আখেরি চাহার শোম্বা একটি বিদআতি আমল

আখেরি চাহার শোম্বা একটি বিদআতি আমল

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। আখেরি চাহার শোম্বা একটি ভিত্তিহীন দিবস

আমাদের উপমহাদেশে (ভাতর, পাকিস্থান, বাংলাদেশ) ইসলামী দিবস হিসাবে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে দিবসটি পালিত না হলেও বাংলাদেশে এই দিনটি সরকারী ছুটির দিন। এই দিনটি উপলক্ষে দেশে সকল দৈনিক পত্রিকাগুলো ফলাউ করে মহত্ব সম্পর্কে প্রচার করে। অধিকাংশেরই এই দিন সম্পর্কে সঠিক কোন ধারনা নাই। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ কিছু ব্যক্তি গতানুগতিকভাবে এই দিবসকে ইসলামী দিবস হিসাবে পালন করে। তারা এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আমলও করেন।

এই দিবসটি ইসলাম ধর্মে কিভাবে চালু হল, তার অনুসন্ধার করতে গিয়ে দেখা গেল। বাংলা ভাষায় বহুল প্রচারিত দুটি অনির্ভরযোগ্য বই যার নাম ‘মুকসুদুল মুমিনীন’ এবং “বার চান্দের ফযীলত” সেখানে এই বিষয় লেখা হয়েছে। এই বই দুটি বাংলার মুসলিমদের ঘরে ঘরে থাকলেও নির্ভরযোগ্যতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে নাই। এই সকল বাজারী বইয়ের অধিকাংশ আমলই মন গড়া। কাজেই “মকছুদোল মুমিনীন ও ‘বার চান্দের ফযীলত’ বিষয়ক যেসব অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকা এক শ্রেণির মানুষের মাঝে প্রচলিত এর কোনো আমলই যাচাই বাচাই ছাড়া গ্রহন করা যাবে না। পরিতাপের বিষয় হলো, এসব অনির্ভরযোগ্য গ্রন্থ এবং অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের প্রচলনকে ভিত্তি করে আমাদের দেশের এ দিবসকে খুব ঘটা কর পালন করা হয়। অথচ শরিয়াতের মানদন্ডে এ দিবসের যেমন কোনো ভিত্তি নেই, তেমন এ দিবসের আমলেরও কোনো ভিত্তি নেই।

২। ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ কী?

আখেরী চাহার শোম্বা একটি আরবী ও ফার্সি শব্দ যুগল। প্রথম অংশ আখেরী একটি আরবী শব্দ যার অর্থ “শেষ” এবং দ্বিতীয় অংশ চাহার শোম্বা ফার্সি যার অর্থ “চতুর্থ বুধবার”। অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা ও দিবস পালনকারীদের প্রচলিত আকিদামতে এ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট হলোঃ

প্রথম দাবিকৃত পেক্ষাপটঃ

‘নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ইহুদি জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য নবীজি মসজিদে যেতে পারেননি। সফর মাসের শেষ বুধবার নবীজি গোসল করেন এবং সুস্থ হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এ গোসলই তাঁর জীবনের শেষ গোসল। নবীজির সুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কিরাম খুশি হয়ে এ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং নফল নামাজ আদায় করেছিলেন। কাজেই উম্মতের জন্যও এ দিন গোসল করে রোজা রেখে নফল নামাজ পড়ে আনন্দ প্রকাশ করা আবশ্যক!!’

এ আকিদা ও বিশ্বাস ধারণ করে আমাদের সমাজের কিছু ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত হিজরি সফর মাসের শেষ বুধবারকে ইসলামী দিবস হিসেবে পালন করেন।

দ্বিতীয় দাবিকৃত পেক্ষাপটঃ ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করেন বলে দিনটিকে মুসলমানেরা প্রতিবছর ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন। তাঁরা নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দিবসটি অতিবাহিত করেন। তাই উম্মতে মুহাম্মদীর আধ্যাত্মিক জীবনে আখেরি চাহার শোম্বার গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। হিজরি সালের সফর মাসের শেষ বুধবার মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা বিভিন্ন নফল ইবাদাতের মাধ্যমে পালন করে।

“মকছুদোল মুমিনীন” এর ভাষ্যঃ-

এই দিন সম্পর্কে “মকছুদোল মুমিনীন বলা হয়েছেঃ “তাযকিরাতুল আওরাদ নামক গ্রন্থে সফর মাসের শেষ বুধবার প্রভাতে গোসল করে  সূর্য উঠার পর দুই রাকআত নফল নামায আদায় করার কথা উল্লেখ আছে। নামাযের নিয়ম নিম্ম রূফঃ

দুই রাকআতের নিয়ত করে এ নামায আদায় করতে হয়। উভয় রাকআতে সূরা ফাতিহার পর এগার বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয়। নামায শেষে সত্তর বার নিম্মের দরূদ শরীফ ও দুআটি পাঠ করে মুনাজাত করতে হয়। …।

মকসুদুল মোমেনিনে আরও  বলা হয়েছেঃ

’…………………..এই গোছলই হুজুরের জীবনের শেষ গোছল ছিল।………অতএব এইদিনে মুসলমানদের বিশেষভাবে গোছলাদি করত, নফল নামায এবং রোযা ইত্যাদি আদায় করত, নবী করিম (দা.) এর রুহের উপর ছওয়াব বখশেষ করা উচিত।’

তৃতীয় দাবিকৃত পেক্ষাপটঃ একটি প্রচলিত বাজারী বইয়ে লেখাঃ-

‘‘হযরত নবী করীম (ﷺ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রা) খুশীতে ৭ সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) ৫ সহস্র দীনার, হযরত ওসমান (রা) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রা) ৩ সহস্র দীনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (ﷺ) এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদৎ বান্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য…।(মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৫)।

মন্তব্যঃ হাদিসের নামে জালিয়াতি কিতাবে ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ লিখেনঃ- উপরের এ কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এ ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পাই নি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা জীবনী গ্রন্থেও আমি এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাই নি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এ কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই।

৩। নির্ভযোগ্য সিরাত গ্রন্থ “আর-রাহীকুল মাখতূম” এর বর্ণায় শেষ দিনগুলির সঠিক ইতিহাসঃ

ওফাত প্রাপ্তির পাঁচ দিনে আগেঃ 

একাদশ হিজরীর ২৯ শে সফর সোমবার দিবস রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি জানাযার উদ্দেশ্যে বাকীতে গমন করেন। সেখান থেকে ফেরার পথেই তাঁর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় এবং উত্তাপ এতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে, মাথায় বাঁধা পট্টির উপরেও তাপ অনুভূত হতে থাকে। এ অসুস্থতাই ছিল তাঁর ওফাতকালীন রোগ ভোগের সূচনা। এ অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি এগার দিন পর্যন্ত সালাতে ইমামত করেন। এ অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১৩ কিংবা ১৪ দিন অতিবাহিত করেন। ওফাত প্রাপ্তির পাঁচ দিন পূর্বে বুধবার দিবস দেহের উত্তাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রোগযন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি বললেন,‏ ‘আমার শরীরে বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি ঢাল, যাতে আমি লোকজনদের নিকট গিয়ে উপদেশ দিকে পারি। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (সাঃ)-কে একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে তাঁর উপর এত বেশী পরিমাণ পানি ঢালা হল যে, তিনি নিজেই ‏‘ক্ষান্ত হও’, ক্ষান্ত হও’ বলতে থাকলেন।

সে সময় নাবী কারীম (সাঃ)-এর রোগ যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং তিনি মসজিদে গমন করেন। তখনো তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। তিনি মিম্বরের উপর উঠে বসেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। সাহাবীগণ (রাঃ) আশপাশে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, “ইয়াহুদ ও নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক এ কারণে যে, তারা তাদের নাবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। অন্য এক রেওয়াতে রয়েছে ‘ইহুদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর শাস্তি যে তারা তাদের নাবীদের কবরকে মসজিদে বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি আরও বললেন,‏‏ ‘তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিওনা এ কারণে যে তার পূজা করা হবে।

ওফাত প্রাপ্তির চার দিনে আগেঃ

ওফাত প্রাপ্তির চার দিনে পূর্বে বৃহস্পতিবার যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কঠিন রোগযন্ত্রণার সম্মুখীন হলেন তখন বললেন, ‘তোমরা আমার নিকট কাগজ কলম নিয়ে এসো, আমি তোমাদের জন্য একটি নোট লিখে দেই যাতে তোমরা আমার পরে কোন দিনই পথভ্রষ্ট হবে না’।

ঐ সময় ঘরে কয়েক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন উমার (রাঃ), তিনি বললেন, ‘আপনার উপর রোগ যন্ত্রণার প্রাধান্য রয়েছে এবং আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব কুরআন রয়েছে। আল্লাহর কিতাব কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট’- এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। কেউ কেউ বললেন, ‘কাগজ কলম আনা হোক এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা বলবেন তা লিখে নেয়া হোক।’ অন্যেরা উমার (রাঃ)-এর মত সমর্থন করলেন। লোকজনদের মধ্যে যখন এভাবে কথা কাটাকাটি চলতে থাকল তখন নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‏(‏قُوْمُوْا عَنِّيْ‏)‏‏ ‘আমার নিকট থেকে তোমরা উঠে যাও’।

অতঃপর নাবী কারীম (সাঃ) সে দিনটিতে উপদেশ প্রদান করলেন। এর প্রথমটি হচ্ছে,‘ইহুদী, নাসারা এবং মুশরিকদেরকে আরব উপদ্বীপ হতে বহিস্কার করবে। দ্বিতীয়টি হল, ‘প্রতিনিধিদলের সে ভাবেই আপ্যায়ণ করবে যেমনটি (আমার আমলে) করা হতো।’ তৃতীয় উপদেশটি বর্ণনাকারী ভুলে গিয়েছিলেন। তবে সম্ভবত সেটি ছিল আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকার উপদেশ, অথবা তা ছিল উসামা (রাঃ)-এর বাহিনী কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপদেশ, অথবা তা ছিল ‘সালাত’ এবং তোমাদের অধীনস্থ অর্থাৎ দাসদাসীদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার উপদেশ। কঠিন অসুস্থতা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঐ দিন (অর্থাৎ ওফাত প্রাপ্তির চার দিন পূর্বের বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সকল সালাতেই ইমামত করেন। এ দিবস মাগরিবের সালাতেও তিনি ইমামতি করেন এবং সূরাহ ‘ওয়াল মুরসালাতে উরফা’ পাঠ করেন।

কিন্তু এশা সালাতের সময় অসুস্থতা এতই বৃদ্ধি পেল যে, মসজিদে যাওয়ার মতো শক্তি সামর্থ্য আর তাঁর রইল না। আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘লোকজনেরা সালাত আদায় করে নিয়েছে? আমি উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আমার জন্য বড় পাত্রে পানি দাও। তাঁর চাহিদা মোতাবেক পানি দেয়া হলে তিনি গোসল করলেন। অতঃপর দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকেরা কি সালাত আদায় করেছে? উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষামান রয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারেও তিনি একইরূপ করলেন, যেমনটি প্রথমবার করেছিলেন, অর্থাৎ গোসল করলেন এবং দাঁড়াতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না।, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। অবশেষে তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে বলে পাঠালেন সালাতে ইমামত করার জন্য। এ প্রেক্ষিতে আবূ বাকর (রাঃ) ঐ দিনগুলোতে সালাতে ইমামত করেন। নাবী কারীম (সাঃ)-এর পবিত্র জীবদ্দশায় আবূ বাকর (সাঃ)-এর ইমামতে সালাতে সংখ্যা ছিল সতের ওয়াক্ত।

ওফাত প্রাপ্তির তিন দিনে আগেঃ

জাবির (রাঃ) বলেন, আমি নাবী (সাঃ)-কে তাঁর ওফাতের তিন দিন পূর্বে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা না নিয়ে মৃত্যুবরণ না করে।

ওফাত প্রাপ্তির এক বা দুই দিনে আগেঃ

শনিবার কিংবা রবিবারে নাবী কারীম (সাঃ) কিছুটা সুস্থতা বোধ করেন। কাজেই, দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে যুহর সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করেন। সেই সময় সাহাবীগণ (রাযি আল্লাহু ‘আনহুম)-এর সালাতের জামাতে ইমামত করছিলেন আবূ বাকর (রাঃ)। তিনি নাবী কারীম (সাঃ)-এর আগমনের আভাস পেয়ে পিছনের সারিতে আসার চেষ্টা করলে তিনি তাঁকে ইশারায় পিছনে আসতে নিষেধ করে সামনেই থাকতে বললেন এবং নিজেকে তাঁর ডান পাশে বসিয়ে দেয়ার জন্য সাহায্যকারীদ্বয়কে নির্দেশ দিলেন। এ প্রেক্ষিতে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ডান পাশে তাঁকে বসিয়ে দেয়া হল। এরপর আবূ বাকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সালাতের অনুকরণ করছিলেন এবং সাহাবীগণ (রাযি.)-কে তাকবীর শোনাচ্ছিলেন।

ওফাত প্রাপ্তির এক দিনে আগেঃ

ওফাত প্রাপ্তির পূর্বের দিবস রবিবার তিনি তাঁর দাসদের মুক্ত করে দেন। তাঁর নিকটে সাতটি স্বর্ণ মুদ্রা ছিল তা সাদকা করে দেন। নিজ অস্ত্রগুলো মুসলিমগণকে হিবা করে দেন। রাত্রিবেলা গৃহে বাতি জ্বালানোর জন্য আয়িশাহ (রাঃ) প্রতিবেশীর নিকট থেকে তেল ধার করে আনেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি লৌহবর্ম ত্রিশ ‘সা’ (৭৫ কেজি) যবের পরিবর্তে এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রাখা ছিল।

৪। ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে দিবসটিঃ

শরিয়াতের দৃষ্টিতে এ দিবস, দিবস পালনের প্রেক্ষাপট এবং এ দিবসে বর্ণিত কোনো আমলই নির্ভরযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত নয়। বরং তা একটি গর্হিত বিদাত ও অবশ্য পরিত্যজ্য বিষয়। এই দিবসের অনির্ভরযোগ্যতার কারণগুলো নিম্নরূপঃ

৫। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জাদু করার সময়ঃ

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ইহুদি জাদু করেছিল, এ কথা ঠিক। সহিহ বুখারীতে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ যুরাইক গোত্রের লাবীদ ইবনু আ‘সাম নামক এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যাদু করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনে হতো যেন তিনি একটি কাজ করেছেন, অথচ তা তিনি করেননি। একদিন বা একরাত্রি তিনি আমার কাছে ছিলেন। তিনি বার বার দু‘আ করতে থাকেন। তারপর তিনি বলেনঃ হে ‘আয়িশাহ! তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে, আমি আল্লাহর কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আমাকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। (স্বপ্নে দেখি) আমার নিকট দু’জন লোক আসেন। তাদের একজন আমার মাথার কাছে এবং অপরজন দু’পায়ের কাছে বসেন। একজন তাঁর সঙ্গীকে বলেনঃ এ লোকটির কী ব্যথা? তিনি বলেনঃ যাদু করা হয়েছে।

প্রথম জন বলেনঃ কে যাদু করেছে? দ্বিতীয় জন বলেন, লাবীদ বিন আ’সাম। প্রথম জন জিজ্ঞেস করেনঃ কিসের মধ্যে? দ্বিতীয় জন উত্তর দেনঃ চিরুনী, মাথা আঁচড়ানোর সময় উঠা চুল এবং এক পুং খেজুর গাছের ‘জুব’-এর মধ্যে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সহাবী সাথে নিয়ে সেখানে যান। পরে ফিরে এসে বলেনঃ হে ‘আয়িশাহ! সে কূপের পানি মেহদীর পানির মত লাল) এবং তার পাড়ের খেজুর গাছের মাথাগুলো শয়তানের মাথার মত। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এ কথা প্রকাশ করে দিবেন না? তিনি বললেনঃ আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন, আমি মানুষকে এমন বিষয়ে প্ররোচিত করতে পছন্দ করি না, যাতে অকল্যাণ রয়েছে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিলে সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। (সহিহ বুখারীত ৫৭৬৩ তাওহীদ)

 মন্তব্যঃ হোদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে খয়বর থেকে ইহুদীদের একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় এলো। তারা আনসারদের বনি যুরাইক গোত্রের বিখ্যাত যাদুকর লাবীদ ইবনে আ’সমের সাথে সাক্ষাত করলো। তারা তাকে বললো , মুহাম্মাদ (সা) আমাদের সাথে যা কিছু করেছেন তা তো তুমি জানো। আমরা তাঁর ওপর অনেকবার যাদু করার চেষ্টা করেছি , কিন্তু সফল হতে পারেনি। এখন তোমার কাছে এসেছি। কারণ তুমি আমাদের চাইতে বড় যাদুকর। তোমার জন্য এ তিনটি আশরাফী ( স্বর্ণ মুদ্রা ) এনেছি। এগুলো গ্রহণ করো এবং মুহাম্মাদের ওপর একটি শক্ত যাদুর আঘাত হানো। এ সময় একটি ইহুদী ছেলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কাজ করতো। তার সাথে যোগসাজশ করে তারা রসূলুল্লাহ (সা) চিরুনীর একটি টুকরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। তাতে তাঁর পবিত্র চুল আটকানো ছিল সেই চুলগুলো ও চিরুনীর দাঁতের ওপর যাদু করা হলো। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে , লাবীদ ইবনে আ’সম নিজেই যাদু করেছিল। আবার কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, তার বোন ছিল তার চেয়ে বড় যাদুকর । তাদের সাহায্যে সে যাদু করেছিল যাহোক এ দু’টির মধ্যে যে কোন একটিই সঠিক হবে। (তাফহিমুল কুরআন, সুরা ফারাকের শানে নুজুল)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর প্রভাব পড়তে পূর্ণ এক বছর সময় লাগলো। বছরের শেষ ছয় মাসে মেজাজে কিছু পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকলো। শেষ চল্লিশ দিন কঠিন এবং শেষ তিন দিন কঠিনতর হয়ে গেলো। তবে উপরে বর্ণিত হাদিসে দেখা যায় আল্লাহ রহমতে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান। কোন অবস্থায়ই তার এই যাদুর প্রভাব জীবনের শেষ ওফাত পর্যান্ত ছিল না। বরং অনেক আগেই এর প্রভাব চলে গিয়েছিল। যাইহোক সুস্থতার তারিখ কোন হিসাব অনুযায়ীই সফরের আখেরী চাহার শোম্বা হতে পারে না। এই সকল কথা পুরুটাই মিথ্যা।

৬। বুধবারের পর বৃহস্পতিবারও গোসল করেছিলেনঃ

 “আর-রাহীকুল মাখতূম” এর বর্ণায় মতে ওফাত প্রাপ্তির পাঁচ দিনে আগে বুধবার তিনি গোসল করেছি। কিন্তু এই গোসলের পর নবীজি (সাঃ) আর গোসল করেননি। এ কথাও ঠিক নয়। কেননা, সহিগ বুখারির এক হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, নবীজি এরপর এশার নামাজের আগে গোসল করেছিলেন। এবং উপর বর্ণীত, “আর-রাহীকুল মাখতূম” এর বর্ণায় মতে ওফাত প্রাপ্তির চার দিনে আগে বৃহস্পতিবার এশার সালাতে গমনের জন্য তিনি গোসর করে ছিলেন। কাজেই বিদআতীরা যে প্রচার করে বুধবারই শেষ গোসল, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কিভাবে হচ্ছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তকালের দিন নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে ইন্তেকালের তারিখ বারোই রবীউল আউয়াল সোমবার বলে মনে করে থাকেন। এই হিসাবে ইন্তিকালের পাঁচ দিন আগে সফর মাস হয় কি করে। ইস্তিকালের পাঁচ দিন আগে হবে সাত-ই রবিউল আউয়াল বুধবার। অথচ আমরা রোগমুক্ত দিবস পালন করছি সফরের বুধবার।  

৭। খুসির জন্য দিবস পালনঃ

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার কারণে মুমিন ব্যক্তি খুশি না হয়ে পারে না। তার সুস্থতার সংবাদ নিঃসন্দেহে উম্মতের জন্য আনন্দ ও খুশির বিষয়। তিনি যখন অসুস্থার পর কিছুটা সুস্থ হন, তখর সকল সাহাবি (বাঃ) আনন্দিত হয়েছিল, খুসি হয়ে ছিল এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারা এই খুসি বা আনন্দ কিভাবে প্রকাশ করেছিলেন? ইসলামে যে কোন নিয়ামত লাভের পর তা প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম হলো, মহান আল্লাহ শুকরিয়া। কাজেই সাহাবি (রাঃ) ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্থতার কারণে শুকরিয়া আদায় করেছেন। কিন্তু একথা দাবি করা যে, সাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী যুগের মনীষীগণ সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, জাহালাত ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোন দলিলও বিদ্যমান নেই।

খুশির দিনকে ইসলামী দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে, এই মর্মে সাহাবায়ে কিরামের জীবনীতে এর কোনো উল্লেখ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অনেক বিভিন্ন বালা মুসিবত এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ রক্তাক্ত হয়েছেন। অহুদে ৭০ জন সহাবি (রাঃ) হারিয়েছেন এবং নিজেও মারাত্বক আহত হয়েছেন এবং মহান আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। যদি বলি তার জীবনের সবচেয়ে বড় খুসির দিন কোনটি? আমার মনে হয় অতীত থেকে শুরু করে বর্তমানের সকল মুসলিম, যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আছে, তারা বলবে, মক্কা বিজয়ের দিন। তার জীবনটি ত্যাগ করে গেছেন ইসলামের জন্য। সেই ইসলাম যে দিন বিজয় লাভ করে তার থেকে আর আনন্দের দিন হতে পারে না। কই কোন কালে তো মক্কা বিজয় বিদস পালিত হল না। ইসলামে কোন খুসি বা সু্স্থতা দিবস পালনের উদযাপনের কোন অবকাশ নাই। তাহলে আখেরী চাহার শোম্বা, যার কোন ভিত্তিই নেই, তা কিভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?

৮। দিবস পালনের জন্য দলীলের প্রয়োজনঃ

 ইসলামি শরীয়তে কিছু দিবস ও রাতকে মহান আল্লাহ মহিমান্বিত বলে ঘোষনা করেছেন। যেমনঃ আরাফার দিন ও লাইলাতুর কদরের রাত। এই সকল দিন রাতের আমল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমানিত। তাই সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ), তাবেইন, তাবে-তাবেইনের যুগও এই সকল আমল সহহি সুন্নাহ মোতাবেগ করা হয়ে আসছে। ইসলামি শরীয়তে কোনো বিশেষ দিনকে ধর্মীয় দিবস মনে করা এবং তাতে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য শরিয়াতের সুনির্দিষ্ট দলিল-প্রমাণ আবশ্যক। অথচ আখেরি চাহার শোম্বা সম্পর্কে কোরআনে কারিম কিংবা হাদিসে উল্লেখ থাকাতো দূরের কথা, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইনের যুগ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ তিন যুগেও এ দিবস পালনের কোনো রেওয়াজ পাওয়া যায় না। সাহাবায়ে কিরাম খুশি হয়ে এ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং নফল নামাজ আদায় করেছিলেন অথচ কোন সহিহ বা যঈফ হাদিসে তা উল্লেখ নাই। এ কেমন কথা?

ইসলামি শরীয়তের যে কোন আমল করার জন্য কুরআন সুন্নাহ থেকে নির্দিষ্ট দলীল লাগবে। দলীল বিহীন ভাল আমল যা আল্লাহকে খুসির জন্য করা হয় তাই বিদআত। কাজেই কোন দিন কে বিশেষ ফযীলতের মনে করা, কিংবা বিশেষ কোন আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে এমন কথা বলা, কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা এই সবগুলো হচ্ছে মুসলমানদের জন্য শরীয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এগুলো শরয়ী দলীল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় না। এজন্য উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওইসব রসম-রেওয়াজ জারী করার কোনো বৈধতা হয় না। যেহেতু সালফে সালেহীনদের আমলে পাওয়া যায় না। তাই এই দিনের বিশেষ যে, সালাত ও সিয়ামের পদ্ধতি মকছুদুল মোমেনীতে বর্ণিত হয়েছে তা সম্পুর্ণই ভিত্তীহীন ও মিথ্যা।

৯। রাসুলুল্লাহ মৃত্যু তারিখ নিয়ে সংশয়ঃ

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগনিত হাদিসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন ভাবে কোন দিন, তারিখ বা সময় বলা হয়নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তেকাল করেন সে বিষয়ে কোন হাদীসেই কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
২য় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিমগন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনাবলী ঐতিহাসিক দিন তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তখন থেকে মুসলিম আলিমগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মোট পেশ করেছেন। তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক মোট রয়েছে। কেউ বলেছেন সফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। কেউ বলেছেন রবিউল আউওয়াল মাসের শুরু থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু।

দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১হি/৭৬৮ খ্রি) বলেনঃ
“রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে। (ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন- নববিয়্যাহ ৪/২৮৯)”

কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়। কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন ১২ দিন, কেউ ১৩ দিন, কেউ বলেছেন ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পর রাসুল (সাঃ) ইন্তিকাল করেন। তিনি কোন তারিখে ইন্তকাল করেছেন সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছনে ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ ২রা রবিউল আউয়াল, এবং কেউ বলেছেন ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।

সর্বাবস্থায় কেউ কোনভাবে বলছেননা যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনদিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

বুখারী সংকলিত ‘আয়িশাহ (রাযি.) বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অসুস্থতা বেড়ে গেলে তিনি আমার ঘরে শুশ্রূষার জন্য তাঁর স্ত্রীদের নিকট অনুমতি চাইলে তাঁরা অনুমতি দিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমার ঘরে আসার জন্য) দু’ ব্যক্তির উপর ভর করে বের হলেন। আর তাঁর পা দু’খানি তখন মাটিতে চিহ্ন রেখে যাচ্ছিল। তিনি ‘আব্বাস (রাযি.) ও অন্য এক ব্যক্তির মাঝখানে ছিলেন। ‘উবাইদুল্লাহ (রহ.) বলেনঃ ‘আমি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.)-কে এ কথা জানালাম। তিনি বললেনঃ সে অন্য ব্যক্তিটি কে তা কি তুমি জান? আমি বললাম, না। তিনি বললেনঃ তিনি হলেন ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাযি.)। ‘আয়িশাহ (রাযি.) বর্ণনা করেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে আসলে অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি বললেনঃ ‘তোমরা আমার উপর মুখের বাঁধন খোলা হয়নি এমন সাতটি মশকের পানি ঢেলে দাও, তাহলে হয়ত আমি মানুষকে কিছু উপদেশ দিতে পারব।’ তাঁকে তাঁর স্ত্রী হাফসাহ (রাযি.)-এর একটি বড় পাত্রে বসিয়ে দেয়া হল। অতঃপর আমরা তাঁর উপর সেই সাত মশক পানি ঢালতে লাগলাম। এভাবে ঢালার পর এক সময় তিনি আমাদের প্রতি ইঙ্গিত করলেন, (এখন থাম) তোমরা তোমাদের কাজ করেছ। অতঃপর তিনি বের হয়ে জনসম্মুক্ষে গেলেন। (সহিহ বুখারী ১৯৮ তাওহীদ প্রকাশনী)

এখানে স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন। এই গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কি বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনু হাযার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার। (ইবনু হাযার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২)।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার বা আখেরী চাহার শোম্বা নামে দবিস কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। তাই এই দিনে ইবাদত, বন্দেগী, সালাত, সিয়াম, জিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য দিনের চেয়ে বেশী বা বিশেষ কোন সওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারনা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।

১০। সফর মাসে শেষ বুধবার অশুভঃ

বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাযিল হয়। এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গ বিশ্বাস করেছেন। যেমন: ‘‘সফর মাসে একলাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাজিল হয় এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শুম্বা-’তে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাজিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকাত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন…। (খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার, রাহাতিল কুলুব- পৃষ্ঠা ১৩৯)”

মন্তব্যঃ আব্দিল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ লিখেন, এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা। তবে আমাদের দেশে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’র প্রসিদ্ধি এ কারণে নয়, অন্য কারণে।  (হাদিসের নামে জালিয়াতী)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment