বিদআত চিনার উপায় পঞ্চম কিস্তি : কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

বিদআত চিনার উপায় পঞ্চম কিস্তি

কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

মুসলীম সমাজ সবচেয়ে বেশী বিভ্রান্তিতে আছে বিদআদ চিহিৃত করণ নিয়ে। যারা বিদআত করে তারা কখন স্বীকার করে না যে তার আমলটি বিদআত। সে নানা অনুহাতে বিদআতটিক ভাল কাজ বলে চালিয়ে যেতে চায়। যখন কাউকে বললেন ভাই আপনার এ আমলটি বিদআত। সে সাথে সাথে উত্তর দেন, দেখুন বুঝালাম আমলটি কি বিদআত, কিন্তু আমিতো কোন খারাপ কাজ করছিনা। আমলটি ভাল, মহান আল্লাহর খুশির জন্যই করছি। তাছাড়া কারও ক্ষতিতো আর হচ্ছে না। কিন্তু যে কিছুতেই বুঝতে চাবে না যে, আমলটি মহান আল্লাহর খুশির জন্যই করা হয় অথচ তার কোন নিয়ম পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সুন্নাহে নেই বা সময় সুযোগ থাকতেও সাহাবিগনও (রাঃ) করেন নাই। কাজেই বিদআতি আমল পরিত্যাগের আগে বিদআত চিনা খুবই দরাকার। যেমন ধরুন মিলাদুন্নবী একটি বিদআতি আমল। যখন আপনি কোন বিদআতি বলেবেন আমলটি বিদআত। সে শত শত ভাল ভাল যুক্তি দিয়ে মিলাদুন্নবী পালনের কথা বলবে। তাদের যুক্তি থেকে কোন খারাপ আপনি পাবেন না। কারন পৃথিবীর শ্রষ্ঠ মানুষের পক্ষে তা যা বলবে তা নিতান্তই কম হবে। তাই তাদের যুক্তি মিলাদুন্নবী পালন আপনি রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু আপনার যদি বিদআত চিনার জ্ঞান থাকে, তা হলে তাদের কোন যুক্তি আপানার কাছে যৌক্তিক মনে হবেন। কারন আপনি জেনে গেছেন যে, কোন ভাল কাজ ইসলাম মনে করে করা হয় অথচ সময় সুযোগ থাকতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এই পদ্ধতিতে এমন আমল করে নাই তাই বিদআত। যখন দেখবেন মিলাদুন্নবী সম্পর্কে কুনআন হাদিসে কোন আমল বর্ণনা নাই। তখন আপনি এই আমলকে বিদআত বলে ঘোষনা দিবেন। কাজেই বুঝা গেলে বিদআত থেকে মুক্ত থাকতে গেলে আগে বিদআতকে সঠিকভাবে চিনতে হবে। শত্রুকে চিনতে পারলে যেমন তার থেকে শর্তক থাকা যায়। বিদআতকে চিনতে পারলেও তার থেকে শর্তক থাকা যাবে। তাই আসুন দেখি, কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত। নিম্ম এমনই কথগুলি মানদন্ড বর্ণনা করা হলোঃ

