তাওয়াফের ফজিলত, প্রকার ভেদ এবং পদ্ধতি

তাওয়াফের ফজিলত, প্রকার ভেদ এবং পদ্ধতি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

তাওয়াফঃ তাওয়াফ (طواف) একই আরবী শব্দ যার অর্থ হলো প্রদক্ষিণ করা বা চক্কর দেয়া। কোনো কিছুর চারদিকে প্রদক্ষিণ করাকে শাব্দিক অর্থে তাওয়াফ বলে। হজ্জের ক্ষেত্রে কাবা শরীফের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। অর্থাৎ হজ্জ ও উমরার সময় মুসলিমরা কাবার চারপাশে ঘড়ির কাটার বিপরীতদিকে সাতবার ঘোরে যা তাওয়াফ নামে পরিচিত। পবিত্র কাবা ব্যতীত অন্য কোনো জায়গায় কোনো জিনিসকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা হারাম। হজ্জ উমরার সময় বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা একটি ফরজ কাজ। যা আদায় না করলে হজ্জ ও উমরা বিশুদ্ধ হবে না। তবে হজ্জ এবং উমরার ছাড়াও যে কোন সময় বাইতুল্লাহ এর চর্তুদিকে তাওয়াফ করা একটি নফল ইবাদাত। তাওয়াফ করা আগে নিয়ত করতে হবে এবং মসজিদে হারামের সীমানার ভিতর থেকে কাবার চারপাশে সাত চক্কর দিতে হবে। কম বেশী দিলে না তাওয়াফ হিসাবে গন্য হবেনা।

তাওয়াফের ফজিলতঃ

তাওয়াফের ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা তাওয়াফকারির প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি করে নেকি লিখবেন এবং একটি করে গুনাহ মাফ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 أَوَلَمْ نُمَكِّن لَّهُمْ حَرَمًا آمِنًا يُجْبَى إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ رِزْقًا مِن لَّدُنَّا وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থঃ আমি কি তাদের জন্যে একটি নিরাপদ হরম প্রতিষ্ঠিত করিনি? এখানে সর্বপ্রকার ফল-মূল আমদানী হয় আমার দেয়া রিযিকস্বরূপ। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। (সুরা কাসাস ২৮:৫৭)

১. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ (মক্কা) শহরকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন, এর একটি কাঁটাও কর্তন করা যাবে না, এতে বিচরণকারী শিকারকে তাড়া করা যাবে না, এখানে মু‘আরিফ (পৌছের দেয়ার ঘোষনা) ব্যতীত পড়ে থাকা কোন বস্তু কেউ তুলে নিবে না। (সহিহ বুখারি ১৫৮৬)

২. উমায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, ইবনু উমার (রাঃ) চাপাচাপি করে হলেও হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামনী বায়তুল্লাহর এই দুই রুকনে যেতেন। আমি একদিন তাঁকে বলাম, আপনি এ দুটি রুকনে ভীড়ে চাপাচাপি করে হলেও গিয়ে উপস্থিত হন কিন্তু অন্য কোন সাহাবী তো ইমন চাপাচাপি করে সেখানে যেতে দেখি না। তিনি বললেন, যদি আমি এরূপ চাপাচাপি-ধাক্কাঁধাক্কি করি তাতে দোষ কি? আমি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, এ দুটো রুকন স্পর্শ করণে গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায় তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, কেউ যদি যথাযথ ভাবে বায়তুল্লাহর সাতবার তাওয়াফ করে একটি ক্রীতদাস করার মত ছওয়াব হয়। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, তাওয়াফ করতে গিয়ে এমন কোন কদম সে রাখেনা বা তা উঠায়না যদ্বারা তার একটি গুনাহ মাফ না হয় এবং একটি নেকী লেখা না হয়। (সুনানে তিরমিজি ৯৬২ ইফাঃ, মিসকাত ২৫৮০)

৩. আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ লোকেদের করলো এবং দু’ রাক‘আত নামায পড়লো, তা একটি ক্রীতদাসকে দাসত্বমুক্ত করার সমতুল্য। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২৯৫৬)

৪. উক্ত ইবনে উমার (রাঃ) হতেই বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সাত চক্র তওয়াফ করার সওয়াব একটি ক্রীতদাস স্বাধীন করার সমান।  (হাদিস সম্ভার ১১৬৩ হাদিসের মান সহিহ)

৫. আবদুল্লাহ্ ইবন উবায়দ ইবন উমায়ার (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি বললো: হে আবু আবদুর রহমান! আমি আপনাকে এই দু (দু’রুকনে ইয়ামানী) ব্যতীত অন্য কোন স্তম্ভ চুম্বন করতে দেখি না। তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ এদের স্পর্শ করা গুনাহ দূর করে দেয় এবং তাঁকে এও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি সাতবার তাওয়াফ করে, সে একটি গোলাম আযাদ করার সাওয়াব পাবে।(সুনানে নাসাঈ ২৯২২)

তাওয়াফের প্রকাভেদঃ

ইসলামি শরীয়তে সাত প্রকার তাওয়াফের প্রচলন রয়েছে। এই সাত প্রকার তাওয়াফ হলোঃ

১। তাওয়াফে কুদুম বা আগমণী তাওয়াফঃ

২। তাওয়াফে জিয়ারত বা এফাদাঃ

৩। তাওয়াফে উমরাঃ

৪। তাওয়াফে নজরঃ

৫। তাওয়াফে তাহিয়্যাঃ

৬।নফল তাওয়াফঃ

৭। তাওয়াফে বিদাঃ

১। তাওয়াফে কুদুম বা আগমণী তাওয়াফঃ

কুদুম শব্দের অর্থ আগমণ। সে হিসেবে তাওয়াফে কুদুম কেবল বহিরাগত হাজিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীরা যেহেতু অন্য কোথাও থেকে আগমন করে না, তাই তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম সুন্নত নয়।

ইফরাদ হজ্জকারী মক্কায় এসে প্রথম যে তাওয়াফ আদায় করে তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। কেরান হজ্জকারী ও তামাত্তু হজ্জকারী উমরার উদ্দেশ্যে যে তাওয়াফ করে থাকেন তা তাওয়াফে কুদুমেরও স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। তবে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী কেরান হজ্জকারীকে উমরার তাওয়াফের পর ভিন্নভাবে তাওয়াফে কুদুম আদায় করতে হয়। হানাফি মাজহাবে তামাত্তু ও শুধু উমরা পালনকারীর জন্য কোনো তাওয়াফে কুদুম নেই।

মন্তব্যঃ যে সকল হজ্জযাত্রীদের সাথে হাদী থাকে না, তারা প্রথমে উমরা করে হালল হয়ে যায় এবং আবার ইহরাম বেধে হজ্জ করে তাদের হজ্জ কে তামাত্তু হজ্জ বলে। অপর পক্ষে যারা হাদী নিয়ে হজ্জে নিয়তে মক্কায় আসেন, তারা একই ইহরামে উমরা ও হজ্জ আদায় করে থাকেন তাদের হজ্জ কে কেরান হজ্জ বলে। সাধারণ যারা হজ্জের সফলে উমরা করার সময় সুযোগ পান না তাদের হজ্জ কে ইফরাদ হজ্জ বলে।

২। তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদাঃ

তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদা হলো হজ্জের একটি ফরজ আমল। এই সাত প্রকার তাওয়াফের মধ্য এটিই হলো, হজ্জের মুল তাওয়াফ। সকল হজ্জকারীকে এ তাওয়াফটি আদায় করতেই হবে। এই তাওয়াফটি বাদ পড়লে হজ্জ সম্পন্ন হবে না। তাওয়াফে ইফাযা  মাধ্যমেই হজ্জের পূর্ণতা লাভ করে। তওয়াফে ইফাযাকে তাওয়াফে জিয়ারতও বলা হয়। আবার অনেকে এটাকে হজের তাওয়াফও বলে থাকেন। এটি না হলে হজ শুদ্ধ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ ثُمَّ لۡيَقۡضُواْ تَفَثَهُمۡ وَلۡيُوفُواْ نُذُورَهُمۡ وَلۡيَطَّوَّفُواْ بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ ٢٩ ﴾

অর্থঃ তারপর তারা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তাদের মানতসমূহ পূরণ করে এবং প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে। (সুরা হজ্জ ২২:২৯)

৩। তাওয়াফে উমরাঃ

তামাত্তু হজ্জযাত্রীগণ প্রথমে উমরা করে হালল হয়ে যায় এবং আবার ইহরাম বেধে হজ্জ করে। কেরাম হজ্জযাত্রীগণ একই ইহরামে উমরা ও হজ্জ আদায় করে থাকেন। অর্থাৎ তামাত্তু ও করান হজ্জ আদায়কারীগন হজ্জের আগে উমরা করা সুযোগ পান। এই উমরা তাওয়াফ করা একটি ফরজ আমল। এই তাওয়াফ না করলে উমরা বাতিল হয়ে যাবে। উমরা আদায়ের ক্ষেত্রে এই ফরজ তাওয়াফকে তাওয়াফে

উমরা বলা হয়। এই তাওয়াফ করার সময় প্রথম তিন চক্করে রমল করবে বা হেলে দুলে তাওয়াফ করবে। পুরুষেরা ইহরামের গায়ের কাপড়টির একমাথা ডান বগলের নীচ দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে দেবেন যাতে ডান কাঁধ, বাহু ও হাত খোলা থাকে। কাপড়ের বাকী অংশ ও উভয় মাথা দিয়ে বাম কাঁধ ও বাহু ঢেকে তাওয়াফ করবে। এই নিয়মটাকে আরবীতেও ইযতিবা বলা হয়। এটা করা সুন্নাত।

৪। তাওয়াফে নজরঃ

কেউ যদি তাওয়াফ করার মান্নত করে তাহলে তার জন্য তাওয়াফ আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যে কোন মান্নত আদায় করার নিমিত্তে যে তাওয়াফ করা হবে তাকে তাওয়াফে নজর বলে। যদি কোন প্রকার মান্নক করা সুন্নাহ সম্মত কাজ নয়। কিন্তু মান্নহ করার পর ভাল কাজের মান্নত আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

৫। তাওয়াফে তাহিয়্যাঃ

মসজিদে প্রবেশের পর মসজিদের সম্মানে তাহিয়্যাতুল মসজিদ দুই রাকাত নামাজ পড়া সুন্নত। আর কাবা ঘরে হাজির হলে মসজিদুল হারামের সম্মানার্থে একটি তাওয়াফ করা মুস্তাহাব। তবে মসজিদে হারামে প্রবেশের পর অন্য কোনো তাওয়াফ করলেও তাতে তাওয়াফে তাহিয়্যা আদায় হয়ে যাবে। এলফল সমজিদে হারামে প্রবেশের সম্মানে তাহিয়্যাতুল মসজিদ দুই রাকাত সালাত আর আদায করার প্রয়োজন হবে না বলে মুজতহীদ আলেমগণ মতপ্রদান করেছেন।

৬। নফল তাওয়াফঃ

মক্কায় থাকা অবস্থায় যখনই সুযোগ পাওয়া যায় তখনই নফল তাওয়াফ করা যায়। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় নফল তাওয়াফ করা বেশি বাঞ্ছনীয়। কারন পৃথিবীর থোকাও কোন সমজিদেই এই আমল করার সুযোগ নাই। যারা হজ্জের মক্কা গমন করেন তারা একটি নির্দিষ্ট সময় সেখানে অবস্থান করে হজ্জের জন্য অপেক্ষা করেন। এই অবসর সময় বেশী বেশী নফল তাওয়াফ করে আল্লাহকে খুসি করা চেষ্টা করা। এই নফল তাওয়াফে কোন প্রকার রমল বা ইযতিবা নাই। নফল তাওয়াফ আদায় কারর সময় কোন প্রকার ইহরামের কাপড় পড়তে হয় না। সাধারণ পোশাকেই কাবাঘরের চতুর্পাশে সাত চক্কর দিলে তাওয়াফ আদায় হয়ে যাবে। অনেকের মনে করে থাকেন হজ্জের ন্যায় শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের পক্ষ থেকে ও তাওয়াফ করা যায়। যেমনঃ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, স্ত্রী-সন্তান ইত্যাদি আপন  জনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কারও পক্ষ থেকে নফল তাওয়াফ করা সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। 

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তামাত্তু আদায়কারী ‘উমরাহ আদায়ের পর যত দিন হালাল অবস্থায় থাকবে ততদিন বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবে। তারপর হাজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবে। এরপর যখন ‘আরাফাতে যাবে তখন উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি যা মুহরিমের জন্য সহজ্জলভ্য হয় তা মীনাতে কুরবানী করবে। আর যে কুরবানীর সঙ্গতি রাখে না সে হাজ্জের দিনসমূহের মধ্যে তিনদিন সওম পালন করবে। আর তা ‘আরাফার দিনের আগে হতে হবে। আর তিনদিনের শেষ দিন যদি ‘আরাফার দিন হয়, তবে তাতে কোন দোষ নেই। তারপর ‘আরাফাত ময়দানে যাবে এবং সেখানে ‘আসরের সালাত হতে সূর্যাস্তের অন্ধকার পর্যন্ত ‘ওকুফ (অবস্থান) করবে। এরপর ‘আরাফা হতে প্রত্যাবর্তন করে মুযদালাফায় পৌঁছে সেখানে পুণ্য অর্জনের কাজ করতে থাকবে আর সেখানে আল্লাহ্কে অধিক অথবা (রাবীর সন্দেহ) সবচেয়ে অধিক স্মরণ করবে। সেখানে ফাজর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকবীর ও তাহলীল পাঠ করবে। এরপর (মীনার দিকে) প্রত্যাবর্তন করবে যেভাবে অন্যান্য লোক প্রত্যাবর্তন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘এরপর প্রত্যাবর্তন কর সেখান হতে, যেখান হতে লোকজন প্রত্যাবর্তন করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল, দয়াময়।’’ তারপর জামরায় প্রস্তর নিক্ষেপ করবে। (সহিহ বুখারি ৪৫২১)

৭। তাওয়াফে বিদাঃ

হজ্জ শেষে বহিরাগত হাজ্জি সাহেবগন যখন বায়তুল্লাহ থেকে প্রত্যাবর্তনের করবেন তখন আরেক বার বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে হয়। এই শেষবার বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করাকে তাওয়াফে বিদা বলে। এই তাওয়াফটি বহিরাগত হাজ্জিদের জন্য মুজতহীদ আলেমগণ ওয়াজিব বলে গন্য করেছেন। কাজেই কোন হাজ্জি মিনায় থেকে সরাসরি নিজ নিজ দেশে চলে যেতে পারবেন না। কেননা, কাবাঘরের শেষ ওয়াজিব তাওয়াফটি এখনও বাকি আছে। তাই বহিরাগত হাজ্জিগন মক্কা হয়ে বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করে নিজ নিজ বাস স্থানে ফিরবেন। এই তাওআফের মাঝেই বহিরাগত হাজ্জিগন তাদের হজ্জ শেষ করে মক্কা থেকে প্রস্থানের অনুমতি পায়। এই বিদায়ী তাওয়াফ আদায় করা হানাফি মাজহাবে ওয়াজিব হিসাবে গন্য করা হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি তাগিদ দিয়েছেন।

১. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা বিভিন্ন পথ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “কেউই যেন শেষবারের মতো বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ না করা পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন না করে।” (সহিহ মুসলিম ৩১১১, সুনানে আবু দাউদ ২০০২)

এক নজরে পুর্নাঙ্গ তাওয়াফ করার পদ্ধতি

ক) কারা ও মসজিদের হারামের যথাযত সম্মান ভক্তি প্রদর্শণ করে কারার চত্তরে প্রবেশ করে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। তাওয়াফ শুরু করার পূর্বেই তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দিতে হবে। যে কোন স্থান থেকেই তাওয়াফ শুরু করা যাবে না। রুকনে হাজরে আসওয়াদ বা কাবার যে কোনায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করা আছে সেই কোন থেকে তাওয়াফ শুরু করেত হবে। হাজরে আসওয়াদ কাবাঘরের দক্ষিন-পূর্ব কোনে স্থাপন করা আছে। কাবাঘরের ‘‘হাজরে আসওয়াদ’’ কোণ থেকে মসজিদে হারামের দেয়াল ঘেষে সবুজ বাতি জ্বালান থাকে। ঐ বাতি দেখেই তাওয়াফ শুরুর স্থান চিনে নিতে হবে।

খ) প্রথমে মনে মনে তাওয়াফের নিয়ত করা। নিয়ত না করলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না, কেননা কোন আমলের জন্য নিয়ত করা ফরজ।

গ) নিয়ত করার পর, প্রথমে ‘হাজারে আসওয়াদ (কাল পাথরের) কাছে গিয়ে, ‘‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’’  বলতে হবে এবং এই পাথরকে চুমু দিয়ে তাওয়াফ কার্য শুরু করতে হবে। কাবাঘরকে বামপাশে রেখে তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফের করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  নীচের দোয়াটি পড়তেন। তাই তাওয়াফের সময় নিম্মের দোয়াটি পড়লে ভাল। কারন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এমনটি করতেন। দোয়াটি হলঃ

**اَللَّهُمَّ إِيْمَانًا بِكَ وَتَصْدِيْقًا بِكِتَابِكَ وَوَفَاءً بِعَهْدِكَ وَاتِّبَاعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ مَحَمَّدٍ -صلى الله عليه وسلم**-

অর্থঃ হে আল্লাহ! তোমার প্রতি ঈমান এনে, তোমার কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের জন্য তোমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করে এ তাওয়াফ কার্যটি করছি।

ঘ) রমজান ও হজ্জের মৌসুমে প্রচন্ড ভীড় থাকে। এই ভীড়ের মধ্য শতকরা দুই চার জন ছাড়া কেউই চুমু দিতে পারে না। বয়স্ক, বৃদ্ধ ও মহিলাদের জন্য পাথর চুম্বন দেয়াতো প্রশ্ন উঠে না। তারপরও যদি কেউ চুমু প্রদান করতে যায়, তবে কোন প্রকার ধাক্কা ধাক্কি করা যাবে না। এই কাজটি হলো সুন্নাহ আর ধাক্কা ধাক্কি করে কাউকে কষ্ট দেয়া হারাম। সুন্নাহ আমল করতে গিয়ে হামার কাজ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত কাজ হবে। কিন্তু ভীড়ের মাঝে কষ্ট না দিয়ে তাওয়াফ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই বেশী ভীড় দেখলে ধাক্কাধাক্কি করে চুমু দেওয়ার চেষ্টা না করাই উত্তম তবে ভীড় কম হলে এবং যে কোন কারনে চুমু দেওয়ার সুযোগ হবে অবশ্যই চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করা। চুমু দেয়া সম্ভব না হলে, ইশারায় চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করে দিতে হবে। ইশারায় চুমু দিয়ে শুরু করা ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত আমল।

ঙ) তাওয়াফ শুরু করার আগে আরও একটি কাজ করতে হবে তা হলো, ইযতিবা করা। ইযতিবা হলো, পুরুষেরা ইহরামের গায়ের কাপড়টির একমাথা ডান বগলের নীচ দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে দেবেন যাতে ডান কাঁধ, বাহু ও হাত খোলা থাকে। কাপড়ের বাকী অংশ ও উভয় মাথা দিয়ে বাম কাঁধ ও বাহু ঢেকে ফেলবেন। এ নিয়মটাকে আরবীতেও ইযতিবা বলা হয়। এটা শুধুমাত্র প্রথম তাওয়াফে করতে হয়। পরবর্তী তাওয়াফগুলোতে এ নিয়ম নেই। এটা করা সুন্নাত। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।

ছ) তাওয়াফের প্রথম তিন চক্কর রমল করা। রমল হলো, তাওয়াফের সময় মুজাহিদের মতো বীরদর্পে দুই কাঁধ দুলিয়ে দ্রুতপায়ে চলা। বিদায় হজ্জের সময়, মক্কার মুশরিকরা যখন বলাবলি করতে থাকে যে, ইয়াসরিবের (মদিনার) আবহাওয়া মুসলমানদেরকে দুর্বল ও রুগ্ন করে ফেলেছে। মুশরিকদের এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমল করে তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এবং পরেও এ বিধান অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।

মক্কায় প্রবেশ করে প্রথম যে তাওয়াফটি করতে হয় শুধু এটাতেই প্রথম তিন চক্রের রমলের এ বিধান। এরপর যতবার তাওয়াফ করবেন সেগুলোতে আর “রম্‌ল” করতে হবে না। এমনকি নফল তাওয়াফ অর্থাৎ হজ্জ ও উমরার নিয়্যাতে নয়, বাইতুল্লায় নামাজের সময় বা আগে পরে তাওয়াফ করার সময় রমল বা ইযতিবা প্রয়োজন নেই। মহিলাদের রমল করতে হয় না।

জ) তাওয়াফ শুরু সাথে সাথে নজরে আসবে মাকামে ইবরাহীম। মাকামে ইবরাহীমের অবস্থান হলো, কাবার পূর্ব পাশে। কাজেই এই স্থানে এসে কুরআন এই আয়াতটি তিলওয়াত করা মু্স্তাহাব। আয়াতটি হলো,

(*وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى*

অর্থঃ তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানাও। (সুরা বাকারাহ ২:১২৫)

ঝ) মাকামে ইবরাহীম অতিক্রমের পরই হাতের বামপাশে নজরে আসবে হিজর বা হাতীম। এটি কাবার উত্তরদিকে অবস্থিত অর্ধেক বৃত্তাকার অংশ যার পরিমান প্রায় পাঁচ হাতের মত। মক্কার কুরাইশগন কাবা নির্মাণের সময় অর্থাভাবের কারনে সম্পূর্ণ কাবা নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়, ফলে তারা এই অংশটুকু ছেড়ে যায়। এই ছাদহীন অর্ধ-বৃত্তাকার দেয়ালঘেরা হাতিম মুলত কাবাঘরেই অংশ। তাই তাওয়াফ করার সময় যদি কেউ হাতিমে প্রবেশ করে এবং হাতীমের ভীতর দিয়ে তাওয়াফ করে তবে তার তাওয়াফ হবেনা। কেননা, তাওয়াফ করতে হবে কাবার চতুর পাশ দিয়ে। কাবার ভীতর দিয়ে তাওয়ফ করা যাবে না।

ঞ) হাতীম অতিক্রম করা পর আপনি চলে আসবেন কাবার পশ্চিম পাশে। এই পাশে তাওয়াফের সাথে সাথে চেষ্টা করেতে হবে যাতে কাবার নিকটি দিয়ে যাওয়া যায়। কারন এই পশ্চিম ও দক্ষিন কোনাকে বলা হয় রুকনে ইয়ামানী, যা ষ্পর্শ করাও একটি মুস্তাহাব কাজ। কাজেই প্রতিটি তাওয়াফের সাথে এই রুকনে ইয়ামনী ষ্পর্শ করা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু প্রচন্ড ভীড় থাকলে, এই আমল না করলে কোন অসুবিধা নাই। ভীড়ের মধ্যে কাউকে কষ্ট দিল ষ্পর্শ না করাই ভাল। তবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, সাথে নারী, শিশু বা বয়স্ক কেউ না থাকলে ভীড়ের মধ্যেও কাউকে কষ্ট না দিয়ে রুকনে ইয়ামানী ষ্পর্শ করা সম্বব। তাই রুকনে ইয়ামানীর পাশে এসে পৌঁছলে ভীড় না হলে এ কোণকে ডান হাত দিয়ে ষ্পর্শ করার চেষ্টা করা। কিন্তু সাবধান, এ রুকনে ইয়ামেনীকে চুমু দেবেন না, এর পাশে এসে হাত উঠিয়ে ইশারাও করবেন না এবং সেখানে ‘আল্লাহু আকবার’ও বলবেন না। ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন হাজরে আসওয়াদে পৌঁছে। রুকনে ইয়ামেনী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে নিম্নের এ দোয়াটি পড়া মুস্তাহাবঃ

**رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ**

অর্থঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে তুমি দুনিয়ায় সুখ দাও, আখেরাতেও আমাদেরকে সুখী কর এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও। (সুরা বাকারা ২:২০১)। (সুনানে আবু দাউদ ১৮৯০ ইফাঃ)

কাজেই এই দোয়াটি পড়তেই থাকবেন। পড়তে পড়তে আপনি হাজরে আসওয়াদ বরাবরা পৌছে যাবেন। অর্থাৎ আপনার এক চক্কর সমাপ্তের পথে।

ট) দোয়াটি পড়তে পড়তেই আপনি রুকনে ইয়ামেনী থেকে হাজরে আসওয়াদে চলে এসেছেন। আপন এবার নতুন তাওয়াফ শুরু করছেন। মনে রাখবেন, তাওয়াফের প্রত্যেক চক্রেই হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বা ষ্পর্শ করা উত্তম। কিন্তু হজ্জের মৌসুমে প্রচন্ড ভীড়ের কারণে এটি খুবই দূরূহ কাজ। সেক্ষেত্রে প্রতি চক্রেই হাজরে আসওয়াদের পাশে এসে এর দিকে মুখ করে ডান হাত উঠিয়ে ইশারা করবেন। ইশারাকৃত এ হাত চুম্বন করবেন না। ইশারা করার সময় একবার বলবেন (بسم الله الله أكبر )‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’।

ঠ) হাজরে আসওয়াদের যে কোনা থেকে সবুজ বাতি দেখে তাওয়াফ শুরু করেছিলেন, আবার সেখানে আসলে তাওয়াফের এক চক্র শেষ হবে। এভাবে সাত চক্কর পূর্ণ করতে হবে। ভীড়ের পরিমাণ যদি আরো বেশী দেখতে পান এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাওয়াফ করা কঠিন মনে করেন তাহলে দু’তলা বা ছাদের উপর দিয়েও তাওয়াফ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সময় একটু বেশী লাগলেও ভীড়ের চাপ থেকে রেহাই পাবেন। ছাদের উপর তাওয়াফ করলে দিনের প্রখর রৌদ্রতাপ ও প্রচন্ড গরমে না গিয়ে রাতের বেলায় করবেন। বেশী ভীড়ের মধ্যে ঢুকে মানুষকে কষ্ট দেবেন না। দিলে ইবাদত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এই ক্ষেতে মনে রাখতে হবে মসজিদে হারামের সীমার বাইলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না।

ড) তাওয়াফরত অবস্থায় খুব বেশী বেশী জিকির, দোয়া ও তাওবা করতে থাকবেন। কুরআন তিলাওয়াতও করা যায়। কিছু কিছু বইতে আছে প্রথম চক্রের দোয়া, ২য় চক্রের দোয়া ইত্যাদি। কুরআন হাদীসে এ ধরনের চক্রভিত্তিক দোয়ার কোন ভিত্তি নেই। যত পারেন একের পর এক দোয়া আপনি করতে থাকবেন। আপনার নিজ ভাষায় আপনার মনের কথাগুলো আল্লাহ্‌র কাছে বলতে থাকবেন, মিনতি সহকারে চাইতে থাকবেন। দলবেঁধে সমস্বরে জোরে জোরে দোয়া করে অন্যদের দোয়ার মনোযোগ নষ্ট করবেন না। আরবীতে দোয়া করলে এগুলোর অর্থ জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন যাতে আল্লাহর সাথে আপনি কি বলছেন তা যেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন

ঢ) তাওয়াফ করার সময় যদি জামা’আতের ইকামত দিয়ে দেয় তখন সঙ্গে সঙ্গে তাওয়াফ বন্ধ করে দিয়ে নামাযের জামা’আতে শরীক হবেন এবং ডান কাঁধ ও বাহু চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলবেন। নামায রত অবস্থায় কাঁধ ও বাহু খোলা রাখা জায়েয না। সালাত শেষে তাওয়াফের বাকী অংশ পূর্ণ করবেন। অর্থাৎ আপনি যদি সালাতে আগে তিন চক্ক দিয়ে থাকেন তবে সালাতে পর বাকি চার চক্কর দিয়ে তাওয়াফ শেষ করবেন।

ণ) তাওয়াফ শেষ করার পর মাকামে ইবরাহীমের পিছনে গিয়ে কাবার দিকে মুখ করে দু্‌ই রাকাত সালাত আদায় করতে হবে।

ত) সালাত আদায়ের পর জমজমের পানি পান করা মুস্তাহাব।

মন্তব্যঃ প্রচন্ড ভীড়ের কারণে কোন পর মহিলার গা স্পর্শ হলে এতে তাওয়াফের কোন ক্ষতি হবে না, অযুও ছুটবে না। তবে সতর্ক থাকতে হবে। তাওয়াফরত অবস্থায় শরীরের কোন স্থান ক্ষত হয়ে গেলে বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়লে এতে তাওয়াফের কোন ক্ষতি হবে না।বিশেষ করে মসজিদে হারামে মুসল্লীর সামনে দিয়ে কেউ হাঁটলে তার গোনাহ হবে না। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ), তবে মুহাদ্দিস আলবানী (রহ.)-এর মতে হাঁটা জায়েয নয়। সেজন্য সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। তাওয়াফ শেষে দু’রাক‘আত সালাত দিন ও রাতের যে কোন সময় এমনকি নিষিদ্ধ ও মাকরূহ ওয়াক্তেও আদায় করা যাবে। তবে নিষিদ্ধ তিনটি সময়ে নামায না পড়া উত্তম।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “তাওয়াফের ফজিলত, প্রকার ভেদ এবং পদ্ধতি

Leave a comment