দ্বিতীয় কিস্তি : অতিরিক্ত ঊনিশটি বিদআতি আকিদা
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন
৬। বিদআতি আকিদা হলোঃ মিলাদ মাহফিল চলা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে বিশ্বাস করা।
সঠিক আকিদা হলোঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বত্র হাজির নাজির নয়।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
অধিকাংশ সুফিদের মতে মিলাদ মাহফিল চলা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে করে বলে বিশ্বাস করে এবং এ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলের মাঝে কিয়াম করে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কামনায় চেয়ারের ব্যবস্থা করে রাখে। এমন বিশ্বাস সাহাবি তাবেয়ী, তাবে তাবেয়িদের মাঝে কখনও ছিল না। এবং সম্পর্কে তাদের মাঝে কোন বিতর্কও ছিল না। “নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কোন অলীর হাজির নাযির নয়, বরং আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা, দর্শন, জ্ঞান ও শুনার দ্বারা সর্বত্র হাজির নাযির”।
কুরআন হাদিসের স্পষ্ট বর্নণাকে ভুল মিথ্যা ও মনগড়া ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুবই গর্হিত কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনে জম্মের আগে পরে তিনি মন জ্ঞানের অধিকারি ছিলেন না। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হাজির নাযির বিশ্বাস করলে মুলত মিরাজ অস্বিকার করা হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন:
سُبۡحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلاً۬ مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكۡنَا حَوۡلَهُ ۥ لِنُرِيَهُ ۥ مِنۡ ءَايَـٰتِنَآۚ إِنَّهُ ۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ (١)
অর্থঃ পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতে নিজের বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন, যাতে তাকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখান৷ আসলে তিনিই সবকিছুর শ্রোতা ও দ্রষ্টা৷ (বনী ইসরাইল ১৭:১)।
মিরাজ হল মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা অতপর সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশে আজিমে পৌছান। রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা সর্বদা হাজির নাযির থাকলেতো আর আরশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি তো সেখানেই হাজিরই ছিলেন। তাহলে মিরাজ আর রইল কোথায়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির নাযির বলাটা বাহ্যিকভাবে সম্মানজনক মনে করা হলেও আসলে তা শির্ক, যা একজন মুসলিম কে ইসলাম থেকে বাহির করে দেয়। এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজকে অস্বীকার করা হয়।
ইন্তিকাল পরবর্তী জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিলাদ মাহফিল চলা কালে আগমনে করে বা হাজরি নাজিন থাকেন মনে করলেতো সহিহ হাদিস অস্বীকার করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যখনই যে কেউ আমাকে সালাম করে তখনই আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন, যেন আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি।’’[আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/২১৮। হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য]।
মন্তব্যঃ পূর্ব এ সম্পর্কে বিস্তারি আলোচনা করা হয়েছে।
৭। বিদআতি আকিদা হলোঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের মাটি কাবা, আরশ কুরছি ও লওহে মাহফুজ থেকে শ্রেষ্ট মনে করে।
সঠিক আকিদা হলোঃ কুরআন সুন্নাহ বর্ণিত হয় নি এমন বিবষ মনগড়া ব্যাখ্যা করা থেকে বিরত থাকা।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
বিদআতিদের কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরের মাটি কাবা, আরশ কুরছি ও লওহে মাহফুজ থেকে শ্রেষ্ট মনে করে। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা’য়ালার সাথে তুলনা করেই খ্যান্ত হয়নি। তারা মনীনাকে মক্কার উপর, মসজিদে নবীকে বাইতুল্লাহ উপর মর্জাদা প্রদান করে। তাদের দলীল বিহীন দৃষ্টাতা হলঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের মাটি, কাবা শরীফ এমনকি আল্লাহর আরশ ও কুরশী থেকে ও উত্তম। এ আকিদার ক্ষেত্রে দেওবন্দী সুফিগন তাদের সাথে একমত। উদাহরন সরূপ বলা যায়ঃ
‘আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ এ বর্ণিত, মক্কা-মদিনার আলমগনের প্রথম প্রশ্নের উত্তরের শেষ দিকে বলা হয়েছে, “রাওদ্বা পাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বশরীরে অবস্থায় করছেন। মুবারক দেহ স্পর্শী এ রোওদ্বাখানি কেন বস্তত: ফুকাহায়ে কেরাম এর বিশদ আলোচনা করেছেন”।
শইখুল হাদিস হযরত জাকারিয়া শাহারানপুরী (রহ), ফাজায়েল হজ্জ্বে লিখেন “যেই জায়গা হুজুরে পাক (ছ) এর শরীর মোবারকের সহিত মিলিত আছে, উহা আল্লাহরপাকের আরশ হইতেও শ্রেষ্ট, কাবা হইতেও শ্রেষ্ট, কুরছি হইতেও শ্রেষ্ট, এমনকি আশমান জমিনের মধ্যে অরস্থিত যে কোন স্থান হইতেও শ্রেষ্ট,।। (ফাজায়েল হজ্জ্ব, পৃষ্ঠা নম্বর ১১৯, একমাত্র পরিবেশক তাবলীগী কুতুর খানা, প্রকাশ কাল অক্টোবর ২০০৫)।
মন্তব্যঃ মুসলমানদের নিকট মক্কা ও মনীনা দুটি পবিত্র স্থান। এ দুটি স্থানে ফজিলত ও বরকত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। কোন স্থানের কি মর্জানা বা সম্মান তা বলা কোন লোকের জন্য শোভা পায়না। কারন স্থানের ফজিলত শুধু মহান আল্লাহ আর তার বাণীবাহক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বলেত পারবেন। কাজেই তিনি যে স্থানে যতটুকু মর্জাদা বলেছেন, তার চেয়ে বেশী কিছু বলেত হলে আপনাকেও অহীর সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু তা এখন অসম্ভব কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর সাথে সাথে অহীর দরজা বন্ধ হয়েগেছে। কাজেই সনদ বিহীন মিথ্যা কথা পরিহার করি।
৮। বিদআতি আকিদা হলোঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্যই মানুষ ও জিন জাতী সৃষ্টি করা হয়েছে।
সঠিক আকিদা হলোঃ মানুষ ও জিন জাতী সৃষ্টির এক মাত্র উদ্যেশ্য মহান আল্লাহ ইবাদাত করা।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
বিদআতীদের দাবি হলোঃ,জিন-ইনসানসহ সমস্ত সৃষ্টি জগত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের দেশের অনেক বক্তাই সুফিদের কথা তাহকিক না করে অত্যন্ত মধুর কণ্ঠে ওয়াজ করার সময় বলেন, (মহান আল্লাহ নাকি বলেছেন), “আমি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) সৃষ্টি না করলে আসমান জমিন কিছুই সৃষ্টি করতাম না”। সমাজে প্রচলিত মি মিলাদ শরীফ পাঠের সময় বলতে শুনা যায় যে, নবী না আসিলে ধরায় কোন কিছুই সৃষ্টি হত না। সমাজে প্রচলিত এ সম্পর্কে ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ লেখা হাদিসের নামে জালিয়াতি বইটি থেকে তার একটা হাদিসের গবেষনা তুলে ধরছি। তার লিখার শিরোনা হলঃ “আরশের গায়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নাম”।
একটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন, “আদম (আ) যখন ভুল করে(নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে) ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেনঃ হে প্রভু, আমি মুহাম্মাদ এর হক(অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে(সা) চিনলে, আমিতো এখনো তাকে সৃষ্টিই করিনি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটিসমূহের গায়ে লিখা রয়েছেঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তার হক্ক(অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ(সা) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতামনা।” (হাকিম, আল মুসতাদরাক ২/৬৭২)।
ইমাম হাকিম নাইসাপুরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। তবে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাঊযূ কিনা মতভেদ করেছেন। ইমাম হাকিম নিজেই অন্যত্র এই হাদীসের বর্ণনাকারী রাবীকে মিথ্যাবাদী বলেছেন।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইমাম হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাঊযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম ইবনূল জাউযী অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন। এজন্য তাঁদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।
এই হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সনদটি খুবই দুর্বল, যে কারণে অনেক মুহাদ্দিস এক মাউযূ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল ফিহরী নামক এক ব্যক্তি দাবি করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক এক ব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা,তার দাদা থেকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব(রা) হতে বর্ণনা করেছেন।
বর্ণনাকারী আব্দুল হারিস একজন অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম(১৮২ হি) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমতো বলতে পারতেননা, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নাইসাপুরী নিজেই তার ‘মাদখাল ইলা মারিফাতিস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন: “আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাঊযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াত ১/২৫০; আলবানী, সিলসিলাতুয যায়ীফাহ ১/৯০)।
এই হাদীসটি উমার(রা) হতে কোনো অন্য কোনো তাবেয়ী বলেননি, আসলাম থেকেও তাঁর কোনো ছাত্র বর্ণনা করেননি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র ছিল। তাঁর কোনো ছাত্র এই হাদীস বর্ণনা করেননি। শুধুমাত্র আব্দুর রাহমান দাবী করছেন যে, তিনি এই হাদীসটি তাঁর পিতার নিকট শুনেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন।
ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই কথাটি মূলত ইহুদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এই কথাটি উমার(রা) এর নিজের কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রাহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এই হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। (তাবারানী, আল মুজামুল আউসাত ৬/৩১৩-৩১৪; মুসতাদরাক হাকিম ২/৬৭২; তারিখ ইবনু কাসীর ২/৩২৩, মোল্লা আলী কারী, আল আসরার পৃ. ১৯৪)।
মন্তব্যঃ এমন অনেক মিথ্যা আর জাল হাদিসের উপর ভিত্তিকরে বিদআতীদের ঈমান, আমল ও আকিদা রচিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ষ্পষ্ট ঘোষনাঃ
(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ)
অর্থঃ আর আমি মানব এবং জিনকে কেবল আমার দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
সুতরাং জিন-ইনসান ও অন্যান্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হচ্ছে মহান আল্লাহর এবাদত তথা পৃখিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। এখানে মন গড়া ও কাল্পনিক ব্যাখ্যার কোন স্থান নেই। ইদানিং অনেক সুফি আকিদার আলেম ঢালাও ভাবে রোফারেন্স দিয়ে প্রচার করছে, “হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনাকে সৃষ্টি না করলে গোটা জগতকে সৃষ্টি করতামনা”। তাদের প্রচারে প্রতারিত হবেন না। দেখুন ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ইমাম হাকিম নাইসাপুরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। কিন্তু তিনি গবেষণা করে ইহাকে জাল পেয়েছেন। এমনি ভাবে কোন মুহাদ্দিস হয়তো তাহকিক ছাড়া সহিহ বলেছেন। তাই ঐ সকল রোফারেন্স দিয়ে প্রচার করা ঠিক হবেনা। এখন সব গবেষনা আমাদের সামনে উম্মুক্ত।
মনে রাখতে হবে জাল যঈফ বর্ননায় আকিদা হয়না। আমাদের দেশে যে সকল আমেম যঈফ হাদিসের উপর আমলকে জায়েয বলে তারাও যঈফ হাদিসের উপর আকিদা প্রষোন কে জায়েয মনে করে না।
৯। বিদআত বিশ্বাস হলোঃ অলিদের কাশফ কে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করে।
সঠিক আকিদা হলোঃ কাশফ বলতে শরীয়তে কিছু নেই। তার পরও যদি কারও কাশফ তবে তা অবশ্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে হয়েছে বলে বিশ্বাস করেত হবে।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
বিদআতীগণ দাবি করেন, অলিদের কাশফ তাদের নিজস্ব ক্ষমতা। তাদের মতে, মানুষ আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে তার হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় এবং তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার অন্তর আত্মা খুলে যায়। এবং এই অন্তর আত্মা খুলে যাওয়া কে তাদের পরিভাষায় কাশফ বলা হয়।
কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন আল্লাহর আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে, জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন। তাদের স্বীকৃত যত অলী আওলীয়া আছে তাদের সকলেরেই কাশফ হত। মনে হবে এটা তাদের অলী হওয়ার একটি শর্থ।
আসুন দেখি কাশফ সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?
‘কাশ্ফ’ অর্থ প্রকাশিত হওয়া বা অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক তার কোন বান্দার নিকট তার অজানা এমন কিছুর জ্ঞান প্রকাশ করা যা অন্যের নিকট অপ্রকাশিত। এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরীয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। তবে অহী হলে তা কেবলমাত্র নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমনঃমহান আল্লাহ বলেন,
عَـٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ فَلَا يُظۡهِرُ عَلَىٰ غَيۡبِهِۦۤ أَحَدًا (٢٦) إِلَّا مَنِ ٱرۡتَضَىٰ مِن رَّسُولٍ۬ فَإِنَّهُ ۥ يَسۡلُكُ مِنۢ بَيۡنِ يَدَيۡهِ وَمِنۡ خَلۡفِهِۦ رَصَدً۬ا (٢٧
অর্থঃ ‘তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারু নিকট প্রকাশ করেন না’। ‘তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তিনি তার (অহীর) সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। (সুরা জিন ৭২:২৬-২৭)।
তবে কখনও কখনও রীতি বহির্ভূতভাবে অন্য কারু নিকট থেকে অলৈাকিক কিছু ঘটতে পারে বা প্রকাশিত হতে পারে। যেমন ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই ‘কাশ্ফ’ কোন নবীর ও ইচ্ছাধীন নয়। এমনকি আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে ও ইচ্ছাধীন ছিলনা।
যেমন, সহিহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬০, হাদিস ৪৩৪। এর একটি ঘটনা সহীহ বুখারীর “তাফসির” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে, আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একজন স্ত্রী, এর কাছে মধু পান করতেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ থাকতেন। তাই আমি (আয়েশাহ) ও হাফসা একমত হলাম যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রসূল (সাঃ) আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? আপনার মুখ থেকে মাগাফীরের গন্ধ পাচ্ছি। (আমরা তাই করলাম) এবং তিনি বললেন, না, বরং আমি যয়নাব বিনতে জাহশ এর ঘরে মধু পান করেছি। তবে আমি কসম করলাম, আর কখনো মধু পান করব না। তুমি এ বিষয়টি আর কাউকে জানাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِذۡ أَسَرَّ ٱلنَّبِىُّ إِلَىٰ بَعۡضِ أَزۡوَٲجِهِۦ حَدِيثً۬ا فَلَمَّا نَبَّأَتۡ بِهِۦ وَأَظۡهَرَهُ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ عَرَّفَ بَعۡضَهُ ۥ وَأَعۡرَضَ عَنۢ بَعۡضٍ۬ۖ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِۦ قَالَتۡ مَنۡ أَنۢبَأَكَ هَـٰذَاۖ قَالَ نَبَّأَنِىَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡخَبِيرُ (٣)
অর্থঃ যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন। তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। (সুরা আত-তাহরীমের আয়াত -৩)।
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগন গোপনে আলাপ করল অথচ তিনি কিছুই জানলেন। তার কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে যানতে পারতেন।
কোন এক সফরে ‘আয়িশা (রা) হার হারিয়ে গেল। সাহাবিদের পথে আটকিয়ে রেখে হার খোজ করা হল। এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেরেসানিতে ফেললেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামক যে উটে তিনি ছিলেন, হার খানা তার নীচে পরে ছিল। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সেঙ্গে হার খানা পেয়ে যেতেন। হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ আলাইহিস সালামে খবর না পাওয়ার কারণে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম কাশফের মাধ্যমে খবর পেলেন নিশ্চই। অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো অমুসলিমদের ও হতে পারে।অতএব এরূপ যদি কোন মুমিন থেকে হয়, তবে সেটা হবে ‘কারামত’। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে এর দ্বারা সম্মানিত করেন। আর যদি কাফির থেকে ঘটে, তবে সেটা হবে ফিৎনা। অর্থাৎ আল্লাহ এর দ্বারা তার পরীক্ষা নিচ্ছেন যে, সে এর মাধ্যমে তার কুফরী বৃদ্ধি করবে, না তওবা করে ফিরে আসবে। কাজেই কাশফকে অলিদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করা কুফরি। আল্লাহ তার বান্দদের মাঝে যাকে ইচ্ছা তাকে অদৃশ্যের খবর জানাবেন এটাই স্বাভাবিক।
১০। বিদআত বিশ্বাস হলোঃ অলি আওলিয়াদের কারামত ইচ্ছাধীন মনে করা।
সঠিক আকিদা হলোঃ কারামত সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ ইচ্ছাধীন।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
বিদাআতী সুফিদের বিশ্বাস হলো, অলি আওলিয়াদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে। তাই তারা কারামতের ব্যপারে একটু বাড়াবাড়ি করে। বিদআতী আকিদাধারীগন বিভিন্ন সময় দাবি করে থাকেঃ- অলী আওলিয়াগন মৃতকে জীবিত করতে পারে, অলীদের আদেশে নদ-নদী ও আসমান-যমিনের কাজ পরিচালিত হয়, ইলমে গায়েবের জানেন, ভবিষ্যত জানেন, মায়ের পেটের সন্তানের খবর বলে দেয়, দুরের খবর সেখানে না গিয়েই বলে দেয়, চট্রগ্রাম বসে ভৈরবের খবর বলে দেয় ইত্যাদি। তাদের জীবিত ও মৃত কল্পিত পীর ও অলীদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাদের কারামত বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকে। যে সকল কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ করার ক্ষমতা রাখে না তা কখনও অলীদের কারামত হতে পারে না।
মানুষের হাতে অলৌকিক বা সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত কোন ঘটনা ঘটলে তার পিছনে দুটি কারন থাকে। হয় যাদু না হয় কারামত। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পুর্ণ অনুসরণ করে তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এবং তা কারামত। অপর পক্ষে যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পুর্ণ অনুসরণ করে না, তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নয় এটা হয় ভেলকিবাজি না হয় যাদু। কাজেই বলা যায় কারামত ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে একমাত্র মাপকাঠি। কারামতে ব্যাপারে আহ্লুস্ সুন্নাতের বিশ্বাস হচ্ছে: আউলীয়াদের কারামত সত্য এবং তাতে বিশ্বাস করা জরুরি। তবে অলী হওয়ার জন্য কারামত প্রকাশিত হওয়া জরুরী নয়।
তবে মনে রাখতে হবে, আওলিয়াদের কারামত তাদের ইচ্ছাধীন নয়। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য একটা সম্মান। এমনকি অলীগণ তা জানতেও পারেন না। চ্যলেন্স করে কারামত ঘটানোর ঘটনা সম্পুর্ন মিথ্যা। কারন মহান আল্লাহ কারো কাছে দায় বদ্ধ নয়। এমন কি আমাদের প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নকিটও নয়।
যেমন: মহান আল্লাহর বলেন,
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَاْىۡءٍ إِنِّى فَاعِلٌ۬ ذَٲلِكَ غَدًا (٢٣) إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُۚ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلۡ عَسَىٰٓ أَن يَهۡدِيَنِ رَبِّى لِأَقۡرَبَ مِنۡ هَـٰذَا رَشَدً۬ا (٢٤)
অর্থঃ আর দেখো, কোনো জিনিসের ব্যাপারে কখনো একথা বলো না, আমি কাল এ কাজটি করবো৷ তবে যদি আল্লাহ চান৷ যদি ভুলে এমন কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে সাথে সাথেই নিজের রবকে স্মরণ করো এবং বলো, “আশা করা যায়, আমার রব এ ব্যাপারে সত্যের নিকটতর কথার দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন৷ (সুরা কাহাব :২৩-২৪)।
কুরআন হাদিসে অসংখ্যা প্রমান আছে, পূর্ববর্তী যুগের অনেক সৎ লোক, সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তী যুগের অনেক সৎ লোকের হাতে আল্লাহ্ কারামত প্রকাশ করেছেন। যেমন মারইয়াম আলাইহিস সালাম, আসহাবে কাহাফ, জুরাইজ, আব্বাদ বিন বিশর, উমার বিন খাত্তাব, উসায়েদ ইবনে হুযায়ের এমনি আরও অনেক সাহাবীর হাতে আল্লাহ তাআলা কারামত প্রকাশ করেছেন। সুতারং আওলিয়াদের কারামত ইচ্ছাধীন মনে করা কুফরি। এ ব্যপারে আহ্লুস্ সুন্নাতের আকিতা অনুসরণ করা উচিৎ। বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।
১১। বিদআত বিশ্বাস হলোঃ সুফিদের মাঝে কেউ কেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে, এমন কি তারা মৃতকে জীবিত করতে পারে।
সঠিক আকিদা হলোঃ মহান আল্লাহ ছাড়া কেউই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পারে না।
সাধারন জনগন মনে করে পীর দুই প্রকার যথাঃ হক্কানী পীর আর ভন্ড পীর। উপমহাদেশে যারা হক্কানী হিসাবে দাবিদার তাদের একজন হল চরমোনাই পীর। তাদের লেখা কিতাব ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার একটা কাহিনী আছে। যাতে বুঝা যায়, সুফীরা বিশ্বাস করে তাদের অলীরা মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম।
যেমনঃ শামসুদ্দীন তাব্রীজী নামের এক লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে পীর সাহেব কেবলা বলত। একদা হযরত পীর সাহেব কিবলা রোম শহরের দিকে রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে ঝুপড়ির ভেতর এক অন্ধ বৃদ্ধকে লাশ সামনে নিয়া কাদঁতে দেখিলেন। হুজুর বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিলে বৃদ্ধ উত্তর করিলেন, হুজুর এই পৃথিবীতে আমার খোঁজ-খবর করিবার আর কেউ নাই, একটি পুত্র ছিল সে আমার যথেষ্ট খেদমত করিত, তাহার ইন্তেকালের পর সে একটি নাতি রাখিয়া যায়।
সেই ১২ বছরের নাতি একটা গাভী পালিয়া আমাকে দুগ্ধ খাওয়াইত এবং আমার খেদমত করিত, তার লাশ আমার সম্মুখে দেখিতেছেন। এখন উপায় না দেখিয়া কাঁদিতেছি। হুজুর বলিলেন এ ঘটনা কি সত্য? বৃদ্ধ উত্তর করিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন হুজুর বলিলেনঃ “হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও”। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে জড়াইয়া ধরিল, বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করিল তুমি কিরুপে জিন্দা হইলে। ছেলে জবাব দিল, আল্লাহর অলি আমাকে জিন্দা করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ) তারপর ঐ অঞ্চলের বাদশাহ হুজুরের এই খবর পেয়ে উনাকে তলব করিলেন। উনাকে পরে জিজ্ঞেস করিলেন “আপনি কি বলিয়া ছেলেটিকে জিন্দা করিয়াছেন”। হুজুর বলিলেন আমি বলেছি হে ছেলে আমার আদেশে জিন্দা হইয়া যাও। অতঃপর বাদশাহ বলিলেন, যদি আপনি বলিতেন আল্লাহর আদেশে। হুজুর বলিলেন “মাবুদ! মাবুদের কাছে আবার কি জিজ্ঞেস করিব। তাহার আন্দাজ নাই (নাউ-যুবিল্লাহ)। এই বৃদ্ধের একটি মাত্র পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে, বাকী ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরুপ জিন্দেগী গোজরান করিত, তাহাকেও নিয়া গেল। তাই আমি আল্লাহ পাকের দরবার থেকে জোড়পূর্বক রুহ নিয়ে আসিয়াছি। (নাউ-যুবিল্লাহ)।
এরপর বাদশাহ বলিলেন আপনি শরীয়াত মানেন কিনা? হুজুর বলিলেন নিশ্চয়ই! শরীয়াত না মানিলে রাসূল (সাঃ) এর শাফায়াত পাইব না। বাদশাহ বলিলেন, আপনি শির্ক করিয়াছেন, সেই অপরাধে আপনার শরীরের সমস্ত চামড়া তুলে নেয়া হবে। এই কথা শুনিয়া আল্লাহর কুতুব নিজের হাতের অঙ্গুলি দ্বারা নিজের পায়ের তলা থেকে আরম্ভ করে পুরো শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নিলেন, তা বাদশাহর কাছে ফেলিয়া জঙ্গলে চলিয়া গেলেন।
পরদিন ভোরবেলা যখন সূর্য উঠিল তার চর্মহীন গায়ে তাপ লাগিল তাই তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন হে সূর্য, আমি শরীয়াত মানিয়াছি, আমাকে কষ্ট দিওনা। তখন ওই দেশের জন্য সূর্য অন্ধকার হইয়া গেল। দেশের মধ্যে শোরগোল পড়িয়া গেল। এই অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ হুজুরকে খুঁজিতে লাগিলেন। জঙ্গলে গিয়া হুজুরের কাছে বলিলেনঃ শরীয়াত জারি করিতে গিয়া আমরা কি অন্যায় করিলাম, যাহার জন্য আমাদের উপর এমন মুসিবত আনিয়া দিলেন। তখন হুজুর সূর্য কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাকে বলিয়াছি আমাকে কষ্ট দিওনা, কিন্তু দেশবাসীকে কষ্ট দাও কেন? সূর্যকে বশ করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা বলা মাত্র সূর্য আলোকিত হইয়া গেল। আল্লাহ্ পাক তাহার ওলীর শরীর ভাল করিয়া দিলেন।
কুরআনের আলোকে তাদের দাবি মিথ্যা প্রমানিতঃ
সুফিদের এই ধরনের বহু ঘটনা তাদের কিতাবাধিতে বর্নিত আছে। উক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
অর্থঃ হে নবী! আপনি জিজ্ঞেস করুন, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সমপাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও ভয় করছ না? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ কথা বিশ্বাস করত না যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখেন না। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
অর্থঃ অথচ আল্লাহ্ই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। তোমাদের সমস্ত কাজই, তোমরা যা কিছুই কর না কেন, আল্লাহ্ সবকিছুই দেখেন। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৫৬)।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
كَذَلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَى وَيُرِيكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
অর্থঃ এভাবে আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তার নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর। (সূরা বাকারাঃ ৭৩)।
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ فَاللَّهُ هُوَ الْوَلِيُّ وَهُوَ يُحْيِي الْمَوْتَى وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থঃ তারা কি আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে অলী বা অভিভাবক স্থির করেছে? উপরন্তু আল্লাহ্ই তো একমাত্র অলী বা অভিভাবক তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। (সূরা শূরা ৪২:৯০।
এমনি আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট। এমন কি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ) এর মুজেযা। যেমনঃ আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেনঃ
وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي
অর্থঃ এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)।
একটি আয়াতে ভুল ব্যাখ্যাঃ
উপরের আলোচনায় বুঝা যায়। শামসুদ্দীন তাব্রীজী পীরের এ দাবি মিথ্যা। এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। যখন বিভিন্ন মতল থেকে এই শির্ক ঘটনা ব্যাপক হারে প্রচার পেল, তখন এর জবাবে চরমোনাই মাদ্রাসার একজন মুদাররিস মুফতি ফয়জুল্লাহ বিন ইদরীস ‘মুমিনের হাতিয়ার’ নামে একটা বই লিখেন যার ১১৩ পৃষ্ঠা থেকে ১৬৭ দীর্ঘ আলোচনা করে উক্ত শির্ক কাহিনী সত্য ও নির্ভজাল করার মিথ্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। হায় আফসস, যদি তারা বলতেন, এ সকল ঘটনা কোন সনদ নেই, হয়তো মুদিদের কোন একটা বিষয় বুঝানোর জন্য সনদ বিহীন ঘটনা তুলে ধরতে যাতে শির্ক কথা বিদ্যমান আছে। আমরা আগামী প্রকাশনায় ইহা বাদ দিয়ে প্রকাশ করব, ইনশ আল্লাহ। তা না করে এই শির্ক কথাকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা দ্বারা জায়েয প্রমান করছেন। আর মানুষের ঈমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।
মুফতি ফয়জুল্লাহ বিন ইদরীস ‘মুমিনের হাতিয়ার’ নামে একটা বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় লিখেন, মহান আল্লাহ বলেন,
وَرَسُولاً إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُم مِّنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللّهِ وَأُبْرِئُ الأكْمَهَ والأَبْرَصَ وَأُحْيِـي الْمَوْتَى بِإِذْنِ اللّهِ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
অর্থঃ আর বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। [ সুরা ইমরান ৩:৪৯ ]
এ আয়াতে ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় ঈসা আলাইহিস সালাম মৃত্যুদের জীবিত করতে পারতেন। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহ মানুষকে জীবিত করার ক্ষমতা প্রদান করেছে। তারপর একটু ব্যাখ্যা করে বলেন, শামসুদ্দীন তাব্রীজী পীর কে আল্লাহ এই ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তাদের দাবি মতে, ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন (قُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ) অর্থাৎ তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও। যেমন, আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে বলেনঃ (وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي)অর্থঃ এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)
আর শামসুদ্দীন তাব্রীজী বললেন قُمْ بِإِذْني অর্থাৎ আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও। এদুটি কথার মধ্য কোন পার্থক্য নেই। (‘মুমিনের হাতিয়ার’ বইয়ের ১২২ পৃষ্ঠা)।
আমারা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালামকে মৃত্যুদের জীবিত করার ক্ষমতা দিয়েছিলের যার সনদ সুরা ইমরান (৩:৪৯)।
শামসুদ্দীন তাব্রীজী পীরের মৃত্যুদের জীবিত করার ক্ষমতা যে আল্লাহ দিয়েছিলেন তার সনদ কই? এমন সনদ বিহীন কল্পকাহিনী বিশ্বাস করলে যে কোন পীর সম্পর্কে তার মুরিদগন আল্লাহ নিজেস্ব কোনগুন দাবী করে বলবে, এটা মহান আল্লাহগুন ঠিক আছে কিন্ত এমন গুন আমাদের পীরকে আল্লাহ দিয়েছেন। তাহলে শির্কি বানিজ্য শুরু হয়ে যাবে। কাজেই সনদবিহীন কথা ত্যাগ করে সহিহ সুন্নাহ দিকে ফিরে আসাটাই কাম্য।
আসলে আল্লাহ অলীদের কারামত সত্য হলেও তার সিমাবদ্ধতা অনেকেই যানা নেই। সুফিরা মনে করে অলি আওলিয়াদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে। তাই তারা কারামতের ব্যপারে একটু বাড়াবাড়ি করে। নবীগণ আল্লাহর ইচ্ছায় বহু মুজিজা মানুষের সামনে উপস্থিত করছেন। এই সকল মুজিজার কোনটি সম্পর্কে তারা আগে জানতেন আবার কখনও জানতে পারতের না। তাদের নিকট যেহেতু আল্লাহর তবফ থেকে অহী আসত তাই তারা এ সম্পর্কে আগেই জেনে যেতেন। আবার অনেক সমায় যানতেন না। যেমনঃ মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ বললেন,
وَأَنْ أَلْقِ عَصَاكَ فَلَمَّا رَآهَا تَهْتَزُّ كَأَنَّهَا جَانٌّ وَلَّى مُدْبِرًا وَلَمْ يُعَقِّبْ يَا مُوسَى أَقْبِلْ وَلَا تَخَفْ إِنَّكَ مِنَ الْآمِنِينَ
অর্থঃ আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন সে লাঠিকে সর্পের ন্যায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখল, তখন সে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে পালাতে লাগল এবং পেছন ফিরে দেখল না। হে মূসা, সামনে এস এবং ভয় করো না। তোমার কোন আশংকা নেই। [ সুরা কাসাস ২৮:৩১ ]
মুসা আলাইহিস সালাম এই মুজিজা সম্পর্কে কিছুই জানতেন যার ফলে তিনি মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে পালাতে লাগল এবং পেছন ফিরে দেখল না।
অলিদের নিকট অহী আসে না তাই তারা কখন বলতে পাবরেন না। আমি এখন এই ধরনের কারামত দেখাব। তবে হ্যা, তিনি দোয়া করতে পারেন, আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন আবার নাও কবুল করতে পারেন। তিনি আল্লাহ এ কাজে কারো কাছে বাধ্য নন। দোয় কবুল করতে ও বাধ্য নন।
যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَاْىۡءٍ إِنِّى فَاعِلٌ۬ ذَٲلِكَ غَدًا (٢٣) إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُۚ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلۡ عَسَىٰٓ أَن يَهۡدِيَنِ رَبِّى لِأَقۡرَبَ مِنۡ هَـٰذَا رَشَدً۬ا (٢٤)
অর্থঃ আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব।`আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন। (সুরা কা’হফ ১৮:২৩-২৪)।
এ আয়াতের পেক্ষাপট একটু জানলে ভাল হবে। এর পেক্ষাপট হলঃ মক্কার মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরীক্ষা নেবার জন্য আহলি কিতাবদের পরামর্শক্রমে তাঁর সামনে যে তিনটি প্রশ্ন করেছিল।প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ
১। আসহাবে কাহফ কারা ছিলেন?
২। খিযিরের আলাইহিস সালাম এর ঘটনাটি এবং তার তাৎপর্য কি ?
৩। বাদশা যুলকারনাইনের ঘটনাটি কি ?
জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর উপর ভবসা রেখে বলে ছিলেন যে, আগামি কাল বলল কিন্তু তিনি ইনসাআল্লাহ বলতে ভুলে যান।তাই বেশ কিছু দিন অহী আসা বদ্ধ থাকে। তার পর উক্ত আয়াত নাজিল হয়। আর তিনটি কাহিনীও আল্লাহ কুরআতে তুলে ধরেন। তা হলে এর দ্বারা বুঝতে পারলাম, মহান আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটও কোন মুজিজা দেখানে বাধ্য নন। কোন আবেদনে সাড়া প্রদান মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছাধীন। এখানে অলী বা পীরদের ব্যাপারতো যোজন বিয়োজন দুরেন কথা। তাই একটা কথা মনে রাখতে হবে আল্লাহ কাউকে তার নিজেস্ব ক্ষমতায় ভাগ দেন না। এমনকি আমাদের রাসুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেও না। কোন মুমিন নকবান্দাকে আল্লাহ তার স্থায়ীগুন দান করেন না। যার কোন নজীর কুরআন সুন্না্হে নেই। তবে পীরদের জীবনিতে সনদবিহীন এমন অনেক শির্কি কথা চালু আছে যা দেখে অনেক অজ্ঞ লোক সহজে ধোকা খান আর আল্লাহর রোহবিয়াতের ক্ষেত্রে শরিক স্থাপন করেন।
মন্তব্যঃ মৃত্যুকে জীবিত করার একমাত্র ক্ষমতা মহান আল্লাহ। কাজেই সনদ বিহীন শির্ক কথা ও কাজ থেকে দুরে থাকি।
১২। বিদআত বিশ্বাস হলোঃ বিদআতীগল তাদের পীর বা অলীদের হিদায়েতের মালিক মনে করে তাদের নিকট ধর্না দেয়।
সঠিক আকিদা হলোঃ হিদায়েতের এক মাত্র মালিকমহান আল্লাহ তায়ালা।
সঠিক আকিদার দলীলঃ
হিদায়েতের এক মাত্র মালিকমহান আল্লাহ তায়ালা। বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালেবের শেষ সময় উপস্থিত হলেন এবং তিনি নিজের সামর্থ মোতাবেক কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর প্রতি ঈমান আনআবার জন্য চুড়ান্ত চেষ্টা চালান। তিনি চাচ্ছিলেন তাঁর চাচা ঈমানের মধ্য দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন। কিন্তু চাচা তা গ্রহন না করে আব্দুল মুত্তালিবের অনুসৃত ধর্মের মধ্যে অবস্থান করে জীবন দেয়াকে অগ্রাধিকার দেন। এ ঘটনায় আল্লাহ বলেন:
إِنَّكَ لَا تَہۡدِى مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ يَہۡدِى مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ (٥٦)
অর্থঃ আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা’আলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন। (সুরা কাসাস ২৮:৫৬)।
তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদ ইত্যাদিতে আবু হুরাইরা (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রা), ইবনে উমর (রা) প্রমুখ সাহাবীগণ বর্ণিত অন্যান্য হাদীসগুলো থেকে অনিবার্যভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না যে, সূরা কাসাসের এ আয়াতটি আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় নাযিল হয়েছিল।
মহান আল্লাহ বলেন,
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَـٰتِلُواْ ٱلَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ ٱلۡڪُفَّارِ وَلۡيَجِدُواْ فِيكُمۡ غِلۡظَةً۬ۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِينَ (١٢٣)
অর্থঃ নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী। (সুরা তাওবা ৯:১১৩)।
এই আয়াতের তফসীর সহীহ বুখারীতে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন নবী (সাঃ)-এর চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এল, তখন নবী (সাঃ) তার নিকট গেলেন। তার নিকট আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ বিন আবী উমাইয়্যাহ বসেছিল। নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘চাচাজান! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ে নিন, যাতে আমি আল্লাহর নিকট আপনার জন্য প্রমাণ পেশ করতে পারি। আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ বিন আবী উমাইয়্যাহ বলল, ‘‘হে আবু তালেব! (মৃত্যুর) সময় আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে?’’ (শেষে ঐ অবস্থাতেই তার মৃত্যু হল)। নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘যতক্ষণ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে নিষেধ না করা হবে, ততক্ষণ আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকব।’’ তখন উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হল, যাতে মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। (সহীহ বুখারী)। এবং সূরা কাসাসের ৫৬ নম্বর আয়াতটিও এই মর্মে অবতীর্ণ হয়েছে।
মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় আছে যে, একদা নবী (সাঃ) তাঁর মাতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চাইলে উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদ আহমদ ৫ম খন্ড ৩৫৫পৃঃ)।
উক্ত ঘটনা দ্বারা বুঝতে পারি, ব্যক্তিগত ভালবাসা ও আত্মিয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির হিদায়াত লাভ করত ততে তিনি ছিলেন আবু তালেব। কিন্তু তাকে হিদায়াত দান করার শক্তি যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামকে দিলেন না, তা হলে একথা একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কাউকে হিদায়াত দান করা বা কাউকে হিদায়াত বঞ্চিত করা নবীর ক্ষমতার বাইরে। এবং বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। আর আল্লাহর কাছ থেকে এ সম্পদটি কোন আত্নীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষের সত্যানুরাগ, এবং সত্যপ্রীতি মানসিকতার ভিত্তিতেই দান করা হয়।
মহান আল্লাহ আরও বলেন:
وَمَآ أَڪۡثَرُ ٱلنَّاسِ وَلَوۡ حَرَصۡتَ بِمُؤۡمِنِينَ ١٠٣
অর্থঃ কিন্তু তুমি যতই চাওনা কেন অধিকাংশ লোক তা মানবে না৷ (সুরা ইউসুফ ১২:১০৩)।
মানুষকে হিদায়াত দান করার দায়িত্ব মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের ওপর অর্পিত হয়নি ৷ আল্লাহ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন। তার দায়িত্ব ছিল কেবল মানুষের নিকট হককথা পৌঁছিয়ে দেয়া। নবী মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামকে যে ক্ষমতা দান করলেন না, তাকি কি করে পীর বা অলীদের দখলে থাকল। পীর বা অলীদের হিদায়েতের মালিক মনে করে ধর্না দেওয়া শির্কে আকবার এতে কোন সন্ধেহ নেই।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)