১। কুনআন ও সহিহ হাদিসে আমলটির কোন দলীল নেই

২। ইসলামী শরীয়ত সম্মত আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি

৩। ইসলামি শরিয়ত সম্মত কোন বিষয়ে বৃদ্ধি

ক। ইবাদতে বৃদ্ধি করা

খ। আকিদায় বৃদ্ধি করা

গ। রাসূল সম্পর্কে বৃদ্ধিকরা

ঘ। অলী আওলীয়া সম্পর্কে বৃদ্ধিকরা

৪। ইসলামি শরিয়ত সম্মত কোন ইবাদতে হ্রাস করা

৫। ইবাদতকে স্থানের সাথে নির্দিষ্ট করা

৬। ইবাদতকে সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করা

৭। ইবাদতকে সংখ্যার সাথে নির্দষ্ট করা

৮। অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের উপর আমল করা

৯। যে আমলটির করার প্রমান খাইরুন রুকনেও পাওয়া যায় না

১০। শরীয়তের বাহিরে সম্পূর্ণ নতুন কোন পদ্ধতি আবিস্কার করে ইবাদত করা

১১। ইসলাম বিরোধী হারাম কাজকে ইবাদত মনে করে বিদআত করা

১২। বিদআতের সম্পর্ক দ্বীনের সাথে দুনিয়ার সাথে নয়

১৩। ইবাদতের উপকরন বিদআত নয়

১৪। বিদআতে আরও কিছু নীতিমালা

৭। ইবাদতকে সংখ্যার সাথে নির্দষ্ট করাঃ

ইবাদাত কিভাবে করতে হবে। ইবাদাত সময়, স্থান ও সংখ্যা সবই মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দষ্ট করা হয়েছে। কোন তাসবিহ কত বার আদায় করলে কি পরিমান নেকী হবে? কোন সুরা কত বার তিলওয়াত করলে কি পরিমান নেক হবে? সবকিছুই অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল তাসবিহ, তাহলীল ও তাকদীর এর সংখ্যা নির্দষ্ট করে বলেছেন, তা ঐভাবেই আদায় করতে হবে। কম বেশী হলে হাদিসে উল্লেখিত নেকী থেকে বঞ্চিত হতে হবে। তবে যে কোন তাসবীহ, তাহলীল ও তাকদীরের সংখ্যা নির্দষ্ট না করে সব সময়ই আদায় করা যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করে, তার নেকী পরিমান উল্লেখ করতে হলে, অবশ্যই অহী হতে হবে বা হাদিসে উল্লেখ থাকতে হবে। কারন এই পরিমান বা এই সংখ্যা বার আদায় করলে এত হাজার বা এত লক্ষ নেকী পাওয়া যাবে। এই নেকীর কথা তাকে কে বলেছে? তার উপরতো আর অহী হয় নাই। সে তো নবী বা রাসূলও নন। কাজেই তাসবীহ, তাহলীল ও তাকদীর এর পরিমার বা সংখ্যা সাথে নেকীর পরিমান উল্লেখ করতে হলে তাকে অবশ্য সহিহ হাদিসের দলীল দিতে হবে। দলীল বিহীন এই সকল নেকীর কথা ইসলামের সাথে পরিহাসের সামিল। তাকে এর জন্য জবাব দিতে হবে। এই আলোচনায় প্রথমে সংখ্যার পরিমান উল্লেখ আছে এমন কিছু সহিহ হাদিস উল্লেখ করব। অতপর, এ সম্পর্কি কিছু জাল, মিথ্যা ও বানোয়াট সংখ্যার সাথে নির্দষ্ট করা কিছু বিদআত উল্লেখ করব।

*** সংখ্যার সাথে নির্দষ্ট এমন কিছু ইবাদাতের সহিহ হাদিসঃ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি প্রত্যেক সালাতের পর সুবহানাল্লাহ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ তেত্রিশবার ও আল্লাহু আকবার তেত্রিশবার বলবে এই হল নিরানব্বই-আর একশত পূর্ণ করার জন্য বলবেঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

তার পাপ সমুহ মাফ হয়ে যাবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মত হয়। (সহিহ মুসলীম হাদিস ১২৩০ ইসলামি ফাইন্ডেশন)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, দরিদ্রলোকেরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)–এর নিকট এসে বললেন, সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের দ্বারা উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী আবাস লাভ করছেন, তাঁরা আমাদের মত সালাত আদায় করছেন, আমাদের মত সিয়াম পালন করছেন এবং অর্থের দ্বারা হাজ্জ, ‘উমরাহ্‌, জিহাদ ও সদাক্বাহ করার মর্যাদাও লাভ করছেন। এ শুনে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের এমন কিছু কাজের কথা বলব, যা তোমরা করলে, যারা নেক কাজে তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে, তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে। তবে যারা পুনরায় এ ধরনের কাজ করবে তাদের কথা স্বতন্ত্র। তোমরা প্রত্যেক সালাতের পর তেত্রিশ বার করে তাসবীহ্‌ (সুবহানাল্লাহ্‌), তাহ্‌মীদ (আলহামদু লিল্লাহ্‌) এবং তাকবীর (আল্লাহ আকবার) পাঠ করবে। (এ নিয়ে) আমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হলো। কেউ বলল, আমরা তেত্রিশ বার তাসবীহ্‌ পড়ব। তেত্রিশ বার তাহ্‌মীদ আর চৌত্রিশ বার তাকবীর পড়ব। অতঃপর আমি তাঁর নিকট ফিরে গেলাম। তিনি বললেন, سُبحانَ اللهِ وَالحَمدُ للّهِ وَ اللهُ أَكبَر বলবে, যাতে সবগুলোই তেত্রিশবার করে হয়ে যায়। (সহিহ বুখারি হাদিস ৮০৩, ইসলামি ফাইন্ডেশন)

