হিফাজনের জন্য মুখস্ত করা শুরু করেছিলেন যা আজও মুসলিম সমাজে বৃদ্যমান।

কুরআন মুখস্ত করা ফরজ। কিন্তু কি পরিমাণ আয়াত বা সূরা মুখস্ত করা ফরজ, তা জানা আবশ্যক। ইবাদত বন্দেগির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। নামাজের জন্য কুরআন তিলাওয়াত ফরজ এবং ওয়াজিব। সুতরাং নামাজ আদায় করা যায়, এই পরিমাণ কুরআন মুখস্ত করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ। পাশাপাশি গোটা কুরআন মাজিদ মুখস্ত করা ফরজে কেফায়া। কেননা যদি কেউই কুরআন হিফজ না করে বা কোন হাফিজ না থাকে বা কুরআন হেফাজতের নিয়্যাতে কাজ না করে তবে সমস্ত মুসলমানকেই সমভাবে গুনাহগার হতে হবে। কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, আমাদের আর কুরআন হেফাজতের দায়িত্ব নেই। মহান আল্লাহই হিফাজত করবেন, এই কাজে তিনি আমাদের ব্যবহার করবেন। কুরআন যেমন দামি, আর কুরআন হিফাজনের জন্য মহান আল্লাহ যাকে ব্যবহার করবে সেও দামি হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, তোমরা কুরআনের যথাযথ যত্ন নাও, তা মুখস্থ ও সংরক্ষণ কর। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায়, তার চেয়েও আরো তীব্র বেগে পালানোর বস্তু এ কুরআন। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।

অর্থঃ“আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণীত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম  বলেছেন, কোরআনের বাহককে জান্নাতে প্রবেশকালে বলা হবে, তুমি পাঠ করতে থাকো এবং উপরে আহরন করতে থাকো। অত:পর সে পড়তে থাকবে এবং প্রতিটি আয়াত পড়ার সাথে সাথে একটি স্তর অতিক্রম করবে। এভাবে সে তার জ্ঞাত শেষ আয়াতটি পর্যন্ত পড়বে। (আবু দাউদ-১৩১৭; আহমাদ-১০৯৬৮;  ২/২০৮; সিলসিলা সহীহাহ ২২৪০;

হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আমার জিকির এবং আমার নিকট প্রার্থনা করা হতে বঞ্চিত রইল, তাকে প্রার্থনাকারীদের চেয়েও বেশি পরিমাণ দান করে থাকি। এবং আল্লাহর কালামের মর্যাদা অন্য সমস্ত কালামের উপর এই পরিমাণ বেশি যেই পরিমাণ স্বয়ং আল্লাহ পাকের মর্যাদা সমস্ত মাখলুকের উপর। (তিরমিজি)

হাফেজ হওয়ার কারনে তাকে সব সময় কুরআন চর্চা করতে হয়, এতে সে প্রতি হরফে ১০ নেকী করে পেয়ে থাকে। এভাবে সাধারন মানুষ হতে নেকী অর্জনের ক্ষেত্রে সে থাকে অগ্রগামী। কেয়ামাতের দিনও একজন হাফেজে কুরাআন বাড়তী মর্যাদা পেয়ে থাকবেন একজন সাধারন মানুষ হতে।

আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কুরআন মজিদে দক্ষ ব্যক্তি (আখেরাতে) সম্মানিত নেককার লিপিকার ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। যে ব্যক্তি ঠেকে ঠেকে কষ্ট করে কুরআন পড়ে সে দু’টি পুরষ্কার পাবে। (বোখারী-৪৯৩৭,মুসলীম-৭৮৯)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণীত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোরআনের বাহককে জান্নাতে প্রবেশকালে বলা হবে, তুমি পাঠ করতে থাকো এবং উপরে আহরন করতে থাকো। অত:পর সে পড়তে থাকবে এবং প্রতিটি আয়াত পড়ার সাথে সাথে একটি স্তর অতিক্রম করবে। এভাবে সে তার জ্ঞাত শেষ আয়াতটি পর্যন্ত পড়বে। (আবু দাউদ-১৩১৭,আহমাদ-১০৯৬৮)

আবদুল্লাহ‌ ইবনু আম্‌র (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “এক মাসে কুরআন খতম কর”। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী করার শক্তি রাখি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে প্রতি সাত দিনে একবার খতম করো এবং এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে খতম করো না। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ৪৬৮৫ ইফাঃ)

আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, হাফেজে কুরআনকে বলা হবে, পড় এবং ওপড়ে উঠ। তারতিলসহ পড় অর্থাৎ ধীরে ধীরে আবৃতি কর, যেমন দুনিয়াতে করতে। কারণ, সর্বশেষ আয়াতের স্থানই হবে তোমার মর্যাদার স্থান। (আবু দাউদ ১৪৬৪)

অর্থঃ “আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম কুরআন মজিদে দক্ষ ব্যক্তি (আখেরাতে) সম্মানিত নেককার লিপিকার ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। যে ব্যক্তি ঠেকে ঠেকে কষ্ট করে কুরআন পড়ে সে দু’টি পুরষ্কার পাবে। (সহিহ বুখারি ৪৯৩৭; সহিহ মুসলীম ৭৮৯; তিরমিযী ২৯০৪; আবু দাউদ ১৪৫৪; আহমাদ ২৩২৯১, ২৪১১৩, ২৪১৪৬, ২৪২৬৭, ২৪৮৩৭; দারিমী ৩৩৬৮)।

হাফিজদের নামে একটি জঈফ হাদিস ও তার পর্যালোচনাঃ

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন তেলওয়াত ও মুখস্থ রেখেছে এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনেছে। তাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশজন লোক সম্পর্কে তার সুপারিশ কবুল করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম আবশ্যক ছিলো।” (তিরমিযী – ২৯০৫; আহমাদ ১২৭১; মিশকাত ২১৪১, তা’লীকুল রাগীব ২/২১০)।

হাদিসের মান যঈফ। এই হাদিসটি সহিহ নয়, খুবই দূর্বল। লক্ষনীয় বিষয় হলো ইমাম তিরমিযী এই হাদীস লিপিবদ্ধ করে লিখেছিলেন, “হাদীসটি গরীব। আমরা কেবল উল্লেখিত সূত্রে হাদীসটি জানতে পেরেছি। এর সনদসূত্র সহীহ নয়।” কিন্তু দুঃখের বিষয় ইমাম তিরমিযী এই হাদীসকে গরীব বলা সত্ত্বেও জাহিল অবিবেচক লোকেরা এ হাদীসটি বিশুদ্ধ হাদীসের মতোই গ্রহণ করছে এবং প্রচার করছে। এরই ভিত্তিতে পরিবারের হাফেজ সদস্যের হাত ধরে জান্নাতে যাওয়ার বুক ভরা আশা নিয়ে বসে আছে। শাফায়াত বিষয়ক কুরআন ও সহিহ হাদীসের সকল বক্তব্যের মুল কথা হলো এর নিরংকুশ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে।

সমাজে আরেকটি কথা প্রচলিত আছে যে, “হাফেজ ব্যাক্তি তার সাথে পিতামাতাকেও জান্নাতে নিতে পারবেন”। এ কথা কতটুকু সত্য নয়। হাদিসের গ্রন্থে এ ধরনের কোনো হাদিস সাব্যস্ত হয়নি। পিতামাত নয় বরং হাফেজকে কেয়ামতের দিন মর্যাদা দেয়া হবে। যার আমল তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে তাকে কেউ সাহায্য করতে পারবেনা। তবে মহান আল্লাহ অনুমতি সাপেক্ষে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সুপারিশ করবেন, কুরআন সুপারিশ করবে, সিয়াম সুপারিশ করবে, নেক বান্দা সুপারিশ করবে। এ হিসাবে আশা করা যায় মহান আল্লাহ তার প্রিয় কালামের হিফাজাতকারী জান্নাত প্রাপ্ত হাফিদের সুপারিশের অনুমতি দিতে পারেন। দিবেন এমন জোর করে বলা যায় না। তাই বল যায় যে, হাফেজকে মর্যাদা দেওয়া হবে কিন্তু তাদের পিতামাতাকেও মর্যাদা দেওয়া হবে যদি তাঁরা মর্যাদার উপযুক্ত হন। কোনো হাফেজ অথবা কোনো আলেম জান্নাতে যাওয়ার সময় দুই তিনজনকে নিয়ে যাবেন, জান্নাত এত সহজও নয়। আল্লাহর বাব্বুল আলামিন এভাবে জান্নাত দিবেন না। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যাকে জান্নাত দেবেন তিনিই জান্নাতে যেতে পারবেন। কেউ কোনো ব্যক্তিকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন না বা এটা কোনো আবদারের বিষয় নয়।

৮। অর্থ বুঝে বুঝে কুরআন পড়া, সম্ভব হলে বিশুদ্ধ তাফসিরের আলোকে পড়াঃ

পৃথিবীর সকল মুসলিম এ কথা স্বীকার করে যে, আল কুরআন হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশিগ্রন্থ। বর্তমান বিশ্বে বিদ্যসান একমাত্র মানবতার মুক্তির সনদ। এই ঐশিগ্রন্থে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক নির্দেশনা। এই গ্রন্থেই আছে কি ভাবে আল্লাহ আইন কানুন মান্য করে আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে, তারই বিশদ বিবরণ। কুরআন থেকেই আমরা আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ নিষেধ সরাসরি জানতে পাই। এখানেই আছে পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম সম্পর্কে শত শত সুস্পষ্ট বর্ণনার সমাহার। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, পূর্ববর্তী জাতীর সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান। দুনিয়ার কোন জ্ঞানের সাথে এর তুলনা করা আল্লাহর সাথে শির্ক করার সামিল। ইসলাম সার্বজনিন, ইহার সকল আমলগুলি সকল মুসলিমের নিকট সমান ভাবে পালনীয়। আমলের জন্য করার জন্য আমলকে বুঝা ও উপলব্ধির করা প্রয়োজন। আমল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা না থাকলে কারো পক্ষে আমল করা সম্ভব নয়। আর আমাদের আমলের ধরন কেমন? কখন করতে হবে? কি ভাবে করতে হবে? তার বিধি বিধান দেওয়ার একমাত্র কর্তৃত্ব হল আল্লাহ। আর কুরআন হল বিদিবিধান প্রদান কারি আল্লাহ সরাসরি নির্দেশ নামা। আর নির্দেশনামা না বুঝে, নির্দেশ পালন করা কতটুকু সম্ভব?

 আর এত সব জানার জন্য এবং মান্য করার জন্য অবশ্যই কুরআন বুঝে বুঝে পড়তে হবে। কোন কিছু থেকে জ্ঞান অর্জন করতে হলে, কোন আদেশ নিষেধ পালন করতে হলে, দিক নির্দেশনা পেতে হলে, বর্ণনা বুঝতে হলে, আপনাকে অবশ্যই অবশ্য তা বুঝে পড়ে শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। কুরআন মজীদ বুঝে পড়ার পাশাপাশি এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে হবে। চিন্তা-ভাবনা করে কুরআন শিখলে এর শিক্ষা, অর্থ ও তাৎপর্য মনের গভীরে প্রবেশ করবে। যারা কুরআন বুঝার চেষ্টা করে না এবং এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেনা, কুরআন তাদের হৃদয় ঢুকবে না। কেননা তাদের মনে তালা লাগানো আছে।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

 أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ (٢٤)

অর্থঃ তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি, নাকি তাদের মনের ওপর তালা লাগানো আছে? (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:২৪)।

** কুরআন মজীদ বুঝে পড়তে হবে তার কিছু দলিল কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে তুলে ধরছিঃ

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ কি উপদেশ দিয়েছেন তা জানতে না পারলে, কখনও মানা সম্ভব নয়। তার উপদেশ জানতে হলে আপনাকে বুঝে বুঝে কুরআন পড়তে হবে। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

سُورَةٌ أَنزَلۡنَـٰهَا وَفَرَضۡنَـٰهَا وَأَنزَلۡنَا فِيہَآ ءَايَـٰتِۭ بَيِّنَـٰتٍ۬ لَّعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ (١)

অর্থ: এটা একটি সূরা যা আমি অবতীর্ণ করেছি এবং যার (বিধানকে) ফরজ করেছি। এর মধ্যে আমি স্পষ্ট আয়াতসমূহ প্রেরণ করেছি, যেনো তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (সুরা নুর ২৪:১)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 نَّحۡنُ أَعۡلَمُ بِمَا يَقُولُونَ‌ۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيۡہِم بِجَبَّارٍ۬‌ۖ فَذَكِّرۡ بِٱلۡقُرۡءَانِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ (٤٥)

অর্থ: ওরা যা বলে তা আমি ভালোভাবেই জানি। তুমি ওদের উপরে জবরদস্তিকারী নও। সুতারাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দান কর। (সুরা ক্বাফ ৫০:৪৫)।

 মহার আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে অনেক দৃষ্টান্ত, উপমা, নিদর্শন, কাহিনী উপস্তাপন করেছেন মানুষকে বুঝানোর জন্য। অথচ আমরা বলি তিলায়াত কর নেকি পাবে, বুঝতে গেলে গোমড়া বা পথভ্রষ্ট হবে।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 لَوۡ أَنزَلۡنَا هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ عَلَىٰ جَبَلٍ۬ لَّرَأَيۡتَهُ ۥ خَـٰشِعً۬ا مُّتَصَدِّعً۬ا مِّنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِ‌ۚ وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَـٰلُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ (٢١) 

যদি আমি এই কুর-আন পর্বতের উপরে অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি উহাকে আল্লাহ্‌র ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হতে দেখতে । এই সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য বর্ণনা করছি যেনো তারা চিন্তা করে।  (সুরা হাসর ৫৯:২১)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

وَلَوۡ شِئۡنَا لَرَفَعۡنَـٰهُ بِہَا وَلَـٰكِنَّهُ ۥۤ أَخۡلَدَ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَٮٰهُ‌ۚ فَمَثَلُهُ ۥ كَمَثَلِ ٱلۡڪَلۡبِ إِن تَحۡمِلۡ عَلَيۡهِ يَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُڪۡهُ يَلۡهَث‌ۚ ذَّٲلِكَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِـَٔايَـٰتِنَا‌ۚ فَٱقۡصُصِ ٱلۡقَصَصَ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ (١٧٦)

আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদ দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো৷ কাজেই তা অবস্থা হয়ে গেল কুকুরের মত, তার ওপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে৷যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই৷ তুমি এ কাহিনী তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা -ভাবনা করবে৷ (সুরা আরাফ ৭:১৭৬)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

كَذَٲلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأَيَـٰتِ لِقَوۡمٍ۬ يَتَفَڪَّرُونَ (٢٤)

এভাবেই আমি আমার নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি যারা চিন্তাশীল তাদের জন্য। (সুরা ইউনুছ ১০:২৪)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَـٰلُ نَضۡرِبُهَا لِلنَّاسِ‌ۖ وَمَا يَعۡقِلُهَآ إِلَّا ٱلۡعَـٰلِمُونَ (٤٣)

এ ভাবেই আমি মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপমা, উপস্থাপন করে থাকি। কিন্তু শুধু তারাই তা বুঝতে পারে যারা জ্ঞানী। (আনকাবুত ২৯:৪৩)।

বুঝে বড়লে বিধর্মী দেয়া অপবাদ কুরআনের অসংগতির উত্তর দেয়া সহজঃ

আজ কাল অনেক বিধর্মী চেষ্টা চালাচ্ছে কুরআনের অসংগতি খুজে বের করার। অথচ মহান আল্লাহর চ্যালেঞ্জ কুরআনের মধ্যে কোন অসংগতি খুজে পাওয়া যাবে না।

মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকদের মনে মনে সন্দেহ করত কুরআন কি সত্যি সত্যিই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। তারা দেখত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অহী নাযিল হয় এবং যা সরাসরি জিব্রাইল (আ:) আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের সল্প বুদ্ধির কারনে তারা মুনাফেকী আচরণ করে এবং শুধু শুধু সন্দেহের সৃষ্টি করে। সুরা নিসায় আল্লাহ তাদের এই মুনাফিকি আচরণের নিন্দা করার পর বলেছেন, তারা কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাই করে না। এই গ্রন্থ নিজেই যুক্তি দিচ্ছে যে, এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো বাণী হতেই পারে না। কেননা এ গ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুসামঞ্জস্য, ভারসাম্যপূর্ণ। এর মধ্যে কোন অসংগতি খুজে পাওয়া যাবে না। কোন পরস্পর বিরোধী আয়াত নেই। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

وَيَقُولُونَ طَاعَةٌ۬ فَإِذَا بَرَزُواْ مِنۡ عِندِكَ بَيَّتَ طَآٮِٕفَةٌ۬ مِّنۡہُمۡ غَيۡرَ ٱلَّذِى تَقُولُ‌ۖ وَٱللَّهُ يَكۡتُبُ مَا يُبَيِّتُونَ‌ۖ فَأَعۡرِضۡ عَنۡہُمۡ وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ‌ۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلاً (٨١) أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ‌ۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَـٰفً۬ا ڪَثِيرً۬ا (٨٢) 

তারা মুখে বলে, আমরা অনুগত ফরমাবরদার ৷ কিন্তু যখন তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায় তখন তাদের একটি দল রাত্রে সমবেত হয়ে তোমার কথার বিরুদ্ধে পরামর্শ করে৷ আল্লাহ তাদের এই সমস্ত কানকথা লিখে রাখছেন৷ তুমি তাদের পরোয়া করো না, আল্লাহর ওপর ভরসা করো, ভরসা করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? যদি এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এর মধ্যে বহু বর্ণনাগত অসংগতি খুজে পেতো৷ (সুরা নিসা ৪:৮২)।

কুরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তা বুঝার জন্যও কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে বলেছেন। আর কুরআনের সংগতি এবং অসংগতি খুজে পেতে হলে তাকে রিতিমত কুরআনের আগাগোড়া বিশ্লেষন করতে হবে। কাজেই কুরআন থেকে উপকৃত হতে হলে আল্লাহ তা‘আলার মহান বাণী বুঝে বুঝে পড়তে হবে আর প্রতি লাইন চিন্তা ভাবনা করে এগুতে হবে। 

‘আবূ আবদুর রহমান রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবী (রা:)  আমাদের কুরআন পড়িয়েছেন তারা বলেছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দশ আয়াত শিখতেন। তারপর আরও দশ আয়াত ততক্ষণ শিখতেন না যাবৎ তাঁরা এ কয়টি আয়াতে কী এলেম আছে আর কী আমল আছে, তা না জানতেন। তাঁরা বলেন, সুতরাং আমরা এলেম শিখেছি এবং আমল শিখেছি। (মুসনাদ আহমদ : ২৩৫৬৯; আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৩০৫৪৯)।

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,  ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না। (আবূ দাউদ – ১৩৯৬)।

যায়েদ বিন সাবেতকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সাত দিনে কুরআন খতম করাটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে

দেখেন? তিনি বললেন, এটা ভালো। অবশ্য আমি এটাকে পনের দিনে বা দশ দিনে খতম করাই পছন্দ করি।

 আমাকে জিজ্ঞেস করো, তা কেন? তিনি বললেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। যায়েদ বললেন, যাতে আমি তার স্থানে স্থানে চিন্তা করি এবং থামি।’ (মুয়াত্তা মালেক : ৪৭২)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খারেজী সম্প্রদায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে কিন্তু তা তাদের গলা অতিক্রম করবে না। (বুখারী – ৩৬১০)।

কুরআন মজীদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়াঃ

কুরআন মজীদ একটি বরকত সম্পন্ন কিতাব। আর বরকত হাসিলের মাধ্যম হিসাবে আল্লাহ বলেছেন  চিন্তা-ভাবনা করতে। আর যারা জ্ঞানী তারা চিন্তা-ভাবনা করে এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়। কুরআন থেকে সেই উপকৃত হতে পারবে, যে আল্লাহ তা‘আলার মহান বাণী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মহিমার কথা ভেবে ভেবে তার আদেশ উপদেশ গ্রহন করেবে। কুরআনের উপদেশ বুঝতে পারলে আমল করা সহজ হবে। তাই কেউ যদি মুখে কুরআন পড়ে আর এর ভাষা না বুঝে তার পড়া দ্বারা সে কাঙ্ক্ষিত ফায়দা অর্জন করতে পারবে না। 

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

 كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ مُبَـٰرَكٌ۬ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَـٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٢٩)

অর্থ: ‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’। (সূরা সোয়াদ ৩৮:২৯)।
আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ مُبَـٰرَكٌ۬ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَـٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٢٩)

অর্থ: এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ন কিতাব, যা (হে মুহাম্মদ!) আমি তোমার প্রতি নাযল করেছি, যাতে এরা তার (কুরআন) আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীশরা তা থেকে শিক্ষা নেয়৷  (সুরা সাদ ৩৮:২৯)।

ইবন কাসির রহ. বলেন, কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করা, কুরআন বুঝতে চেষ্টা না করাও কুরআন পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। কুরআনের আমল ছেড়ে দেয়া, এর নির্দেশ পালন না করা এবং নিষেধ উপেক্ষা করাও তা পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। এবং কুরআন ছেড়ে অন্য কথা-কাব্যে, অনর্থক বাক্যালাপ ও গান-বাজনায় ডুবে থাকাও পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। কারো কাছ থেকে জ্ঞান আহরন করতে হলে, আদেশ পালন করতে হলে, সুসংবাদ বা সতর্ক বাণী শুনতে হলে প্রথমেই তার ভাষা বুঝতে হবে। সে কি বলছে বা কি বুঝাতে চাচ্ছে তাও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ قُرۡءَٲنًا عَرَبِيًّ۬ا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ (٢) 

অর্থ: আমি ইহা আরবী ভাষায় কুর-আন অবতীর্ণ করেছি, যেনো তোমরা জ্ঞান আহরণ করতে পার। (ইউছুপ ১২:২)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡڪِتَـٰبَ بِٱلۡحَقِّ فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصً۬ا لَّهُ ٱلدِّينَ (٢)

অর্থ: আমি তোমার কাছে হকসহ এ কিতাব নাযিল করেছি৷ তাই তুমি একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর ইবাদাত করো৷ (যুমার ৪৩:২)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

كِتَـٰبٌ۬ فُصِّلَتۡ ءَايَـٰتُهُ ۥ قُرۡءَانًا عَرَبِيًّ۬ا لِّقَوۡمٍ۬ يَعۡلَمُونَ (٣) بَشِيرً۬ا وَنَذِيرً۬ا فَأَعۡرَضَ أَڪۡثَرُهُمۡ فَهُمۡ لَا يَسۡمَعُونَ (٤) 

অর্থ: এটি এমন এক গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে৷ আরবী ভাষার কুরআন৷ সেই সব লোকদের জন্য যারা জ্ঞানের অধিকারী। সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী৷ কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারা শুনতেই পায় না৷  (সুরা হা মীম সেজদা ৪১:৩-৪)।

যদি শুধুই কুরআনর তিলাওয়াত করি আর খতমের পর খতম দেই। অর্থ না বুঝলে কি জ্ঞান আহরন করতে পারব? আদেশ পালন (আল্লাহর ইবাদাত) করতে পারব? এমন কি আল্লাহর সুসংবাদ ও সতর্ক বাণী থেকেও বঞ্চিত থাকব। কুরআনের দাবি বুঝে পড়া ধোকা খাবেন না।

আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিসের বিশদ বিবরণ, সরাসরি পথ নির্দেশ ও রহমত হিসাবে আল কুরআন নজিল করেছেন, যেমনটি করেছিলেন বনী ইসরাঈলীদের নিকট। এই বিশদ বিবরণ জানতে হলে নিজের ভাষায় নিজের মত করে বুঝে পড়তে হবে। হিদায়েতের জন্য দরকার আল্লাহে পথ নির্দেশণা আর এই পথ নির্দেশ নিতে হবে কুরআন থেকে। যখনই বান্দা কুরআনের বিবরণ বুঝে আল্লাহর নির্দেশিত পথের অনুসরণ করবে তখনই মহান আল্লাহর রহমত পাবে। 

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

  ثُمَّ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَـٰبَ تَمَامًا عَلَى ٱلَّذِىٓ أَحۡسَنَ وَتَفۡصِيلاً۬ لِّكُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُدً۬ى وَرَحۡمَةً۬ لَّعَلَّهُم بِلِقَآءِ رَبِّهِمۡ يُؤۡمِنُونَ (١٥٤) وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكٌ۬ فَٱتَّبِعُوهُ وَٱتَّقُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ (١٥٥)

অর্থ: তারপর আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, যা সৎকার্মশীল মানুষের প্রতি নিয়ামতের পূর্ণতা এবং প্রত্যেকটি জিনিসের বিশদ বিবরণ, সরাসরি পথ নির্দেশ ও রহমত ছিল, সম্ভবত লোকেরা নিজেদের রবের সাথে সাক্ষাতের প্রতি ঈমান আনবে৷ আর এভাবেই এ কিতাব আমি নাযিল করেছি একটি বরকতপূর্ণ কিতাব হিসেবে৷ কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করো, হয়তো তোমাদের প্রতি রহম করা হবে৷  (আনআম ৬: ১৫৪-১৫৫)।

কুরআনে আল্লহ বারবার উল্লেখ করেছেন, এই কিতাব তিনি নাযিল করেছেন যাতে লোকদেরকে অন্ধকার (জুলমাত) থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসা যায়। অন্ধকার অর্থ হল অজ্ঞতা বা গোমরাহি আর আলো (নূর) অর্থ হল হিদায়েত। যদি এক কথায় মহা গ্রন্থ আল কুরআনের নাজিলের উদ্দেশ্য জানতে চাই। সকল নবী রাসূর আলাই-হিস সালামদের আগমনের হেতু জানতে চাই, তবে তার উত্তর একটাই আদম সন্তানদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসে। কুরআনে এমন কি আছে যা আপনাকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে দিকে নিয়ে আসবে। নিশ্চই মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন। তাই আসুন আজই বুঝে বুঝে কুরআন পড়ি আর অনুসন্ধান করি। এবং দেখি কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ কি বলেন,

  মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

الٓر‌ۚ ڪِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ صِرَٲطِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ (١)

অর্থ: আলিফ লাম-র। হে মুহাম্মদ৷ এটি একটি কিতাব, তোমার প্রতি এটি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো তাদের রবের প্রদত্ত সুযোগ ও সামর্থের ভিত্তিতে, এমন এক আল্লাহর পথে যিনি প্রবল প্রতাপান্বিত ও আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত। (ইবরাহীম ১৪:১)।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَهۡدِى بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٲنَهُ ۥ سُبُلَ ٱلسَّلَـٰمِ وَيُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِهِۦ وَيَهۡدِيهِمۡ إِلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (١٦)

অর্থ: যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তোষকামী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথপ্রদর্শন করেন এবং  নিজ ইচ্ছাক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন। (মায়েদা-৫:১৬)।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔايَـٰتِنَآ أَنۡ أَخۡرِجۡ قَوۡمَكَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ وَذَڪِّرۡهُم بِأَيَّٮٰمِ ٱللَّهِ‌ۚ إِنَّ فِى ذَٲلِكَ لَأَيَـٰتٍ۬ لِّكُلِّ صَبَّارٍ۬ شَكُورٍ۬ (٥)

অর্থ: আমি এর আগে মূসাকেও নিজের নিদর্শনাবলী সহকারে পাঠিয়েছিলাম৷ তাকেও আমি হুকুম দিয়েছিলাম, নিজের সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে এসো এবং তাদেরকে ইতিহাসের  শিক্ষণীয় ঘটনাবলী শুনিয়ে উপদেশ দাও৷ এ ঘটনাবলীর মধ্যে বিরাট নির্দশণ  রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে সবর করে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে৷ (ইবরাহীম ১৪:৫)।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ‌ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَوۡلِيَآؤُهُمُ ٱلطَّـٰغُوتُ يُخۡرِجُونَهُم مِّنَ ٱلنُّورِ إِلَى ٱلظُّلُمَـٰتِ‌ۗ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ‌ۖ هُمۡ فِيہَا خَـٰلِدُونَ (٢٥٧)

অর্থ: যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের সাহায্যকার ও সহায় ৷ তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে নিয়ে আসেন ৷ আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাদের সাহায্যকারী ও সহায় হচ্ছে তাগুত ৷ সে তাদের আলোক থেকে অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিয়ে যায় ৷ এরা আগুনের অধিবাসী ৷ সেখানে থাকবে এরা চিরকালের জন্য ৷ (বাকারা ২:২৫৭)।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

هُوَ ٱلَّذِى يُصَلِّى عَلَيۡكُمۡ وَمَلَـٰٓٮِٕكَتُهُ ۥ لِيُخۡرِجَكُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۚ وَڪَانَ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَحِيمً۬ا (٤٣)

অর্থ: তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে আসেন, তিনি মুমিনদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। (আহজাব- ৩৩:৪৩)।

মহান আল্লাহ কুরআনে সকল জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথ নির্দেশনা করেছেন তারই অনুসরণ করতে বলেছেনঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَـٰبَ تِبۡيَـٰنً۬ا لِّكُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُدً۬ى وَرَحۡمَةً۬ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ (٨٩) 

 অর্থ: আমি এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যা সব জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথ নির্দেশনা, রহমত ও সুসংবাদ বহন করে তাদের জন্য যারা আনুগত্যের শীর নত করে দিয়েছে৷ (সুরা নাহল ১৬:৮৯)। 

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহর ঘোসনা করেন, কুরআনে প্রতিটি জিনিস সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যাতে তার বান্দা সহজে বুঝতে পারে কোন পথে হিদায়েত আর কোন পথে গোমরাহী, কোন কাজে লাভ আর কোন কাজে ক্ষতি। আর বান্দা এসব জানার পর আল্লাহ অনুগত হয়ে সঠিক পথে চলতে থাকে। অর্খ না বুঝে পড়লে আল্লাহ দেখান পথ পাওয়া দুস্কর। কোন বিদেশির ভাষা না বুঝে তার আদেশ, নিষেধ, অনুরোধ মান্য করা যেমন কঠিন কাজ, ঠিক তেমনি ভাবে আল্লাহ আদেশ, নিষেধ না জেনে মান্য করা খুবই কঠিন। আর যখনই অর্থ বুঝে বুঝে পড়বে তখনই বান্দা তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে তার প্রতিটি বিষয় কুরআনে আলোকে জানতে পারবে। কাজেই বান্দা কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়াতের সন্ধান করবে। কুরআনের শিক্ষাই এক মাত্র সরল ও সঠিক পথে দেখাতে পারে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,

 إِنَّ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَہۡدِى لِلَّتِى هِىَ أَقۡوَمُ

অর্থ: ‘নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক’। (সূরা বনি-ইসরাঈল ১৭:৯)।

সমাজের এক শ্রেণীর আলেম আছে যারা কুরআনের অর্থ বুঝে পড়তে নিষেধ করে থাকে। অনেক সময় বলে থাকেন কুরআনের অর্থ বুঝে পড়তে হলে পনের প্রকার এলম থাকতে হবে। যাদের এই এলম নেই, তারা কুরআনের অর্থসহ তিলাওয়াত করতে পারবে না। সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদেরও কঠোরভাবে কুরআনের অর্থসহ তিলাওয়াত করতে নিষেধ করেন। তাদের এই নিষেধাজ্ঞা কতটুকু যৌত্তিক?

উত্তরঃ কোন বিষয় বুঝতে গেলে, সে বিষয় সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকা দরকার। আপনি যত ভাল শিক্ষকই হোন না কেন, নিরক্ষর অজ্ঞ লোককে আপনি কোন শ্রণীর অংক বুঝাতে পারবেন না। জ্ঞান দানের জন্য উপযুক্ত পাত্রের প্রয়োজন হয়। আবার ভাল মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও হবে না, বিষয়ের প্রতিও নজর রাখতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থী ডাক্তারি পাশ করেছেন অনায়াসে, তাকে ইজ্ঞিনিয়ারিং এর কোন জ্ঞান দিলে কত টুকু বুঝবে? তা যে কেউ বলতে পারবে। কাজেই বিষয় এবং শিক্ষার্থী দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।

এবার তাহলে আমাদের বিষয়টিতে আসি। আমাদের বিষয় হল আল কুরআন আর শিক্ষার্থী হল সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক।

প্রথমে আল কুরআনের বিষয় বস্তু উল্লেখ করব। তাহলেই পাঠক কুরআনের শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে পারবেন।

কুরআনের প্রধান বিষয় বস্তু হল আল্লাহ একত্বাবাদ বা তাওহীদ। কুরআনে প্রতিটি সূরায় তাওহীদ বর্ণনার পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি আয়াতের শেষে আল্লাহর পরিচয় দিয়েছেন। পঁচিশ জন নবী আলোচনার পাশাপাশি চৌদ্দটি জাতীর বিবরণ আছে অসংখ্য আয়াতে। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মুলক আয়াত প্রায় দুই হাজারের মত।  এছাড়াও জান্নাত, জাহান্নাম, রিসালত, আখেরাত, আল্লাহর কিতাব, ফিরেস্তা, তাকদির, কিয়ামত, সালাত, সাওম, হজ্জ্ব, যাকাত, দুয়া মুনাজাত, যিকির, তাওবা, বান্দার হক, বন্ধু নির্বাচন,  নারী, বিবাহ, তালাক, মোহর, জিনা, পর্দা, উত্তারাধিকারির সম্পদ, হালাল, হারাম, মদ, সুদ, ঘুষ, জিহাদ, খেলাফত, মুমিন, ইয়াহুদি, খৃষ্টান, মুশরিক, মুনাফিকদের চরিত্র ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি বুঝার জন্য কোন বিষেশ এলমের প্রয়োজন নেই। তবে কিছু কিছু আয়াত আছে যে গুলো বুঝার জন্য শানে নুজুল, সময়, কারন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, একজন আদর্শ মুমির বান্দা হিসাবে পৃথিবীতে চলতে গেলে যা যা দরকার তার সবই আছে।  অর্থাৎ মানুষের হোদায়াত পাওয়া ও পথ দেখার জন্য যেসব জিনিসের প্রয়োজন তার প্রত্যেটির বিস্তারিত বিবরণ মহান আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

لَقَدۡ كَانَ فِى قَصَصِہِمۡ عِبۡرَةٌ۬ لِّأُوْلِى ٱلۡأَلۡبَـٰبِ‌ۗ مَا كَانَ حَدِيثً۬ا يُفۡتَرَىٰ وَلَـٰڪِن تَصۡدِيقَ ٱلَّذِى بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ ڪُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُدً۬ى وَرَحۡمَةً۬ لِّقَوۡمٍ۬ يُؤۡمِنُونَ (١١١)

অর্থঃ পূর্ববর্তী লোকদের এ কাহিনীর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেচনা সম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে৷ কুরআনে এ যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো বানোয়াট কথা নয় বরং এগুলো ইতিপূর্বে এসে যাওয়া কিতাবগুলোতে বর্ণিত সত্যের সমর্থন এবং সবকিছুর বিশদ বিবরণ, আর যারা ঈমান এসেছে তাদের জন্য হেদায়াত ও রহমত৷ (সুরা ইউসুফ ১২:১১১)।

আবার কখন কখন আবার শুধু শিরোনাম দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও, (২:৪৩)। কিন্তু সালাত ও যাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ন ইবাদাত হলেও শুধু শিরোনামের মত উল্লেখ করা হইয়াছে। এই শিরনামের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনিতে বা হাদিস সমুহে। হাদিস সমুহ আল্লাহর এক প্রকার অহী। আল্লাহ বলেন,

 لَأَخَذۡنَا مِنۡهُ بِٱلۡيَمِينِ (٤٥) ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡهُ ٱلۡوَتِينَ (٤٦) فَمَا مِنكُم مِّنۡ أَحَدٍ عَنۡهُ حَـٰجِزِينَ (٤٧)

অর্থ: যদি এ নবী নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিতো। তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। এবং ঘাড়ের রগ কেটে দিতাম৷ তোমাদের কেউ-ই (আমাকে ) এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতো না৷ (সুরা হাক্ক ৬৯:৪৫-৪৭)। 

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ তার লিখিত প্রসিদ্ধ কিতাব “ফওজুল কবির”-এ কুরআনের আলোচ্য বিষয় বস্তুসমুহ মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন।

১। ইলমুল আহকাম বা সাংবিধানিক জ্ঞানঃ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিয় জীবনের সকল বিধি নিষেধ এবং ফরজ, ওয়াজির, হালাল, হারামসহ সকল আদেশ  নিষেধ।

২। ইলমুল মুখাদামা বা ন্যায়শাস্ত্রঃ ইয়াহুদি, খৃষ্টান, মুশরিক ও মুনাফিক এই চার দলের ভ্রান্ত মতবাদ সংক্রান্ত।

২। ইলমুল তাজকির বা স্রষ্টাতত্ত্বঃ তাওহীদ বা একত্ববাদের সকল বিষয় আলোচনা।

২। ইলমুল তাজকির বিলআইয়ামিল্লাহ বা সৃষ্টিতত্ত্বঃ আল্লাহর সৃষ্টি বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা।

২। ইলমুল তাজকির বিল মাইত বা পরকাল জ্ঞানঃ আখেরাত বা পরকাল সংক্রান্ত শাস্তি ও পুরস্কারের আলোচনা।

এক অনুসন্ধানে দেখা যায় কুরআনে মোট আদেশমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, নিষেধমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, ভীতিমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, প্রতিজ্ঞামূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, দৃষ্টান্তমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, ইতিহাসমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, প্রশংসামূলক আয়াতের সংখ্যা আড়াই শত, উদ্দেশ্যমূলক আয়াতের সংখ্যা আড়াই শত, পুর্ণতামূলক আয়াতের সংখ্যা এক শত।

এই সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে দখা যাবে, অদৃশ্যের বর্ণনার পাশাপাশি, মানব জীবনের জীবন ঘনিষ্ট সকল বিষয় উঠে এসেছে মহা গ্রন্থ আর কুরআনে। বিশ্ব জাহানের সকল জ্ঞানের উত্স হল আল কুরআন। সকল জ্ঞানের উত্স থেকে নাজিল করা জ্ঞান, যা অবশ্যই আদম সন্তানের দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ করার একক ক্ষমতা রাখে। কুরআন কোন একক শ্রেণী পেশার জন্য নাজির হয় নি।

যেমন প্রতিবেশী হিন্দুদের কথাই ধরুন। সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম। উপমহাদেশে এক সময় নিম্ম বর্ণের হিন্দুদের জন্য তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়া নিষেধ ছিল। তাদের গ্রন্থ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত। তাই  নিম্ম বর্ণের কোন হিন্দু তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে কিছু পড়লে বা কিছু শুনলে তাদের শাস্তি প্রদান করা হত।

কুরআন যেহেতু সব শ্রেণী পেশার জন্য নাজিল হয়েছে। আর তিনি নাজিল করেছেন তিনি তো সকল সৃষ্টির মন মানুষিকতা বুঝেই নাজিল করেছেন। মহান আল্লাহ উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন। তাই কুরআনের পঠন, পাঠন, তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এবং কুরআনের অনুশাসন মেনে চলাকে আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন বলে সূরা আল-কামারে মোট চারবার ঘোষণা দিয়েছেন। এবং বলেছেন,

وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ

অর্থঃ আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি? (সূরা কামার ৫৪:১৭,২২,৩২,৪০)।

হাজার হাজার হাফেজ দেখলেই মনে হবে আল কুরআনের শব্দমালা কত সহজেই তিলাওয়াত ও হিফয করা যায়। কুরআনের ভাষা খুবই সহজ সাবলিল, মাধুর্যপূর্ণ, নিখুদ ও সহজেই বোধগম্য। অথচ লেখাগুলি কাব্যিক ছন্দে। পৃথিবীর কোন কেউ এমন করে রচনা করতে পারবেনা, (২:২৩-২৪: ১৭:৮৮)। যে বা যারাই কুরআনের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের জন্য তা নিতান্তই সহজ করে দেন। কুরআনের অর্থগত দিকটাও চমত্কার। এমন অনেক অনারব অমুসলিম আছে যাদের আরবি সম্পর্কে নুন্যতম ধারনা নেই। অনুবাদ পড়ে কুরআনের ভুল ধরার চেষ্টা করে, নিজেই কুরআনের কাছে আত্বসমার্পণ করে মুসলিম হয়েছেন।

মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِنَّمَا يَسَّرۡنَـٰهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَڪَّرُونَ (٥٨)

অর্থঃ ‘অতঃপর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা দুখান ৪৪:৫৮)।

মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْماً لُدّاً

 অর্থঃ আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং হঠকারীদেরকে ভয় দেখাতে পারো৷ (সূরা মারইয়াম ১৯:৯৭)।

কুরআনের কুরআনের বিষয় বস্তু ও আল্লার নাজির কৃত আয়াত দ্বারা এ কথা বুঝা গেল এক জন সাধারন আদম সন্তান থেকে শুরু করে, মহা জ্ঞানীও কুরআনকে সহজে বুঝতে পারবে। তাছাড়া এ মহান গ্রন্থ আল্লাহ সকল বিশ্ববাসির জন্য নাজিল করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

 هَـٰذَا بَلَـٰغٌ۬ لِّلنَّاسِ وَلِيُنذَرُواْ بِهِۦ وَلِيَعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا هُوَ إِلَـٰهٌ۬ وَٲحِدٌ۬ وَلِيَذَّكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٥٢

 অর্থঃ এটি একটি পয়গাম সব মানুষের জন্য এবং এটি পাঠানো হয়েছে এ জন্য যাতে এর মাধ্যমে তাদেরকে সতর্ক করা যায় এবং তারা জেনে নেয় যে, আসলে আল্লাহ মাত্র একজনই আর যারা বুদ্ধি-বিবেচনা রাখে তারা সচেতন হয়ে যায়৷  (সুরা ইব্রাহীম ১৪:৫২)।

মহান আল্লাহ বলেন,

تَبَارَكَ ٱلَّذِى نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَـٰلَمِينَ نَذِيرًا (١)

 অর্থ: বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি এ ফুরকান যাতে সে সারা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হয়৷ তারঁ বান্দার ওপর নাযিল করেছেন। (সুরা ফুরকান ২৫:১)। 

মহান আল্লাহ বলেন,

هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

 অর্থঃ এটা সব মানুষের জন্য দূরদৃষ্টির আলো এবং যারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে তাদের জন্য হিদায়াত ও রহমত৷(সুরা জাসিয়া ৪৫:২০)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 هَـٰذَا بَيَانٌ۬ لِّلنَّاسِ وَهُدً۬ى وَمَوۡعِظَةٌ۬ لِّلۡمُتَّقِينَ (١٣٨)

 অর্থঃ এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সর্তকবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ৷ (সুরা আল ইমরান ৩:১৩৮)। 

কুরআনের বিষয় বস্তু আর আল্লাহ বনী একথার সাক্ষ্য দেয় যে, সর্বজনিন ও সকল মানব জাতির জন্য নাজিলকৃত কুরআনের বানী কঠিন ও দুর্ভেদ্য নয়।

এবার আসুন শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে। শিক্ষার্থী হল সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক। সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত সকল মানুষই কি কুরআনের অর্থ বুঝার বা জানার চেষ্টা করে? একটা উদাহরন দিলেই ব্যপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার নিজের গ্রামে দুইটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাই স্কুল, একটি হিফজ খানাসহ কওমী মাদ্রাসা আছে যেখানে দাওরা হাদিস পর্যান্ত পড়ান হয়। এবং প্রায় আড়াই হাজারের মত ভোটার আর নামাজ ফরজতো আরও বেশী জনের উপর। তিন/চারটি সমজিদ আছে কিন্তু জুমার সালাত হয় মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে। মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছাড়া নিয়মিত জামাতে সালাত আদায় করে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ জনের মত। বাকি মসজিদে পাঁচ থেকে দশ জনের মত। এই হল একটি আদর্শ গ্রামের নামাজিদের চিত্র। গ্রাম বাংলার চিত্র আরও করুন। বেশীর ভাগ গ্রামে মসজিদই নেই। আবার যেখানে মসজিদ আছে, নিয়মিত আযানই হয় না। ইসলামী ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে শতকরা পাঁচ জন লোক নিয়মিত সালাত আদায় করে। এই শতকরা পাঁচ জন লোকের মধ্যে আছেন, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসাই, খেটে খাওয়া মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র, চাকুরি জীবি এমনকি বেকার শ্রণীও। এদের মধ্যে আবার সহিহ করে কুরআন পড়তে পারা লোকের সংখ্যা শতকরা দশ জন হবে কি না সন্দেহ আছে। সহিহ করে কুরআন পড়তে পারা শতকরা দশ জনের নয় জনই হবে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক (মাদ্রাসায় পড়া আলেম ও ছাত্র বাদে)। সমাজে যারা নিরক্ষর তারাই কৃষক, শ্রমিক  বা ব্যবসাসহ নানান কাজের সাথে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। অর্থসহ কুরআন পড়াতো দুরের কথা কেউ নিয়মিত তিলাওয়াত করতে পারে কিনা সন্দেহ। তাহলে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক (শিক্ষক, ছাত্র, চাকুরি জীবি), যারা রুটিন মত কাজ করে এবং নিয়মিত সালাতও আদায় করে তাদেরই একটা অংশ নিয়মিত তিলাওয়াত পাশাপাশি অর্থসহ কুরআন পড়ার বা বুঝার চেষ্টা করে। এই সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলিই দেশ চালাচ্ছে, ডাক্তারি করছে, বড় বড় ইমারতের ডিজাইন দিচ্ছে, সফট ওয়ার বানাচ্ছে, নতুন নতুন আবিস্কার করছে। অথচ আল্লাহ প্রদত্ত সার্বজনিন আদেশ, নিষেধ, আইন কানুন, ইতিহাস সম্ভলিত গ্রন্থ পড়লে গোমড়া হবে।

অনেক বিধর্মীর আছে আরবি কি বুঝেনা। তাদের নিজের ভাষায় কু্রআন পড়েই ইসলাম গ্রহন করেছে। অনেক নন মুসলিম গবেষক, বিজ্ঞানি, ডাক্তার আছে, যারা শুধু ভুল ধরার জন্যই কুরআন নিয়ে গবেষণা করে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুসলিম হয়েছে। জ্ঞানী মুসলিম কি করে কু্রআন পড়ে গোমরা হবে?

তাহলে বুঝতে পারলাম বিষয় (কুরআন) আর শিক্ষার্থী (সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত ) দুটিই উপযুক্ত। সমাজে যে সকল আলেম এই রকম ফতোয়া দিবে তাদের কথায় কান দিবেন না। সময় সুযোগ হলে বুঝাতে চেষ্টা করবেন।

তবে কুরআনে এমন কিছু ব্যতিক্রমি আয়াত আছে যেগুলির সরল অনুবাদই মুখ্য নয়, বিশেষ অর্থ আছে। তাই কুরআন বুঝে পড়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে, তা না হলে ভুল ত্রুটি হয়ে যেতে পারে।  কখনো পাঠক বুঝে থাকতে পারেন এমন অর্থ যা বুঝানো কুরআনের উদ্ধেশ্য নয়। এমনটি সাহাবাগণের কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেছিল। যেমনঃ আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

অর্থঃ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে৷ (সুরা তওবা- ৯:৩১)। হাদীসে বলা হয়েছে হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী (সা) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খৃস্টান। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তিনি নবী (সা) কে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের এ আয়াতটিতে (সুরা তওবা- ৯:৩১) আমাদের বিরুদ্ধে উলামা ও দরবেশদেরকে খোদা বানিয়ে নেবার যে দোষারূপ করা হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য কি৷ জবাবে তিনি বলেন, তারা যেগুলোকে হারাম বলতো তোমরা সেগুলোকে হারাম বলে মেনে নিতে এবং তারা যেগুলোকে হালাল বলতো তোমরা সেগুলোকে হালাল বলে মেনে নিতে, একথা কি সত্য নয়৷ জবাবে হযরত আদী বলেন , হাঁ, একথা তো ঠিক, আমরা অবশ্যি এমনটি করতাম। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ব্যাস, এটিই তো হচ্ছে তোমাদে প্রভু বানিয়ে নেয়া। (আহম্মদ, তিরমিজ, তাফসিরে ইবনে কাসির)। 

আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে তার আযাব হবে।’’ আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেন নি,   ﴿فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً﴾  ‘‘অতঃপর অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব নিকাশ করা হবে।’’ (সূরা ইনশিকাক ৮৪:৮)। তিনি বললেন, ‘‘এটা সে হিসাব নয়, বরং এটা শুধু উপস্থাপন মাত্র। কিয়ামতের দিন যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেয়া হবে, তার আযাব হবে।’’ (সহীহ বুখারী – ৪৫৫৮; , সহীহ মুসলিম – ৫১২২)।

 এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আয়েশা রা. হিসাবের সাধারণ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছিলেন যা কম বেশী সব ধরনের হিসাবকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করে দিলেন যে, আয়াতে উল্লিখিত হিসাব মানে হল, মুমিন ব্যক্তির কাছে তার আমল উপস্থাপন, যাতে সে আল্লাহর সে অনুগ্রহ অনুধাবন করতে পারে যা তিনি দুনিয়ায় তার দোষ গোপন করার মাধ্যমে এবং আখিরাতে ক্ষমা করার মাধ্যম করেছিলেন। (হাফিয ইবন হাজার, ফাতহুল বারী – ৬০৫৬)।

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, যখন অবতীর্ণ হল ﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ﴾  ‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলম দ্বারা মিশ্রিত করেনি।’’ আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তার নিজের উপর যুলম করে নি? তিনি বললেন, ‘‘আয়াতটির ব্যাপারে তোমরা যা বলছ বিষয়টি তেমন নয়, বরং যুলম মানে এখানে শির্ক। তোমরা কি শোননি লুকমান তার ছেলেকে বলছিলেন,

 ﴿لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾ “হে বৎস, তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম।’’ (সূরা লুকমান ৩১:১৩)। সহীহ বুখারী – ৩১৭৫;  সহীহ মুসলিম -১৭৮)।

আমার জানা মতে আজ পর্যান্ত যতগুলি কুরআনের অনুবাদ ছাপা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সাথে টিকা সংযোজিত আছে। যাতে এই ধরনের কোন আয়াতের জন্য পাঠককে দিধা দন্ধে পড়তে না হয়। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। এই সমস্যা সমাধানর জন্য ভাল অনুবাদকের অনুবাদ (টিকাসহ) ক্রয় করা পড়তে থাকবেন।

সকল মানুষের চিন্তা, চেতনা, বুঝার ক্ষমা ও আকীদা এক নয়। সে অনুবাদের ভাবার্থ নিজের চিন্তা চেতনা ও আকীদার দ্বারা বিচার বিবেচনা করে আয়াতটি অর্থ তার অনুকুলে নিয়ে বুঝে তাকে। এবং পূর্ব থেকেই একটি বিষয় স্থির হয়ে আছে, যে কোন ভাবেই সে নিজের ধারণাটি কুরআনের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এটাই শুধু অনুবাদ পড়ার ক্ষেত্র আসল ত্রুটি। কিন্তু শুধু এই কারনে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোকটিকে কুরআন বুঝে পড়া থেকে দুরে রাখা যাবে না। তাকে সাজেশন করতে হবে। এই সকল ব্যপারে কোন ভাল মানের তাফসিরের (ইবনে কাসির) সাহা্য্য নিয়ে আসল অর্থ গ্রহন করা। আর তা সম্ভব না হলে, ভাল কোন আলেমের সাথে দেখা করে বিষয়টি জেনে নেওয়া। এই অজিহাতে কুরআন বুঝে পড়া থেকে দুরে থাকা কতটুকু যৌক্তিক।

কুরআন নাযিলের প্রধান কারন হল, মানুষ আল্লাহর পরিচয় পেয়ে তার প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী আমল করবে। যে ব্যক্তি কুরআন পড়র অথচ বুঝল না তাহলে সে কিভাবে আমল করবে। বুঝে পড়া যে কত জরুরি, এ কথা বুঝার জন্য কয়েকটি উদাহরন দিচ্ছি:

উদাহরণ – ০১ : যুদ্ধরত একদল সেনাদের নিকট তার অধিনায়ক ফরমান পাঠালেন যে, “তোমরা এখন যে পথে অগ্রসর হচ্ছ সেখানে শত্রুরা ওতপেতে আছে। কাজেই দিক পরিবর্তন করে অগ্রসর হবে অথবা আমি আসা পর্যান্ত অপেক্ষা করবে। আমার কথার ব্যতিক্রম হলে ধ্বংশ অনিবার্য”। সেনা অধিনায়কের ফরমান সকলে মিলে বার বার না বুঝে শুধুই তিলাওয়াত করলেন, সম্মান দেখালেন, ফরমানের কাগজে চুমু খেলেন, লাল কাপড়ে মুড়ে রাখলেন। আসল হুকুম ছিল, দিক পরিবর্তন করে অগ্রসর হওয়া, তা অনুসরন করলেন না। তা হলে ঐ সেনাদেরধ্বংশ অনিবার্য। যদি ফরমানের আদেশ বুঝো আমল (কাজ) করত, তবে ধ্বংশ থেকে রক্ষা পেত। এবার আপনি বলুন অর্থ না বুঝে কুরআন পড়ে, আমল বঞ্চিত অবস্থায় আল্লাহে সামনে হাজির হলে আমাদের ওযর কত টুকু গ্রহন যোগ্য হবে? কিয়ামতে দিন কোন কার ওযর গ্রহন করা হবে না। কারণ তাওবা, ঈমান ও সৎকাজের দিকে ফিরে আসার সকল সুযোগই তারা হারিয়ে ফেলেছে  এবং পরীক্ষার সময় পার হয়ে গিয়ে এখনি ফল প্রকাশের সময় সমাগত হবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

 يَوۡمَ لَا يَنفَعُ ٱلظَّـٰلِمِينَ مَعۡذِرَتُہُمۡۖ وَلَهُمُ ٱللَّعۡنَةُ وَلَهُمۡ سُوٓءُ ٱلدَّارِ (٥٢)

অর্থ: যেদিন ওজর ও যুক্তি পেশ জালেমদের কোন উপকারে আসবে না, তাদের ওপর লা’নত পড়বে এবং তাদের জন্য হবে জঘন্যতম ঠিকানা৷  (সুরা মুমিন ৪০:৫২)।

فَيَوۡمَٮِٕذٍ۬ لَّا يَنفَعُ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مَعۡذِرَتُهُمۡ وَلَا هُمۡ يُسۡتَعۡتَبُونَ (٥٧)

অর্থ: কাজেই সেদিন জালেমদের কোন ওজর- আপত্তি কাজে লাগবে না এবং তাদেরকে ক্ষমা চাইতেও বলা হবে না৷ (রুম ৩০:৫৭)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَا تَعۡتَذِرُواْ ٱلۡيَوۡمَ‌ۖ إِنَّمَا تُجۡزَوۡنَ مَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ (٧)   

হে কাফেরগণ! আজ ওযর প্রকাশ করো না৷ তোমরা যেমন আমল করছিলে তেমনটি প্রতিদানই দেয়া হচ্ছে৷ (সুরা তাহরিম ৬৬:৭)।

উদাহরণ – ০২ : আপনার মোবাইলে প্রায়ই ম্যাসেস আসে। আপনি কখন দেখেন আবার কখন দেখেন না। আপনি চাকুরির জন্য দরখাস্ত করেছেন। মোবাইলে ম্যাসেসের মাধ্যমে আপনাকে চাকুরিতে যোগদানে তারিখ জানিয়ে ম্যাসেস করা হল। আপনি ম্যাসেস দেখলেন কিন্তু পড়লেন না, পড়ার চেষ্টা ও করলেন না। যোগদানে তারিখ শেষ হওয়ার পর জানতে পারলেন, আপনাকে ম্যাসেস করা হইয়াছিল। তখন আপনার আফসস করা ছারা আর কি করার আছে। আর এক বার সুযোগের কথা বললে, বলা হবে আপনার স্থানে অন্য লোক নিয়োগ পেয়েছে।

ঠিক তেমনি ভাবে আজ যারা কুরআন পড়ছে না বা ইহার অর্থ না বুঝুর জন্য আমর করছে না। তারাও আবার এক বার সুযোগ দানের জন্য কাকুতি মিনুতি করে বলবেন। আল্লাহর কুরআনের ভাষায়,

 أَوۡ تَقُولَ حِينَ تَرَى ٱلۡعَذَابَ لَوۡ أَنَّ لِى ڪَرَّةً۬ فَأَكُونَ مِنَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ (٥٨) 

অর্থ: কিংবা অযাব দেখতে পেয়ে বলবেঃ “কতই না ভাল হতো যদি আরো একবার সুযোগ পেতাম তাহলে নেক আমলকারীদের অন্তরভুক্ত হয়ে যেতাম৷ (সুরা যুমার ৩৯:৫৮)।

তাদের এ আশার গুরেবালি। আর কোন সুযোগ দেওয়া হবে না। বরং বলা হবে (কুরআনের ভাষায়),

بَلَىٰ قَدۡ جَآءَتۡكَ ءَايَـٰتِى فَكَذَّبۡتَ بِہَا وَٱسۡتَكۡبَرۡتَ وَكُنتَ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِينَ (٥٩) وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَـٰمَةِ تَرَى ٱلَّذِينَ كَذَبُواْ عَلَى ٱللَّهِ وُجُوهُهُم مُّسۡوَدَّةٌ‌ۚ أَلَيۡسَ فِى جَهَنَّمَ مَثۡوً۬ى لِّلۡمُتَكَبِّرِينَ (٦٠)

অর্থ: কেন নয়, আমার আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিলো৷ কিন্তু তুমি তা অস্বীকার করেছিলে এবং গর্ব করেছিলে৷ আর তুমি তো কাফেরদের অন্তরভুক্ত ছিলে৷ আজ যেসব লোক আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে কিয়ামতের দিন তুমি দেখবে তাদের মুখমণ্ডল হবে কাল৷ অহংকারীদের জন্য কি জাহান্নামে যথেষ্ট জায়গা নেই?  (সুরা যুমার ৩৯:৫৯-৬০)।

উদাহরণ – ০৩ : আপনি বড় কোন কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। আপনার মালিক আপনাকে ই-মেইল করে জানালেন, “আগামি কাল বিদেশি ডেলিগেট আসবে। আপনি অফিসের প্রয়োজনিয় ডকুমেন্টসহ সকাল দশটায় উপস্তিত থাকবেন। যেহেতু দিনটি, ছুটির দিন তাই আপনাকে জানালাম। আপনি প্রয়োজনিয় ডকুমেন্ট নিয়ে উপস্থিত না থাকলে কোম্পানি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হবে”। আপনি মালিকের ই-মেইল পড়লেন, বার বার পড়লেন কিত্তু বুঝে পড়লেন না। অর্থাৎ মালিক কি বলছেন তা বুঝলেন না বা বুঝার চেষ্টাও করলেন না। আমল (কাজ করা) তো অনেক দুরের ব্যপার। তাহলে আপনার চাকুরি থাকবে তো? আপনি যদি পাগল না হন, তবে মালিকের এহেন ই-মেইলের অর্থ অনুধাপণ করতে পেরেও কি স্থির থাকতে পারবেন।

আমাদের আসল মালিক আল্লাহর পাঠান এর থেকেও হাজার হাজার জরুরি ই-মেইল কুরআনে আছে। কুরআন না বুঝো পড়ার কারনে আল্লাহে ই-মেইলগুলোর মর্ম অণুধাপন করতে পারছিনা। যখই আল্লাহর ম্যাসেস বা মেইল সঠিক ভাবে বুঝব তখন আমল করা সহজ হবে। কাজেই কুরআনের অর্থ না বুঝার মানেই হল দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকা।

 আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘‘এটা সে সময় যখন মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে, ফলে তারা তা অর্জন করতে সক্ষম হবে না।’’ তখন যিয়াদ ইবন লাবিদ আল-আনসারী বললেন, কিভাবে জ্ঞান আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে অথচ আমরা কুরআন পড়েছি?  আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই কুরআন পড়ব, আর আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে কুরআন পড়াব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘হে যিয়াদ তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক (তোমার মৃত্যু হোক), আমি তো তোমাকে মদীনাবাসী ফাকীহদের মধ্যে গণ্য করতাম। এ তাওরাত এবং ইনজিল ইয়াহুদ ও নাসারাদের কাছে আছে। কিন্তু তা তাদের কি কাজে এসেছে?’’ জুবায়ের বললেন, এরপর আমরা উবাদাহ ইবন আস-সামিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, তুমি কি শুনেছ তোমার ভাই আবুদ্দারদা কি বলছে?  আর আবুদ্দারদা কি বলেছে তা তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আবুদ্দারদা সত্য বলেছে, তুমি চাইলে আমি তোমার কাছে সে ইলম সম্পর্কে বলব যা সর্বপ্রথম উঠিয়ে নেয়া হবে, তা হল খুশূ ও বিনয়। তুমি হয়ত কোন মাসজিদে প্রবেশ করে সেখানে কোন বিনয়ী লোক পাবে না। (সুনান তিরমিযী, কিতাবুল ইলম, হাদীস নং ২৬৫৩, তিরমিযী বলেন, এটি হাসান গরীব হাদীস, আলবানী সহিহ বলেছেন)।

    যদি জ্ঞানার্জন সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাকর কাজ হয়ে থাকে তাহলে এর অগ্রভাগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আল্লাহর কালাম জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করা। কেননা জ্ঞানের মর্যাদা জ্ঞানগত বিষয়ের মর্যাদার উপর নির্ভর করে। কিতাবুল্লাহ হচ্ছে জগতের সবচেয়ে সম্মানিত বিষয়। সুতরাং এর জ্ঞানার্জনই হল সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাকর কাজ।

৯।  কুরআন অনুসারে জীবন যাপর করাঃ

পূর্বের আলোচনার দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝেছি মহান আল্লাহ কুরআন বুঝে পড়ার জন্য নাজিল করেছেন। কুরআন বুঝলে আল্লাহর আদেশ নিষেধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা হবে। আর কোন ক্রমেই তার হুকুম আহকাম অমান্য করা সম্ভব হবে না। কুরআন নাজিলের বহুবিদ কারন থাকলেও প্রধান কারন হল, মানুষ কিভাবে বা কি কাজ করা মহান আল্লাহর সন্ত্বষ্টি অর্জন করতে পারে। নবী রাসুলদের দেখান পদ্দতি যে কাজ করবে তাই নেক আমল বলে বিবেচত হবে। আর বান্দা নেক আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহ দাসত্ব স্বীকার করে নেয়। শুধু এ জন্যই আল্লাহ আদম সন্তান সৃষ্টি করেছেন।

** আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে যত নবী রাসুল এসেছেন সকলই এক আল্লাহর (তৌহীদের) ইবাদতের জন্য দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

 وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ (٥٦) 

অর্থ: জিন ও মানুষকে আমি শুধু এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার দাসত্ব করবে৷ (সুরা জারিয়াত ৫১:৫৬)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

অর্থঃ আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই পাঠিয়েছি তাঁকে এ প্রত্যাদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং একমাত্র আমারই ইবাদত কর। (সূরা আম্বিয়া ২১:২৫)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

 ذَٲلِڪُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ‌ۖ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ‌ۖ خَـٰلِقُ ڪُلِّ شَىۡءٍ۬ فَٱعۡبُدُوهُ‌ۚ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ۬ وَڪِيلٌ۬ (١٠٢)

অর্থ: এ তো আল্লাহ তোমাদের রব৷ তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই৷ সবকিছুর তিনিই স্রষ্টা৷ কাজেই তোমরা তাঁরই বন্দেগী করো৷ তিনি সবকিছুর তত্বাবধায়ক৷  (সুরা আনআম ৬:১০২)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থঃ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক। (সূরা নাহল ১৬:৩৬)।

কুরআন সর্বক্ষেত্রে ইবাদাত করার হুকুম প্রদান করেনঃ

কুরআনের বর্ণনাতে দেখা যায় হযরত আদম আলাইহিস সালাম তার সন্তানদের যে সৎ ও সুস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে যান তার প্রথম বিকৃতি দেখা দেয় হযরত নূহ আলাইহিস সালামেন যুগে এবং তার সংশোধন এবং জীবনে ব্যব্স্থাকে আবার সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যে মহান আল্লাহ হযরত নূহকে পাঠান। এবং এক মাত্র তার ইবাদাত করার হুকুম প্রদান করেন।মহান আল্লাহ বলেন,

 لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَقَالَ يَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَيۡرُهُ ۥۤ إِنِّىٓ أَخَافُ عَلَيۡكُمۡ عَذَابَ يَوۡمٍ عَظِيمٍ۬ (٥٩)

অর্থ: নুহকে আমি তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই৷ সে বলে, হে আমার স্বগোত্রীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই৷ আমি তোমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি৷  ( আরাফ ৭:৫৯)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّ هَـٰذِهِۦۤ أُمَّتُكُمۡ أُمَّةً۬ وَٲحِدَةً۬ وَأَنَا۟ رَبُّڪُمۡ فَٱعۡبُدُونِ (٩٢) وَتَقَطَّعُوٓاْ أَمۡرَهُم بَيۡنَهُمۡ‌ۖ ڪُلٌّ إِلَيۡنَا رَٲجِعُونَ (٩٣) فَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَهُوَ مُؤۡمِنٌ۬ فَلَا ڪُفۡرَانَ لِسَعۡيِهِۦ وَإِنَّا لَهُ ۥ ڪَـٰتِبُونَ (٩٤)

অর্থ: তোমাদের এ উম্মত আসলে একই উম্মত৷ আর আমি তোমাদের রব৷ কাজেই তোমরা আমার ইবাদাত করো৷ কিন্তু (নিজেদের কার্যকলাপের মাধ্যমে) লোকেরা পরস্পরের মধ্যে নিজেদের দীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে৷ সবাইকে আমার দিকে ফিরে আসতে হবে৷  কাজেই যে ব্যক্তি মুমিন থাকা অবস্থায় সৎকাজ করে, তার কাজের অমর্যাদা করা হবে না এবং আমি তা লিখে রাখছি৷ (সুরা আম্বিয়া ২১:৯২-৯৪)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 يَـٰٓأَيُّہَا ٱلرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ ٱلطَّيِّبَـٰتِ وَٱعۡمَلُواْ صَـٰلِحًا‌ۖ إِنِّى بِمَا تَعۡمَلُونَ عَلِيمٌ۬ (٥١)

 অর্থ: হে রসূল! পাক-পবিত্র জিনিস খাও এবং সৎকাজ করো৷  তোমারা যা কিছুই করো না কেন আমি তা ভালোভাবেই জানি। (সুরা মুমিনুন ২৩:৫১)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 وَلَهُ ۥ مَن فِى ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَٱلۡأَرۡضِ‌ۚ وَمَنۡ عِندَهُ ۥ لَا يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَلَا يَسۡتَحۡسِرُونَ (١٩) يُسَبِّحُونَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّہَارَ لَا يَفۡتُرُونَ (٢٠)

অর্থঃ পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যে সৃষ্টিই আছে তা আল্লাহরই৷  আর যে (ফেরেশতারা) তাঁর কাছে আছে তারা না নিজেদেরকে বড় মনে করে তাঁর বন্দেগী থেকে বিমুখ হয় এবং না ক্লান্ত ও বিষন্ন হয়। দিন রাত তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকে, বিরাম-বিশ্রাম নেয় না৷ (সুরা আম্বিয়া ২১:১৯-২০)

কুরআন অনুযায়ী আমল করা কুরআনের হকঃ

আল্লাহর আদেশ মান্য করা ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার করার মাধ্যমে কুরআন অনুযায়ী জীবন-যাপন করাই হচ্ছে কুরআনের হক। অর্থাৎ কুরআনের সকল সংবাদ বিশ্বাস, কুরআনে বর্ণিত সকল নিষিদ্ধ বস্তু বর্জন ও সকল নির্দেশ পালন করার মাধ্যমে কুরআনের হুকুম আহকাম মেনে চলা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থ: ‘আমি এমন বরকতপূর্ণ কিতাব তোমার নিকট নাজিল করেছি, যাতে করে তারা এর আয়াত নিয়ে গবেষণা করতে পারে এবং যাতে করে জ্ঞানবানরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। (সূরা সাদ ৩৮:২৯)।

আমাদের পূর্ব পুরুষ সালফে সালেহিনগণ এ আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী কুরআন অধ্যয়ন করতেন। তারা এর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও সুদৃঢ় আকিদা পোষণ করে এর হুকুম আহকামগুলো বাস্তবায়ন করতেন।

তাবেঈ আবু আব্দুর রহমান আস্সুলামা রহ. বলেন, “যারা আমাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন, তারা আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ ওসমান বিন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবাবৃন্দ। যখন তারা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআনের দশটি আয়াত শিখতেন, তখন তারা এ দশটি আয়াতই ভালভাবে আত্মস্থ করতেন এবং এতে যা এলম ও আমল আছে তা বাস্তবায়ন করা ছাড়া সামনে অগ্রসর হতেন না। তারা বলেন, এভাবেই আমরা কুরআন, এলম ও আমল সব এক সঙ্গে শিখেছি।”

কুরআন অনুযায়ী আমল করলে পুরস্কারের ঘোষনাঃ

কুরআন অনুযায়ী আমল করলে খারাপ কাজগুলি আল্লাহ দুর করে দিবেন। ভাল আমলের বদলা আল্লাহ বহুগুন বাড়িয়ে দিবেন। কিন্তু অসৎ কাজ যতটুকু করবে ফলও ততটুকু পাবে। কেননা আল্লাহ করো প্রতি জুলুম করেন না। তিনি বিচারকেরও বিচারক। যারা ভাল আমল করবে কেবল তাদের নেকী অনুযায়ীই প্রতিদান পাবে না রবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো পুরস্কৃত করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُ ۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَا‌ۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ (١٦٠) 

অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে হাযির হবে সৎকাজ নিয়ে তার জন্য রয়েছে দশগুণ প্রতিফল আর যে ব্যক্তি অসৎকাজ নিয়ে আসবে সে ততটুকু প্রতিফল পাবে যতটুকু অপরাধ সে করেছে এবং কারোর জুলুম করা হবে না৷ ( সুরা আনআম ৬:১৬০)।

মহান আল্লাহ বলেন,

لِّلَّذِينَ أَحۡسَنُواْ ٱلۡحُسۡنَىٰ وَزِيَادَةٌ۬‌ۖ وَلَا يَرۡهَقُ وُجُوهَهُمۡ قَتَرٌ۬ وَلَا ذِلَّةٌ‌ۚ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡجَنَّةِ‌ۖ هُمۡ فِيہَا خَـٰلِدُونَ (٢٦)

অর্থঃযারা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য আছে কল্যাণ এবং আরো বেশী৷  কলংক কালিম বা লাঞ্ছনা তাদের চেহারাকে আবৃত করবে না৷ তারা জান্নাতের হকদার, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল৷ ( সূরা ইউনুস ১০:২৬)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُ ۥ خَيۡرٌ۬ مِّنۡہَا‌ۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَى ٱلَّذِينَ عَمِلُواْ ٱلسَّيِّـَٔاتِ إِلَّا مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (٨٤)

অর্থঃ যে কেউ ভাল কাজ নিয়ে আসবে তার জন্য রয়েছে তার চেয়ে ভাল ফল এবং যে কেউ খারাপ কাজ নিয়ে আসে তার জানা উচিৎ যে, অসৎ কর্মশীলরা যেমন কাজ করতো তেমনটিই প্রতিদান পাবে৷ (কাসাস ২৮:৮৪)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 وَمَآ أَمۡوَٲلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَـٰدُكُم بِٱلَّتِى تُقَرِّبُكُمۡ عِندَنَا زُلۡفَىٰٓ إِلَّا مَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَـٰلِحً۬ا فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ لَهُمۡ جَزَآءُ ٱلضِّعۡفِ بِمَا عَمِلُواْ وَهُمۡ فِى ٱلۡغُرُفَـٰتِ ءَامِنُونَ (٣٧)

অর্থঃ তোমাদের এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে। হ্যাঁ, তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে৷এরাই এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ ইমারত সমূহে নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাকবে৷ (সুরা  সাবা ৩৪:৩৭)।

মহান আল্লাহ বলেন,

مَنۡ عَمِلَ سَيِّئَةً۬ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَاۖ وَمَنۡ عَمِلَ صَـٰلِحً۬ا مِّن ذَڪَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٌ۬ فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ يُرۡزَقُونَ فِيہَا بِغَيۡرِ حِسَابٍ۬ (٤٠) 

অর্থ: যে মন্দ কাজ করবে সে যতটুকু মন্দ করবে ততটুকুরই প্রতিফল লাভ করবে৷ আর নারী হোক বা পুরুষ যে নেক কাজ করবে সে যদি ঈমানদার হয় তাহলে তারা সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে৷ সেখানে তাদেরকে বেহিসেব রিযিক দেয়া হবে৷  (সুরা মু’মিন ৪০:৪০)।

পৃথিবী আমলেরই পরীক্ষা ক্ষেত্রঃ

পৃথিবী একটি পরীক্ষার স্থান। ইহার সাজ সরঞ্জামই দিয়েই আদম সন্তান কে পরীক্ষা করা হবে। কিন্তু যে ঈমান আনবে আর সৎকাজ করবে তাকে আল্লাহ তাআলা খারাপ থেকে বাচিয়ে পরীক্ষায় পাশ করাবেন। এবং এটা হবে তার ভাল কাজগুলোর প্রতিদান। কিন্তু মনে রাখতে হবে শুধু “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। বললাম “আমরা ঈমান এনেছি” আর করলাম খারাপ কাজ এবং এতেই সন্তুষ্টি থাকলাম তাহলে পরিনাম খুবই খারাপ। 

মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّا جَعَلۡنَا مَا عَلَى ٱلۡأَرۡضِ زِينَةً۬ لَّهَا لِنَبۡلُوَهُمۡ أَيُّہُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلاً۬ (٧)

অর্থ: আসলে পৃথিবীতে এ যাকিছু সাজ সরঞ্জামই আছে এগুলো দিয়ে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য বিধান করেছি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্য থেকে কে ভালো কাজ করে৷  (সুরা কাহফ ১৮:৭)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنۡهُمۡ سَيِّـَٔاتِهِمۡ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَحۡسَنَ ٱلَّذِى كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (٧)

অর্থ: আর যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদের দুষ্কৃতিগুলো আমি তাদের থেকে দূর করে দেবো এবং তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম কাজগুলোর প্রতিদান দেবো৷  (সুরা আনকাবুত ২৯:৭)। 

মহান আল্লাহ বলেন,

أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتۡرَكُوٓاْ أَن يَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا وَهُمۡ لَا يُفۡتَنُونَ (٢) وَلَقَدۡ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ‌ۖ فَلَيَعۡلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَلَيَعۡلَمَنَّ ٱلۡكَـٰذِبِينَ (٣) أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّيِّـَٔاتِ أَن يَسۡبِقُونَا‌ۚ سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ (٤)

অর্থ: লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি  আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন  কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক৷ আর যারা খারাপ কাজ করছে তারা কি মনে করে বসেছে তারা আমার থেকে এগিয়ে চলে যাবে ? বড়ই ভুল সিদ্ধান্ত তারা করছে৷   (আনকাবুত ২৯:২-৪)।

কুরআন বিরোধী আমলে ধ্বংশ অনিবার্যঃ

বান্দাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই এককভাবে সমস্ত সৃষ্টির ইবাদাতের অধিকার সংরক্ষন। এটাই আল্লাহ প্রদত্ত সরল পথ যা সোজা জান্নাতে দিকে নিয়ে যাবে। অপর পক্ষ যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মাত্র ইবাদাত করবে সে ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে কাফির ও মুশরীক বলে বিবেচিত হবে। কুরআনের স্পষ্ট ঘোসনার পরোও যদি কেউ ভুল পথ অবলম্বন করে তাহলে তার জন্য কেবল ধ্বংস অপেক্ষা করছে৷

যেমন:  আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

قُلۡ يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّاسُ إِن كُنتُمۡ فِى شَكٍّ۬ مِّن دِينِى فَلَآ أَعۡبُدُ ٱلَّذِينَ تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَـٰكِنۡ أَعۡبُدُ ٱللَّهَ ٱلَّذِى يَتَوَفَّٮٰكُمۡ‌ۖ وَأُمِرۡتُ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ (١٠٤)

অর্থ: হে নবী! বলে দাও হে লোকেরা! যদি তোমরা এখনো পর্যন্ত আমার দীনের ব্যাপারে কোন সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে শুনে রাখো, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের বন্দেগী করো আমি তাদের বন্দেগী করি না বরং আমি কেবলমাত্র এমন আল্লাহর বন্দেগী করি যার করতলে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু৷ (সুরা ইউনুস ১০:১০৪)।

আল্লাহ তা’আলা আরওএরশাদ করেন:

 قُلۡ يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَڪُمُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكُمۡ‌ۖ فَمَنِ ٱهۡتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَہۡتَدِى لِنَفۡسِهِۦ‌ۖ وَمَن ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيۡہَا‌ۖ وَمَآ أَنَا۟ عَلَيۡكُم بِوَڪِيلٍ۬ (١٠٨)

অর্থ: হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য এসে গেছে৷ এখন যারা সোজা পথ অবলম্বন করবে তাদের সোজা পথ অবলম্ব তাদের জন্যই কল্যাণকর হবে৷ এবং যারা ভুল পথ অবলম্বন করবে তাদের ভুল পথ অবলম্বন তাদের জন্যই ধ্বংস কর হবে৷ আর আমি তোমাদের ওপর হাবিলদার হয়ে আসেনি৷  (সুরা ইউনুস ১০:১০৮)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ لَا بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُونَ

অর্থ: ‘আর যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, তার কাছে যার কোন সনদ নেই। তার হিসাব তার পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয় কাফেররা সফলকাম হবে না, (মুমিনুন-১১৭)।

কুরআন অনুসারে আমলের পুরস্কার হলো জান্নাতঃ

মহান আল্লাহর তাআলার নিকট থেকে বান্দার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হল হল জান্নাহ। জন্নাত পেতে হলে তাকে কুরআন অনুসারে আকিদা ঈনান ঠিক করে আল্লাহ প্রদত্ত সীমা রেখার মধ্যে থেকে নিয়মিত নেক আমল করে যেতে হবে।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

هَـٰذَا ذِكۡرٌ۬‌ۚ وَإِنَّ لِلۡمُتَّقِينَ لَحُسۡنَ مَـَٔابٍ۬ (٤٩) جَنَّـٰتِ عَدۡنٍ۬ مُّفَتَّحَةً۬ لَّهُمُ ٱلۡأَبۡوَٲبُ (٥٠) مُتَّكِـِٔينَ فِيہَا يَدۡعُونَ فِيہَا بِفَـٰكِهَةٍ۬ ڪَثِيرَةٍ۬ وَشَرَابٍ۬ (٥١) ۞ وَعِندَهُمۡ قَـٰصِرَٲتُ ٱلطَّرۡفِ أَتۡرَابٌ (٥٢) هَـٰذَا مَا تُوعَدُونَ لِيَوۡمِ ٱلۡحِسَابِ (٥٣) إِنَّ هَـٰذَا لَرِزۡقُنَا مَا لَهُ ۥ مِن نَّفَادٍ (٥٤) 

অর্থ: এ ছিল একটি স্মরণ৷ (এখন শোনো) মুত্তাকীদের জন্য নিশ্চিতভাবেই রয়েছে উত্তম আবাস্ত। চিরন্তন জান্নাত, যার দরোজাগুলো খোলা থাকবে তাদের জন্য৷ সেখানে তারা বসে থাকবে হেলান দিয়ে, বহুবিধ ফলমূল ও পানীয়ের ফরমাশ করতে থাকবে৷   এবং তাদের কাছে থাকবে লজ্জাবতী কম বয়সী স্ত্রীরা৷ এসব এমন জিনিস যেগুলো হিসেবের দিন দেবার জন্য তোমাদের কাছে অংগীকার করা হচ্ছে৷ এ হচ্ছে আমার রিযিক, যা কখনো শেষ হবে না৷ (সুরা সাদ ৩৮:৪৯-৫৪)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

 إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمۡ خَيۡرُ ٱلۡبَرِيَّةِ (٧) جَزَآؤُهُمۡ عِندَ رَبِّہِمۡ جَنَّـٰتُ عَدۡنٍ۬ تَجۡرِى مِن تَحۡتِہَا ٱلۡأَنۡہَـٰرُ خَـٰلِدِينَ فِيہَآ أَبَدً۬ا‌ۖ رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنۡہُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ‌ۚ ذَٲلِكَ لِمَنۡ خَشِىَ رَبَّهُ ۥ (٨)

 অর্থ: যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিত ভাবে সৃষ্টির সেরা। তাদের পুরষ্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত ৷ সেখানে তারা চিরকাল থাকবে ৷ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ৷ এসব সে ব্যক্তির জন্য যে তার রবকে ভয় করে ৷ (সুরা বাইয়েনা ৯৮:৭-৮)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

 إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَهُمۡ جَنَّـٰتٌ۬ تَجۡرِى مِن تَحۡتِہَا ٱلۡأَنۡہَـٰرُ‌ۚ ذَٲلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡكَبِيرُ (١١)

অর্থ: যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান যার নিম্নদেশে প্রবাহিত হতে থাকবে ঝরণাধারা৷ এটিই বড় সাফল্য৷  (সুরা বুরুজ ৮৫:১১)।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

 قُلۡ أَذَٲلِكَ خَيۡرٌ أَمۡ جَنَّةُ ٱلۡخُلۡدِ ٱلَّتِى وُعِدَ ٱلۡمُتَّقُونَ‌ۚ كَانَتۡ لَهُمۡ جَزَآءً۬ وَمَصِيرً۬ا (١٥) لَّهُمۡ فِيهَا مَا يَشَآءُونَ خَـٰلِدِينَ‌ۚ كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ وَعۡدً۬ا مَّسۡـُٔولاً۬ (١٦) 

অর্থ: এদের বল, এ পরিণাম ভলো অথবা সেই চিরন্তন জান্নাত যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছ মুত্তাকীদেরকে? সেটি হবে তাদের কর্মফল এবং তাদের সফরের শেষ মনযিল৷  সেখানে তাদের প্রত্যেকটি ইচ্ছা পূর্ণ হবে৷ তার মধ্যে তারা থাকবে চিরকাল তা প্রদান করা হবে তোমার রবের দায়িত্বের অন্তরভুক্ত একটি অবশ্য পালনীয় প্রতিশ্রুতি৷ (সুরা ফুরকান ২৫:১৫-১৬)।

কুরআন বিরোধী আমলের শাস্তিঃ

কুরআনের আদেশ নিষেধ অনুসারে আমল না করলে মহান আল্লাহ আজাবের ভয় দেখিয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আজাবে কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন: অধোমুখে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে, তাদের চেয়ারায় কালো করে উঠাবেন, ফুটন্ত পানি, ক্ষত মুশ্রিত পুজ, যককূম বৃক্ষ ইত্যাদি খেতে দিবেন৷

মহান আল্লাহ বলেন,

 لَّا يَذُوقُونَ فِيہَا بَرۡدً۬ا وَلَا شَرَابًا (٢٤) إِلَّا حَمِيمً۬ا وَغَسَّاقً۬ا (٢٥) جَزَآءً۬ وِفَاقًا (٢٦)

অর্থ: সেখানে তারা কোন রকম ঠাণ্ডা পানযোগ্য কোন জিনিসের স্বাদই পাবে না৷ গরম পানি ও ক্ষতঝরা ছাড়া। (তাদের কার্যকলাপের) পূর্ণ প্রতিফল৷ (সুরা নাবা ৭৮:২৪-২৬)।

মহান আল্লাহ বলেন,

ثُمَّ إِنَّكُمۡ أَيُّہَا ٱلضَّآلُّونَ ٱلۡمُكَذِّبُونَ (٥١) لَأَكِلُونَ مِن شَجَرٍ۬ مِّن زَقُّومٍ۬ (٥٢)

অর্থ: তারপর হে পথভ্রষ্ট ও অস্বীকারকারীরা। তোমাদেরকে ‘যাককূম’ বৃক্ষজাত খাদ্য খেতে হবে৷ (সুরা ওয়াকেয়া ৫৬: ৫১-৫২)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّ شَجَرَتَ ٱلزَّقُّومِ (٤٣) طَعَامُ ٱلۡأَثِيمِ (٤٤) كَٱلۡمُهۡلِ يَغۡلِى فِى ٱلۡبُطُونِ (٤٥) كَغَلۡىِ ٱلۡحَمِيمِ (٤٦) خُذُوهُ فَٱعۡتِلُوهُ إِلَىٰ سَوَآءِ ٱلۡجَحِيمِ (٤٧)

অর্থ: “যাককূম”! গাছ হবে গোনাগারদের খাদ্য৷ তেলের তলানির মত৷ পেটের মধ্যে এমনভাবে উথলাতে থাকবে যেমন ফুটন্তপানি উথলায়৷ পাকড়াও করো একে এবং টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যখানে। (সুরা দুখান ৪৪:৪৩-৪৭)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَكُبَّتۡ وُجُوهُهُمۡ فِى ٱلنَّارِ هَلۡ تُجۡزَوۡنَ إِلَّا مَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ (٩٠)

অর্থ: আর যারা অসৎ কাজ নিয়ে আসবে, তাদের সবাইকে অধোমুখে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে৷ তোমরা কি যেমন কর্ম তেমন ফল। এ ছাড়া অন্য কোন প্রতিদান পেতে পার? (সুরা নমল ২৭:৯০)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَٱلَّذِينَ يَسۡعَوۡنَ فِىٓ ءَايَـٰتِنَا مُعَـٰجِزِينَ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ فِى ٱلۡعَذَابِ مُحۡضَرُونَ (٣٨)

অর্থ: যারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তারা শাস্তি ভোগ করবে৷ (সুরা  সাবা ৩৪:৩৮)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَٱلَّذِينَ كَسَبُواْ ٱلسَّيِّـَٔاتِ جَزَآءُ سَيِّئَةِۭ بِمِثۡلِهَا وَتَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٌ۬‌ۖ مَّا لَهُم مِّنَ ٱللَّهِ مِنۡ عَاصِمٍ۬‌ۖ كَأَنَّمَآ أُغۡشِيَتۡ وُجُوهُهُمۡ قِطَعً۬ا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مُظۡلِمًا‌ۚ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ‌ۖ هُمۡ فِيہَا خَـٰلِدُونَ (٢٧)

অর্থ: আর যারা খারাপ কাজ করেছে, তারা তাদের খারাপ কাজ অনুযায়ীই প্রতিফল পাবে৷ লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে৷ আল্লাহর হাত থেকে তাদেরকে বাঁচাবার কেউ থাকবে না৷ তাদের চেহারা যেন আধার রাতের কালো আবরণে আচ্ছাদিত হবে৷ তারা দোজখের হকদার, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে৷   ( সূরা ইউনুস ১০:২৭)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ (٩٩)

অর্থ: এবং যে চূড়ান্ত সময়টি আসা অবধারিত সেই সময় পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো। সুরা হিজর ১৫:৯৯)।৫৩. অর্থাৎ সত্যের বাণী প্রচার এবং সংস্কার প্রচেষ্টা চালাবার ক্ষেত্রে তোমাকে অশেষ কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয় । এগুলোর মোকাবিলা করার শক্তি তুমি একমাত্র নামায ও আল্লাহর বন্দেগী করার ক্ষেত্রে অবিচল দৃঢ়তার পথ অবলম্বন করার মাধ্যমেই অর্জন করতে পারো । এ জিনিসটি তোমার মনকে প্রশান্তিতে ভরে তুলবে , তোমার মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার জন্ম দেবে , তোমার সাহস ও হিম্মত বাড়িয়ে দেবে এবং তোমাকে এমন যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলবে যার ফলে সারা দুনিয়ার মানুষের গালিগালাজ নিন্দাবাদ ও প্রতিরোধের মুখে তুমি দৃঢ়ভাবে এমন দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে যার মধ্যে তোমার রবের রেজামন্দি রয়েছে ।মহান আল্লাহ বলেন,

 أَفَمَنۡ أَسَّسَ بُنۡيَـٰنَهُ ۥ عَلَىٰ تَقۡوَىٰ مِنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٲنٍ خَيۡرٌ أَم مَّنۡ أَسَّسَ بُنۡيَـٰنَهُ ۥ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٍ۬ فَٱنۡہَارَ بِهِۦ فِى نَارِ جَهَنَّمَ‌ۗ وَٱللَّهُ لَا يَہۡدِى ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ (١٠٩) 

অর্থ: তাহলে তুমি কি মনে করো , যে ব্যক্তি আল্লাহ ভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপর নিজের ইমারতের ভীত্তি স্থাপন করলো সে ভাল, না যে ব্যক্তি তার ইমারতের ভিত উঠালো একটি পতাকার স্থিতিহীন ফাঁপা প্রাণ্তের ওপর এবং তা তাকে নিয়ে সোজা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়লো? এ ধরনের জালেমদের কে আল্লাহ কখনো সোজা পথ দেখান না৷ (সুরা তাওরা ৯:১০৯)।

মহান আল্লাহ বলেন,

قُلۡ إِنَّ رَبِّى يَقۡذِفُ بِٱلۡحَقِّ عَلَّـٰمُ ٱلۡغُيُوبِ (٤٨)

অর্থ: যারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তারা শাস্তি ভোগ করবে৷ (সুরা  সাবা ৩৪:৩৮)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 إِلَيۡهِ مَرۡجِعُكُمۡ جَمِيعً۬ا‌ۖ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقًّا‌ۚ إِنَّهُ ۥ يَبۡدَؤُاْ ٱلۡخَلۡقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ ۥ لِيَجۡزِىَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ بِٱلۡقِسۡطِ‌ۚ وَٱلَّذِينَ ڪَفَرُواْ لَهُمۡ شَرَابٌ۬ مِّنۡ حَمِيمٍ۬ وَعَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡفُرُونَ (٤)

অর্থ: তাঁরই দিকে তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে৷ এটা আল্লাহর পাকাপোক্ত ওয়াদা৷ নিসন্দেহে সৃষ্টির সূচনা তিনিই করেন তারপর তিনিই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবেন, যাতে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদেরকে পূর্ণ ইনসাফ সহকারে প্রতিদান দেয়া যায় এবং যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে তারা পান করে ফুটন্ত পানি এবং ভোগ করে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি নিজেদের সত্য অস্বীকৃতির প্রতিফল হিসেবে৷ (সুরা ইউনুস ১০:৪)।

Leave a comment