মিনায় অবস্থানের সময় কাল বা আইয়ামে তাশরিক

মিনায় অবস্থানের সময় কাল বা আইয়ামে তাশরিক

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১০ জিলহজ্জ মুজদালিফায় থেকে ফজরের পর রওয়ানা দিয়ে মিনায় খুব সকালে পৌছে, বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। দিনের বেলায় কুরবানী, তাওয়াফ ও মাথা মুন্ডনসহ হজ্জ সংশ্লিষ্ট কাজে করে রাতে মিনায় থাকতে হবে। যদি হজ্জ সংশ্লিষ্ট কাজ বাকি থাকে তবে ১১ জিলহজ্জ তারিখ সকালে করার চেষ্টা করতে হবে। এই দিন বিকালে তিনটি জামারার প্রতিটটিতে সাতটি করে মোট ২১ পাথার মারতে হবে এবং দিবাগত রাত মিনায় থাকতে হবে। মাজুর না হলে হজ্জের কোন আমল বাকি থাকার কথা না। তাই ১২ জিলহজ্জ তারিখ সকালে মিনায় বিশ্রাম করে বিকালে তিনটি জামারার প্রতিটটিতে সাতটি করে মোট ২১ পাথার মারতে হবে। যদি সম্বম হয় কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোন কারনে যদি ১২ তারিখ সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারেন তবে এই রাতও মিনায় থাকতে হবে।  তখন যথারীতি ১৩ জিলহজ্জ কঙ্কর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করতে হবে।

মনে রাখত হবে, রাতের বেশির ভাগ কিংবা অর্ধরাত অবস্থানের মাধ্যমে রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। এ হুকুম তাদের জন্য যাদের পক্ষে মিনায় অবস্থান করা সহজ এবং যারা তাঁবু পেয়েছে। পক্ষান্তরে যারা মিনায় তাঁবু পাননি বরং তাদের তাঁবু মুযদালিফার সীমায় পড়ে গেছে, তাদের তাঁবু যদি মিনার তাঁবুর সাথে লাগানো থাকে, তবে তারা তাদের তাঁবুতে অবস্থান করলেই মিনায় রাত্রিযাপন হয়ে যাবে।

এককথায় ১০ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ মিনায় থাকা ওয়াজিব। ১২ তারিখ সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারেলে ১৩ জিলহজ্জ মিনায় থাকতে হবে।

দলিলঃ

১. আবদুর রহমান ইবনু ইয়া‘মুর আদ্ দায়লী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি ‘আরাফাই হচ্ছে হজ্জ। যে ব্যক্তি ‘আরাফায় মুযদালিফার রাতে (৯ যিলহজ্জ শেষ রাতে) ভোর হবার আগে ‘আরাফাতে পৌঁছতে পেরেছে সে হজ্জ পেয়ে গেছে। মিনায় অবস্থানের সময় হলো তিনদিন। যে দুই দিনে তাড়াতাড়ি মিনা হতে ফিরে আসলো তার গুনাহ হলো না। আর যে (তিনদিন পূর্ণ করে) দেরী করবে তারও গুনাহ হলো না। (মিসকাত ২৭১৪, আহমাদ ১৮৭৭৪, দারিমী ১৯২৯, ইবনু হিব্বান ৩৮৯২।

আইয়ামে তাশরিকের ফজিলতঃ

এ দিনগুলো ইবাদত-বন্দেগী, আল্লাহ রাববুল আলামীনের যিকর ও তাঁর শুকরিয়া আদায়ের দিন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ ۞وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ﴾

অর্থঃ আর আল্লাহকে স্মরণ কর নির্দিষ্ট দিনসমূহে। (সুরা রাকারা ২:২০৩)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ’ বলতে আইয়ামুত-তাশরীক বুঝানো হয়েছে। (সহিহ বুখারী ঈদ অধ্যায়ের ভুমিকা)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আইয়ামুত-তাশরীক হলো, খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহ রাববুল আলামীনের যিকরের দিন। (সহিহ মুসলিম ১১৪১)

ইমাম ইবন রজব রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, আইয়ামুত-তাশরীক এমন কতগুলো দিন যাতে ঈমানদারদের দেহ-মনের নিয়ামত তথা স্বতঃস্ফূর্ততা একত্র করা হয়েছে। কারণ, খাওয়া-দাওয়া দেহের খোরাক আর আল্লাহর যিকর ও শুকরিয়া মনের খোরাক। আর এভাবেই এ দিনসমূহে নিয়ামতের পূর্ণতা লাভ করে।

. আইয়ামুত-তাশরীক তথা তাশরীকের দিনগুলো ঈদের দিন হিসেবে গণ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আরাফার দিন, কুরবানীর দিন ও মিনার দিনগুলো (কুরবানী পরবর্তী তিন দিন) আমাদের তথা ইসলাম অনুসারিদের ঈদের দিন। (আবূ দাউদ : ২৪১৯)

জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের আমল ও ফজিলতঃ

মহান আল্লাহ তায়াল আমাদের জন্য চারটি মাস পবিত্র এ সম্মানিত করেছেন। এই মাসগুলোর মধ্যে জিলহজ্জ মাস অন্যতম। এই মাসের প্রথম দশদিনের আবার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হজ্জ এই মাসের প্রথম দশকেই হয়ে থাকে। কুনআন সুন্নাহে তাই এই মাসের প্রথম দশদিনের বেশ গুরত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে।  এই দশকের সম্মান ও পরিত্রতা প্রকাশান্তে এই দশকের রাতের নামে মহান আল্লাহ শপথ করে ইরশাদ করেন, 

وَٱلۡفَجۡرِ (١) وَلَيَالٍ عَشۡرٍ۬ (٢) وَٱلشَّفۡعِ وَٱلۡوَتۡرِ (٣)

অর্থঃ শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির, শপথ তার, যা জোড় ও যা বিজোড়। (সুরা ফাজর ১-৩)

সুরা ফজরের আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ লিখেন, দশ রজনী দ্বারা জিলহজ্জ মাসের প্রথশ দশ রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। এই কথা ইবনে আব্বাস রাঃ, ইবনে জুবায়ের রাঃ ও মুজাহীদ রহঃ এবং আগে পরের বহু গুরুজন বলেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ ٢٨ ﴾

অর্থঃ যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। (সুরা হজ্জ আয়াত ২৮)

‌এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ বলতে কোনো দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ সহিহ বুখারির ৯৬৯ নম্বর হাদিসের শিরোনামে বলেন,

ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) বলেন, وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ  مَعْدُودَاتٍ   (সূরা বাকরাহ ২:২০৩) দ্বারা (যিলহাজ্জ মাসের) দশ দিন বুঝায় এবং   مَعْدُودَاتٍ  দ্বারা ‘আইয়ামুত তাশরীক’ বুঝায়। ইবনু ‘উমার ও আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) এই দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত। মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী (রহ.) নফল সালাতের পরেও তাকবীর বলতেন।

ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোন দিনের ‘আমলই উত্তম নয়। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ছাড়া যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না। (সহিহ বুখারি ৯৬৯)

জিলহজ্জের প্রথম দশদিনের ফজিলতঃ

১. ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহর নিকট যে কোনো দিনের সৎ আমলে চেয়ে যিলহজ্জ (হজ্জ) মাসের দশ প্রথম দিনের আমলের অধিক প্রিয়। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? তিনি বললেনঃ না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে জিহাদে বের হয় এবং কোনো একটি নিয়েও ফিরে না আসে তার কথা স্বতন্ত্র। (আবূ দাউদ : ২৪৩৮)

২. ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এমন কোন দিন নেই যে দিনসমূহের সৎকাজ আল্লাহ্ তা’আলার নিকট যুলহিজ্জা মাসের এই দশ দিনের সৎকাজ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ করাও কি (এত প্রিয়) নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ তা’আলার পথে জিহাদও তার চেয়ে বেশি প্রিয় নয়। তবে জান-মাল নিয়ে যদি কোন লোক আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদে বের হয় এবং এ দুটির কোনটিই নিয়ে যদি সে আর ফিরে না আসতে পারে তার কথা (অর্থাৎ সেই শহীদের মর্যাদা) আলাদা। (তিরমিজি ৭৫৭)

৩. আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়। (মুসনাদ আহমদ ২/৭৫)

উপরের হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ সময়টার ফযীলত প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এই দশকে নিম্মের আমলগুলো করা যেতে পারেঃ

ক। হজ্জ ও উমরা পালন করাঃ

হজ্জ ও উমরা আদায়ের ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই দশকের বাহিরে হজ্জ করার কোন প্রশ্নই উঠেনা কেননা এই মাসের ০৮ তারিখ ইহরাম বেধে মিনায় যায়, ০৯ তারিখ আরাফাতের অবস্থানের মাধ্যমে হজ্জ শুরু করে। ১০ তারিখ হজ্জের বাকি কাজগুলো করে সময় কাটায়। ইসলামি শরীয়তে এর কোন বিকল্প নাই। তবে এই মাসের বাহিরে যে কোন সময উমরা করা যায়। রমজান মাসের উমরার ফজিলত বেশী বর্ণিত হয়েছে।

খ। কুরবানি করাঃ

এই সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই মাসের কত তারিখে, কখন কিভাবে কুরবানি করতে হবে। কুরবানির হুকুম কি? এর ফজিলতও বর্নণা করা হয়েছে। কাজেই সামর্থবানদের উচিত এই মাসের কুরবানি করা।

গ। কুরবানী আদায়কারী চুল ও নখ কাটবে নাঃ

যারা কুরাবানীর নিয়ত করবে তারা এই ১০ তিন চুল ও নখ কাটবে না। এই মর্মে বহু সহিহ হাদিস আছে। যেমনঃ

১. উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন (যিলহাজ্জ মাসের) প্রথম দশদিন উপস্থিত হয় আর কারো নিকট কুরবানীর পশু উপস্থিত থাকে, যা সে যাবাহ করার নিয়্যাত রাখে, তবে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (সহিহ মুসলিম ৫০১২, আবু দাউদ ২৭৯১)

২. নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে লোকের কাছে কুরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহাজ্জের নতুন চাঁদ দেখার পর ঈদের দিন থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।(সহিহ মুসলিম ৫০১৫)

ঘ এই দশকের পুরাটাই সিয়াম পারন করা বিশেষ করে আরাফার দিনের সিয়ামঃ

১. আবূ কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আমি আল্লাহ্‌ তা’আলার নিকট আরাফাতের দিনের রোযা সম্পর্কে আশা করি যে, তিনি এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (সুনানে তিরমিজি ৭৪৯ ও ইবনু মাজাহ ১৭৩০)

২. আবূ ক্বাতাদাহহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আরাফার দিনের রোযা রাখলে আল্লাহ্‌র নিকট আশা রাখি যে তিনি বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহিহ মুসলিম ১১৬২)

আরাফার দিনের সিয়াম পালন একটি সুন্নাহ সম্মত ও ফজিলত পূর্ণ আমল কিন্তু এই দিনের সিয়ামের অনেক ফজিলত হলেও হাজিগণ যারা এই দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করবেন তারা রাখতে পারবেন না। বিশেষ করে মাঠে অবস্থানকারী হাজীদের জন্য ঐ দিন রোযা না রাখা মুস্তাহাব। নিম্মের হাদিসটি একটু লক্ষ করুন।

১. মায়মূনাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, কিছু সংখ্যক লোক ‘আরাফাতের দিনে আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সওম পালন সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলে তিনি স্বল্প পরিমাণ দুধ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট পাঠিয়ে দিলে তিনি তা পান করলেন ও লোকেরা তা প্রত্যক্ষ করছিল। তখন তিনি (‘আরাফাতে) অবস্থান স্থলে ওকূফ করছিলেন। (সহিহ বুখারি ১৯৮৯)

২. উম্মু ফাযল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আরাফার দিনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সিয়াম এর ব্যাপারে লোকজন সন্দেহ করতে লাগলেন। তাই আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট শরবত পাঠিয়ে দিলাম। তিনি তা পান করলেন। (সহিহ বুখারী ১৬৫৮ তাওহিদ এবং ১৫৫৫ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ আরাফার দিনে হাজিদের সিয়াম পালণ একটি ভুল আমল।

ঙ। খাঁটি তওবা করাঃ

তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। মহান আল্লাহ আদেশ অমান্য করে যে সকল কাজ করা হয়েছে তা থেকে এই তওবা করা। অতীতে যে সকল আদেশ অমান্য করেছে তার জন্য অনুতপ্ত হবে, ভবিশ্যতে আর করবেনা এবং বান্দার হক থাকরে তা মিটিয়ে ফেলাম নামই তওবা। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আল্লাহর নাফরমানি না করা ও তার হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। এ দিন গুলোতে তাওবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ يَوۡمَ لَا يُخۡزِي ٱللَّهُ ٱلنَّبِيَّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥۖ نُورُهُمۡ يَسۡعَىٰ بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَبِأَيۡمَٰنِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَتۡمِمۡ لَنَا نُورَنَا وَٱغۡفِرۡ لَنَآۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٨ ﴾

অর্থঃ হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা তাহরিম ৮)

চ। ফরজ সালাতের পাশাপাশি নফল সালাত আদায় করাঃ

ফরয ও নফল সালাতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা। অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরয সালাতগুলো সময় মত সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল সালাত আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। 

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি শুধুমাত্র তা দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না বরং আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত দ্বারা আমার অধিক নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে কোন দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।(সহিহ বুখারি ৬৫০২)

ছ। বেশী বেশী দোয়া, জিকির ও কুরআন তিলওয়াত করাঃ

বান্দার আমলের সময়ই আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে প্রিয়। সকল প্রকারে আমলে আগে প্রস্ততি দরকার হয় কিন্তু দোয়া, জিকির ও কুরআন তিলওয়াতের জন্য কোন প্রকার পূর্ব প্রস্ততি প্রয়োজন নাই। তাই এই বরকতময় দিনগুলোতে বেশী বেশী দোয়া, জিকির ও কুরআন তিলওয়াত করা। এই দিনগুলিতে জিকিরের নির্দেশ আল্লাহই দিয়েছেন। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ ٢٨ ﴾

অর্থঃ যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। (সুরা হজ্জ আয়াত ২৮)

মন্তব্যঃ নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে বলা হয়েছে। এর অর্থ হলে এই জিলহজ্জের শেষ দশকে স্মরণ করা। আর স্মরনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম জিকির ও দোয়া।

১. আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লাইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর।’ (মুসনাদে আহমদ ৫৪৪৬, বায়হাকি ৩৭৫০, ত্ববারানী ১১১১৬)

জ। উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা

এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাববুল আলামীনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদে, বাড়ি-ঘরে, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। তবে মহিলাদের তাকবীর হবে নিম্ন স্বরে। তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপঃ

اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ وَلِله الحَمْدُ.

(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ)

যিলহজ্জ মাসের সূচনা হতে আইয়ামে তাশরীক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবীর পাঠ করা সকলের জন্য ব্যাপকভাবে মুস্তাহাব। তবে বিশেষভাবে আরাফা দিবসের ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর উক্ত তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।

সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “মিনায় অবস্থানের সময় কাল বা আইয়ামে তাশরিক

Leave a comment