তারাবীহ সালাত এর একটি নিরপেক্ষ বিশ্লষণ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

তারাবীহ শব্দটি সাথে সকল মুসলমানই পরিচিত। মুসলিম সমাজে যে মাসায়েলগুলি নিয়ে মতভেদ তুঙ্গে তার মাঝে অন্যতম হল সালাতুত তারবীর রাকাত সংখ্যা। আমাদের অনুসরণীয় সলফে সালেহিনদের মাঝেও এ নিয়ে মতভেদ ছিল কিন্তু মতবিরোধ ছিলনা। এই সালাতের রাকাত নিয়ে বহু কিতাব রচনা হয়েছে। লেখকগণ তাদের নিজ নিজ পক্ষের যুক্তি দিয়েছেন। যখন যে লেখকের লেখা পড়ি তাকেই সঠিক মনে হয়। সাধারনের জন্য আরো কঠিন কারন অনেক লেখক নিজের মতাদর্শণ প্রমান করার জন্য জাল হাদিসকে সহিহ আর সহিহ হাদিস কে জাল বলে চালিয়ে দিয়েছেন। অপর পক্ষে বিরোধী পক্ষ অনেক সহিহ হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে নিজেদের মতাদর্শণ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। এই দুটি পক্ষকে সামনে রেখে সবার সঠিক দাবিকে  সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

তারাবীহঃ ‘তারাবীহ’ (التراويح) একটি আবরি শব্দ যার অর্থ বিশ্রাম করা। আরবী শব্দ (‘ترويحة)  তারবীহাতুন শব্দটির বহুবচন হল তারাবীহ। আভিধানিক অর্থ মতে তারবীহা শব্দের অর্থ হলো, আরাম করে বসা, প্রশান্তির বৈঠক, আরাম প্রদান, শান্তি করণ। তাই সালাতুত তারাবীহ এর অর্থ হবে বিশ্রামের সালাত। তারাবীহ বহু দীর্ঘায়িত একটি সালাত বিধায় একাধারে আদায় করা খুবই কষ্টকর। তাই প্রতি চার রাকআত সালাত শেষে একটু বিশ্রাম নিতে হয়। প্রতি চার রাকাত শেষে একটু বিশ্রাম গ্রহণ করা হয় বলে, এই সালাতের নামকরণ করা হয়েছে তারাবীহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক আয়াত ও দীর্ঘ সময় নিয়ে তারাবীহ পড়তেন। তার রাতের একাকী সকল সালাতই ছিল অতি দীর্ঘ। এমনকি কিয়াম, রুকু, সাজদা সবই ছিল খুব লম্বা ও ধীরস্থির। চার রাকাত পর পর বিশ্রাম করতেন বলেই একে বিশ্রামের সালাত বা তারাবীর সালাত বলা হয়।

তারাবীহ সালাতের হুকুমঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এই সালাত সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “এটি এমন মাস যাতে আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য রোযাকে ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য এর রাতের নামাযকে সুন্নত করেছি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩২৮, সুনানে নাসায়ী, হাদীসস নং-২২১০)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রমযানের (রাত্র জেগে) ইবাদাত-বন্দিগীতে মাশ্‌গুল থাকতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহিত করতেন, তবে সেটাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে নির্দেশ দেননি। তিনি বলতেনঃ ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশা করে যে লোক রমযান মাসে (রাতে ইবাদাতে) দন্ডায়মান হবে সে লোকের পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে। এ নিয়মই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু পর্যন্ত চালু ছিল। এ বিষয়টি আবূ বকর (রাঃ)-এর খিলাফত এবং উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-আর খিলাফতের প্রথম দিকেও এমনই ছিল। (হাদিসের মান সহিহ, তিরমিজ ৮০৮, আবূ দাঊদ১২৪১, নাসাঈ, ইমাম বুখারীর মতে মৃত্যু পর্যন্ত…এই বাক্যাংশটি যুহরী হাদীসে সংযোগ করেছেন।

মুসলিম সমাজে প্রচলিত চার মাযহাবের ইমামগণসহ সকল মুজতাহীদ ফকীহগণের মতে তারাবীহর সালাত নারী-পুরষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সুন্নাত। আর এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রকাশ্য দ্বীনের নিদর্শন। অধিকাংশ মুজতাহীদ আলেমগনের মত হলো, কেউ তারাবীর সালাত ইচ্ছা করে ত্যাগ করলেও গুনাহগার হবে না কিন্তু রমজানের বিশাল সওয়াব থেকে মাহরুম হয়ে যাবে। তবে কিছু কিছু মুজতাহীদ ফকীহগণের মতে তারাবীর নামাজ সুন্নতে মুআক্কাদাহ। তাদের মতে এই সালাত আদায় না করলে অবশ্যই গুনাহ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের জন্য তারাবীহকে সুন্নত করেছেন। তিনি তার সাহাবীদের নিয়ে তিন রাত্রি তারাবীহ আদায় করেছেন। উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় পরেরদিন তিনি আর জামাতের সাথে তারাবীহ আদায় করেননি। মুসলমানগন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর খেলাফত কাল ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর খেলাফতের প্রথম দিকে এ অবস্থায়ই ছিল। এরপর আমীরুল মুমিনীন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রখ্যাত সাহাবী তামীম আদদারী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উবাই ইবনে কাআব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতিতে তারাবীর জামাতের ব্যবস্থা করেন। আলহামদুলিল্লাহ! এ তারাবীর জামাতশুধু রমজান মাসেই সুন্নাত।

রমজান মাসের তারাবীহর সালাতের ফজিলতঃ

তারাবীর সালাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। রমজান মাসের প্রতিটি ইবাদতের মুল্য অনেক অনেক গুন বেশী বেড়ে যায়। আর তারাবীর সালাত শুধুই রমজান মাসের জন্য খাস, তাই এর ফজিলতও বেশী। যেমনঃ 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় তারাবীহর সালাতে দাঁড়াবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।

হাদীসের রাবী ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন এবং তারাবীহর ব্যাপারটি এ ভাবেই চালু ছিল। এমনকি আবূ বাকর (রাঃ) এর খিলাফতকালে ও ‘উমর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রথম ভাগে এরূপই ছিল। ইবনু শিহাব (রহঃ) ‘উরওয়া ইবনু যুবায়র (রহঃ) সূত্রে ‘আবদুর রাহমান ইবনু ‘আবদ আল ক্বারী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রমযানের এক রাতে ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পাই যে, লোকেরা বিক্ষিপ্ত জামায়াতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত (আদায় করছে আবার কোন ব্যাক্তি সালাত আদায় করছে এবং তার ইকতেদা করে একদল লোক সালাত আদায় করছে। ‘উমর (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি যে, এই লোকদের যদি আমি একজন ক্বারীর (ইমামের) পিছনে একত্রিত করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) এর পিছনে সকলকে একত্রিত করে দিলেন। পরে আর এক রাতে আমি তাঁর [‘উমর (রাঃ)] সঙ্গে বের হই। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে সালাত আদায় করছিল। ‘উমর (রাঃ) বললেন, কত না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা! তোমরা রাতের যে অংশে ঘুমিয়ে থাক তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম যে অংশে তোমরা সালাত আদায় কর, এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন, কেননা তখন রাতের প্রথমভাগে লোকেরা সালাত আদায় করত। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮৩ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

আবূ যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সিয়াম পালন করছিলাম। (এর মধ্যে) রমযানের সাতদিন বাকি থাকার পূর্ব পর্যন্ত (প্রথম ২৩ দিন) তিনি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন নি। বাকি সাতদিনের প্রথম রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তিনি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। তারপর ষষ্ঠ রাতে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন না। পঞ্চম রাতের অর্ধাংশপর্যন্ত পুনরায় আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি রাতে যদি আমাদের নিয়ে নফল সালাত আদায় করতেন?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সালাত আদায় করবে, তার আমলনামায় সারারাত সালাত আদায়ের সাওয়াব লেখা হবে। (তিরমিযী- ৮০৬; ইবন মাজাহ্- ১৩৭৫; হাদিসটি চার সুনান কিতাবেই সহীহ সনদে সংকলিত হয়েছে)।

রাকাত সংখ্যাঃ

তারাবীহর সালাতের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি বিধায় এই সালাত এর রাকার সংখ্যা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক মতভেদ লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে বর্তমান বিশ্বে ৮ রাকাত ও ২০ রাকাত এর মত দুটিই ব্যাপক প্রচলিত। তারাবীর সালাত দুই দুই রাকআত করে যেকোনো সংখ্যক রাকআত পড়া হয়। তারাবীহ সালাতের পর বিতের সালাত পড়া হয়। হানাফি শাফেয়ী ও হাম্বলী ফিকহের অনুসারীগণ ২০ রাকআত, মালিকি ফিকহের অনুসারীগণ ৩৬ রাকআত এবং উপমহাদেশের আহলে হাদীস অনুসারীগণ ৮ রাকআত তারাবীহ পড়েন। অপর পক্ষ মক্কা মদীনার সালাফি আলেমগন আট ও বিশ দুটি সংখ্যাকেই সঠিক বলে মত প্রদান করে থাকেন, তবে তারা আট রাকাতের প্রতিই বেশী মতামত প্রদান করেন।  তারাবীহর সালাতের রাকাত সংখ্যা একটি ইখতিলাফী বা মতভেদ পূর্ণ মাসআলা। কেউ কেউ বলেছেন বিতরসহ তারাবীহ ৪১ রাক‘আত। অর্থাৎ বিতর ৩ রাকআত হলে তারাবীহ হবে ৩৮ রাক‘আত। অথবা বিতর ১ রাকআত ও তারাবীহ ৪০ রাকআত। এভাবে তারাবীহ ও বিতর মিলেঃ

কেউ বলেছেন ১১ রাকআত (তারাবীহ ৮ + বিতর ৩)

কেউ বলেছেন ১৩ রাকআত (তারাবীহ ১১ + বিতর ৩)

কেউ বলেছেন ১৯ রাকআত (তারাবীহ ১৬ + বিতর ৩)

কেউ বলেছেন ২৩ রাকআত (তারাবীহ ২০ + বিতর ৩)

কেউ বলেছেন ২৯ রাকআত (তারাবীহ ২৬ + বিতর ৩)

কেউ বলেছেন ৩৯ রাকআত (তারাবীহ ৩৬ + বিতর ৩)

এবার দেখব এই সকল দাবি সম্পর্কে তাদের দলীল কি?

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গভীর রাতে বের হয়ে মসজিদে সালাত আদায় করেন, কিছু সংখ্যক পুরুষ তাঁর পিছনে সালাত আদায় করেন। সকালে লোকেরা এ সম্পর্কে আলোচনা করেন, ফলে লোকেরা অধিক সংখ্যায় সমবেত হন। তিনি সালাত আদায় করেন এবং লোকেরা তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করেন। সকালে তাঁরা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে সালাত আদায় করেন ও লোকেরা তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করেন। চতুর্থ রাতে মসজিদে মুসল্লীর সংকুলান হল না। কিন্তু তিনি রাতে আর বের না হয়ে ফজরের সালাতে বেরিয়ে আসলেন এবং সালাত শেষে লোকদের দিকে ফিরে প্রথমে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়ার পর বললেনঃ শোন! তোমাদের (গতরাতের) অবস্থান আমার অজানা ছিল না, কিন্তু আমি এই সালাত তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবার আশংকা করছি (বিধায় বের হই নাই)। কেননা তোমরা তা আদায় করায় অপারগ হয়ে পড়তে। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত হল আর ব্যাপারটি এভাবেই থেকে যায়। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮৫ ইসলামি ফাউন্ডেশন, আবু দাউদ ১৩৭৩ ইঃফাঃ)

মন্তব্যঃ এই সহিহ হাদিসটি ভাষার কমবেশসহ পৃথিবীর বিখ্যাত  প্রায় সকল হাদিস গ্রন্থেই স্থান পেয়েছে। এই হাদিস দ্বারা মুজতাহীদ আলেমগণ একমত হয়েছের যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবির সালাত জামাতের সাথে আদায় করছেন। কিন্তু রাকাতের সংখ্যা নির্ধারণ করেছি।

 

যারা বলে তারবীহ ৮ তাদের দলীলঃ

আবূ সালামা ইবনু ‘আবদুর রাহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি ‘আায়িশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেন যে, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাত কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, রমযান মাসে ও রমযান ছাড়া অন্য সময়ে (রাতে) তিনি এগারো রাক‘আত হতে বৃদ্ধি করতেন না। তিনি চার রাকআত সালাত আদায় করতেন, সে চার রাকআতের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য ছিল প্রশ্নাতীত। এরপর চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, সে চার রাকআতের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য ছিল প্রশ্নাতীত। এরপর তিন রাকআত সালাত আদায় করতেন। আমি [‘আয়িশা (রাঃ)] বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বিতর আদায়ের আগে ঘুমিয়ে যাবেন? তিনি বললেনঃ হে ‘আয়িশা! আমার দু’চোখ ঘুমায় বটে কিন্তু আমার কালব নিদ্রাভিভূত হয় না। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন, তিরমিজি হাদিস নম্বর ৪৩৯ ইফাঃ)।

মন্তব্যঃ এই হাদিসে আলোক রমজান মাসের সালাতের একটি সংখ্যা উল্লেখ আছে বিধায়। অনেক আলেম তারাবিহ সালাত ০৮ রাকাত বলে প্রমান হিসাবে হাদিসটি উল্লেখ করেন। কিন্তু বিরোধী আলেমগম মনে করে এই সালাত তার তাহাজ্জুদের সালাত। কাজেই এই হাদিস দিয়ে শুধু তাহাজ্জুদের দলীল দেয়া যাবে, তারাবীহ দলীল দেয়া যাবেনা। কারন তাদের মতে তাহজ্জুদ ও তারাবিহ আলাদা সালাত।

২। সায়িব ইবনু ইয়াযিদ (র) থেকে বর্ণিতঃ উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-উবাই ইবনু কা’ব এবং তামীমদারী (রাঃ)-কে লোকজনের (মুসল্লিগণের) জন্য এগার রাক’আত (তারাবীহ) কায়েম করতে (পড়াইতে) নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারী একশত আয়াতবিশিষ্ট সূরা পাঠ করতেন, আর (আমাদের অবস্থা এই ছিল) আমরা নামায দীর্ঘ সময় দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে (ক্লান্ত হয়ে পড়লে) সাহায্য গ্রহণ করতাম অর্থাৎ লাঠির উপর ভর দিতাম। (এইভাবে নামায পড়তে পড়তে রাত শেষ হত) আমরা ভোর হওয়ার কিছু পূর্বে ঘরে ফিরে আসতাম। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক হাদিস নম্বর ২৪৩, হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) একক ভাবে বর্ণনা করেছেন)

মন্তব্যঃ এই হাদিসটি মান সহিহ। এবং সায়েদ ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) মুয়াত্তা মালিকে আরও চারটি হাদিস সহিহ সনদে বর্ণতি আছে। অপর পক্ষে একটি সনদে ২০ রাকাত আছে যাকে মুহাদ্দিসগর জাল বলেছেন।  অপর সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিস হলোঃ

মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) বলেন, আমি সায়েদ ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমরা ওমর (রাঃ) জামানায় ১১ রাকাত ছালাত আদায় করতাম। (সাঈদ ইবনু মানছুর, আস সুনান, আওনুল মাবুদ ৪/১৭৫ হাদিস নম্বর-১৩৭২)।

সায়েদ ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) বলেসন, আমরা ওমর রাদিয়াল্লহু আনহু জামানায় রমাজান মাসে ১৩ রাকাত ছালাত আদায় পড়তাম। (সাঈদ ইবনু মানছুর, আস সুনান, আওনুল মাবুদ ৪/১৭৫ হাদিস নম্বর-১৩৭২)।

যারা বলে তারবীহ ২০ তাদের দলীলঃ

১। মুয়ত্তার লেখক ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ, ইয়াযিদ ইবনু রুমান (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, লোকজন উমার ইবনু খাত্তাব রাদিয়াল্লহু আনহু এর খিলাফতকালে রমযানে তেইশ রাক’আত তারাবীহ পড়াতেন, তিন রাক’আত বিতর এবং বিশ রাক’আত তারাবীহ। এটাই উমার (রা) শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক হাদিস নম্বর ২৪৪, হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) একক ভাবে বর্ণনা করেছেন)।

মন্তব্যঃ আলোচ্য বর্ণনাটি মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন সনদে, কেননা ইয়াযিদ ইবন রুমান ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে পাননি। (দেখুন, ইমাম যাইলীঈ, নাসবুর রায়িয়াহ, (২/১৫৪); উমদাতুল কারী, আঈনী (১১/১২৬)।

২। ইবনে আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন। এ হাদীসটি বায়হাকী (খন্ড- ২, পৃষ্ঠা-৪৯৬)। ইমাম তাবরানীর আল-মুজামুল কাবীর (খন্ড- ১১, পৃষ্ঠা-৩১)। আল-আওসাত তাবরানী (খন্ড- ১, পৃষ্ঠা-৪৪৪)।  আল ইসতিযকার (খন্ড- ৫, পৃষ্ঠা-১৫৬)।

হাদীসটির মানঃ শাইখ নাসির উদ্দিন আলবানি তার বিখ্যাত যঈফ ও জাল হাদিস সিরিজ “সিলসীলাতুল আহাদিসিয যইফাহ ওয়াল মাওযুআহ” গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেন নিশ্চয়ই হাদিসটি জাল। হাদিস নম্বর ৫৬০। অনেক আহলে হাদিস অনুসারী আলেমগনও এই হাদীসটি মাওযু বা জাল আখ্যা দিয়ে থাকেন।

উপমহাদেশে প্রচলিত হানাফি মাযহাবের অনুসারী আলেম যারা ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করে এবং মুহাদ্দিস বিশাল এক অংশের মতে এ হাদীসের সনদকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন। কেননা, এর সনদে ‘ইব্রাহীম বিন উসমান’ নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, যিনি দুর্বল। তবে তিনি চরম দুর্বল বা মাতরুক (পরিত্যাজ্য) নন।

ইমাম বায়হাকী সুনানুল কুবরা গ্রন্থে ইয়াযিদ ইবন খাসীফাহ হতে এবং তিনি সায়েব ইবনে ইয়াযিদ বলেন, তারা (সাহাবা ও তাবেয়ীন) উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর যুগে রমযান মাসে ২০ রাকাআত তারাবী পড়তেন। তিনি আরও বলেন যে, তারা নামাযে শতাধিক আয়াত বিশিষ্ট সুরা সমূহ পড়তেন এবং উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) এর যুগে দীর্ঘ নামাজের কারণে তাদের কেউ কেউ লাঠিতে ভর করে দাঁড়াতেন। (বায়হাক্কী, সুনানুল কুবরাহ হাদিস নম্বর ৪৬১৭, পৃষ্ঠা ৬৯৮, আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী-২/৪৯৬)।

মন্তব্যঃ হানাফি মাযহাবের অনুসারী আলেম যারা ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করে তারা এই হাদিসটি উল্লেখ করে দাবি করেন, সনদগত ভাবে হাদিসটি কিছু আলেম সহিহ বলেছেন।

কিন্তু “তারাবীহ্‌ সালাতের রাকা‘আতঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” নাম প্রবন্ধে ডঃ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া লিখেনঃ  এ বর্ণনায় ইয়াযিদ ইবন খাসীফাহ একক বর্ণনাকারী তিনি সায়েব ইবন ইয়াযিদ হতে এবং তিনি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে। আর এটি তারা যা বর্ণনা করেছেন সেটি নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে বিপরীতমুখী বর্ণনা রয়েছে। অত:এব বিরোধিতার কারণে বর্ণনায় দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ইমাম আহমদ (রহঃ) ইয়াযিদ ইবন খাসীফাহ সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি মুনকারুল হাদীস। (মীযানুল ই‘তিদাল, (৪/৪৩০)।

হাফেয ইবন হাজর আসকালানী ফতহুল বারী গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন: ‘মুনকারুল হাদীস’ এ শব্দটি ইমাম আহমদ ঐ ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করেছেন, যিনি হাদীসের সাথে খুব সীমিতভাবে সম্পৃক্ত বা অপরিচিত। তার অবস্থার সার্বিক বিশ্লেষণ মাধ্যমে এটি বুঝা যায়। আর ইমাম মালেক ও অন্যান্য আইম্মায়ে কিরামগণ ইবন খাসীফাহকে হুজ্জত মনে করেন। (মুকাদ্দামাতুল ফাতহুল বারী, পৃ. ৪৫৩)।

যেহেতু ইয়াযীদ ইবন খাসীফাহ এর বর্ণনা সহীহ হওয়ার দিক থেকে দুর্ভোদ্য ও অপ্রতুল। (ইমাম নববী শরহে মুহাযযাব গ্রন্থে বিষয়টি আরো দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন। আল-মাকতাবাতুল ‘আলামিয়্যা, তাহকীক: মুহাম্মদ নাজীব আল- মুতি‘ঈ (৩/৫২৭)।

** কেননা এটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনার বিপরীত। কেননা ইবন খাসীফাহ ও মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ উভয়ে নির্ভরযোগ্য এবং তারা সায়েব ইবন ইয়াযিদ হতে বর্ণনা করেছেন। প্রথমে তিনি বলেছেন একুশ রাকা‘আত, আর দ্বিতীয়বার এগার রাকা‘আত। ফলে দ্বিতীয় মতটি অগ্রাধিকার পাবে।  ন

সায়েব ইবনে ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহিহ সনদে ১১ রাকাত সালাত বর্ণিত হাদিস হলোঃ

মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) বলেন, আমি সায়েদ ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমরা ওমর (রাঃ) জামানায় ১১ রাকাত ছালাত আদায় করতাম। (সাঈদ ইবনু মানছুর, আস সুনান, আওনুল মাবুদ ৪/১৭৫ হাদিস নম্বর-১৩৭২)।

সায়েব ইবনে ইয়াযীদ (বাঃ) থেকে সহিহ সনদে মোট চারটি হাদিস আছে যেখানে তিনি ১১ রাকাত সালাত আদায় করার কথা বলেছেন। অপর পক্ষে বিশ বিশটি হাদিসটি যঈফ।

৪।  ইবন আবি শাইবাহ আব্দুল আযীয ইবন রুফাঈ‘ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, রমযান মাসে মদিনাতে উবাই ইবন কা‘ব বিশ বাকা‘আত সালাত আদায় করতেন এবং তিন রাকা‘আত বিতির পড়তেন।

 পড়তেন। (ইবন আবি শাইবা, মুসান্নাফ (২/৩৯৩)।

মন্তব্যঃ এ বর্ণনাটিও মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন। কেননা আব্দুল আযীয উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে পাননি, তিনি রাদিয়াল্লাহু আনহু ১৯ হিজরীতে অথবা ৩২ হিজরীতে মারা গিয়েছেন, আর আব্দুল আযীয মারা গেছে ১৩০ হিজরীতে। তার জীবনীতে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যে তিনি উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন। অথচ তিনি শুধুমাত্র ছোট সাহাবী ও বড় বড় তাবেঈন থেকে বর্ণনা করেছেন। (আহমদ ইবন হাজার আল-আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব (হলব, দারুর রাশীদ, সিরিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪১১ হি.) অনুবাদ নং (৪০৯৫) এ হিসেবে একে চর্তুথ সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়)।

ইবন আবি শাইবাহ আব্দুল আযীয ইবন রুফাঈ‘ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, রমযান মাসে মদিনাতে উবাই ইবন কা‘ব বিশ বাকা‘আত সালাত আদায় করতেন এবং তিন রাকা‘আত বিতির আদায করতেন। (ইবন আবি শাইবা, মুসান্নাফ – ২/৩৯৩)।

মন্তব্যঃ এ বর্ণনাটিও মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন। কেননা আব্দুল আযীয উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে পাননি, তিনি রাদিয়াল্লাহু আনহু ১৯ হিজরীতে অথবা ৩২ হিজরীতে মারা গিয়েছেন, আর আব্দুল আযীয মারা গেছে ১৩০ হিজরীতে। তার জীবনীতে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যে তিনি উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন। অথচ তিনি শুধুমাত্র ছোট সাহাবী ও বড় বড় তাবেঈন থেকে বর্ণনা করেছেন। (আহমদ ইবন হাজার আল-আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব (হলব, দারুর রাশীদ, সিরিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪১১ হি.) অনুবাদ নং (৪০৯৫) এ হিসেবে একে চর্তুথ সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়)।

৬। মুহাম্মদ ইবন নসর আল-মারওয়াযী হতে কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আ‘মাশ বলেন, ইবন মাসউদ বিশ রাকা‘আত তারাবীহ্‌ পড়তেন এবং তিন রাকা‘আত বিতির সালাত পড়তেন।  (মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, পৃ. ১৪৮)।

মন্তব্যঃ আলোচ্য বর্ণনাটিও মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন। কেননা, নিশ্চয় আ‘মাশ (রহ.) ইবন মাসউদ কে পাননি। (তাহযীবুত তাহযীব, (৪/১৯৫)।

 ইমাম বায়হাকী তার সুনানে কুবরা গ্রন্থে আবুল হাসনা হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু মানুষকে পাঁচ বার বিশ্রামের সাথে বিশ রাকা‘আত তারাবীর সালাত পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। (বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, (২/১৯৭)।

ইমাম বায়হাকী অন্য আরেকটি বর্ণনায় হাম্মাদ ইবন শুয়াইব হতে এবং তিনি আতা ইবন আস-সায়েব হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আব্দুর রহমান আস সুলামী হতে, তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু রমযান মাসে কারীদেরকে তার কাছে ডেকে পাঠালেন, তারপর তাদের মধ্যে হতে একজনকে বিশ রাকা‘আত তারাবীহ্‌র সালাত মানুষদের পড়াতে নিদের্শ দিলেন। আর তিনি (আলী রা. স্বয়ং) লোকদের সঙ্গে বিতির সালাত আদায় করতেন।

মন্তব্যঃ প্রথম হাদিসটির বর্ণনা যঈফ বা দুর্বল। কেননা আবুল হাসনা একজন অপরিচিত ব্যক্তি। (ইবন হাজার, তাকরীব নং ৮০৫৩, অপরিচিত, সাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল (৪/৫১৫) নং ১০১০৬)।

দ্বিতীয় বর্ণনাটিও দুর্বল বা যঈফ। কেননা, এখানে হাম্মাদ ইবন শু‘য়াঈব দুর্বল রাবী। (ইবন মঈন ও অন্যান্যরা এটাকে যঈফ বলেছেন)।

মোট কথা উপরোক্ত বর্ণনাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখতে পেলাম ২০ রাকাকের প্রায় সকল বর্ণনাই জাল অথবা যইফ। তখন তারা দুটি যুক্তি দেখায়।

১। বর্ণনা যঈফ হলেও আমল করা যায়।

২। সাহাবা ও তাবেয়ীনের যুগ থেকে চলে আসা সম্মিলিতও অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে অনেক মুজতাহীদ আলেম ২০ রাকাত তারাবীহ এর পক্ষে মত প্রদান করছেন।

নিম্মে বিশ্ব বিখ্যাত কয়েকজন মুজতাহীদ আলেমের মতমত তুলে ধরলামঃ

১। ইমাম মালেকঃ

ইমাম মালেক বলেন, ছত্রিশ রাকা‘আত বিষয়টি উপরোক্ত বিষয়ের উপর র্নিভর করে শত বছরের বেশী সময় ধরে চলে আসছে। আর এ বিষয়ে কোন সংর্কীণতা নেই। (ফতহুল বারী, (৪/২৫৩)।

২। ইমাম শাফেয়ীঃ

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, আমি মদিনাতে মানুষকে উনচল্লিশ রাকা‘আত এবং মক্কায় তেইশ রাকা‘আত পড়তে দেখেছি। এ থেকে এখানে আর কোন কিছু সংকীর্ণ নেই। তার থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, যদি কিয়াম দীর্ঘ হয়, সিজদা কম হয় তবে তা ভালো। আবার যদি সিজদা বেশী হয় এবং কিরাত সহজ হয় তাও উত্তম। তবে প্রথমটি আমার নিকট বেশী প্রিয়। (ফতহুল বারী, (৪/২৯৮)।

৩। ইমাম তিরমিযীঃ

ইমাম তিরমিযী বলেন, জ্ঞানীগণ রমযান মাসে কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে মতবিরোধ করেছে। ফলে তাদের কারো কারো অভিমত বিতিরসহ একচল্লিশ রাকা‘আত, আর এটি মদিনাবাসীর বক্তব্য এবং মদিনায় এটির উপর আমল হয় বেশী। তবে অধিকাংশ আলেম যারা ওমর (রা.), আলী (রা.) সহ অন্যান্য সাহাবীদের হতে বিশ রাকা‘আত সালাত বর্ণনা করেছেন; তাদের মধ্যে সুফিয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারক, শাফেয়ী‘ অন্যতম। শাফেয়ী বলেন, আর অনুরূপ সংখ্যা আমি আমার শহর মক্কায় পেয়েছি। তারা বিশ রাকা‘আত সালাত আদায় করে। ইমাম আহমদ বলেন, এ বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। আর তিনি এ বিষয়ে কোন সুরাহা করেন নি। ইসহাক বলেন, বরং আমরা একচল্লিশ রাকা‘আত গ্রহন করব যা উবাই ইবন কা‘ব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে।

৪। ইমাম বাইহাকীঃ

ইমাম বাইহাকী বলেন, উভয় বর্ণনার মধ্যে এ ভাবে সমন্বয় করা সম্ভব যে, তারা সাধারণত: এগারো রাকা‘আত আদায় করতেন, পরে বিশ রাকা‘আত পড়তেন এবং তিন রাকা‘আতের বিতির পড়তেন। আল্লাহই অধিক জানেন। (ইমাম বাইহাকী; আস-সুনানুল কুবরা (২/৪৯৬)।

৫। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহঃ

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন, বর্ণনাগুলোর পারস্পরিক বৈপরিত্য ও সেগুলোর মাঝে সমন্বয় করতে গিয়ে বলা যায়, রাকা‘আত সংখ্যা কম বা বেশী হতে পারে দন্ডায়মানের দীর্ঘতা ও স্বল্পতার উপর। তিনি বলেন, উত্তম হলো মুসল্লীদের সিদ্ধান্ত বা পারিপাশ্বিকতা যদি তাদের র্দীঘ সময় দন্ডায়মান থেকে দশ রাকা‘আত তারাবীহ্‌ ও তিন রাকা‘আত বিতির সালাত আদায় করা সম্ভব হয় যেমনটি নবী করিম (স.) ও অন্যান্যরা রমযানে আদায় করেছেন, তবে সেটিই উত্তম। আর যদি মুসল্লীরা সেটা করতে সমর্থ না হয় তবে বিশ রাক‘আত পড়া উত্তম। আর এটির উপরই অধিকাংশ মুসলিম আমল করে থাকেন। কেননা বিশ সংখ্যাটি দশ ও চল্লিশ এর মাঝামাঝি। আর যদি কেউ চল্লিশ রাকা‘আত বা অন্য কিছু পড়ে তবে তাও জায়েয। এখানে মাকরূহ হওয়ার কিছু নেই। আর যে ব্যক্তি এ ধারণা করে যে রমযানে কিয়ামুল লাইলে রাকা‘আতের সংখ্যা নির্দিষ্ট, তাতে কম বেশী করা যাবে না, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। (শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবন আবদুল হালীম ইবন আব্দুস সালাম ইবন তাইমিয়্যাহ মাজমুউল ফাতাওয়া, মুহাম্মদ মালেক ফাহাদ, আল মাসহাফ আশ-শরীফ সৌদি আরব: ওয়াযারাতুল শুয়ু‘নিল ইসলামিয়্যাহ ১৪১৬ হি. (২৩/১১৩)।

৬। শাইখ আব্দুর রহমান ইবন জিবরীনঃ

শাইখ আব্দুর রহমান ইবন জিবরীন বলেন, শায়খুল ইসলামের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, নিশ্চয় কিয়ামুল লাইল সময়সীমার সাথে নির্দিষ্ট, রাকা‘আতের সংখ্যার সাথে নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগার রাকা‘আত পড়তেন পাঁচ ঘন্টা সময় ধরে। মাঝেমাঝে সারা রাত ব্যাপী। এমন কি সেহেরীর সময় শেষ হয়ে যাবার আশংকা হয়ে যেত। আর এটি দন্ডায়মানের দীর্ঘতাকে বুঝায় যাতে এক রাকা‘আতে চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। আর সাহাবায়ে কিরাম তা করতেন। কারণ, তারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য লাঠির উপর ভর করতেন। অতঃপর যখন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা ও অন্যান্য রুকনগুলো তাদের নিকট কষ্টকর মনে হলো, তখন তারা সহজ করে নিলেন, তারা রাকা‘আতের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন, শেষ পর্যন্ত সারা রাত অথবা রাতের অধিকাংশ সময় তারা সালাতে মশগুল থাকতেন।

এটা হলো সাহাবাগণের সুন্নাত, সহজ করে আরকান আদায় করার সাথে অধিক রাকা‘আত সালাত আদায় অথবা দীর্ঘ সময় রুকন আদায়ে ব্যয় করার পাশাপাশি কম সংখ্যক রাকা‘আত সালাত আদায় করা। তবে তাদের কেউ একে অপরের বিরোধিতা করেননি। সুতরাং তাদের প্রত্যেকেই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং সকলে এমন ইবাদত করতেন যাতে কবুল ও বহুগুণ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা যায়। (ইবন জিবরীন, ফাতাওয়া আস-সিয়াম, ( রিয়াদ: দারু ইবন খুযাইমাহ, ১৪২০ হি.) পৃ. ১৪২-১৪৪।

শাইখ ইবন জিবরীন আরও বলেন, সে যুগে তের রাকা‘আত তারাবীহ্‌ এর সালাত আদায় করা হতো। আর তারা কিরাআত এমন দীর্ঘ করতেন যে, বার রাকা‘আতের মধ্যে তারা সূরা বাকারাহ শেষ করতেন, মাঝে মাঝে আট রাকা‘আতের মধ্যে। এ কারণে যে, নবী করীম (স.) এ সালাতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করেননি। ফলে এ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। যদি কেউ ইচ্ছা করে তবে রাকা‘আত সংখ্যা কম করে রুকনসমূহ দীর্ঘ করবে, আর ইচ্ছা করলে রাকা‘আতের সংখ্যা বাড়িয়ে রুকনসমূহ সহজ করতে পারে। (ইবন জিবরীন, ফাতাওয়া আস-সিয়াম,  রিয়াদ: দারু ইবন খুযাইমাহ, ১৪২০ হি.) পৃ. ১৩৫)।

৭। হাফেয ইবন হাজার আসকালানীঃ

হাফেয ইবন হাজার আসকালানী (রহ.) উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের সমন্বয় সাধনে বলেন: মানুষের প্রয়োজন ও পারিপাশ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে বর্ণনা ও সংখ্যার ভিন্নতা। ফলে মাঝে মাঝে তারা এগারো রাকা‘আত পড়তেন। কখনো কখনো একুশ রাকা‘আত, মাঝে মধ্যে তেইশ রাকা‘আত, মানুষের শক্তি উদ্যমের ভিত্তিতে পড়া হতো। যখন তারা এগার রাকা‘আত পড়তেন. তখন তারা, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কিরাত পড়তেন; এমনকি দীর্ঘ দাঁড়িয়ে থাকার সুবিধার্থে লাঠিতে ভর দিতেন। আর যখন তেইশ রাকা‘আত পড়তেন, তখন দাঁড়িয়ে থাকাটা সহজ করতেন, অর্থ্যাৎ কিরাআতকে ছোট করে পড়তেন। যাতে করে এটা মানুষের জন্য কষ্টকর না হয়। তিনি আরও বলেন, উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এভাবে সম্ভব যে, তা অবস্থার ভিন্নতার কারণে হয়ে থাকবে। আর সম্ভবত: এ মতবিরোধটি কিরাআত দীর্ঘ ও সহজ হওয়ার দিক থেকে হতে পারে। ফলে দীর্ঘ কিরাআতে রাকা‘আত সংখ্যা কমবে এবং সহজ কিরাআতে রাকা‘আত সংখ্যা বাড়বে। (ফতহুল বারী, (৪/২৯৮)।

৮। শাইখ সালেহ উসাইমিনঃ

শাইখ সালেহ উসাইমিন বলেন, এর রাকা‘আত সংখ্যা এগার অথবা তের। কেননা বিভিন্ন মাধ্যমে সালফে সালেহীন থেকে কম বা বেশীর বর্ণনা এসেছে। অথচ কেউ এতে বিরোধিতা করেননি। সুতরাং যদি কেউ বৃদ্ধি করে তাও অস্বীকার করা হবে না। আর যে ব্যক্তি উপরোক্ত সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করবে তবে তা উত্তম। এছাড়াও হাদীসে এসেছে, সংখ্যা বেশী করার ব্যপারে কোন অসুবিধা নেই। সহীহ বুখারী ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে ইবন ওমর (রা.) হতে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে কোন এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেছিল রাতের সালাত সম্পর্কে, তখন তিনি বলেন,

«مثني مثني فإذا خشي أحدكم الصبح صلى واحدة فأوترت له ما قد صلى»

“দুই দু্ই রাকা‘আত। যদি কেউ সকাল হয়ে যাবার আশংকা করে তাহলে এক রাকা‘আত পড়বে। সেই এক রাকা‘আত যা সে পড়েছে সেটাকে বিতির বা বেজোড় সালাতে পরিগণিত করবে। (ইমাম বুখারী, সহীহ, হাদীস নং ৪৭৩; ইমাম মুসলিম, সহীহ, হাদীস নং ৭৪৯)।

সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সালাতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি। (ইবনুল উসাইমিন, আল-ফাতাওয়া, কিতাবুদ দাওয়াত, (রিয়াদ; মুয়াসসাসাতুত দা‘ওয়াহ আল-ইসলামিয়া আস-সহীফাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.), পৃ. ১/১৯১-১৯২)।

৯। শাইখ মুহাম্মদ ইবন সালেহ উসাইমিনঃ

শাইখ মুহাম্মদ ইবন সালেহ উসাইমিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: যখন কোনও ব্যক্তি ইমামের পিছনে সালাত আদায় করবে, আর তিনি এগার রাকা‘আতের বেশী পড়ছেন, তখন ইমামের অনুসরণ করবে নাকি কিয়াম থেকে ফিরে আসবে? জবাবে তিনি বলেন, সুন্নাত হলো ইমামের অনুসরণ করা। কেননা যদি সে ইমামের সালাত সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ফিরে আসে, তবে তার কিয়ামুল লাইলের সওয়াব মিলবে না। কেননা এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত সালাত আদায় করে তার কিয়ামুল লাইল লিপিবদ্ধ করা হয়’’

কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ কথা দ্বারা ইমামের অনুসরণ তথা বাকী সালাতেও ইমামের সাথে থাকার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়ার জন্য বলেছেন। আর যখন সাহাবীগণ (কোন কোন ফরয সালাতে) এক রাকা‘আত অতিরিক্ত করার পরও ইমামের অনুসরণ করেছিলেন, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আদায় করা যায় এমন সালাত আদায়ের সময়ে তাদের জন্য ইমামের অনুসরণে কি সমস্যা হবে?

সাহাবীগণ এক সালাতে শরয়ী বিধানে অতিরিক্ত বৃদ্ধি করার পরও তাদের ইমামের অনুসরণ করেছেন। আর এটি আমীরুল মু’মেনীন উসমান ইবন আফফান (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি হজ্বের সময় মিনাতে সালাত সম্পন্ন করতেন অর্থাৎ চার রাকা‘আত পড়তেন। অথচ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর (রা.), ওমর (রা.) এমনকি ওসমান (রা.) এর প্রথম আট বছর এভাবে অতিবাহিত হলো যে, তারা সবাই দু’ রাকা‘আত পড়তেন। তারপর তিনি (উসমান) চার রাকা‘আত পড়েন। সাহাবাগণ তার এ মতটি অস্বীকার করলেন, তবুও তাকে অনুসরণ করে তারা চার রাকা‘আত সালাত পড়েন। যদি ইমামের অনুসরণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াই হয় সাহাবীদের প্রদর্শিত পথ, তবে আমরা যাদেরকে দেখি নবী (স.) যে এগার রাকা‘আত পড়তেন তা থেকে ইমাম বৃদ্ধি করে পড়লে তারা সালাতের মধ্যে ইমামের পিছন থেকে সরে পড়ে; যেমনটি আজকাল আমরা দেখি কতিপয় মানুষ ইমামের সালাত সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে “এগার রাকা‘আতই শর‘য়ী হুকুম” এ অজুহাতে সরে পড়ে। আমরা বলব: শরী‘আতের দৃষ্টিতে ইমামের অনুসরণই অধিক ওয়াজিব।

(ইবনলু উসাইমিন, প্রাগুক্ত, (১/১৯৪-১৯৬।

শাইখ ইবন জিবরীন এরূপ মাস‘আলায় বলেন, ইমাম আহমদ (রহ.) ইমামের সাথে সালাত আদায় করতেন, তিনি তার পিছন থেকে সরে যেতেন না। (ইবন জিবরীন, ফাতাওয়া আস-সিয়াম, পৃ. ১৪৪-১৪৫)। 

*** সবগুলি মতামত সংগৃহীত হয়েছেঃ ডঃ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া এর লেখা প্রবন্ধ, “তারাবীহ্‌ সালাতের রাকা‘আত: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” থেকে।

মন্তব্যঃ আমার মনে হয় যে বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোলাসা করেন নি, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোন কোন দরকার নেই। এই সালাতের অনেক ফজিলত আর রমজান মাসের জন্য এর ফজিলত আরও বেড়ে যায়। যে যত বেশী ইবাদাত করবে সে ততই লাভবান হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু রাকাত নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি। তাই আমাদেরও নির্দষ্ট কিছু বলে, তার উপর ইস্তিকামাত হয়ে যাওয়া মনে হল ঠিক হবে না। মানুষের শারীরিক ক্ষমতা বিবেচনা করে মহান আল্লাহ আদায় যোগ্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ হেকমত দেখুন, তিনি নফলের (তাহাজ্জুদ) কোন সীমা নির্ধারণ করে নাই। ঠিক তেমনি তারাবীহ এর সীমা নির্ধারণ করে দিলে বা ফরজ করে দিলে উম্মত আদায় করতে পারবে না। প্রমান সহিহ বুখারির ১৮৮৫ নম্বর হাদিস যেখানে তারাবীর সালাত সম্পর্কে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের (গতরাতের) অবস্থান আমার অজানা ছিল না, কিন্তু আমি এই সালাত তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবার আশংকা করছি (বিধায় বের হই নাই)। কেননা তোমরা তা আদায় করায় অপারগ হয়ে পড়তে। (হাদিসের অংশ বিশেষ, পূর্বে পূর্ন হাদিস উল্লেখ করা আছে)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশঙ্কা করে ছিল যে, উম্মতের মাঝে এই সালাতের সীমা নির্ধারণ দিলে কষ্ট হবে। আর আমরা সীমা নির্ধারনের ব্যস্ত। তাই নির্দিষ্ট না করার হেকমত হল, সাধ্য অনুসারে আমল করা। যার যতটুকু সাধ্য আছে সে তত টুকুই আদায় করবে। যে সমাজে বিশ রাকাত চালু আছে সেখানে বিশ পড়াই ভাল, আর সে সমাজে আট রাকাত চালু আছে সেখানে আট পড়াই ভাল। উম্মতের ঐক্যের জন্য এতটুকু ছাড় দিলে আশা করি বিষয়টি দ্বারা ক্ষতি হয়েছে তার কিছুটা হলেও পুরন করে। বিষয়টি যেহেতু মতভেদপূর্ণ মাসায়েল, কাজেই যে কোন আম মানুষ সুধারনার ভিত্তিতে যে কোন বিজ্ঞ আলেমের মতামত গ্রহন করা করতে পারেন। আর যারা এই বিষয় জ্ঞান রাখের তারা কুরআন সুন্নাহ নিকটবর্তী মাসায়েল অনুসরণ করে। (আল্লাহ আলাম)। যে বা যারা বিষয়টি নিয়ে উম্মদের মাঝে ফিতনার সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে, তাকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চলবেন। আকিদাগত সমস্যা হলে কঠোর অবস্থান নেয়ার দরকার হত। ফিকহি মাসায়েলে অনেক প্রস্ততা আছে, কাজেই ফিকহি মাসায়েলে অন্যের মতকে মুল্যয়ন করুন। আশা করি উম্মতের মাঝে ঐক্য সৃষ্ট হবে।

তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদঃ

তারাবীহ সালাতের মতভেদের কারনে হাদিসের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে আর একটি মতভেদ মতবিরোধে রূপ নিয়েছে। তা হলো, একদল বলছে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত, দুটি নাম মাত্র। আরেক দল বলছে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আলাদা দুটি ভিন্ন সালাত। যাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম ও সময় আছে। সহিহ বুখারির ১৮৮৬ নম্বর হাদিসে আায়িশা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেন যে, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সালাত কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, রমযান মাসে ও রমযান ছাড়া অন্য সময়ে (রাতে) তিনি এগারো রাক‘আত হতে বৃদ্ধি করতেন না। এই হাদিসে আলোক রমজান মাসের সালাত ১১ রাকার উল্লেখ করা হয়। যারা আট রাকাত তারাবীহ আদায় করে তারা বলে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত কাজেই তারাবীহ আট রাকাত ও বিতের তিন রাকআত। অপর পক্ষে যারা বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করে তারা বলে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ সালাত নয়, কাজেই এই হাদিস দিয়ে শুধু তাহাজ্জুদের দলীল দেয়া যাবে, তারাবীহ দলীল দেয়া যাবেনা। তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত, না কি ভিন্ন সালাত এ সম্পর্ক যারা দাবি করছে তাদেরই কিছু দলীল তুলে ধরছি।

যারা বলে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত তাদের যুক্তিঃ

আবূ যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সিয়াম পালন করেছিলাম। রমযান মাসে তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহর সালাত আদায় করলেন। যখন মাসের মাত্র সাত রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল, তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহর সালাত আদায় করতে লাগলেন রাত্রের তৃতীয় প্রহর অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত। যখন মাসের ছয় রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহর সালাত আদায় করলেন না। যখন পাঁচ রাত্র অবশিষ্ট রয়ে গেল আমাদের নিয়ে তারাবীহর সালাত আদায় করলেন অর্ধ রাত্রি অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি আপনি আমাদের নিয়ে অত্র রাত্রের অবশিষ্ট অংশেও নফল সালাত আদায় করতেন! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে তারাবীহর সালাত আদায় করে ঘরে ফিরে যায় আল্লাহ তা’আলা তার জন্য পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায় করার সওয়াব লিখে রাখেন। অতঃপর আমাদের নিয়েও তারাবীহর সালাত আদায় করলেন না এবং নিজেও আদায় করলেন না। যখন মাসের তিন রাত্রি অবশিষ্ট রয়ে গেল, তিনি আমাদের নিয়ে ঐ রাত্রে তারাবীহর সালাত আদায় করলেন (এবং ঐ সালাতে) তার সন্তান সন্ততি এবং পরিবারবর্গও জড়ো হয়ে গেল। আমরা আশংকা করতে লাগলাম যে, “ফালাহ” না হারিয়ে ফেলি। আমি বললাম, “ফালাহ” এর অর্থ কি? বললেন, সাহরী খাওয়ার সময়।

(সুনানে নাসাঈ ১৬০৮ ইফাঃ, ইবন মাজাহ ১৩২৭)।

আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করা যায়। তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ রমযান মাসে সাওম পালন করেছিলাম, তখন তিনি এ মাসের সাতটি রাত অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত কোন অংশ সালাতে দাঁড়ান নি। সে সময় (২৩ তারিখের রাত) তিনি আমাদের সাথে নিয়ে রাতের এক-তৃতীয়াংশ জাগ্রত ছিলেন। তারপর অবশিষ্ট ষষ্ঠ (২৪ তারিখের রাত) জাগ্রত ছিলেন না। অত:পর যখন অবশিষ্ট পঞ্চম রাত্রি (২৫ তারিখের রাত) এলো, তখন তিনি আমাদের নিয়ে রাত্রের অর্ধেক সময় পর্যন্ত জাগ্রত ছিলেন। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি এটাকে আরও বর্ধিত করতে পারি? তখন তিনি বললেন, ‘‘কোন ব্যক্তি যখন ঈমামের সাথে সালাত আদায়ে শেষ পর্যন্ত দন্ডায়মান থাকে, তখন তার কিয়ামুল লাইল বা রাত্রি জাগরণ হয়ে যায়’’। তারপর অবশিষ্ট চতুর্থ রাত্রিতেও (২৬ তারিখের রাত) তিনি জাগ্রত ছিলেন না। তারপর যখন অবশিষ্ট তৃতীয় রাত (২৭ তারিখের রাত) এলো, তখন তিনি আমাদের সাথে নিয়ে জাগ্রত রইলেন। এমনকি আমরা فلاح ‘ফালাহ’ শেষ হয়ে যওয়ার আশংকা করলাম। আমি জিজ্ঞাস করলাম, ফালাহ কি? জবাবে তিনি বললেন, সাহরী। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি এ রাত্রিতে তাঁর পরিবার পরিজন, কন্যাগণ ও স্ত্রীগণকেও জাগিয়ে দিতেন। ( ইমাম আহমদ, মুসনাদ, বৈরুত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, লেবানন, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৪ খ্রীঃ, তাহকীক; শুয়াইব আল আরনাউত ও অন্যান্যরা, (৫/১৬৩) শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত বলেন হাদীসটির সনদ মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ।

মন্তব্যঃ এই হাদিসের আলোকে জানা গেল তিনি প্রায় সাহরী পর্যান্ত তিনি তারাবিহ আদায় করেছেন। অর্থাৎ তিনি রমজানে তাহাজ্জুদ সালাত আলাদাভাবে আদায় করে নাই। যারা বলে তাহাজ্জুদ এ তারাবিহ একই সালাত তাদের দাবিঃ তারাবীহ এর সালাত, রমযানের কিয়াম বা রাত্রের সালাত, ‘রমযানে তাহাজ্জুদ এর সালাত সবই এক, যদিও প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র নামে পরিচিত। রমযানে তারাবীহ্ ব্যতীত কোনো তাহাজ্জুদ নেই। কেননা, কোনো সহীহ বা দুর্বল বর্ণনা দ্বারা এটি সাব্যস্ত হয় নি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে রাত্রে দু’ধরনের সালাত আদায় করেছেন, একটি তারাবীহ্‌ এবং অপরটি তাহাজ্জুদ। অতএব, রমযান মাস ব্যতীত অন্যান্য মাসে যেটি তাহাজ্জুদ সেটিই রমযানে তারাবীহ্‌। উপরোক্ত হাদীস থেকে এও প্রমাণিত হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখিত রাত্রিগুলোতে এ সালাত ব্যতীত অন্য কোন সালাত পড়ে নাই। অথচ তাহাজ্জুদের সালাত তাঁর জন্য ওয়াজিব ছিল। যদি তারাবীহ্‌ এর সালাত তাহাজ্জুদের সালাতের ভিন্ন কোন সালাত হতো তবে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সালাত আদায় করতেন। তাই তাদের দাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ব্যতিত বছরের ১১ মাসের রাতে যে সালাত আদায় করেছেন তাই তাহাজ্জুদ। আর রমজান মাসের রাতের সালাতই হল তারাবীহ। এই স্বপক্ষে তারা বুখারীতে বর্ণতি আয়াশা রাঃ ঐ সহিহ হাদিসটিও উল্লেখ করে যেখান তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে ও রমযান ছাড়া অন্য সময়ে (রাতে) তিনি এগারো রাক‘আত হতে বৃদ্ধি করতেন না। (বুখারি ১৮৮৫)

যারা বলে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আলাদা দুটি সালাত তাদের যুক্তিঃ

১। দুটি সালাতের নাম যেমন আলাদা, আদায় করার সময় ও আলাদা। কাজেই একই সালাত হতে পারে না। যেমনঃ তাহাজ্জুদ নামায ঘুমের পর ঘুম থেকে উঠে পড়া হয় অথচ তারাবীহ পড়া হয় ইশার পর ঘুমের আগেই। (আমল দ্বারা প্রমানিত মতভেদ নেই)।

২। তারাবীহ পড়তে হয় রমজান মাসে। রমজানের চাঁদ দেখে তারাবীহ শুরু হয় শাওয়ালের চাঁদ দেখে তারাবীহ পড়া শেষ করতে হয়। কাজেই তারাবীহের জন্য রমজান আবশ্যক। কিন্তু তাহাজ্জুদের জন্য রমাজান শর্ত নয়। বছরের যে কোন সময় তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়।

৩। হুকুমের দিক থেকে দুটি সালাত আলদা। তারাবি পড়া সুন্নাহ আর তাহাজ্জুদ আদায় করা নফল।

৪। বহু মুহাদ্দিস তাদের হাদিস গ্রন্থে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের জন্য আলাদা দু’টি অধ্যায় কায়েম করেছেন। যা পরিস্কার প্রমাণ করে এ দু’টি ভিন্ন নামায।

৫। তারাবীহের পর বিতরের জামাত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। কিন্তু তাহাজ্জুদের পর বিতরের জামাতের কোন প্রমাণ নেই।

৬।  তারাবীহ নামাযে পুরো কুরআন খতম করার বিষয়টি খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে প্রমাণিত। কিন্তু তাহাজ্জুদ নামাযে এভাবে প্রমাণিত নয়।

৭। তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য হুকুম করা হয় মক্কায় থাকা অবস্থায়। আর তারাবিহ আদায়ের জন্য হুকুম করা হয় মদীনায়।

হযরত উমর (রাঃ) যখন হযরত উবাই বিন কাব রাঃ কে তারাবীহ নামাযের ইমাম নিযুক্ত করলেন, তখন তিনি রাতের শুরুভাগে ইশার পর তারাবী পড়াতেন। তখন হযরত উমর (রাঃ) তারাবী ছাড়া তাহাজ্জুদ পড়ার উৎসাহ প্রদান করে বলেন, যে নামায থেকে তোমরা ঘুমিয়ে যাও (তাহাজ্জুদ) যা তোমরা আদায় করতে শেষ রাতে, সেটি এ নামায থেকে উত্তম যা তোমরা আদায় করছো। আর লোকজন প্রথম রাতে তারাবীহ পড়তো। (মুয়াত্তা মালিক-৩৭৮, সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১১০০)।

মন্তব্যঃ  হযরত উমর (রাঃ) এর উক্তি দ্বারা বুঝা যায় তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আলাদা দুটি সালাত।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা কাউন্সিলের সাবেক প্রধান মুফতী সম্মানিত শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (র:)কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারাবী, কিয়ামুল লাইল এবং তাহাজ্জুদের মধ্যে পার্থক্য কি? 

উত্তর: সম্মানিত শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (র:) বলেন: রাতের নামাযকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। একে কিয়ামও বলা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ

অর্থঃ আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়, ওটা তোমার জন্য নফল।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৭৯) 
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلا قَلِيلًا

অর্থঃ ওহে চাদরে আবৃত (ব্যক্তি), রাতে সালাতে দাড়াও, রাতের কিছু অংশ বাদে।” (সূরা মুজাম্মেলঃ ১-২) 
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ

অর্থঃ তাদের প্রতিপালক যা তাদেরকে দিবেন, তা তারা ভোগ করবে, কারণ তারা পূর্বে (দুনিয়ার জীবনে) ছিল সৎ কর্মশীল। তারা রাত্রিকালে খুব কমই শয়ন করত।” (সূরা আয-যারিয়াতঃ ১৬-১৭)

আর মানুষের উপর সহজ করে এবং বেশী দীর্ঘ না করে রামাযান মাসে রাতের প্রথম ভাগে কিয়ামুল লাইল করাকে আলেমদের পরিভাষায় তারাবী হিসেবে নাম করণ করা হয়। একে তাহাজ্জুদ এবং কিয়ামুল লাইল হিসেবে নাম করণ করাও জায়েজ আছে। এতে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহই তাওফিক দাতা

আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী রাহেমাহুল্লাহ্ বলেনঃ আমার নিকট গ্রহণযোগ্য হলো তারাবীহ্‌ ও রাত্রের সালাত এক সালাত। যদিও উভয়ের বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে যে, তারাবীহ্ এ নিরবিচ্ছিন্নতা থাকে না আবার জামা‘আতে আদায় করা হয়। কখনও রাত্রের প্রথমাংশে আদায় করা এবং অন্যভাবে সেহরী পর্যন্ত পৌছার ব্যাপারে তাহাজ্জুদ ব্যতিক্রম। কেননা তাহাজ্জুদ হলো শেষ রাত্রের সালাত। আর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার ফলে ভিন্ন প্রকার মনে করা আমার নিকট ভালো মনে হয় না। বরং এগুলো একই সালাত। যদি রাত্রের প্রথমাংশে পড়া হয় তবে তাকে তারাবীহ্‌ বলে, আর শেষে পড়লে তাহাজ্জুদ বলা হয়। বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন থাকা সত্বেও উভয় সালাতকে এক নামে নামকরণ করাটা বিদ‘আত হবে না। কেননা নামের পরিবর্তনে কোন সমস্যা নেই, কারণ উম্মত এতে ঐক্যমত পোষণ করেছে। আর দুই প্রকারের ব্যাখ্যা সাব্যস্ত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনা থেকে যে, তিনি তারাবীহ্‌র সালাত আদায়ের মাধ্যমে তাহাজ্জুদ আদায় করেছেন।” (শায়খ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, ফয়জুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ২/৪২০, বৈরুত: দারুল মারিফাহ্: লেবানন)।

দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েলঃ

। খতর তারাবীহ বা অন্য যে কোন সালাতে যদি তন্দ্রা চলে আসে, তাহলে সালাত আদায় করতে থাকবে নাকি সালাত ত্যাগ করে ঘুমানো উত্তম?

 আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ সালাতে ঝিমায়, তার উচিত শুয়ে পড়া, যেন তার থেকে ঘুম চলে যায়। কারণ ঘুমানো অবস্থায় যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, তখন হয়তো সে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে গিয়ে নিজেকে গালি দেবে”। সহিহ বুখারি ২১২, সহিহ মুসলিম  ৭৮৬)।

 আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘মারফূ’ সনদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে দণ্ডায়মান হয়, অতঃপর তার জন্য যদি কুরআন পড়া কষ্টকর হয়, কি বলে বলতে পারে না, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে”। (মুসলিম: (৭৮৭)

মন্তব্যঃ কাজেই সালাত আদায় করা সময় ঘুম আসলে সালাত চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সালাত ছেড়ে দিতে হবে ঘুম কেটে গেলে আরাব আদায় করা যায়।

২। তারাবীর সালাত আদায় কালে, কুরআন খতমের নিমিত্তে খুবই দ্রুত কুরআন তিলওয়াত করে সালাত আদায়ের হুকুম কি?

তারাবির সালাতে মনোযোগ সহকারে ও বুঝে বুঝে যে পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত উচিত। সালাত আদায় কালে কুরাআন মনোযোগ সহকারে শুনা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

অর্থঃ আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। (সুরা আরাফ ৭:২০৪)।

প্রতিদিন কতটুকু তিলওয়া করা যায়?

সময়  ও ধৈর্য থাকলে এক পারা বা তারে থেকে বেশী বা কম পড়া যায়। হাদিসে এসছে, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন এক রাতে সালাত আদায় করেছি, তিনি এত লম্বা করলেন যে আমি খারাপ ইচ্ছা করে ছিলাম, বলা হল: কি ইচ্ছা করে ছিলেন? তিনি বললেন: আমি ইচ্ছা করে ছিলাম তাকে ত্যাগ করে আমি বসে যাব”। (সহিহ বুখারি: (১১৩৫), সহিহ মুসলিম: (৭৭৩)।

হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি কোন এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করেছি, তিনি বাকারা আরম্ভ করলেন, আমি বললাম: একশ’ আয়াত হলে হয়ত রুকু করবে। তিনি পড়তে থাকলেন আমি বললাম হয়ত এক রাকাতে এ সূরা শেষ করবেন, তিনি পড়তে থাকলেন আমি বললাম: এর দ্বারা হয়ত রুকু করবেন। অতঃপর তিনি সূরা আলে-ইমরান আরম্ভ করে তা শেষ করলেন। অতঃপর তিনি সূরা নিসা আরম্ভ করে শেষ করলেন। তিনি ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে পড়তে ছিলেন। যখন কোন তাসবীহের আয়াত পাঠ করতেন, তাসবীহ পড়তেন, যখন কোন প্রার্থনার আয়াত পড়তেন, প্রার্থনা করতেন। যখন কোন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত পড়তেন, আশ্রয় চাইতেন…”। (সহিহ মুসলিম ৭৭২)।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment