রামাদান মাসের কিছু ভুল আমল : প্রথম কিস্তি

রামাদান মাসের কিছু ভুল আমল : প্রথম কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। আমাদের সম্পুর্ণ দেশে একই সাথে ও শেষ না করা একটি বিদআতঃ

আমাদের দেশে রমজান শুরু ও শেষ নিয়ে আজ কাজ বেশ মত বিরোধ দেখা যায়। মিডিয়ার কল্যানে দেখা যায় সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে বেশ কিছু স্থানে আগেই ঈদুল ফিতর আদায় করে থাকে। চাঁদ দেখার উপর ভিত্তিকরে সিয়াম শুরু করা নিয়ম ইসলাম স্বীকৃত। নিজে না দেখেও নির্ভর যোগ্য সংবাদের ভিত্তিতেও সিয়াম শুরু করার বিধান আছে। এই দুটি বিধানের উপর ভিত্ত করে মুলত মত বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদ দেখার নির্ভর যোগ্য সংবাদের ভিত্তিতেও সিয়াম শুরু করা হবে ঠিক আছে কিন্তু যিনি চাঁদ দেখলের তিনি কত দুরত্বে অবস্থান করতে পারবে? এই উত্তরে কেউ বলেছেন নিজের দেশের মধ্য হতে হবে, আবার কেউ বলছেন না পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে নতুন চাঁদ দেখা গেলেই সিয়াম শুরু হবে। ইসলামি শরীয়তে নির্দিষ্ট দুরত্ব ঠিক করে ষ্পষ্ট কোন বিধান নাই বিধায় এই ভিন্ন  চিন্তাধারা থেকেই উম্মতের মাঝে মতভেদের সৃষ্টি হয়ছে। তাই আসুন বিষয়টি নিয়ে ইসলামি চিন্তাবীদগন কি বলেন একটু দেখে আসি। চাঁদের উপর ভিত্তি করে সিয়াম শুরু ও ঈদ উদযাপন করা সম্পর্কে দুটি আধুনসিক ফতওয়া উল্লেখ করলাম আশা করি ইহার ফলে এ সমস্যার অনকেটা সমাধান হবে।

প্রথম ফতওয়াঃ সৌদি আরবের বিশিষ্ট আলেম শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আবদুল্লাহ ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ এর ফতওয়াঃ

শাইখ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ কে প্রশ্ন করা হয়ঃ যদি কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে চাঁদ দেখা যায়, আর  আমি যে দেশে বসবাস করি, সেখানে শাবান ও রমজান মাস ত্রিশ দিনে পুরো করা হয়, তাহলে আমি কী করব? রমজান প্রসঙ্গে মানুষের মতপার্থক্যের কারণ কী?

তিনি জবাব দেনঃ  আলহামদুলিল্লাহ, আপনার জন্য রোযা আপনার দেশের লোকদের সাথে থাকাই আবশ্যক। তারা যদি রোযা রাখে তাদের সাথে রোযা রাখবেন; আর তারা যদি রোযা না রাখে তবে আপনিও তাদের সাথে রোযা রাখবেন না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّونَ»

অর্থঃ ‘তোমরা যেদিন রোযা রাখবে সেদিনই রোযা, যেদিন ইফতার করবে সেদিনই ইফতার, আর তোমরা যেদিন কোরবানি করবে সেদিনই কোরবানি।’’ (তিরমিযী : ৬৯৭)

দ্বিতীয়তঃ  ইখতিলাফ ভাল জিনিস নয়, তাই আপনার দেশের সাথে থাকাই আপনার জন্য জরুরি ও সঙ্গত। আপনার দেশের মুসলিমগণ যখন রোযা করবেন না, আপনি তাদের সাথে রোযা না করবেন। আর যখন তারা রোযা রাখবে আপনি তাদের সাথে রোযা রাখবেন।

আর মত পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, কেউ চাঁদ দেখে, কেউ চাঁদ দেখে না। অতপর যারা চাঁদ দেখে, অন্যরা তাদের উপর ভরসা করে, তাদেরকে বিশ্বাস এবং তাদের দেখা অনুযায়ী আমল করে। আবার কখনো তাদের বিশ্বাস কিংবা তাদের দেখা অনুযায়ী আমল করা হয় না, ফলে ইখতিলাফ সংঘটিত হয়। কোনো দেশ চাঁদ দেখে এবং চাঁদ দেখার ফয়সালা দেয়, ফলে দেশবাসী রোযা রাখে অথবা ইফতার করে। আর অন্য দেশ এ দেখার উপর ভরসা কিংবা বিশ্বাস করে না- ভৌগলিক কিংবা রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণে।

সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যিক হল চাঁদ দেখেই রোযা রাখবে আবার চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গবে করবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস ব্যাপকঃ

«إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَصُومُوا ثَلَاثِينَ يَوْمًا»

অর্থঃ ‘যখন তোমরা চাঁদ দেখবে রোযা রাখবে, আবার যখন চাঁদ দেখবে ইফতার করবে। আর আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন হয়, তবে সংখ্যা ত্রিশ দিন পূরণ করবে।’’ (মুসলিম : ১০৮১)

যদি সকলে চাঁদ দেখা বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে, বাস্তবিকই তা দেখা গেছে, তবে সে হিসেবে রোযা রাখা ও ইফতার করা ওয়াজিব। হ্যাঁ, যদি বাস্তবতার ব্যাপারে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, আর কেউ কাউকে বিশ্বাস না করে, তখন আপনার জন্য সঙ্গত হবে আপনার দেশের মুসলমানদের সাথে রোযা রাখা এবং তাদের সাথে ইফতার করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

«الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّونَ»

অর্থঃ ‘তোমরা যেদিন রোযা রাখবে সেদিনই রোযা, যেদিন ইফতার করবে সেদিনই ইফতার, আর তোমরা যেদিন কোরবানি করবে সেদিনই কোরবানি।’’ (তিরমিযী : ৬৯৭)।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে প্রমাণিত, কুরাইব তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, শাম দেশের লোকেরা জুমুআর দিন রোযা রেখেছে। ইবনে আব্বাস বললেন, আমরা চাঁদ দেখেছি শনিবার, আমরা যতক্ষণ না চাঁদ দেখব রোযা রাখব না, অন্যথায় ত্রিশ দিন পূর্ণ করব।

তিনি শামবাসীদের চাঁদ দেখার উপর আমল করেন নি, যেহেতু উভয় দেশের মাঝে দূরত্ব অনেক বেশী এবং উভয়ের উদয়স্থলও ভিন্ন। তাঁর দৃষ্টিতে এটা ইজতেহাদের বিষয়। ইবনে আব্বাস এবং তার অনুসরণ করে যারা বলেছেন, নিজ দেশের সাথে রোযা এবং নিজ দেশের সাথে ইফতার করার জন্য, তাদের মতই আমাদের জন্য অনুসরণীয়। শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, মজমু ফাতওয়া ওয়ামাকালাত মুতানাওয়েয়াহ, অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ, সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব)।

শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, যে হাদিটির কথা উল্লেখ করেছেন সেই হাদিসটি হলঃ

কুরাইব বলেন, একদা উম্মুল ফাযল বিনতে হারেষ আমাকে শাম দেশে মুআবিয়ার নিকট পাঠালেন। আমি শাম (সিরিয়া) পৌঁছে তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করলাম। অতঃপর আমার শামে থাকা কালেই রমাযান শুরু হল। (বৃহস্পতিবার দিবাগত) জুমআর রাত্রে চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষ দিকে মদ্বীনায় এলাম। আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) আমাকে চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘আমরা জুমআর রাত্রে দেখেছি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি নিজে দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ। আর লোকেরাও দেখে রোযা রেখেছে এবং মুআবিয়াও রোযা রেখেছেন।’ ইবনে আববাস (রাঃ) বললেন, ‘কিন্তু আমরা তো (শুক্রবার দিবাগত) শনিবার রাত্রে চাঁদ দেখেছি। অতএব আমরা ৩০ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অথবা নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখতে থাকব।’ আমি বললাম, ‘মুআবিয়ার দর্শন ও তাঁর রোযার খবর কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?’ তিনি বললেন, ‘না। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে এ রকমই আদেশ দিয়েছেন।’ (মুসলিম ১০৭৮ নং)

 দ্বিতীয় ফতওয়াঃ

চাঁদ উঠার বিভিন্ন উদয়স্থল সংক্রান্ত মতভেদ কি বিবেচনাযোগ্য? এ ব্যাপারে অমুসলিম দেশে মুসলিম কমিউনিটির অবস্থান সম্পর্ক সৌদি আরবের সর্বচ্চো উলামা পরিষদের ফতওয়া বোর্ড “ফাতাওয়া আল-লাজ্‌নাহ আদ-দা’ইমাহ” এর সিদ্ধান্ত।

প্রশ্ন: আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কিছু মুসলিম ছাত্র। প্রতি বছর রমযান মাসের শুরুতে আমাদের একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যা মুসলিমদের তিনটি দলে ভাগ করে দেয়ঃ

  এক দল, তারা যে দেশে বাস করে সে দেশের চাঁদ দেখে সাওম রাখে।

  এক দল, যারা সউদি আরবে সিয়াম শুরু হলে সাওম পালন করে।

 এক দল, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নের খবর (নতুন চাঁদ দেখার) পৌঁছলে সাওম রাখে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে। তারা (সেই মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন) দেশের কোন স্থানে চাঁদ দেখলে বিভিন্ন সেন্টারসমূহে তা দেখার খবর পৌঁছে দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিমরা একই দিনে সাওম পালন করে যদিও এই শহরগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত।

এক্ষেত্রে সিয়াম পালন, চাঁদ দেখা ও এ সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে কারা বেশি অনুসরণ যোগ্য?

আমাদের এ ব্যাপারে দয়া করে ফাতওয়া দিন, আল্লাহ আপনাদেরকে পুরস্কৃত করুন, সাওয়াব দিন।

উত্তরঃ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

প্রথমতঃ:

নতুন চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল থাকার ব্যাপারটি ইন্দ্রিয় ও ‘আক্বল (বুদ্ধি) দ্বারা অবধারিতভাবে জানা বিষয়গুলোর একটি। যে ব্যাপারে ‘আলিমগণের কেউ দ্বিমত পোষণ করেন নি। তবে মুসলিমদের ‘আলিমগণের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনাযোগ্য কিনা তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ

ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল এবং তা বিবেচনাযোগ্য না হওয়ার মাসআলাটি তাত্ত্বিক মাসআলাগুলোর একটি, যাতে ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে। জ্ঞান ও দ্বীনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞজনদের মাঝে এ ব্যাপারে ইখতিলাফ (দ্বিমত) আছে। আর এটি এমন একটি গ্রহণযোগ্য মতভেদ যে ব্যাপারে সঠিক মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) দুইবার সাওয়াব পাবেন-ইজতিহাদ করার সাওয়াব ও সঠিক মত প্রদান করার সাওয়াব এবং ভুল মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) শুধু ইজতিহাদ করার সাওয়াব পাবেন।

এই মাসআলাটিতে ‘আলিমগণ দুটি মত প্রদান করেছেনঃ

ক. তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেছেন।

খ. আবার তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেননি।

তবে উভয়পক্ষই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল দিয়েছেন, এমনকি একই পাঠ থেকে দলীল দিয়েছেন। কারণ তা দুটি মতের সপক্ষেই দলীল হিসেবে পেশ করা যায়। আর তা আল্লাহ্‌র-তা‘আলার বাণীঃ

*يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ*

অর্থঃ তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ (গণনা) এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (সুরা বাকারা ২:১৮৯)।

এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীঃ তিনি বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” (সহিহ বুখারী ১৯০৯, সহিহ মুসলিম ১০৮১)।

আর এ ভিন্ন মতভেদের কারণ হল পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্নতা হওয়া এবং এ ব্যাপারে দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা।

তৃতীয়তঃ

চাঁদ দেখা সংক্রান্ত কমিটি নতুন চাঁদ হিসাবের সাহায্যে নিশ্চিত হবার ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত দলীলসমূহ গবেষণা করে দেখেছেন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে ‘আলিমগণের বক্তব্য যাচাই করেছেন। এরপর তাঁরা ইজমা‘ (ঐকমত্য) ক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব দ্বারা শারী‘আত সংক্রান্ত মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারটি বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর দলীল হিসেবে তাঁরা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ তিনি বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” (সহিহ বুখারী ১৯০৯, সহিহ মুসলিম ১০৮১)।

এবং তাঁর (রাসূলুল্লাহ)  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, তিনি বলেন, “তোমরা তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম রেখো না ও তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম শেষ করো না।” (মালিক ৬৩৫, ও এর অর্থে অন্যান্য দলীল সমূহও রয়েছে)।

গবেষণা ও ফাত্‌ওয়া ইস্যুকারী স্থায়ী কমিটি এ মত পোষণ করে যে, মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন (অথবা এ ধরণের অন্য কোনো সংস্থা যারা ইসলামী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করে) অমুসলিম সরকার শাসিত দেশসমূহে সেখানে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মুসলিম সরকারের স্থলাভিষিক্ত হবে।

আর পূর্বে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, এই ইউনিয়নের দুটো মতের যে কোনো একটি মত- ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করা বা না করা- এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার আছে। এরপর তারা সেই মতকে সে দেশের সমস্ত মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করবে। আর সে মুসলিমদের সেই মতকে যা তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে তা মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক; ঐক্যের স্বার্থে, সিয়াম শুরুর জন্য এবং মতভেদ ও বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলার জন্য।

এ সমস্ত দেশে যারা বাস করে তাদের উচিত নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে তৎপর হওয়া, তাদের মাঝে এক বা একাধিক বিশ্বস্ত ব্যক্তি যদি তা (নতুন চাঁদ) দেখে তবে তারা সাওম পালন করবে এবং সেই ইউনিয়নকে খবর দিবে যাতে তারা সবার উপর এটি প্রয়োগ করতে পারে। এটি হল মাস শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে।

আর তা (মাস) শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে শাউওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা বা রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করার ব্যাপারে দুইজন ‘আদল ব্যক্তির শাহাদাহ (সাক্ষ্য) অবশ্য প্রয়োজন। এর দলীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম পালন কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ করো বা ঈদুল ফিতর আদায় কর। আর যদি নতুন চাঁদ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে দেখা না যায় তবে (মাসকে) ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।” আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। (ফাতাওয়া আল-লাজ্‌নাহ আদ-দা’ইমাহ (১০/১০৯); অনুবাদক : ইবতিসাম আযাদ আব্দুর রাহমান, মাক্তাবা আস-সাবাত)।।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনায় বুঝতে পেরেছি। যারা আমাদের দেশে একই সাথে সিয়াম শুরু ও শেষ না করা করে সৌদির সাথে মিল রেখে সিয়াম শুরু ও শেষ করে তাদেরও যুক্তি আছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি সিয়াম শুরু ও শেষ বিষয় টি মুসলিম দেশের সরকার বা অমুসলিম দেশের আলেমদের নিয়ে গঠিত চাঁদ দেখা কমিটি উপর নির্ভর করতে হবে। এই কমিটি সিন্ধান্ত নিবে যে তারা কিভাবে সিয়াম শুরু ও শেষ করবে। তারা যদি নিজ দেশের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে তবে তার উপর সকলকে একমত থাকতে হবে। তারা যদি সৌদী অথবা পৃথিবীর অন্য কোন স্থানের চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে সিয়াম শুরু ও শেষ করতে চায় তবে তাদের মতামতকেই প্রধান্য দিতে হবে। উম্মতের ঐক্য রক্ষা করা ফরজ। ফিকহী মতভেদ জায়েয আছে কিন্তু উম্মতের ঐক্য বিনষ্ট করা যাবে না। তাই আমাদের দেশের পরিপেক্ষিতে বলা যায় যে, আমাদের দেশে একটি শক্তিশালী চাঁদ দেখা কমিটি আছে। তাদের মতামত অনুসারে সিয়াম শুরু ও শেষ করতে হবে। তাদের স্বাধীনতা আছে যে, তারা দুটি পদ্ধতির কোনটি পছন্দ করবে। কিন্তু জনগনের স্বাধীনত নাই কারন এর দ্বারা উম্মতের ঐক্যই নষ্ট হবে।

২। সিয়ামের নিয়ত সম্পর্কিত ভুল বিষয়ঃ

সিয়ামের নিয়ত করা জরুরি এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রতিটি ইবাদতে যেমন নিয়ত করা শর্ত তেমনি সিয়ামেও নিয়ত করা ফরজ এবং রোজা সহীহ হওয়ার জন্য নিয়ত করা শর্ত। নিয়ত ছাড়া সিয়াম সহিহ হবে না। আকলামা ইবনু ওয়াক্কাস আল লাইসি রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত. আমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে মিম্বরে উপর দাড়িয়ে খুতবা বলতে শুনেছি। (তিনি বলেন) আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় সমস্ত আমল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল আর প্রতিটি ব্যক্তিই যা নিয়ত করে তাই সে পায়। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সে উদ্দেশ্যেই হবে তার প্রাপ্য।  (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ০১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

সিয়াম আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তি রোজা শুরু করার সময় অন্তরে উপস্থাপন করবে যে, আমি রমজানের রোজা রাখছি অথাব ক্বাজা রোজা রাখছি কিংবা মান্নত বা কাফ্ফারার রোজ রাখছি। সিয়ামের নিয়মই হল সারাদিন দিন ব্যাপিই পানাহার ও স্ত্রী ব্যবহার পরিহার করা। তাই পূর্ণ দিন সিয়াম পালন করা ওয়াজিব।

নিয়তের স্থান হল মানুষের অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। সুতরাং নিয়ত অন্তরেই করবে, মুখে উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করাকে অনেক বিজ্ঞ আলেম শরিয়ত পরিপন্থি মনে করেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের কারো থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি যে, তারা সিয়াম এর নিয়ত মুখে উচ্চারণ করেছেন। কিন্ত আমাদের সমাজে অনেক সিয়াম পালনের জন্য নিম্মের বর্ণিত নিয়তটি মুখে উচ্চারণ করে থাকলেও কোন হাদিস গ্রন্থে এটি পাওয়া যায় না। নিয়তটি হলঃ

نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ সিয়াম রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোযা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

নিয়তের অর্থটির প্রতি একটু লক্ষ করুন। ঐ নিয়তের বলা হয়েছে, আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ সিয়াম রাখার ইচ্ছা পোষণ করলাম। অথচ আরবি দিন শুরু হয় সূর্য়াস্তের সাথে সাথে। তাই যদি কেউ আজকের দিনের সিয়ামকে আগামি কালের সিয়াম বলে তা হলে তার নিয়ত কতটুকু শুদ্ধ হবে। আমার ধারনা কোন একজন সাধারণ আলেম যার আরবি জ্ঞান অতটা সমৃদ্ধ নয়, তিনি এই কথা রচনা করে চালিয়ে দিয়েছন।

সুতরাং নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত।  সিয়ামের নিয়তে সেহর ইফতার খাওয়াই যথেষ্ট। এতে সিয়াম আদায় হয়ে যাবে। শায়খ তকি উদ্দিন ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‍‍‌রোজাদার যখন রাতের খাবার খায় রোজা রাখার ইচ্ছায়ই খায়। এ কারেণইতো রমজানের রাতের খাওয়া এবং ঈদের রাতের খাওয়ার মধ্যে প্রার্থক্য করে। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি জানতে পারে যে, আগামি কাল রমজান এবং সে রোজা রাখার ইচ্ছা করে, এতেই তার নিয়ত হয়ে যায়। আলাদাভাবে নিয়ত করার প্রয়োজন নেই। যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের আমল এ রকমই চলে আসছে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment