মিনায় অবস্থানের সময় আমল

মিনায় অবস্থানের সময় আমল

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

মিনায় দ্বিতীয় দফা অবস্থানঃ

জিলহজ্জের দশ তারিখ মুজদালিফা থেকে দ্বিতীয় দফা মিনায় আসা হয়। এই স্থানে ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্জ অবস্থান করা ওয়াজিব। এই কয় দিন মিনায় অবস্থানের অন্যতম কারন জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ। কঙ্কর নিক্ষেপ হজ্জের একটি ওয়াজিব আমল। মক্কা বা মিনার বাহিরে রাত্রি যাপন করে এসে মিনায় কঙ্কর মারলেই হবে না। সহিহ হাদিসে মিনায় অবস্থান করার কথাই ষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ জিলহজ্জ মিনাতে রাত্রিযাপন করালেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। কোন কারনে ১২ জিলহজ্জ দুপুরের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ১৩ তারিখও অবস্থান করতে হবে। পরের দিন ১৩ই যিলহজ্জ দুপুরের পর ৩টি জামারাকে আরো ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে পরে মিনা ত্যাগ করতে হবে। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এর মতে দুপুরের আগে কঙ্কর মারা জায়েয আছে। কিন্তু একই মাযহাবের তাঁরই দুজন সঙ্গী ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে দুপুরে সূর্য ঢলার আগে কঙ্কর নিক্ষেপ জায়েয হবে না। কাজেই দুপুরের আগে নিক্ষেপ না করাই উত্তম।

মিনায় থাকার হুকুমঃ

বিশুদ্ধ মতে, আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোতে হাজ্জি সাহেবদের জন্য মিনায় রাত্রিযাপন করা ওয়াজিব। তাই উক্ত দিনগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মিনায় অবস্থায় করতে হবে। হাজী সাহেবগণ যদি কোন রাতই মিনায় যাপন না করেন, তাহলে আলিমদের মতে, তার ওপর দম দেয়া ওয়াজিব হবে। আর যদি কিছু রাত মিনায় থাকেন এবং কিছু রাত অন্যত্র, তাহলে গুনাহগার হবেন। এক্ষেত্রে কিছু সদকা করতে হবে। পারতপক্ষে দিনের বেলায়ও মিনাতেই থাকুন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোও মিনায় কাটিয়েছেন।

দলিলঃ

১. আবদুর রাহমান ইবনু ইয়ামার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ সূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে নাজদবাসী কিছু লোক আসলো। তিনি তখন আরাফাতে অবস্থান করছিলেন। তারা হজ্জ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করে। এই মর্মে এক ঘোষণাকারীকে তিনি ঘোষণা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেনঃ হজ্জ হচ্ছে আরাফাতে অবস্থান। মুযদালিফার রাতে ফজর উদয় হওয়ার পূর্বেই কোন লোক এখানে পৌঁছতে পারলে সে হজ্জ পেল। তিনটি দিন হচ্ছে মিনায় অবস্থানের। দুই দিন অবস্থান করে কোন লোক তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করলে তাতে কোন সমস্যা নেই। আর তিন দিন পর্যন্ত অবস্থানকে কোন লোক বিলম্বিত করলে তাতেও কোন সমস্যা নেই। মুহাম্মাদ আল-বুখারী বলেন, ইয়াহইয়ার বর্ণনায় আরো আছেঃ এক লোককে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পিছনে আরোহণ করালেন। সে লোক তা ঘোষণা দিতে থাকল। (সুনানে তিরমিজ ৮৮৯, ইবনু মাজাহ (০১৫)।

২. ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘উমর রা. আকাবার ওপারে (মিনার বাইরে) রাত্রিযাপন করা থেকে নিষেধ করতেন এবং তিনি মানুষদেরকে মিনায় প্রবেশ করতে নির্দেশ দিতেন’। (ইবন আবী শায়বা ১৪৩৬৮)।

উজরের কারনে মিনার রাতগুলোতে মক্কায় অবস্থানঃ

ইব্‌নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আব্বাস (রাঃ) পানি পান করানোর জন্য মিনার রাতগুলোতে মক্কায় অবস্থানের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। (সহিহ বুখারি ১৭৪৫)

হাজ্জীদেরকে পানি পান করানোর জন্য মক্কা অবস্থানঃ

ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল-‘আব্বাস (রাঃ) হাজ্জীদেরকে পানি পান করানোর জন্য মিনায় অবস্থানের রাতগুলোতে মক্কায় অবস্থান করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাকে অনুমতি দেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৫৯)

মিনায় অবস্থান কালে প্রধান আমলঃ

ক। ১০ জিলহজ্জ বা ঈদের দিনের কাজঃ

মুজদালিফায় থেকে ফজরের পর রওয়ানা দিয়ে মিনায় খুব সকালে পৌছান যায় এবং সূর্যোদয়ের পর থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ শুরু হয়। কিন্তু মাজুল, দুর্বল, শিশু, নারী ও অক্ষম ব্যক্তিরা যারা মুজদালিফা থেকে মধ্য রাতেই চলে এসেছিল, তারা মধ্যরাত্রির পর থেকে কঙ্কর মারা শুরু করতে পারে। তবে ফজরের আউয়াল ওয়াক্ত থেকে সূর্য উঠার আগেও কঙ্কর নিক্ষেপ জায়েয আছে।  কিন্তু মনে রাখতে হবে,  এই ঈদের দিনে কঙ্কর নিক্ষেপের উত্তম সময় হল সূর্যোদয় থেকে শুরু করে দুপুরে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত মারাও জায়েয আছে। কারণবশতঃ সন্ধ্যার পর থেকে ঐ দিবাগত রাতের ফজর উদয় হওয়ার আগেও যদি মারে তবু চলবে। তবে এ সময়ে মাকরূহ হবে। আর অন্যান্য দিনে দুপুর পর থেকে মারা সুন্নাহ। জিলহজ্জের দশ তারিখ বা ঈদের দিন সকালে মিনায় পৌছেই বড় জামারায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মুস্তাহাব হলো এর আগে অন্য কোন কাজ না করা। হারাম শরীফ থেকে মিনায় আসলে ঐ পথে যেটা কাবার নিকটতম সেটাই বড় জামরা। এখন আর এই সব হিসাব করার দরকার নাই। তিনটি জামারা পর পর আছে। কাবা দিক থেকে প্রথম জামারাই হলো বড় জামারাহ।

দলিলঃ

১. আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি জামরাতুল কুবরা বা বড় জামরার কাছে গিয়ে বায়তুল্লাহকে বামে ও মিনাকে ডানে রেখে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। আর বলেন, যাঁর প্রতি সূরা আল-বাকারাহ নাযিল হয়েছে তিনিও এরূপ কঙ্কর মেরেছেন।  (সহিহ বুখারি ১৭৪৮)

২. আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন জামরাতুল আকাবায় কংকর মেরে মিনায় তাঁর অবস্থান স্থলে ফিরে এসে কুরবানীর পশু আনিয়ে তা যাবাহ করলেন। পরে নাপিত ডাকিয়ে প্রথমে তাঁর মাথার ডান দিকের চুল মুড়ালেন এবং তিনি উপস্থিত লোকদেরকে এক বা দুইগাছি করে চুল বিতরণ করলেন। তারপর মাথার বাম দিকের চুল মুড়ালেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আবু ত্বালহা আছে কি না? অবশিষ্ট চুলগুলো তিনি আবু ত্বালহা (রাঃ)-কে দিলেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৮১)

কঙ্কর নিক্ষেপর আগে জামারার অবস্থান দেখে নিন।

খ। ১১ জিলহজ্জ বা ঈদের পরের দিনের কাজঃ

১০ যিলহজ দিবাগত রাত অর্থাৎ ১১ যিলহজের রাত মিনাতেই যাপন করতে হবে। এটি যেহেতু আইয়ামুত-তাশরীকের রাত তাই সবার উচিত এ সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করা এবং পরদিন ১১ তারিখের আমলের জন্য প্রস্তুত থাকা।

প্রাথমিকভাবে হালাল হওয়ার জন্য সে সকল কাজ করা দরকার তা না করে থাকলে আজ প্রথমেই সেই কাজগুলো করতে হবে। যদি কোন কারনে ১০ তারিখের আমলের মধ্যে হাদী যবেহ, মাথা মু্ণ্ডন বা চুল ছোট করা অথবা তাওয়াফে ইফাযা বা যিয়ারত সম্পাদন বাকি থাকে, তবে তিনি আজ তা সম্পন্ন করতে পারেন। গত কাল শুধু বড় জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করেছিল। আজ তিনটি জামরাতেই কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। প্রত্যেক জামরাতে সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। সবগুলোর সমষ্টি দাঁড়াবে একুশটি কঙ্কর। তবে আরো দু’চারটি বাড়তি কঙ্কর সাথে নেবেন। যাতে কোন কঙ্কর লক্ষভ্রষ্ট হয়ে নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পড়ে গেলে তা কাজে লাগানো যায়। আজ ছোট জামরা থেকে শুরু করতে হবে এবং বড় জামরা দিয়ে শেষ করতে  হবে।  কঙ্কর নিক্ষেপের সময় হলো সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে। এদিন সূর্য হেলে যাওয়ার পূর্বে কঙ্কর নিক্ষেপ করা জায়েয নয়।

দলিলঃ

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন সূর্য পূর্ণভাবে আলোকিত হওয়ার পর জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। আর পরের দিনগুলোতে (নিক্ষেপ করেছেন) সূর্য হেলে যাওয়া পর। সহিহ মুসলিম ১২৯৯)

২.  ওয়াবারা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কখন কঙ্কর নিক্ষেপ করব? তিনি বললেন, তোমার ইমাম যখন কঙ্কর নিক্ষেপ করবে, তখন তুমিও নিক্ষেপ করবে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমরা সময়ের অপেক্ষা করতাম, যখন সূর্য ঢলে যেত তখনই আমরা কঙ্কর নিক্ষেপ করতাম। (সহিহ বুখারি ১৭৪৬)

কঙ্কন নিক্ষেপের যে বিস্তারিত পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে তার অনুসরণেই এই দিনে কঙ্কন নিক্ষেপ করতে হবে। তবে এই দিনে যিনি ইমাম বা ইমামের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি তিনি লোকজনের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করবেন। এ খুতবায় তিনি দীনের বিষয়সমূহ তুলে ধরবেন।

দলিলঃ

১. ইবনু আবূ নাজীহ (রহ.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি তাঁর পিতা থেকে বনী বাকরের দুই ব্যক্তি সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ‘আইয়্যামে তাশরীকে’ মধ্যের দিন (বারো তারিখ) খুৎবা দিতে দেখেছি। এই সময় আমরা তাঁর সওয়ারীর নিকটেই ছিলাম। মিনাতে এটাই ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেশকৃত খুৎবা। (আবু দাউদ ১৯৫২)

আজকের দিনটি আইয়ামে তাশরীকের অন্তর্ভুক্ত। আইয়ামে তাশরীক হলো আল্লাহর যিকর করার দিন। হাজীদের কর্তব্য স্থান, কাল ও অবস্থার মর্যাদা অনুধাবন করে তদনুযায়ী চলা ও আমল করা। সময়টাকে আল্লাহ তা‘আলার যিকর, তাকবীর বা অন্য কোন নেক আমলের মাধ্যমে কাজে লাগানো এবং সব রকমের অন্যায়, অপরাধ, ঝগড়া, অনর্থক ও অহেতুক বিষয় থেকে বেঁচে থাকা।

গ। ১২ জিলহজ্জ দিনের কাজঃ

১২ জিলহজ্জের আমল পুরোপুরি ১১ জিলহজ্জের আমলের মত। এই দিনে হাজ্জি সাহেবগণ সাধারণত ‘মুতা‘আজ্জেল’ তথা দ্রুতপ্রস্থানকারী এবং ‘মুতা’আখখের’ তথা ধীরপ্রস্থানকারী এই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوۡمَيۡنِ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِۖ لِمَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ إِلَيۡهِ تُحۡشَرُونَ ٢٠٣ ﴾

অর্থঃ অতঃপর যে তাড়াহুড়া করে দু’দিনে চলে আসবে। তার কোনো পাপ নেই। আর যে বিলম্ব করবে, তারও কোনো অপরাধ নেই। (এ বিধান) তার জন্য, যে তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় তোমাদেরকে তাঁরই কাছে সমবেত করা হবে। (সুরা বাকারা ২:২০৩)

মুতা‘আজ্জেল বা দ্রুতপ্রস্থানকারী হাজীগন এই দিন মিনা থেকে সূর্যাস্তের পূর্বেই বের যেতে হবে। সূর্য অস্ত গেলে আর বের হওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে মুতা’আখখের বা ধীরপ্রস্থানকারী হাজীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এবং তিনি মিনায় রাত্রিযাপন করবেন এবং পরের দিন কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন।

কারণ ইবন উমর রা. বলেন, ‘আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝির দিকে (১২ তারিখ) যে ব্যক্তি মিনায় থাকতে সূর্য ডুবে যায়, সে যেন পরদিন কঙ্কর নিক্ষেপ না করে (মিনা থেকে) প্রস্থান না করে। (মুয়াত্তা মালিক ১/১০৪)

যদি দ্রুতপ্রস্থানকারী হাজীগণ বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন তারপরও কোন কারণে বের হতে পারেননি বা পথিমধ্যে সূর্য অস্ত গিয়েছে। তবে তারা অধিকাংশ আলিমের মতে মুতা‘আজ্জেল থাকবেন এবং বের হয়ে যেতে পারবেন। অনুরূপভাবে মুতা‘আজ্জেল হাজীগণ যদি মিনায় তাদের কোন সামগ্রী রেখে আসেন এবং সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা থেকে বের হয়ে যান, তাহলে তারাও ফিরে গিয়ে তা নিয়ে আসতে পারবেন। এ জন্য আর পরদিন থাকতে হবে না।

মুতা‘আজ্জেল বা দ্রুতপ্রস্থানকারী এবং মুতা’আখখের বা ধীরপ্রস্থানকারী হাজীদের মধ্যে মুতা’আখখের বা ধীরপ্রস্থানকারী হাজ্জি সাহেবগনই উত্তম। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ১৩ তারিখ মিনায় অবস্থান করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর হুবহু অনুসরণের মধ্যেই যাবতীয় কল্যাণ নিহিত। তবে যদি কেউ ১২ তারিখ বিকালে আসতে চায তবে কোন অসুবিধা নাই। যদি কেউ হজ্জের কাজ থেকে বিরক্ত হয়ে শেষ দিন কঙ্কর নিক্ষেপ ত্যাগ করে বা আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনায় মিনা ত্যাগ করে, তবে তার কাজটি তাকওয়ার পরিপন্থি হবে। এই জন্যই সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত ১৩ মিনায় অবস্থান করা। 

ঘ। মিনায় অবস্থান কালে ফরজ ও ওয়াজিব আদায়ঃ

মিনায় রাত্রি জাপন ওয়াজিব। মিনার এই ওয়াজিব পালনের পাশিপাশি কিছু আমলও চালিতে যেতে হবে। মুজদালিফা থেকে মিনায় আসার পর চারটি আবশ্যকীয় আমল করেত হবে। কাজ চারটি হলোঃ

১. কঙ্কর নিক্ষেপ করা

২. কুরবানী করা

৩. মাথা মুন্ডন করা বা চুল ছোট করা

৪. তাওয়াফে ইফাদা বা হজ্জের জন্য তাওয়াফ করা

মন্তব্যঃ এই চারটি কাজের মধ্যে তাওয়াফে ইফাদা ব্যতিত প্রতিটি কাজই ওয়াজিব। তাই কোন কাজ হালকা করে নেয়া যাবে না। মিনায় অবস্থান কাজেই এই ফরজ ও ওয়াজিবগুলো গুরুত্ব দিয় আদায় করতে হয়। তাওয়াফে ইফাদা ব্যতিত বাকি তিনটি কাজই মিনায় করা যায়। তাওয়াফে ইফাদা আদায়ের জন্য মক্কায় গেলেও আবার মিনায় ফিরে এসে রাত্রিযাপন করতে হবে।

ঙ। দিনের বেলায় মিনা ত্যাগ করাতে অসিবুধা নাইঃ

 মিনায় শুধু রাত্রি জাপন ওয়াজিব। তাই দিনের বেলায় হাজ্জিগন হজ্জের অন্যতম কাজ তাওয়াফে ইফাযা ও সা‘ঈ করার জন্য মক্কায় চলে যেতে পারেন। যারা মক্কা গমন করবে, তাঁদেরকে অবশ্যই তাওয়াফ-সাঈ শেষ করে মিনায় ফিরে আসতে হবে। আবার অনেকে কুরবানী করার জন্যও মিনার বাহিরে যায়। তাদেরও দিন শেষে আবার মিনায় রাত্রি জাপনের জন্য ফিরে আসতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, মিনায় রাত্রিযাপন গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। এমনকি সঠিক মতে এটি ওয়াজিব।

দলিলঃ

১. হিশাম ইবনু উরওয়াহ (র) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেন মিনায় অবস্থানের রাত্রিসমূহে কেউ যেন মিনা ব্যতীত অন্যত্র রাত্রি যাপন না করে। (মুয়াত্তা মালিক ৯০৫, হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) একক ভাবে বর্ণনা করেছেন)

২. ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন মক্কায় এসে তাওয়াফে যিয়ারত সমাপ্ত করে পুনরায় মিনায় ফিরে এসে সেখানে যুহরের সলাত আদায় করেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৯৮)

৩. ইবনু ‘উমার (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন মক্কায় এসে তাওয়াফে যিয়ারা সমাপ্ত করে পুনরায় মিানয়ই ফিরে এসে সেখানে যুহরের সালাত আদায় করেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৯৮)

৪. আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন মাক্কায় গিয়ে তাওয়াফে ইফাযাহ্ (তাওয়াফে যিয়ারত) করলেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিনায় ফিরে যুহরের সালাত আদায় করলেন। (মিসকাত ২৬৫২)

৫. আয়িশাহ্ (রাঃ)] থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত আদায়ে পর দিনের শেষ বেলায় তাওয়াফে ইফাযাহ্ সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার মিনায় ফিরে এলেন এবং সেখানেই আইয়্যামে তাশরীক্বের দিনগুলো অবস্থান করলেন। এ দিনগুলোতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সূর্যাস্তের পর জামারায় সাতটি করে পাথর মারতেন। প্রত্যেক পাথর মারার সাথে সাথে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলতেন। আর প্রথম ও দ্বিতীয় জামারার নিকট দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন ও আল্লাহর কাছে (অনুনয়-বিনয় করে) প্রার্থনা করতেন। কিন্তু তৃতীয় জামারায় (পূর্বের ন্যায় পাথর মারার পর) অপেক্ষা করতেন না। (মিসকাত ২৬৭৬, আবূ দাঊদ ১৯৭৩)

চ। মিনায় রাত্রিযাপনের সময় আমলঃ

বলাবাহুল্য, মিনায় রাত্রিযাপনের অর্থ মিনার এলাকাতে রাত কাটানো। রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু ঘুমিয়ে বা শুয়ে থাকতে হবে। সুতরাং যদি মিনায় বসে সালাত আদায় করে, দোয়া যিকর কিংবা কথাবার্তা বলে তাহলেও রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। মিনা রাত্রযাপন কালে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। হজ্জের বিধান বর্ণনা করছেন। এমনি কি তিনি সাহাবীদের জন্য ওয়াজ নসিয়ত করেছেন। তাই হাজ্জিদের মিনা অবস্থান কাজে ব্যক্তিগত আমলের পাশাপাশি আলেমদের বক্তব্য শুনার চেষ্টা করতে হবে। নিজ দেশের ও নিজের ভাষার বহু আলেম হজ্জে যায়। তাদের কাছে থেকে ইমল অর্জন করে আমলের চেষ্টা করি।

দলিলঃ

১. আবূ বাক্‌রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী দিবসে মিনায় ভাষণ দানকালে বলেছেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সন্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস, তোমাদের এ শহর মর্যাদাসম্পন্ন । (উবনু মাজাহ ২৩৩, আহমাদ ১৯৮৭৩)

২. আবূ বাক্‌রাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি একদা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা উল্লেখ করে বলেন, (মিনায়) তিনি তাঁর উটের উপর উপবেশন করলেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর উটের লাগাম ধরে রেখেছিলো। তিনি বললেনঃ ‘এটা কোন্‌ দিন?’ আমরা চুপ করে রইলাম আর ধারণা করলাম যে, অচিরেই তিনি এ দিনটির আলাদা কোন নাম দিবেন। তিনি বললেনঃ “এটা কি কুরবানীর দিন নয়?” আমরা বললাম, ‘জি হ্যাঁ।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘এটা কোন্‌ মাস?’ আমরা নীরব রইলাম আর ধারণা করলাম যে, অচিরেই তিনি এর আলাদা কোন নাম দিবেন। তিনি বললেনঃ ‘এটা কি যিলহাজ্জ মাস নয়?’ আমরা বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেনঃ ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস, তোমাদের এ শহর মর্যাদাসম্পন্ন। এখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা (আমার এ বাণী) যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট এসব কথা পৌঁছে দেয়। কারণ উপস্থিত ব্যক্তি সম্ভবত এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছাবে, যে এ বাণীকে তার চেয়ে অধিক আয়ত্তে রাখতে পারবে। (সহিহ বুখারি ৬৭, ১০৫, ১৭৪১, ৩১৯৭, ৪৪০৬, ৪৬৬২, ৫৫৫০)

৩. আবদুর রহমান ইবনু মুয়ায আত-তাইমী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিনায় আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। এ সময় আমরা ছিলাম উৎকর্ণ, যাতে তার বক্তব্য (ভাল করে) শুনতে পাই। আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থানেই ছিলাম। তিনি তাদের হাজ্জের যাবতীয় বিধি-বিধান শিখালেন, এমনকি কংকর মারা সম্পর্কেও। তিনি তাঁর উভয় শাহাদাত আঙ্গুল নিজের দু’ কানের মধ্যে রেখে বললেনঃ কংকরগুলো খুবই ক্ষুদ্র হওয়া চাই। তারপর মুহাজিরদেরকে নির্দেশ দিলে তারা মাসজিদের পেছনে গিয়ে অবস্থান করলেন। অত:পর অন্যান্য লোক তাদের অবস্থান গ্রহণ করে। (আব দাউদ ১৯৫৭)

ছ। মিনায় রাত্রযাপন কালে সালাতঃ

প্রথম দফায় ইহরাম বাঁধার পর হাজ্জিগণ মিনার দিকে রওয়ানা হয়ে যাওয়াই হলো সুন্নাত তরিকা। সূর্য ঢলার পূর্বে হোক আর পরে হোক ৮ জিলহজ্জ মিনায় পৌছাইতে চেষ্টা করা। মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অর্থাৎ ৮ জিলহজ্জ ‘জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা এবং ৯ জিলহজ্জ সকালের ফজর। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব। মিনায় থাকাকালীন সময়ে মক্কার অবস্থানকারী বা বহিরাগত সকলকে এই পাঁচ প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাতে তিন ওয়াক্ত (জোহর, আসর ও ইশা) সালাত নির্দিষ্ট সময়ে কসর পড়া।

দ্বিতীয় দফায় ১০ জিলহজ্জ সকালের ফজর সালাত আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় আসা হয়। এ সময় একটাকা ৪/৫ দিন মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। এই সময়ও সালাতের কসর আদায় করেত হবে। তবে অনেকে পূর্ণ সালাতও আদায় করে থাকে। তাদেরও দলিল আছে। দুটি দলিল পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে মিনার সকল সালাত কসরই হবে বলে মনে হবে। সে যা হোক আপনি অধিক যৌক্তিক ও হাদিস সম্মত কসরই আদায় করবেন তবে যদি কেউ কোন দলিলের আলোকে এখানে সালাত কসর না করে তবে তাকে ভতসনা করা যাবে না। তার সাথে বিবাদে জড়ান যাবে না। বিস্তরিত সফরের পরিচ্ছেদে দলিলসহ বর্ণানা করা হয়েছে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “মিনায় অবস্থানের সময় আমল

Leave a comment