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যে লোক প্রত্যেক সলাতের শেষে সুব্‌হানাল্ল তেত্রিশবার, ‘আলহাম্‌দু লিল্লাতেত্রিশবার এবং আল্লহু আকবারতেত্রিশবার পড়বে, যার মোট সংখ্যা হবে নিরানব্বই বার, একশত পূর্ণ করার জন্যে একবার “লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহ্‌দাহূ লা-শারীকা লাহূ লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হাম্‌দু ওয়াহুওয়া ‘আলা-কুল্লি শাইয়্যিন ক্বদীর” (অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শারীক নেই। সমগ্র রাজত্ব একমাত্র তাঁরই ও সকল প্রকারের প্রশংসা তাঁরই জন্য এবং তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান।) পাঠ করবে, তাহলে তার সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে, যদি তা সাগরের ফেনারাশির সমানও হয়। (সহিহ মুসলিম ইসলামি ফাইন্ডেশন ১২৩০)

উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (মুনাফিক সর্দার) আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল* মারা গেলে তার জানাযার সালাতের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আহবান করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে) দাঁড়ালে আমি দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ইবনু উবাই-এর জানাযার সালাত আদায় করতে যাচ্ছেন? অথচ সে অমুক অমুক দিন (আপনার শানে এবং ঈমানদারদের সম্পর্কে) এই এই কথা বলেছে। এ বলে আমি তার উক্তিগুলো গুনেগুনে পুনরাবৃত্তি করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, উমর, সরে যাও! আমি বারবার আপত্তি করলে তিনি বললেন, আমাকে (তার সালাত আদায় করার ব্যাপারে) ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। কাজেই আমি তা গ্রহণ করলাম। আমি যদি জানতাম যে, সত্তর বারের অধিক মাগফিরাত কামনা করলে তাকে মাফ করা হবে তা হলে আমি অবশ্যই তার চাইতে অধিক বার মাফ চাইতাম। উমর (রাঃ) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা জানাযার সালাত আদায় করেন এবং ফিরে আসেন। এর কিছুক্ষণ পরেই সূরা বারাআতের এ দু’টি আয়াত নাযিল হলঃ

*وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلاَ تَقُمْ عَلَىَ قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُواْ وَهُمْ فَاسِقُونَ*

অর্থঃ আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রসূলের প্রতিও। বস্তুতঃ তারা না ফরমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে। (সূরা তাওবাঃ ৯:৮৪)

রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে আমার ঐ দিনের দুঃসাহসিক আচরণ করায় আমি বিস্মিত হয়েছি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই সমধিক অবগত। (সহিহ মুসলিম ইসলামি ফাইন্ডেশন ১২৮২)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি প্রত্যহ একশত বার সুবাহানআল্লাহি ওয়া বিহামদিহি বলবে তার গুনাহগুলি মাফ করে দেওয়া হবে তা সমুদ্রের ফেনা পরিমান হলেও।(সহিহ বুখারি হাদিস ৫৯৬৩ ইসলামি ফাইন্ডেশন)

সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াককাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদিন আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ছিলাম। এ সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমাদের কেউ কি একদিনে এক অর্জন করতে সক্ষম? তার সাথে বসা লোকদের কেউ বললেন, আমাদের কেউ কিভাবে একদিনে এক হাজার নেকী আদায় করতে সক্ষম হবেন? তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কেউ যদি একদিনে একশ’বার ‘‘সুবহা-নাল্ল-হ’’ পড়ে তাহলে এতে তার জন্য এক হাজার নেকী লেখা হবে অথবা তার এক হাজার গুনাহ মাফ করা হবে। (মুসলিম সহীহ : মুসলিম ২৬৯৮, তিরমিযী ৩৪৬৩, ইনু হিববান ৮২৫, আদ্ দা‘ওয়াতুল কাবীর ১৪৯, শু‘আবূল ঈমান ৫৯৩, আল কালিমুত্ব ত্বইয়্যিব ১১, সহীহাহ্ ৩৬০২, সহীহ আত্ তারগীব ১৫৪৪, সহীহ আল জামি‘ ২৬৬৫।

মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসি‘ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি মক্কায় পৌঁছালে আমার ভাই সালিম ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তার বাবা হতে, তার দাদার সনদে আমার কাছে হাদীস রিওয়ায়াত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে লোক বাজারে প্রবেশ করে বলে, “আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন মাবূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, সকল ক্ষমতা তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য, তিনিই প্রাণ দান করেন ও মৃত্যু দেন, তিনি চিরজীবি, তিনি কক্ষনো মৃত্যুবরণ করবেন না, তাঁর হাতেই মঙ্গল এবং তিনিই সবসময় প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতার অধিকারী”, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা দশ বরাদ্দ করেন, তার দশ লক্ষ গুনাহ মাফ করেন এবং তার দশ লক্ষ গুণ সম্মান বৃদ্ধি করেন। (হাদিসের মান হাসানঃ তিরমিজি ৩৪২৮,ইবনু মাজাহ ২২৩৫ আবূ ‘ঈসা বলেন, হাদীসটি গারীব । এ হাদীস যুবাইর পরিবারের কোষাধ্যক্ষ ‘আমর ইবনু দীনার সালিম ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে একই রকম রিওয়ায়াত করেছেন)।

 

৮। অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের উপর আমল করাঃ

হাদিসের মান বর্ণার ক্ষেতে সহিহ, যঈফ, হাসান ও জাল কথাগুলি ব্যবহার করছি। তাই বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য সহিহ হাদিস, হাসান হাদিস, জাল হাদিস ও যঈফ হাদিস সম্পর্কে একটু ধারনা থাকা দরকার।  তা হলেই সহজে বুঝতে পারব কেন অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের উপর আমল করার ফলে বিদআতের সৃষ্টি হয়। তাই খুবই সংক্ষেপে এই সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা হল।

সহিহ হাদিসঃ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদিসের মধ্যে পাঁচটি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহিহ হাদিস বলা হয়। শর্ত পাঁচট হলোঃ

১। আদালত  (হাদীসের সকল রাবী পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত)

২। যাবত (সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত)

৩। ইত্তিসাল (সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত)।

৪। শুযূয মুক্তি (হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত বলে প্রমাণিত নয়)। এবং

৫। ইল্লাত মুক্তি (হাদীসটির মধ্যে সূক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত)।

(হাদিসের নামে জালিয়াতি, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিঃ এর গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে)।

হাসান হাদিসঃ উপরোক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। তবে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে যদি সামান্যতম দূর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ (সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য হাদীস) বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদের রাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, প্রত্যেকে হাদীসটি উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ নেই। তবে সনদের কোনো রাবীর নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা বা ‘যাবত’ কিছুটা দুর্বল বলে বুঝা যায়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এইরূপ ‘রাবী’র বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ.৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)।

যঈফ বা দুর্বল হাদীসঃ যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলির মধ্যে কোনো একটি অবিদ্যমান থাকে, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী বা তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে থেকে সরাসরি বা স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা…..ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে বিদ্যমান থাকলে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত তাকয়ীদ, পৃ.৬২; ফাতহুর মুগীস পৃ.৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)।

মাউযূ বা জাল হাদীসঃ যদি প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ (স) এর নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র (সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কম বেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস। (বিস্তারিত দেখুনঃ হাকিম নাইসাপুরী (৪০৫ হি), মারি’ফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ. ১৪-১৭. ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত তাকয়ীদ ওয়াল ইদাহ, পৃ.২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নাম ব্যবহার করে প্রচারিত বানোয়াট হাদিস। এধরনের হাদিসের বর্ণনাকারিদের মধ্যে এক বা একাধিক জন প্রতারক এবং কুখ্যাত হাদিস জালকারি বলে স্বীকৃত। অনেক সময় বর্ণনাকারিদের নামগুলোও মিথ্যা বানানো। এছাড়াও হাদিসটি কোন স্বীকৃত হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যায়নি। অনেক সময় এধরনের হাদিস পীর, দরবেশ, আলেমরা নিজেরাই বানিয়ে প্রচার করেছেন কোন বিশেষ স্বার্থে। মাউযূ বা জাল হাদীস হাদিস গ্রহনের ফলে যুগে যুগে মুসলীমদের আকিদা ও আমলের ক্ষেত্রে বহু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে।

৯। দুর্বল বা যঈফ হাদিসে কি সত্যিই আমল করা যায় না?

প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বিধান প্রমাণ করা যায় না। যঈফ বা দুর্বল হাদীসের উপর আমল করার জন্য কয়েকটি শর্ত লাগিয়েছেন তারা। শর্তগুলো নিম্নরূপঃ

১. হাদীসটির মূল বক্তব্য অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিরোধীতা করবেনা, বরং কোন শুদ্ধ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

২. হাদীসটি একেবারেই দুর্বল অথবা বানোয়াট হলে চলবে না।

৩. হাদীসটির উপর আমল করার সময় এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ রাসূল থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করলে রাসূলের উপর মিথ্যাচারিতার পাপ হবে, ফলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে পড়বে।

৪. হাদীসটি ফাদায়িল তথা কোন আমলের ফযীলত বর্ণনা সংক্রান্ত হতে হবে। আহকাম (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ) ইত্যাদি সাব্যস্তকারী না হতে হবে।

৫. বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে একান্ত ব্যক্তিগত কোন আমলের ক্ষেত্রে হাদীসটির নির্ভরতা নেয়া যাবে। তবে এ হাদীসের উপর আমল করার জন্য একে অপরকে আহবান করতে পারবে না।

কাজেই যখন কোন আমলের দলীল হবে, অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে তখন বুঝতে হবে আমলটি বিদআত।

যেমনঃ মিরাজের রজণী নাম দিয়ে ২৭ শে রজব ইবাদতে মধ্যে রাত কাটান এবং পরের দিন সিয়াম পালন করা। শাবান মাসের ১৫ তারিখ দিনের বেলা রোজা রাখা এবং রাতে নির্দিষ্ট নামায আদায় করা। মহরর্ম মাসের ইরাদাত, আখেরী চাহার সোম্বা, ঈদের রাতের ইবাদাত ইত্যাদি।  

১০। যে আমলটির করার প্রমান আমাদের সালাফে সালেহীনদের যুগে পাওয়া যায় নাঃ

সালাফে সালেহীনদের যুগ সম্পর্কে আগে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী এই তিন যুগকে খাইরুন রুকুন বলে। আলোচনা দেখেছি এই তিন যুগের আমলও ইসলামি শরীয়তে দলীল হিসাবেব বিবেচিত হয়। কারন হিসাবে নিম্মের হাদিসগুলো অনুধাপন যোগ্য।

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তায়ারা আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে, আমার প্রজন্ম। এরপর তাদের পরে যারা। এরপর তাদের পরে যারা। অতঃপর এমন কওম আসবে যাদের সাক্ষ্য হলফের পিছনে, হলফ সাক্ষ্যের পিছনে ছুটাছুটি করবে। (সহিহস বুখারী-৩৬৫১ ও সহিহ মুসলিম -২৫৩৩)

 ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম যুগ হল আমার সাহাবিদের যুগ। অতঃপর তৎপরবর্তী (তাবেয়িদের) যুগ। ইমরান বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যুগের পর উত্তম যুগ হিসাবে দুই যুগ উল্লেখ করেছেন, না তিন যুগ তা আমার জানা (স্মরণ) নেই।’ অতঃপর তোমাদের পর এমন এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা সাক্ষ্য দেবে অথচ তাদেরকে সাক্ষী মানা হবে না। তারা খেয়ানত করবে এবং তাদের নিকট আমানত রাখা যাবে না। তারা আল্লাহর নামে মানত করবে কিন্তু তা পুরা করবে না। আর তাদের দেহে স্থূলত্ব প্রকাশ পাবে। (সহিহ বুখারি ২৬৫১, ৩৬৫০, ৬৪২৮, ৬৬৯৫, মুসলিম ২৫৩৫, তিরমিযি ২২২১, ২২২২, নাসায়ি৩৮০৯, আবু দাউদ ৪৬৫৭, আহমদ ১৯৩১৯, ১৯৩৩৪, ১৯৪০৫, ১৯৪৫১)।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নাবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “আমার যুগ হচ্ছে সর্বোত্তম যুগ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগ। তারপর এরূপভাবে মিথ্যার প্রসার ঘটবে যে, কারো নিকট সাক্ষ্য তলব না করা হলেও সে সাক্ষ্য দিবে, শপথ করতে বলা না হলেও শপথ করবে”। (তিরমিজী ২৩০৩, সহীহ, মাজমাউয যাওয়াইদ (১০/১৯)। মমন

ইমাম নববী বলেন, বিশুদ্ধ মতানুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রজন্ম হচ্ছে- সাহাবীদের (রাঃ), দ্বিতীয় প্রজন্ম হচ্ছে- তাবেয়ীগণ এবং তৃতীয় প্রজন্ম হচ্ছে- তাবে-তাবেয়ীগণ। (ইমাম নববী রচিত সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ১৬/৮৫)।

পূর্বের আলোচনা দেখেছি, এই তিন যুগ কম-বেশী ২২০ ধরা হয়। অর্থাৎ তাবে-তাবেয়ীগন যত দিন বেচে ছিলেন ঠিক তত দিনই তাদের যুগ ছিল। এ হিসাবে তাদের যুগ কম বেশী ২২০ হিজরী পর্যান্ত স্থায়ী ছিল। এই তিন যুগের মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও কর্ম পদ্ধতি সঠিক ছিল। তাই এই তিন যুগে যে সকল আমলের দলীল প্রমান পাওয়া যায়, সেগুলোকে বিদআত বলা যাবে না। আর গবেষণা করে এর কথার সত্যতা পাওয়া গিয়েছে যে এই  তিন প্রজম্মের আলেমগন সঠিক দিনের উপর ছিলেন।

মন্তব্যঃ কাজেই যখন দেখবেন যে, আমলটি ২২০ হিজরীর পর মুসলিমদের মাঝে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে তা নিঃসন্দেহে বিদআত। উদারণ হিসাবে বলা যায়, আমাদের সমাজে প্রচলিত মিলাদ কিয়ামের প্রথা হিজরী ৬০৪ সনে আরবিলার সুলতান মুজাফফরউদ্দীন মওসিল শহরে (ইরাকের পার্শ্ববর্তী একটি শহর) এই মিলাদ নামক ইবাদতে প্রথম প্রচলন করেন।  যে সময় ক্রুসেডের মহাসমরে লক্ষ লক্ষ খৃষ্টান সৈন্য সিরিয়া ও জেরুজালেম শহরে আগমণ করে। যিশু খৃষ্টের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আকর্ষণীয় মেলা দেখে সুলতান মুজাফফরের হৃদয়ে রাসূলে কারীম (সাঃ) এর জন্মদিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের প্রেরণা জাগ্রত হয়, অনুগত একজন মৌলভীকে দিয়ে এই মিলাদের আনুষ্ঠানিকতা চালু করা হয়। এমনিভাবে কোন ইবাদাত যদি খাইরুর রুকন বা ২২০ হিজরির পরে প্রচলন হয় তবে আমরা তা বিদআত হিসাবে ধরে নিতে পারি।

১১। শরীয়তের বাহিরে সম্পূর্ণ নতুন কোন পদ্ধতি আবিস্কার করে ইবাদত করাঃ

ইসলামি শরীয়তের প্রতিটি ইবাদতে নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। ঈমান আনার পর ইসলামি শরীয়তের প্রধান চারটি আমল হলো- সালাত, সিয়াম, হজ্জ ও জাকাত। এই চারটি আমলের প্রতিটি আদায় করার ক্ষেত্রে নির্দষ্ট নিয়ম কানুন আছে যা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নাই। এমনিভাবে এর বাহিরেও যদি কোন আমল করতে যান তবে তারও নির্দষ্ট নিয়ম কানুন আছে। দুনিয়াবি কাজ যখন ইসরামি শরীয়তের ভিতরে থেকে করা হবে তখন তা ইবাদাত। দুনিয়াবী শরীয়ত সম্মত কাজ আর ইবাদতের পদ্ধতি আবিস্কার এক নয়।

ধরুন আপনি জীবন ধারনের জন্য আয় রোজগার করা নিয়ত করছেন। এই হিসাবে হালালভাবে আয় করার নিমিত্তে যে কোন শরীয়ত সম্মত হালাল পন্থা গ্রহন করা স্বাধীণত আছে। তাই আপনি চাকুরী করেন, ব্যবসা করেন বা কৃষিকাজ করেন। এটি কোন ইবাদতের পদ্ধতি নয়। এখানে শর্ত শুধু হালাল পন্থা অবলম্ভন। কিন্তু ইবাদতের পদ্ধতি আবিস্কার হল, আপনি আল্লাহকে খুশি করার জন্য এমন কোন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করলেন যা ইসলামি শরীয়তে নাই। যেমনঃ ধরুন, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জম্ম দিবস পালন করবেন। এর জন্য আপনি ধারা বাহিকভাবে কতগুলি পদ্ধতি আবিস্কার করলেন। যেমনঃ খুব সকালে উঠে গোসল করবেন, ভাল জামা কাপড় পড়বেন, আতল বা সেন্ট মাখবেন। এরপর সকলকে মিলে মিসিলসহ শোভা যাত্রার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সম্মন কবলেন। মিসিল শেষে সবাই মিলে মিলাদ কিয়াম করলেন। তার পর ভাল মানের খাবের ব্যবস্থা করলেন। আর একে ঈদ বলে চালিয়ে দিলেন। এর নাম করণও করে দিলেন ঈদে-মিলাদুন্নবী। এখানে দুনাবি কোন উদ্দেশ্য নাই। শুরু মহান আল্লাহকে খুসি করার জন্য এই ইবাদতের পদ্ধতি তৈরি করা হয়ছে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের শ্রেষ্ট তিন যুগের দিক তাকাই তবে দেখব, তারা সময় সুযোগ থাকা সত্বেও এমন কোন ইবাদত করেন নাই। এই ধরনের ইবাদাত শরীয়তের বাহিরে সম্পূর্ণ নতুন আবিস্কার। ইবাদতে ক্ষেত্রে এই ধরনের নতুন আবিস্কারই বিদআত। আল-কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

* وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ *

অর্থঃ যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অনুসন্ধান করে, তা কখনোই তার কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে না। (সূরা আলে-ইমরান ৩:৮৫)

ইসলামি শরীয়ত যেহেতু স্বয়ং সম্পূর্ণ এখানে আর নতুন কিছু প্রবেশের সুযোগ নাই। মহান আল্লাহ প্রদত্ত চুড়ান্ত শরীয়াত হল ইসলাম। এখান কোন ইবাদতের পদ্ধতি প্রবেশ করানোর সুযোগ নেই। এমনকি ভবিশ্যাতে কোন নবী আসবেন না। তাই কিয়ামত পর্য়ান্ত এটাই চুড়ান্ত শরীয়ত। এই শরীয়তের বাহিবে মহান আল্লাহকে খুশি করা যাবে না। একটি হাদিসের দিকে লক্ষ করি।

হাম্মাম ইবনু মুনাব্বিহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এ হলো সে সব হাদীস, যা আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আমাদের নিকট উল্লেখ করেছেন। তারপর তিনি কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেন। তার একটি হলো, আবূল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার দৃষ্টান্ত ও আমার পূর্বেকার নাবীগণের দৃষ্টান্ত সে লোকের উপমার মতো, যে কতকগুলো গৃহ বানালো, তা সুন্দর করল ও সুদৃশ্য করল এবং পূর্ণাঙ্গ করল; কিন্তু তার কোন একটির কোণে একটি ইটের স্থান ছাড়া (খালি রাখল)। লোকেরা সে ঘরগুলোর চারদিকে চক্কর দিতে লাগল আর সে ঘরগুলো তাদের মুগ্ধ করতে লাগল। পরিশেষে তারা বলতে লাগল, এখানে একখানি ইট লাগালেন না কেন? তাহলে তো আপনার অট্টালিকা পূর্ণাঙ্গ হত। অতঃপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, আমি-ই হলাম সে ইটখানি। (সহিহ মুসলিম হাদিস একাডেমি ৫৮৫৪,  ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৭৬১, ইসলামিক সেন্টার ৫৭৯১)

কোন উম্মত কোন পদ্ধতিতে, কি ইবাদাত করবেন, তা শুধু ঐ উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট নবীই বলতে পারবেন। আমাদের জন্য এবং কিয়ামত পর্যান্ত যত মানব জাতি আসবে, সবার জন্যই একমাত্র আমাদের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখান পদ্ধিতে আমল করতে হবে। এর বাহিরে কোন পদ্ধতিই গ্রহনীয় নয়। কাজেই ইসলামি শরীয়তের বাহিরে কোন প্রকার আমলের পদ্ধতি দেখলেই বিদআত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

১২। ইসলাম বিরোধী হারাম কাজকে ইবাদত মনে করে বিদআত করাঃ

বর্তমান যুগে অনেক ইসলাম বিরোধী কাজ চলেছে অথচ অজ্ঞ মুসলিম ইহাকে ইবাদাত মনে করছে। যেমন একটি  উদাহরণ দেই। কোন কোন নামধারী অলীর মাজার কে কেন্দ্র করে বার্ষিক উরশ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এই সকল উরশ মাহফিলে সাধারণত, মুরিদদের মানত করা পশু জবাই করে খাওয়ান হয়। নারী পুরুষ এক সাথে গান গায় এবং ঢোল বা বাদ্যের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে নাচে। মানতের নামে মাজাবের সেবকগন টাকা উত্তলন করে। কোথাও কোথাও ইসলাম বিরোধী গাজার আসর বসে। এমনকি জুয়ার আসরও বসে। এই উরশ কে কেন্দ্র করে যতগুলি কাজ হয়, তার সবই  ইসলাম বিরোধী হারাম কাজ অথচ জাহেল বা অজ্ঞ মুসলিম ইহাকে ইবাদাত মনে করে আমল করছে। এই সকল ইসলাম বিরোধী কাজ কে বিদআত বললে কমই হবে। এই সকল কাজ সম্পূর্ণ হারাম, হারাম। যেহেতু এর উপর আমল কারীগণ ইহাকে ইবাদত মনে করে তাই ইহাকে বিদআতও বলা হয়।

আমাদের সমাজে এমনই অনেক শত শত হারাম কাজকে ইসলামি কাজ বলে চালিয়ে যাচ্ছে। আর অজ্ঞ মুসলিম ইহাকে ইবাদাত মনে করে অর্থ ও সময় ব্যয় করে যাচ্ছে। কাজেই ইসলামি শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ যদি ইসলামি কাজ হিসাবে দেখা যায় তবে তাকেও আমরা বিদআত বলেত পারি।     

৩। বিদআতের সম্পর্ক দ্বীনের সাথে দুনিয়ার সাথে নয়ঃ

বিদআতের সম্পর্ক ইসলামি শরীয়ার ইবাদতের সাথে, পার্থির কোন বিষয় বা কাজের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। পার্থিব বিষয়ে বিদআতের অপর নাম নতুন আবিষ্কৃত বিষয়। এ প্রকার বিদআত বৈধ। কেননা দুয়িয়ার সাথে সম্পর্কশীল সকল বিষয়ের ব্যাপারে মূলনীতি হল তা বৈধ। তবে শর্ত হল তাতে শরঈ কোন নিষেধ না থাকা। শরীয়তের নিষেধ থাকলে তা করা বিদআত নয় বরং হারাম। দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদআত তথা নতুন কিছু উদ্ভাবন করা হারাম। কারণ দ্বীনের ব্যাপারে মূলনীতি হল তা অহীর উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দ্বীনের সমস্ত বিধান কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করতে হবে। 

আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ আমাদের এই দ্বীনে কিছু উদ্ভাবন করে যা তাতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত। (সহিহ বুখারী ২৬৯৭, মুসলিম ১৭১৮, আবূ দাঊদ ৪৬০৬, আহমাদ ২৩৯২৯)

১৪। ইবাদতের উপকরন বিদআত নয়ঃ

বিদআতে আলোচনা দ্বারা এ কথা বুঝেছি যে, আমলের পদ্ধতি বা নিয়ম কানুন সরাসরি আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখান। কিন্তু কিছু কিছু্ ইবাদাত পালনের জন্য কিছু উপকরণের প্রয়োজন হয় যা তিনি নির্দিষ্ট করেন নাই। যেমনঃ জামাতে সালাত আদায়ের জন্য মসজিদ একটি উপকরণ। এখন মসজিদটি কি পাকা হবে না কাচা হবে, মসজিদের দৈর্য্য কতটুকু হবে, মসজিদে কতটুকু কারুকাজ করা যাবে, না কি কারুকাজ করাই যাবে না, মসজিদের হুজরা কেমন হবে, মিনার থাকবে কি না ইত্যাদি। জামাতে সালাত আদায় করলে যেমন সওয়াব বেশী হওয়ার কথা সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে। কিন্তু কোথাও বলা হয়নি কাচা মসজিদের চেয়ে পাকা মসজিদে সালাত আদায় করলে বেশী সওয়াব হবে। উপকরণ এমন একটি বিষয় যা থাকলে ইবাদাত পালনের সহজ হয় কিন্তু উপরণটি না থাকলেও ইবাদতের কোন ক্ষতি হয় না বা সওয়াব কম বেশী হয় না।

কুরআন তিনওয়া করার নেকীর কাজ। কুরআনের প্রতি হবরফের জন্য দশটি নেকী পাওয়ার ঘোষণা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। উমাইয়া যুগে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অনারব ভাষী মানুষের জন্য কুরআন তিলওয়াত সহজ করার জন্য কুরআনে হরকত অর্থাৎ জের, জবর, পেশ সংযুক্ত করেন। তার এই হরকত সংযুক্ত হওয়ার পর কোন মুসলিম মনে করে না যে, কুরআনের প্রতি হবরফের জন্য দশটি বেশী নেকী পাওয়া  যায়। এই হরকত হল উপকরণ, এর ফলে কুনআন তিলওয়াত সহজ হয়েছে মাত্র। এই উপকরণ দ্বারা ইবাদাত করা সহজ হয়, কিন্তু ইবাদাতের কোন পদ্ধতি আবিস্কার হয় না বিধায় উপকরণে বিদআত হয়না।

এমনিভাবে মুসলিমদের অন্যতম ফরজ ইবাদাত হল হজ্জ্ব। যার জন্য সৌদির আরবের মক্কায় সফর করা ফরজ। এই সফরে বাহন খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপদান। কিন্তু মহান আল্লাহ সফরের এই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি নির্দষ্ট করে নাই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জামানায় মানুষ পায় হেঁটে বা উট বা গাধার পিঠে চড়ে হজ্জের সফর করত। যদি উপকরণটি নির্দিষ্ট থাকতো তবে অনেকের জন্যই হজ্জ করা কষ্ট সাধ্য হয়ে যেত। কিন্তু হজ্জ যাত্রার বাহন নির্দিষ্ট করে ফরজ করে নাই। তাই আপনি আধুনিক যুগের যে কোন সুযোগ সুবিধা নিয়ে হজ্জে গমন করতে পারেন। কেউ এ কথা বিশ্বাস করে না যে বিমানে হজ্জ গমনে কষ্ট কম হয় তাই নেকীর পরিমানও কম হবে। কারন উপকরণের সাথে মুল ইবাদতের কোন সম্পর্ক নেই।

আশা করি ইবাদাত ও উপকরণে সাথে কি সম্পর্ক তা বুঝতে পেরেছি। এই জন্য বিজ্ঞ আলেমগন একমত যে ইবাদাতের উপকরণে কখনও বিদআত হবে না। বিদআত চিহিৃত করারা জন্য এই মান দন্ডটি খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। কারণ বিদআতগন এই উপকরণের উদাহরণ দিয়ে, বিদআতী ইবাদতের পদ্ধতিকেও বিদআত বলতে নারাজ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment