দ্বিতীয় কিস্তি : হাদিসের আলোকে শবে বরাত পর্যালোচনা

দ্বিতীয় কিস্তি : হাদিসের আলোকে শবে বরাত পর্যালোচনা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। হাদিস থেকে তাদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

আলোচনা শুরুতে শবে বরাত সম্পর্কিত তাদের ব্যবহৃত কয়েকটি হাদিস উল্লখ করছি। সাথে সাথে হাদিসের মানও উল্লেখ করব যাতে সহজে এ সম্পর্কে একটি ষ্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়।

হাদিস নম্বরঃ-১

মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ “লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করে দেন।

হাদিসের মানঃ হাদিসটি সহিহ। ইমাম ইবনে হিব্বান তার ছহিহ, ইমাম বায়হাক্বী তার শুয়াবুল ইমান, ইমাম তাবরানী আল মু’জামুল কাবীর এবং আবু নায়ী’ম আল হুলয়ার মধ্যে এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাইসামী এই হাদিসটি বর্ণনা করারপর বলেন, এই হাদিসটির সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত এবং হাদিসটি সহিহ। এছাড়া ইমাম মুনজারী আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মানসুরে উল্লেখ করেছেন। শাইখ ‎আলবানী তার সিলসিলাতুস সহিহ এর ৩ নং খন্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন। “এই হাদিসটি সহীহ” এটি ‎সাহাবাদের এক জামাত বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। তাদের ‎মাঝে রয়েছেন বিশষ্ট সাহাবী মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), আবু সা’লাবা (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আবু মুসা ‎আশয়ারী (রাঃ), আবু হুরায়রা (রাঃ), আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), আউফ বিন মালিক (রাঃ),  আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ ‎সাহাবাগণ। উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস তিনি তার কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর শেষে ‎তিনি বলেন, সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহিহ, এতে কোন ‎সন্দেহ নেই। আর সহিহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ ‎না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। এমনই কয়েকটি সনদ উল্লেখ করছি।

*** আবি সা’লাবাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত আসে তখন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফকরে দেন। এবং তিনি তাদেরকে তাদের শত্রুতার মধ্যে রেখে দেন।
(ইমাম বায়হাক্বী তার শুয়াবুল ইমান, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মানসুরে ও হাফিজ বিন আছিম কিতাবুস সুন্নাহয় উল্লেখ করেছেন)।

*** অব্দুল্লাহ বিন আ’মর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ যখন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টি জগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। দুই ব্যক্তি, খুনি ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করেদেন। (ইমাম আহমদ তার মুসনাদে ও ইমাম হাইসামী মাজমাউজ জাওয়াইদে ও ইমাম মুনজারী আত- তারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে বর্ননা করেছেন)।

মন্তব্যঃ আল্লামা শায়েখ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ এর বিশ্লেষণ থেকে একথা নির্ধিদ্ধায় আমরা বলতে পারি হাদিস দ্বারা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাতটি প্রমানিত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবানের মধ্য রাতের ক্ষমার বিষয়টিও এই হাদিসে উল্লেখ করছেন। ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত বাক্যটি হাদিসে আসলেও শবে ‎বারাআত নামের কোন শব্দ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই হাদিস দ্বারা শাবানের মধ্য রাত্রির ফজিলতের সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু কোন আমলের প্রমান পাওয়া যায় না।

২। হাদিস নম্বরঃ-২

আবু মূসা আল আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

মন্তব্যঃ হদিসের মান যইফ। আল্লামা বুছীরি বলেন, ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং ১৯৮০)।

এ হাদীসটি দুর্বল। খুব দুর্বল বা বানোয়াট নয়। সে হিসেবে এ রাতের ফজিলত প্রমানিত কিন্তু আমল প্রমানিত নয়। এই সূত্রেই অনেক হাদীসবিদ শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেনঃ ইমাম আহমাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন)।

ইমাম আওযায়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন)।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪)।

ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ছিলছিলাতুল আহাদীস আস্‌সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯)

মন্তব্যঃ এই সকল হাদিসে ফজিলত বর্ননা করা হলেও আমল বর্ণনা করা হয় নাই। তাই এই রাতের বিশেষ নিয়মে ইবাদত করার পদ্ধতি আবিস্কারের করানে অনেক মুহাদ্দিস বিদআত বলেছেন। আমাদের কোন সলফে সালেহিন ফজিলত জানার পরও এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ইবাদত করেন নাই। এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন এবং বিষেশ নিয়মে সারা রাত সালাত আদায় ও পরের দিন সিয়াম পালন করাকে বিদআত বলেছেন।

৩।হাদিস নম্বরঃ-৩

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়। আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)

মন্তব্যঃ হদিসের মান যইফ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন। শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেনঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।

                                                                      

৪। হাদিস নম্বরঃ-৪

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন,  ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেনঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্‌ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি। এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন। অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত। শায়খ বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত অর্থ বহনকারী হাদীছটি কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সকল বর্ণনাই যঈফ বা দূর্বল। দেখুনঃ ইমাম আলবানীর তাহ্কীকসহ মিশকাত (১/২৮৯) হাদীছ নং- ১২৯৯। নির্দিষ্টভাবে এ রাতে আল্লাহর দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার প্রতি আহবান জানানোর হাদীছটি সুনানের কিতাবে যঈফ ও জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া হাদীছটি বুখারীসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত সহীহ হাদীছের কিছুটা বিরোধী। সহিহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেনঃ কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি ক্ষমা করে দিব। অমুক আছে কি? অমুক আছে কি? এভাবে প্রতি রাতেই ঘোষণা করতে থাকেন। দেখুন বুখারী, হাদীছ নং- ১০৯৪, মুসলিম, হাদীছ নং- ১৬৮।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনায় থেকে জানতে পেরেছি হাদিসটির মান যইফ। তারপরও যদি হাদীসটিকে সহিহ বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও কি কোন প্রকার আমল প্রমাণিত। না, এ হাদিস দ্বারা কোন আমল প্রমানিত হয় না। এই হাদিসে দ্বারা তিনটি বিষয় পরিস্কার।

১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক করব জিয়ারত করা

২। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।

৩। কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

যদি কেউ এই হাদিসের আলোকে এই রাতে কবর জিয়ারত করে করতে পারে কিন্তু এই কবর জিয়ারত হবে একাকি, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। তিনি সময় সুযোগ থাকা সত্বেও নিজের স্ত্রী বা সাহাবী কাউকে এ আমলে শরীক করান নাই। এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। কাজেই সম্মিলিতভাবে করব জিয়ারত এই রাতের আমল নয় বিদআত। কিন্তু যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে নানান প্রকারের ইবাদতের মাধ্যমে এই যেভাবে উদযাপন করে, তারা কিভাবে এই হাদিস দিয়ে আমলের পক্ষে দলীল দেয়।

মহান আল্লাহ শুধু মধ্য শাবানের রাত্রি বান্দাদের নিকটবর্তী আকাশে আবির্ভূত এমনটি নয় বরং তিনি প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছে।  

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের রব মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)

উল্লিখিত হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। হাদীসটি প্রসিদ্ধ এবং অনেক আলেম মনে করেন মশহুর হাদীসের বিরোধী বক্তের অংশটুকু সঠিক নয়। কারণ এ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে এবং অন্য হাদিসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অনর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ শুধু শাবান মাসের জন্য খাস করা ঠিক হবে না।

*** এই রাতে ফজিলত আছে, তা হলে আমল করলে ক্ষতি কি?

ফজিলত থাকলেই আমল করার প্রমান বহন করে না। কোন কাজ করলে ইবাদত হবে আর কোন কাজ করলে ইবাদত হবে এর মান দন্ড দিয়েছেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কাজেই কোন আমল দ্বারা মহান আল্লাহকে রাজি খুসি করতে হলে সে আমল অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত হতে হবে। নিজের খেয়াল খুসিমত ইবাদতের পদ্ধতি, সময় সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট করা যাবে না। কোন ইবাদাতের ক্ষেত্রে কোন আলেমের মন্তব্য দলীল নয়, বরং দলীল হল আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বানী ও কাজ (সহিহ হাদিস), যদি এই দু’ইয়ের মধ্যে দলীল থাকে তাহলেই আমল অথবা ইবাদাত করা যাবে আর না থাকলে করা যাবে না।

কোন দিন অথবা রাতের ফযিলত থাকলেই তাতে ইবাদাতকরা যাবে বা করতে হবে এরূপ কোন বিধান ইসলামে নেই। যেমনঃ শুক্রবারের ফজিলত সম্পর্কে কয়েকটি সহিহ হাদিসের দিকে লক্ষ করি।।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম ১৮৫০ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কেয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সব জাতিকে (ইহুদি ও খ্রিস্টান) গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে তাদের পরে। অতপর জেনে রাখো এ দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পেছনে আছে। ইহুদিরা জুমার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খ্রিস্টানেরা তার পরের দিন (রবিবার) উদযাপন করে।’ (সহিহ মুসলিম ১৮৫৪ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

এই হাদিস দ্বারা জুমআর দিনের ফযিলত প্রমানিত। ফযিলত প্রমানিত হলে কি আমল প্রমানিত হয় নিম্মের হাদিস দুটি লক্ষ করি।   

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কোন ব্যক্তি যেন শুধু জুমার দিন সিয়াম না রাখে। হ্যাঁ, জুমার আগের অথবা পরের দিনসহ সিয়াম রাখতে পারে।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান সহিহ। মিশকাত-২০৫১, সহিহ বুখারী ১৯৮৫, সহিহ মুসলিম ১১৪৪, তিরমিযী ৭৪৩, আবূ দাঊদ ২০৯১)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অন্যান্য রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল জুমাকে ‘ইবাদাত বন্দেগীর জন্য খাস করো না। আর ইয়াওমুল জুমাকেও (জুমার দিন) অন্যান্য দিনের মধ্যে সিয়াম জন্য নির্দিষ্ট করে নিও না। তবে তোমাদের কেউ যদি আগে থেকেই অভ্যস্ত থাকে, জুমাহও এর মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে জুমার দিন সিয়ামে অসুবিধা নেই।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান সহিহ। (মিশকাত-২০৫২, মুসলিম ১১৪৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৯০, সহীহাহ্ ৯৮০, সহীহ আল জামি‘ ৭২৫৪)।

উপরের হাদীস থেকে প্রমানিত হয় যে জুমআর দিন খাস করে কোন প্রকার সিয়াম পালন করা যাবে না। তবে হ্যা, যারা নিয়মিত সিয়াম আদায় করে তারা রাখতে পারে বা এর সাথে আরেক দিন বাড়িয়ে সিয়াম পালনের নির্দেষ প্রদান করে। ঠিক তেমনিভাবে এ উপলক্ষে কোন ইবাদাত করা যাবে না, কিন্তু জুম’আর দিনের ফযিলত তো রয়েছে। তার পরও জুম’আর দিন উপলক্ষে ইবাদাত করা যাবে না।

এছাড়াও ফযিলতের সাথে ইবাদাতের কোন সম্পর্ক নেই, এর আরেকটা উদাহরন হল লাইলাতুল ক্বাদর।
আমরা জানি যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল ক্বাদর এর ফযিলত সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং ইবাদাত সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। যদি এমনটি হত যে ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করতে হবে বা করা যাবে তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল ক্বাদর এর ইবাদাতের ব্যাপারে কিছু বলতেন না শুধু মাত্র ফযিলতের কথাই বলতেন, কেননা ফযিলতের কথা বললে ইবাদাত এমনিতেই করবে, কিন্তু তিনি এমনটি করেন নি বরং ফযিলতের সাথে সাথে ইবাদাতের কথাও বলেছেন, এটাই প্রমান করে যে ফযিলতের সাথে ইবাদাত সম্পৃক্ত নয়। কেননা যদি সম্পৃক্ত থাকতো তাহলে ইবাদাতের কথা আর বর্ণনা করার প্রয়োজন পড়তো না কারন ফযিলতের বিষয় তো বর্ণনা করা হয়েছে। ফযিলত থাকলেই ইবাদাত থাকবে এমন কোন কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় ছিল না, এটাই তার প্রমান।

জুম’আর দিনের তো ফযিলত রয়েছে তার পরও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুম’আর দিন উপলক্ষে বাড়তি ইবাদাত করতে নিষেধ করাতে এটাই প্রমান হয় যে ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করা বৈধ হবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য ইবাদাতের নির্দেশ থাকতে হবে।

সুতরাং ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করা যাবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য কুরআন ও সহিহ হাদিস থেকে দলীল প্রয়োজন। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে নেই, তা তার উপর নিক্ষিপ্ত হবে। (সহিহ বুখালী ২৬৯৭)।

সুতরাং প্রকৃত পক্ষেই লাইলাতুর নিসফে মিন শাবার বা মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ পাক মুশরিক ও সুন্নত বিরোধী অথবা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যাক্তি ব্যাতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এই রাতের ফযিলত স্বীকার করেছেনঃ

১। ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (কিতাবুল উম্ম, ১মখণ্ড, পৃঃ ২৩১)

২। ইমাম আহমাদ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।(ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতেমুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন)

৩। ইমাম আওযায়ী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন)

৪। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ইকতিদায়ে ছিরাতেমুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪)।

৫। ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। [তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]।
৬।প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ছিলছিলাতুল আহাদীস আসসাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯)

***  বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতি কাজী ইবরাহিম

সুতরাং লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান অথবা শবে বরাতের ফযিলত প্রমানিত। যারা এই রাতে ইবাদাতের পক্ষে কথা বলেন তারা এই বলে যুক্তি দেন যে, ফযিলতপূর্ণ রাত কি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিব? এটা তো অযৌক্তিক। এছাড়া তাদের আর কোন দলীল ও যুক্তি নেই। এই রাতে ব্যাক্তিগত ইবাদাত করার পক্ষে মত দিয়েছেনঃ

১. ইমাম আওযা‘য়ী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

২. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৩. আল্লামা ইবনে রজব রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

১১। এই রাত উপলক্ষে যে কোন ইবাদাত করা কে বিদ’আত বলেছেনঃ

১। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

২। ইবনে আবি মুলাইকা রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৩। মদীনার ফুকাহাগণ

৪। প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৫। ইমাম মালেকের ছাত্রগণ

৬। শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

তবে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ এই রাতকে কেন্দ্র করে কোন ইবাদাত এর পক্ষে বা বিপক্ষে মত দিয়েছেন বলে যানা যায় না।

৫। হাদিস নম্বরঃ-৫

আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন, হে আয়িশা অথবা হে হুমায়রা! তুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন? আমি বললামঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা “লাইলতুল নিসফে মিন শাবান” বা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)

মন্তব্যঃ হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়। কেননা বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।

৬। হাদিস নম্বরঃ-৬

শবে বরাত পালনকারীগন যে হাদিসের আলোকে রাতে সালাত আয়াদ করে দিনে সিয়াম পালন করে তা হল, আলী ইবনে আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্য অস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থনাকারী আমি রিজিক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যান্ত বলা হয়ে থাকে। (হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে ১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮; বর্ণনা করেছেন; বাইহাকীদে হাদিসটি আছে) 

মন্তব্যঃ এই হাদিসটি জাল। আল্লামা বুছীরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীসটির বর্ণনাকারী হিসাবে ইবনে আবি সুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন বা জাল করতেন। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল বা যইফ। অপর পক্ষে একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহিহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট। হাদিস জাল রচনাকারী একজন রাবী থেকে এরূপ আরেকটি হাদিস ইবনে মাজাহ উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি হলঃ শাবান মাসের মধ্যরাত এলে তোমরা রাতে কিয়াম কর এবং দিনে ছিয়াম পালন কর। এই হাদীছের সনদে ইবনে আবু সাবরাহ নামক একজন জাল হাদীছ রচনাকারী রাবী থাকার কারণে হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে যাঈফা, হাদীছ নং- ২১৩২)

মন্তব্যঃ এই হাদিসটি জাল বিধান এর কোন প্রকার হুকুম মানা যাবে না। উম্মতের মাঝে ঐক্যমত আছে কোন প্রকারের জাল হাদিসের উপর আমল করা যাবে না। এই হাদিসে বলা  হয়েছে, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত আত্মভোলা নয় যে তিনি সালাত ও সিয়ামের কথা বলবেন বলতে ভুলে গেলের।

৭। হাদিস নম্বরঃ-৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।

মন্তব্যঃ  হাদিসটির মান জাল। ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়। অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

৮। হাদিস নম্বরঃ-৮

যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে রুহ বের হবে না।

হাদিসটির মানঃ হাদিসটির মান জাল। এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম (রাহ:) আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন)।

***  হাদিসে এই রাতের আমল সম্পর্কে কোন প্রমান আছে কি?

উপরের হাদিসগুলি থেকে এ কথা স্পষ্ট যে হাদিসের কোথাও শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাত নামের কোন রাতের কথা বলা হয়নি। কিন্তু কিছু হাদিসে‘ লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি ফজিলত বর্নিত হয়েছে। ইহার মধ্য একটি যঈফ হাদিস কয়েকটি সনদের কারনে নাসিরউদ্দন আলবাণী রাহিমাহুল্লাহ হাদিসটি সহিহ বলেছেন (হাদিস নম্বর-১)। বাকি সবগুলি (হাদিস নম্বর ২-৮) হয় যঈফ না হয় জাল। বহু গবেষনার পর শাইখ বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “শবে বরাত সম্পর্কিত সকল হাদিস হয় জাল, না হয় যঈফ”।  যে হাদিসে (৬ নম্বর) দিনে সিয়াম ও রাতে কিয়ামের কথা বলা হয়েছে সে হাদিসটি কিন্তু জাল। এই জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করেই শবে বরাতের দিনে সিয়াম ও রাতে কিয়ামের আমল যুগ যুগ ধরে মুসলীম সমাজে চালু আছে। এই ব্যাপারের আলেমগন ঐক্যমত প্রষণ করেছেন যে, সকল প্রকারের সহিহ হাদিসের উপর আমল করা যাবে এবং কোন জাল হাদিসের উপর আমল করা যাবে না। কিন্ত যঈফ হাদিসের উপর আমলের ক্ষেত্র দুটি মত পাওয়া যায়। আলমদের একদল বলছেন, যঈফ হাদিস থেকে কোন প্রকার আমল করা যাবে না। অন্যদল বলছেন, যঈফ হাদিসের উপর আমল করা যাবে। কিন্তু লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত্রি ফজিলত বর্ণিত হাদিস দ্বারা আমলের রেওয়াজ চালু করার কোন যুক্ত নেই। যদি কোন আমল করা খাস হত তবে আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ছাড়তেন না। কমছে কম কোন সাহাবি দ্বারা এর প্রমান পাওয়া যেত। অথচ কোন সহিহ বা যঈফ হাদিসে আমলের কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যে সকল হাদিসে আমলের ঘ্রান পেলাম তা জাল। আর উম্মতের মাঝে ইজমা বা ঐক্যমত হল জাল হাদিসের উপর আমল করা জায়েয নয়।

বিদআতের উৎপত্তি আলোচনা সহিহ, যঈফ, হাসান ও জাল সম্পর্কে আলোচ করছি। ঐ আলোচনায়  দেখেছি মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদিসের মধ্যে পাঁচটি (আদালত, যাবত, ইত্তিসাল, শুযূয মুক্তি, ইল্লাত মুক্তি) শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহিহ হাদিস বলা হয়।

হাসান হাদিসঃ উপরোক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। তবে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে যদি সামান্যতম দূর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ (সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য হাদীস) বলা হয়।

যঈফ বা দুর্বল হাদীসঃ যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলির মধ্যে কোনো একটি অবিদ্যমান থাকে, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়।

মাউযূ বা জাল হাদীসঃ যদি প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ (স) এর নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র (সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কম বেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। এমন কি এরা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নাম ব্যবহার করে হাদিস বানিয়েছেন।  অনেক সময় কিছু পীর, দরবেশ, আলেমগন নিজেরাই হাদিস বানিয়ে প্রচার করেছেন কোন বিশেষ স্বার্থে। মাউযূ বা জাল হাদীস হাদিস গ্রহনের ফলে যুগে যুগে মুসলীমদের আকিদা ও আমলের ক্ষেত্রে বহু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে।

কাজেই বুঝতে পারছেন জাল হাদিস দ্বারা কোন প্রকার আমল করা যাবে না এবং প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বিধান প্রমাণ করা যায় না। তারা দুর্বল হাদীসের উপর আমল করার জন্য যে শর্ত লাগিয়েছেন তাও আলোচন করা হয়েছে। এই শর্তাবলীর আলোকে যদি উপরোক্ত হাদীসগুলো পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহের মধ্যে ৬ নম্বরে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসটিসহ ৭ এবং ৮ নম্বর হাদিস দুটি জাল বা বানোয়াট। সুতরাং তার উপর আমল করা উম্মাতের আলেমদের ঐক্যমতে জায়েয হবে না। আর ১ নম্বর থেকে ৫ নম্বর পর্যান্ত হাদিসে মধ্য শাবানের ফজিলত বর্ণনা করলেও কোন প্রমান আমলের কথা নেই। তাই নির্দিধায় বলা যায় শবে বরাত তথা মধ্য শাবান রাতের কোন আমল নেই। যদি কেউ অন্য রাতের মত এ রাতেও আমল করে ক্ষতি নেই। কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্মিলীতভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা বিদআত হবে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment