সিয়াম এর নিয়ত করার বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

সিয়ামের নিয়ত করা জরুরি এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রতিটি ইবাদতে যেমন নিয়ত করা শর্ত তেমনি সিয়ামেও নিয়ত করা ফরজ এবং রোজা সহীহ হওয়ার জন্য নিয়ত করা শর্ত। নিয়ত ছাড়া সিয়াম সহিহ হবে না। আকলামা ইবনু ওয়াক্কাস আল লাইসি রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত. আমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে মিম্বরে উপর দাড়িয়ে খুতবা বলতে শুনেছি। (তিনি বলেন) আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় সমস্ত আমল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল আর প্রতিটি ব্যক্তিই যা নিয়ত করে তাই সে পায়। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সে উদ্দেশ্যেই হবে তার প্রাপ্য।  (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ০১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

নিয়তের পদ্ধতিঃ

রোজা আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তি রোজা শুরু করার সময় অন্তরে উপস্থাপন করবে যে, আমি রমজানের রোজা রাখছি অথাব ক্বাজা রোজা রাখছি কিংবা মান্নত বা কাফ্ফারার রোজ রাখছি। সিয়ামের নিয়মই হল সারাদিন দিন ব্যাপিই পানাহার ও স্ত্রী ব্যবহার পরিহার করা। তাই পূর্ণ দিন সিয়াম পালন করা ওয়াজিব।

নিয়তের স্থান হল মানুষের অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। সুতরাং নিয়ত অন্তরেই করবে, মুখে উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করাকে অনেক বিজ্ঞ আলেম শরিয়ত পরিপন্থি মনে করেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের কারো থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি যে, তারা সিয়াম এর নিয়ত মুখে উচ্চারণ করেছেন। কিন্ত আমাদের সমাজে অনেক সিয়াম পালনের জন্য নিম্মের বর্ণিত নিয়তটি মুখে উচ্চারণ করে থাকলেও কোন হাদিস গ্রন্থে এটি পাওয়া যায় না। নিয়তটি হলঃ

نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ সিয়াম রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোযা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

নিয়তের অর্থটির প্রতি একটু লক্ষ করুন। ঐ নিয়তের বলা হয়েছে, আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ সিয়াম রাখার ইচ্ছা পোষণ করলাম। অথচ আরবি দিন শুরু হয় সূর্য়াস্তের সাথে সাথে। তাই যদি কেউ আজকের দিনের সিয়ামকে আগামি কালের সিয়াম বলে তা হলে তার নিয়ত কতটুকু শুদ্ধ হবে। আমার ধারনা কোন একজন সাধারণ আলেম যার আরবি জ্ঞান অতটা সমৃদ্ধ নয়, তিনি এই কথা রচনা করে চালিয়ে দিয়েছন।

সুতরাং নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত। রোজার নিয়তে সেহর- ইফতার খাওয়াই যথেষ্ট। এতে রোজা আদায় হয়ে যাবে। শায়খ তকি উদ্দিন ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‍‍‌রোজাদার যখন রাতের খাবার খায় রোজা রাখার ইচ্ছায়ই খায়। এ কারেণইতো রমজানের রাতের খাওয়া এবং ঈদের রাতের খাওয়ার মধ্যে প্রার্থক্য করে। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি জানতে পারে যে, আগামি কাল রমজান এবং সে রোজা রাখার ইচ্ছা করে, এতেই তার নিয়ত হয়ে যায়। আলাদাভাবে নিয়ত করার প্রয়োজন নেই। যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের আমল এ রকমই চলে আসছে।

সিয়ামের নিয়ত করার সময়ঃ

 সাধারনত সিয়ামের নিয়ত রাত থেকেই করতে হবে। রাতের প্রথম অংশে হতে পারে, মাঝের অংশে হতে পারে অথবা শেষাংশেও হতে পারে। ‍‍‍‍‍‍‍‍‍

ফরজ সিয়ামের নিয়তঃ

ফরজ, কাজা, কাফ্ফারা ও মানতের সিয়াম অবশ্যই সেহরীর পূর্বে সম্পন্ন করতে হবে। যদি দিনের কিছু অংশ সিয়াম পালন করার নিয়ত ছাড়া অতিবাহিত করে তাহলে এ কথা বলা সঠিক হবে না যে, লোকটি পূর্ণ দিন সিয়াম পালন করেছে।  নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদাত কবুল হবে না। এই আমল মহান আল্লাহর জন্য হলে ইবাদাত আর গাইরুল্লাহ জন্য হলে শির্ক। আমলে কিন্তু কোন পার্থক্য নেই, আসল পার্থক্য হল নিয়তে। কাজেই যে সময় নিয়ত ব্যতিত অতিবাহিত হয়েছে তাকে সিয়ামের মাঝে অন্তর্ভূক্ত করা যাবেনা। তাই ফরজ, ওয়াজির ও কাজা সিয়ামের নিয়ত আগেই করতে হবে। যখন থেকে নিয়ত করে তখন থেকেই তার কার্যকারিতা শুরু বলে বিবেচিত হয়।

আয়েশা রা. হতে মারফু হাদিস বর্ণিতঃ যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার পূর্বে-রাতেই রোজার রাখা স্থির করে না, তার রোজা বিশুদ্ধ হয় না। ( দারা কুতনি : ১৭২/২, বাইহাকি ২০২/৪ তিনি বলেন হাদিসটির সকল বর্ণনা কারিই নির্ভরযোগ্য)

হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ফজরের আগে সিয়ামের নিয়্যাত করবে না তার সিয়াম হবে না। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৮৭, আবূ দাঊদ ২৪৫৪, তিরমিযী ৭৩০, নাসায়ী ২৩৩৩, আহমাদ ২৬৪৫৭, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৯৩৩, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৩৭, সহীহ আল জামি‘ ৬৫৩৫। তবে আহমাদের হাদীসটি দুর্বল। কারণ তাতে ইবনু লাহ্ইয়া রয়েছে)।

নফল সিয়ামের নিয়তঃ

ফরজ সিয়াম যেমন সেহরীর আগে করতে হয় নফল সিয়ামের নিয়তের ব্যপারটি ভিন্ন। নফর সিয়ামের নিয়ত দিনের বেলায়ও করা জায়েয আছে। তবে শর্ত হচ্ছে সুবহে সাদেক থেকে নিয়ে নিয়তের সময় পর্যন্ত সিয়াম পরিপন্থি কোন কাজ যথা খাওয়া পান করা ইত্যাদি তার থেকে সংঘটিত হতে পারবে না। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট প্রবেশ করে বললেন, তোমার নিকট খাওয়ার কোন কিছু আছে কি? আমরা বললাম: না,তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, তাহলে আমি রোজা রাখলাম। ( মুসলিম, হাদিস নং – ১১৫২)  

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাবার চাওয়া দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি ইতি পূর্ব হতে রোজা রাখার নিয়ত করেননি। তাই বলা যায় তিনি সিয়াম আরম্ভ করেছেন দিনের বেলা হতে। এতে বুঝা যায় নফল রোজার নিয়ত দিনের বেলা করলেও চলবে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ নফল সিয়াম দিনের বেলা নিয়ত করার মাধ্যমে সহিহ হবে। এ বিষয়টি যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া আরও প্রমাণ করে যে, নফলের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা ফরজের তুলনায় বেশি। যেমন ফরজ নামাজ দাড়ানো এবং জমিনে ভালোভাবে স্থির হওয়া ব্যতিত সহিহ হয় না। আর নফল নামাজে এগুলো আবশ্যিক নয়। নফল সালাত বসে ও বাহনের উপর আরোহণ করে উভয় অবস্থায় সহিহ। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ যে তিনি নফলের ব্যাপারটি প্রশস্ত করেছেন। এ কারণে দেখা যায় নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে ফরজের তুলনায় আমাদের জন্য অনেকটা শৈথিল্য দেখানো হয়েছে।   

নফল রোজার নিয়ত দিনের বেলায় করার বিষয়টি একাধিক সাহাবি হতে বর্ণিত হয়েছে, যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মুয়াজ বিন জাবাল, হুজাইফা, আবু তালহা, আবু হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ প্রমুখ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

       

Leave a comment