কুরবানির দেওয়ার ১৭ টি শর্তসমূহ

কুরবানির দেওয়ার ১৭ টি শর্তসমূহ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

মহান আল্লাহ কুরবানিকে সঠিকভাবে করতে হলে রাসূল এর দেখান সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি আদায় করতে হবে। আমাদের মন মত যে কোন পশু ধরে জবেহ দিলেই কুরবানী আদায় হবে না। কোন পশু কোন তারিখে কি পদ্ধতিতে জবেহ করতে হবে। জবেহকৃত পশুর গোশ্তের বিধানা কি এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান কুরআন সুন্নাহ থেকে জেনে আমল করতে হবে। কুরবানিকে সঠিক ও কবুল যোগ্য কারার জন্য আমাদের নিম্মের শর্তগুলি লক্ষ রাখতে হবে।

১। এক মাত্র মহান আল্লাহ জন্য কুরবানি করতে হবে

২। পশু হিসাবে গৃহপালিত হতে হবে

৩। কুরবানির পশুর নির্দিষ্ট বয়স হতে হবে

৪। পশুটি অবশ্যই রোগমুক্ত হতে হবে

৫। পশুটি অবশ্যই সুসাস্থের অধিকারী হতে হবে

৬। বড় পশুকে সাতজন ও ছোট পশুকে একজনে কুরবানি দিতে হবে

৭। হাজ্জিদেরকে মিনা অথবা মক্কার অলীগলিতে পশু জবেহ করতে হবে

৮। হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরিকে দিনে জবেহ করতে হবে

৯। ঈদের সালাতে পূর্বে জবেহ করা যাবে না

১০। শরীয়ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে জবেহ করতে হবে

১১। দাঁত ও নখ দ্বারা জবেহ করা যাবে না

১২। আল্লাহর নামে জবেহ করতে হবে

১৩। গাইরুল্লাহ নামে জবেহ করা যাবে না

১৪। জবেহ হবে পরিবারের পক্ষ থেকে

১৫। শরীয়ত সম্মতভাবে গোশ্ত বন্টন করা

১৬। কাসাইকে পারিশ্রমিক হিসাবে কুরবানীর কোন অংশ দেয়া যাবে না

১৭। কুরবানী নিয়তকরী নিজের চুল ও নখ কাটবে না

১। এক মাত্র মহান আল্লাহ জন্য কুরবানি করতে হবেঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

*لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ*

অর্থঃ এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। ( সুরা হাজ্জ্ব ২২:৩৭ )

২। পশু হিসাবে গৃহপালিত হতে হবেঃ

কুরবাণীর পশু হলো, উঁট, গরু, ছাগল, দুম্বা বা মেষ। এর দলিল মহান আল্লাহর বলেন,

(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ)

অর্থঃ আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযক্ দেয়া হয়েছে সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। কারণ, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য, কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও বিনীতদেরকে। (সুরা হজ্জ ২২:৩৪)

মন্তব্যঃ মহান আল্লাহ পশুর ধরণ বলেছেন, গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু। আমাদের সমাজে প্রচলিত গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হলোঃ- উঁট, গরু, ছাগল, দুম্বা বা মেষ।

১. আনাস ইব্‌ন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন আমাদের খুৎবা দিলেন এবং দু’টি কালো-সাদা রঙের দুম্বার নিকট গিয়ে তা যবেহ করলেন। (নাসাঈ ৪৩৮৮)

২. আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’টি শিংওয়ালা হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা কুরবানী করলেন, যার পা সমূহ শুভ্র ছিল আর পূর্ন শরীর কালো আর তার পেট ছিল কালো, আর চোখও ছিল কালো। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৯০)

৩. .জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন ‘আয়িশা (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী করেন। (সহিহ মুসলিম ৩০৮২)

৪. যিয়াদ ইবনু জুবায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত, ইবনু ‘উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির কাছে এলেন। সে তার উটকে বসিয়ে কুরবানী করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তিনি বললেন, এটাকে দাঁড় করিয়ে কুরবানী কর। এটাই তোমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত। (সহিহ মুসলিম ৩০৮৪)

৫. আবূ জামরাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) কে তামাত্তু‘ হাজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে তা আদায় করতে আদেশ দিলেন। এরপর আমি তাঁকে কুরবানী সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তামাত্তু‘র কুরবানী হলো একটি উট, গরু বা বকরী অথবা এক কুরবানীর পশুর মধ্যে শরীকানা এক অংশ। আবূ জামরাহ (রহ.) বলেন, লোকেরা তামাত্তু হাজ্জকে যেন অপছন্দ করত। একদা আমি ঘুমালাম তখন দেখলাম, একটি লোক যেন (আমাকে লক্ষ্য করে) ঘোষণা দিচ্ছে, উত্তম হাজ্জ এবং মাকবূল তামাত্তু‘। এরপর আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে এসে স্বপ্নের কথা বললাম। তিনি আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করে বললেন, এটাই তো আবুল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত। আদম, ওয়াহাব ইবনু জারীর এবং গুনদার (রহ.) শু‘বাহ্ (রহ.) হতে মাকবূল ‘উমরাহ এবং উত্তম হাজ্জ বলে উল্লেখ করেছেন। (সহিহ বুখারি ১৬৮৮)

৩। কুরবানির পশুর নির্দিষ্ট বয়স হতে হবেঃ

ইসলামি শরীয়ত পশুর নির্ধারিত বয়স ঠিক করে দিয়ছে। আর তা হচ্ছে, উঁটের বয়স পাঁচ বছর সম্পূর্ণ হওয়া, গরুর বয়স দুই বছর সম্পূর্ণ হওয়া, ছাগলের বয়স এক বছর সম্পূর্ণ হওয়া, মেষ বা দুম্বার বয়স ছয় মাস পূর্ণ হওয়া। এর কম বয়সের হলে তা কুরবানীতে যথেষ্ট হবে না। এর দলিলঃ

১. উকবা ইবন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন করলেন। আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়লো। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়েছে। তিনি বললেনঃ তুমি তা কুরবানী কর। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৮১)

২. উকবা ইবন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে একটি এক বছর বয়সী ভেড়া কুরবানী করেছি। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৮৩)

৩. কুলায়ব (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একবার সফরে ছিলাম, তখন কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হলো। আমাদের একেক ব্যক্তি দুটি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু’ বছরের বয়সের ভেড়া খরিদ করছিল। তখন মুযায়না গোত্রের এক ব্যক্তি বললোঃ আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। এমন সময় দিনটি উপস্থিত হলে এক ব্যক্তি দুটি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু বছরের ভেড়া তালাশ করছিল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বকরীর ক্ষেত্রে দু বছর বয়সী দ্বারা যেভাবে কুরবানী আদায় হয়, তদ্রুপ এক বছর বয়সী দ্বারাও আদায় হয়ে যাবে। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৮৪)

৪। আসিম ইবনু কুলাইব (রহঃ) হতে তার পিতার সূত্র থেকে বর্ণিতঃ তিনি (কুলাইব) বলেন, আমরা বনী সুলাইম গোত্রের মুজাশি’ নামক নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এক সাহাবীর সাথে ছিলাম। একবার বকরীর মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে তিনি ঘোষককে নির্দেশ দেয়ায় সে ঘোষণা করলো রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ এক বছর বয়সের ছাগলের স্থানে ছয় মাস বয়সের ভেড়া যথেষ্ট। আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, তিনি মাসউদের পুত্র মুজাশি’ (রাঃ)। (আাবু দাউদ ২৭৯৯)

৫। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে একবার উটের স্বল্পতা দেখা দিলে তিনি লোকেদেরকে গরু কোরবানী করার নির্দেশ দেন। (ইবনে মাজাহ ৩১৩৪)

৬। মুজাশি‘ বিন মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ (কুলায়ব) বলেন, আমরা সুলায়ম গোত্রের মুজাশি‘ (রাঃ) নামক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এক সাহাবীর সাথে ছিলাম। মেষ-বকরীর স্বল্পতা দেখা দিলে তিনি একজন ঘোষককে নির্দেশ দিলেন এবং তদনুযায়ী সে ঘোষণা করলোঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ এক বছর বয়সের বকরীর দ্বারা যে কাজ হয় (কোরবানীর ক্ষেত্রে) ছয় মাস বয়সের মেষ দ্বারাও তা হতে পারে। (ইবনে মাজাহ ৩১৪০, আলবালীঃ হাদিসের মান সহিহ, নাসায়ী ৪৩৮৩, ৪৩৮৪, আবূ দাউদ ২৭৯৯)

৭। আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সালাতের পূর্বে যে যবেহ্ করবে তাকে পুনরায় যবহ্ করতে হবে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আজকের এ দিনটিতে গোশত খাবার আকাঙ্ক্ষা করা হয়। সে তার প্রতিবেশীদের অবস্থা উল্লেখ করল। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন তার কথার সত্যতা স্বীকার করলেন। সে বলল, আমার নিকট এখন ছয় মাসের এমন একটি মেষ শাবক আছে, যা আমার নিকট দু’টি হৃষ্টপুষ্ট বকরীর চাইতেও অধিক পছন্দনীয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সেটা কুরবানী করার অনুমতি দিলেন। অবশ্য আমি জানি না, এ অনুমতি তাকে ছাড়া অন্যদের জন্যও কিনা? (সহিহ বুখারি ৯৮৪, ৫৫৪৬, ৫৫৪৯, ৫৫৬১)

৮. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা মুসিন্নাহ্‌ (দুধ দাঁত পড়ে গেছে এমন পশু) ছাড়া কুরবানী করবে না। তবে এটা তোমাদের জন্য কষ্টকর মনে হলে তোমরা ছ’মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার। (সহিহ মুসলিম ৪৯৭৬)

৪। পশুটি অবশ্যই রোগমুক্ত হতে হবেঃ

১. উবাইদ ইবনে ফাইরূয (রাঃ) বলেন, আমি বারাআ ইবনে আযিব (রাঃ) কে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধরনের পশু কোরবানী করতে অপছন্দ অথবা নিষেধ করেছেন সেই সম্পর্কে আমাদের বলুন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের ইশারায় বলেন, এরূপ, আর আমার হাত তাঁর হাতের চেয়ে ক্ষুদ্র। চার প্রকারের পশু কোরবানী করলে তা যথেষ্ট হবে না। অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রুগ্ন পশু যার রোগ সুস্পষ্ট, খোঁড়া পশু যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট এবং কৃশকায় দুর্বল পশু যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। উবাইদ (রাঃ) বলেন, আমি ক্রটিযুক্ত কানবিশিষ্ট পশু কোরবানী করা অপছন্দ করি। বারাআ (রাঃ) বলেন, যে ধরনের পশু তুমি নিজে অপছন্দ করো তা পরিহার করো, কিন্তু অন্যদের জন্য তা হারাম করো না। (ইবনে মাজাহ ৩১৪৪)

২. বারাআ ইবনু আযিব (রাঃ) মারফু হাদীস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসাবে বর্ণনা করেছেনঃ খোড়া জন্তু যার খোড়ামী স্পষ্টভাবে প্রকাশিত; অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত; রুগ্ন পশু যার রোগ দৃশ্যমান এবং ক্ষীণকায় পশু যার হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে- তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে না। (সুনানে তিরমিযী ১৪৯৭)

৩. বনী শায়বানের আযাদকৃত দাস আবু যাহহাক উবায়দ ইবন ফায়রূয (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বারা (রাঃ)-কে বললাম, যে সকল পশু কুরবানী করতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, তা আমার নিকট বর্ণনা করুন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (খুতবা দিতে) দাঁড়ালেন আর আমার হাত তাঁর হাত অপেক্ষা ছােট। তিনি বললেন, চার প্রকার পশু কুরবানী বৈধ নয়, কানা পশু যার কানা হওয়াটা সুস্পষ্ট, রুগ্ন যার রোগ সুস্পষ্ট, খোঁড়া পশু যার খোঁড়া হওয়া সুস্পষ্ট; দুর্বল, যার হাঁড়ে মজ্জা নেই। আমি বললামঃ আমি শিং ও দাঁতে ত্রুটি থাকাও পছন্দ করি না। তিনি বললেনঃ তুমি যা অপছন্দ কর, তা ত্যাগ কর; কিন্তু অন্য লোকের জন্য তা হারাম করো না।(নাসায়ী ৪৩৭০, ৪৩৭১)

৪. হুজায়্যা ইব্‌ন আদী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি আলী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন আমরা যেন কুরবানীর পশুর চোখ ও কান উত্তমরূপে দেখে নিই। (নাসায়ী ৪৩৭৬)

উপরের হাদিসগুলো থেকে ষ্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয়ে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি দোষ হতে কুরবানীর পশুর মুক্ত হওয়া জন্য বলেছেন। কুরবানীর পশুর যে চারটি দোষমুক্ত হবে তা হলোঃ

১। অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট

২। রুগ্ন পশু যার রোগ সুস্পষ্ট

৩। খোঁড়া পশু যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট এবং

৪। কৃশকায় দুর্বল পশু যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে।

৫। পশুটি অবশ্যই সুসাস্থের অধিকারী হতে হবেঃ

কুরবানীর পশুতে যে সব গুণ থাকা উত্তম তা হলো, কুরবানীর পশুর মোটা হওয়া, শক্তিশালী হওয়া, দৈহিক গঠনে বড় হওয়া এবং দেখতে সুন্দর হওয়া। সুতরাং কুরবানীর পশু যত ভাল হবে ততই মহান আল্লাহর নিকট তা প্রিয় হবে। আর সহীহ হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ সুন্দর ও উত্তম, তাই তিনি সুন্দর ও উত্তম ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।

দলিলঃ

১. আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন শিংবিশিষ্ট মোটাতাজা দুম্বা কুরবানী করেছেন যার চোখ, মুখ ও পা কালো বর্ণের ছিলো। (আবু দাউদ ২৭৯৬)

২. আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানির ইচ্ছা করলে দু’টি মোটাতাজা, মাংসল, শিংযুক্ত, ধুসর বর্ণের ও খাসি করা মেষ ক্রয় করতেন। অতঃপর এর একটি নিজ উম্মাতের যারা আল্লাহ্‌র একত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁর নবুয়াতের সাক্ষ্য দেয় তাদের পক্ষ থেকে এবং অপরটি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন। ইবনে মাজাহ ৩১২২)

৩. আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে (কোরবানীর পশুর) চোখ ও কান উত্তমরূপে পরীক্ষা করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ ৩১৪৩)

৬। বড় পশুকে সাতজন ও ছোট পশুকে একজনে কুরবানি দিতে হবেঃ

১. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, হুদাইবিয়ার বছর (৬ষ্ঠ হিজরী) আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে প্রতি সাতজনের পক্ষ থেকে একটি উট এবং প্রতি সাতজনের পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী করেছি। (সহিহ মুসলিম ৩০৭৬)

২. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হাজ্জের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে রওনা হলাম। তিনি আমাদেরকে প্রতিটি উট বা গরু সাতজনে মিলে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন। (সহিহ মুসলিম ৩০৭৭)

৩. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ পালনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাতজনে মিলে একটি উট কুরবানী করেছি। এক ব্যক্তি জাবির (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, জাযূর-এ যে ক’জন শারীক হতে পারে- বাদানাহ্-তেও কি অনুরূপ শারীক হওয়া যায়? তখন তিনি বললেন, উভয় তো একই। জাবির (রাঃ) হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা ঐদিন ৭০টি উট কুরবানী করেছি। প্রতিটি উটেই ৭ জন শারীক ছিলাম। (সহিহ মুসলিম ৩০৭৯)

৪. ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, কোন এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ আসলে আমরা একটি গরুতে সাতজন এবং একটি উটে দশজন করে শরীক হই। (তিরমিজি ৯০৫, ইবনু মাজাহ ৩১৩১)

৫. ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সফরে ছিলাম, তখন কুরবানীর সময় উপস্থিত হলে আমরা একটি উটে দশজন শরীক হলাম, আর একটি গাভীতে সাতজন। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৯৩)

৬. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা রসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগে তামাত্তু হাজ্জ করতাম এবং সাতজন মিলে একটি গরু কুরবানী করতাম। অনুরূপভাবে একটি উটেও সাতজন শরীক হয়ে কুরবানী করেছি। আবু দাইদ ২৮০৭)

৭. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সঙ্গে তামাত্তু হজ্জ করতাম। আমরা সাতজনের পক্ষ থেকে গরু যবেহ করতাম এবং তাতে শরীক হতাম। (সুনানে নাসাঈ ৪৩৯৪)

৮. আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, বিদায় হাজ্জে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যে সকল স্ত্রী উমরাহ (অর্থাৎ তামাত্তো হাজ্জ) করেন, তিনি তাদের সকলের পক্ষ থেকে একটি গাভী কোরবানী করেন।  ইবনে মাজাহ ৩১৩৩

মন্তব্যঃ এই সকল হাদীস থেকে প্রমানিত হয় যে, ভাগে কুরবানী তথা কয়েকজন মিলে একটি পশু কুরবানী করা জায়িয। অধিকাংশ মুজতাহীদ আলেমদের অভিমত হল ভাগে কুরবানী জায়িয, কুরবানী ওয়াজিব হোক আর মুস্তাহাব হোক। উপরে বর্ণিত হাদিসই তার দলিল। অন্যদিকে সামান্য কিছু আলেমদের মত হলো, নাফলের ক্ষেত্রে ভাগ দেয়া, বৈধ ওয়াজিব এর ক্ষেত্রে নয়।

ইমাম আবূ হানিফার মতে, সকলেরই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য হয় তবে ভাগে কুরবানী জায়িয, অন্যথায় জায়িয নয় (অর্থাৎ শারীকদের মধ্যে কেউ যেন কেবল গোশত খাওয়ার নিয়্যাত না করে)।

আর সকলের ঐকমত্যে ছাগল-বকরীতে ভাগে কুরবানী জায়িয নয় । বর্ণিত হাদীসসমূহ থেকে জানা যায় যে, উট এবং গরুর ক্ষেত্রে সাত সাতজন ব্যক্তি শারীক হতে পারে। যাবির (রাঃ)-এর শেষ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তামাত্তু‘ হাজ্জ পালনকারীর উপর কুরবানী ওয়াজিব এবং ওয়াজিব কুরবানীতে ভাগে কুরবানী করা জায়িয । মূলকথা কুরবানী ভাগে না দিয়ে একাই দেয়াই উত্তম।

৭। হাজ্জিদেরকে মিনা অথবা মক্কার অলীগলিতে পশু জবেহ করতে হবেঃ

হজ্জ সংশ্লিষ্ট সকল স্থানই হাদী জবেহ করার স্থান নয়। শুধু মিনা এবং মক্কা বা হারামের এলাকায় হাদী জবেহ জায়েয। এর দলিলঃ

১. আত্বা (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদা জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) আমাকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আরাফাহ্‌র পুরো এলাকাই অবস্থানের জায়গা। মিনার সম্পূর্ণ এলাকা কুরবানীর স্থান এবং মুযদালিফার বিস্তৃত এলাকা অবস্থানের স্থান এবং মক্কার প্রতিটি অলি-গলি চলাচলের পথ এবং কুরবানীর স্থান। (আবু দা্‌উদ ১৯৩৭)

২. ‘আতা (রহ.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযি.) আমাকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আরাফার পুরো এলাকাই অবস্থানের জায়গা। মিনার সম্পূর্ণ এলাকা কুরবানীর স্থান এবং মুযদালিফার বিস্তৃত এলাকা অবস্থানের স্থান এবং মক্কার প্রতিটি অলি-গলি চলাচলের পথ এবং কুরবানীর স্থান। (আবু দা্‌উদ ১৯৩৭)

৩. জাবির (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি এ স্থানে কুরবানী করেছি। আর মিনার পুরো এলাকাই কুরবানীর স্থান। তিনি আরাফার এক স্থানে অবস্থান করেছেন এবং বলেছেনঃ আমি এ স্থানে অবস্থান করেছি, আর আরাফার সম্পূর্ণ এলাকাই অবস্থানের স্থান। তিনি মুযদালিফার এক স্থানে অবস্থান করেছেন এবং বলেছেনঃ আমি এ স্থানে অবস্থান করেছি, আর মুযদালিফার পুরো এলাকাই অবস্থানের স্থান। (আবু দাউদ ১৯০৭)

৪. জাবির (রাযিঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তার এ হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আমি এখানে কুরবানী করেছি এবং মিনার গোটা এলাকা কুরবানীর স্থান। অতএব তোমরা যার যার অবস্থানে কুরবানী কর। আর আমি এখানে অবস্থান করছি এবং গোটা ‘আরাফাহই অবস্থানস্থল (মাওকিফ), মুযদালিফার সবই অবস্থানস্থল এবং আমি এখানে অবস্থান করছি।” (সহিহ মুসলিম ২৮৪২)

৫. আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুযদালিফায় রাত যাপনের পর সকালে ‘কুযাহ’ পাহাড়ে অবস্থান করেন এবং বললেনঃ এটি ‘কুযাহ’ এবং এটাই অবস্থানস্থল। মুযদালিফার গোটা এলাকাই অবস্থানের স্থান। (তারপর মিনায় এসে বললেন) আমি এ স্থানে কুরবানী করেছি। মিনার পুরো এলাকাই কুরবানী স্থান। সুতরাং তোমরা তোমাদের নিজ নিজ অবস্থানে কুরবানী করো। (আবু দা্‌উদ ১৯৩৫)

৬. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন মিনার সমস্ত এলাকাই কোরবানীর স্থান, মক্কার প্রতিটি প্রশস্ত সড়কই রাস্তা এবং কোরবানীর স্থান, আরাফাতের গোটা এলাকাই অবস্থানস্থল এবং মুযদালিফার সমস্ত এলাকাও অবস্থানস্থল। ইবনে মাজাহ ৩০৪৮)

মন্তব্যঃ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, হারামের সমস্ত এলাকা হচ্ছে কুরবানীস্থল, সুতরাং হাজ্জে বা উমরায় হারামের যে কোন স্থানে কুরবানী করলেই যথেষ্ট হবে। তাই যদি দেখা যায় যে, কুরবানী মক্কায় করলে দরিদ্রদের বেশী লাভ হবে তাহলে মক্কাতেই কুরবানী করবে, তা ঈদের দিন হোক কিংবা তার পরের তিন দিনে হোক। আর যদি কেউ হারামের এলাকার বাইরে, যেমন আরফায় বা অন্য কোন হালাল স্থানে হাদী জবেহ করলে প্রসিদ্ধ মতে তা যথেষ্ট হবে না।

হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরিকে দিনে জবেহ করতে হবেঃ

১০ ই জিলহাজ্জ অর্থাৎ ঈদের দিন সূর্য এক বর্ষা পরিমাণ উদয় হওয়া ও ঈদের সলাত সমাপ্ত হওয়ার পর থেকে হাদী জবেহের সময় শুরু হয়। এই কাজ একটা তাশরীকের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ই জিলহাজ্জ সূর্যাস্তের আগ পর্যান্ত চলতে থাকবে। তবে সুন্নাহ হলে ঈদের সালাতের পর দেরী না করে সকাল সকাল কুরআনী দেয়া, কেননা, নাবী (সা.) নিজ কুরবানীর পশু ঈদের দিন সকাল বেলা যবাহ করেছেন।

দলিল পেলে দিব

অনুরূপ তাশরীকের দিনগুলি অতিবাহিত হওয়ার পর কুরবানী করা জায়েয নয়। কারণ, ইহা কুরবানীর জন্য নির্ধারিত দিনের বাইরে। আর এই চার দিনের রাত দিন যে কোন সময় কুরবানী করা জায়েয, তবে দিনে কুরবানী করা উত্তম।

৯। ঈদের সালাতে পূর্বে জবেহ করা যাবে নাঃ

ঈদের দিন মাঠে দু’রাক’আত নামায আদায়ের পূর্বে কেউ যদি কুরবানীর পশু যাবাহ করে ফেলে তাহলে সেটি কুরবানী হবে না বরং তা সাধারণ পশু যাবাহের মত হবে।

১. জুনদুব ইবন সুফয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ঈদগাহে উপস্থিত ছিলাম। তিনি লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন, সালাত শেষে দেখলেন একটি বকরী যবেহ করা হয়েছে। তখন তিনি বললেন, সালাতের পূর্বে কে যবেহ করলো? সে যেন এর পরিবর্তে অন্য একটি বকরী যবেহ করে। আর যে এখনও যবেহ করেনি, সে যেন আল্লাহর নামে যবেহ করে। (নাসায়ী ৪৩৬৯)

২. বারাআ ইবনু ‘আযিব (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ঈদুল আযহার দিন সালাতের পর আমাদের উদ্দেশে খুৎবাহ দান করেন। খুৎবাহ্য় তিনি বলেনঃ যে আমাদের মত সালাত আদায় করল এবং আমাদের মত কুরবানী করল, সে কুরবানীর রীতিনীতি যথাযথ পালন করল। আর যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে কুরবানী করল তা সালাতের পূর্বে হয়ে গেল, এতে তার কুরবানী হবে না। বারাআ-এর মামা আবূ বুরদাহ্ ইবনু নিয়ার (রাযি.) তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জানা মতে আজকের দিনটি পানাহারের দিন। তাই আমি পছন্দ করলাম যে, আমার ঘরে সর্বপ্রথম যবহ্ করা হোক আমার বকরীই। তাই আমি আমার বকরীটি যবহ্ করেছি এবং সালাতে আসার পূর্বে তা দিয়ে নাশ্তাও করেছি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার বকরীটি গোশ্তের উদ্দেশ্যে যবেহ্ করা হয়েছে। তখন তিনি আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের নিকট এমন একট ছয় মাসের মেষ শাবক আছে যা আমার নিকট দু’টি বকরীর চাইতেও পছন্দনীয়। এটি (কুরবানী করলে) কি আমার জন্য যথেষ্ট হবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তবে তুমি ছাড়া অন্য কারো জন্য যথেষ্ট হবে না। (সহিহ বুখারি ৯৮৫)

৩. জুন্‌দাব ইবনু সুফ্‌ইয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ঈদুল আয্‌হায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি অন্য কোন কাজ না করে সলাত আদায় করলেন। সলাত শেষে সালাম ফিরলেন। অতঃপর তিনি কুরবানীর গোশ্‌ত দেখতে পেলেন, যা তাঁর সলাত আদায়ের আগেই যাবাহ করা হয়েছিল। তারপর তিনি বললেন, যে লোক সলাত আদায়ের আগে তার কুরবানীর পশু যাবাহ করেছে, সে যেন এর জায়গায় অন্য একটি পশু যাবাহ করে। আর যে ব্যক্তি যাবাহ করেনি সে যেন আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে (বিস্‌মিল্লা-হ) যাবাহ করে। (সহিহ মুসলিম ৪৯৫৮)

১০। শরীয়ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে জবেহ করতে হবেঃ

কুরবানি দাতা নিজের কুরবানির পশু নিজেই যবেহ করবেন, যদি তিনি ভালভাবে যবেহ করতে পারেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যবেহ করেছেন। আর যবেহ করা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কুরবানি নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিৎ। উট জবেহ করার ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো, পশু দাঁড় করে সামনের বাম পা বাঁধা অবস্থায় কুরবানী করা। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে পশু দাঁড়ান অবস্থায় বা বসা অবস্থায় জবেহ করবে। পক্ষান্তরে উঁট ছাড়া অন্য পশু যবহের ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো, পশুকে কাত করে শুয়ে দিয়ে জবেহ করা। দাঁড় করে জবেহ করা পশুর বুকের দিক থেকে গলার নিচভাগে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে শুইয়ে যবহ করা পশুর মাথার দিক থেকে গলার উপরভাগে হয়ে থাকে। দাঁড় করে যবহ করা হোক কিংবা শুইয়ে যবহ করা, উভয় ক্ষেত্রে পশুর গলার ‘ওয়াদাজ’ নামক দুটো শিরা কেটে রক্ত প্রবাহিত করা আবশ্যক। আর রক্ত প্রবাহিত করার শরীয়াত সম্মত পদ্ধতি হলো, গলার দুটো শিরা কেটে দেয়া। দুই ওয়াদাজ হলো, খাদ্য নালীর দুই পাশ্বের মোটা শিরা। আর তা সম্পূর্ণভাবে কাটতে হলে খাদ্যনালী এবং কণ্ঠনালীও তার সাথে কাটতে হবে। পশুর প্রতি সহনশীল আচরণ করে জবেহ করা উচিত। যাতে প্রানীর কষ্ট কম হয় তার প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে।

দলিলঃ

শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি জিনিসের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শনের আবশ্যকতা গণ্য করেছেন। অতএব তোমরা (কিসাসে অথবা জিহাদে) কোন লোককে হত্যা করলে উত্তম পন্থায় হত্যা করবে এবং কোন কিছু যবেহ করার সময় উত্তম পন্থায় যবেহ করবে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ যেন তার ছুরি ভালভাবে ধারালো করে নেয় এবং যবেহ করার পশুটিকে আরাম দেয়। (সুনানে তিরমিজি ১৪০৯, ইবনু মাজাহ ৩১৭০ হাদিসের মান সহিহ)

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি ধারালো করতে এবং তা পশুর দৃষ্টির অগোচরে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যবেহ করার সময় যেন দ্রুত যবেহ করে।(ইবনে মাজাহ ৩১৭২)

১১। দাঁত ও নখ দ্বারা জবেহ করা যাবে নাঃ

রাফি’ ইবনু খাদীজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা আগামীকাল শত্রুর সঙ্গে মুকাবিলা করবো। অথচ আমাদের সঙ্গে কোন ছুরি নেই। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি কিংবা ভালভাবে দেখে নিখঁতভাবে যাবাহ করবে। যা রক্ত প্রবাহিত করে, যার উপর আল্লাহ্‌র নাম নেয়া হয় তা (দিয়ে যাবাহকৃত জন্তু) খাও। তবে তা যেন দাঁত ও নখ না হয়। আমি তোমাদের কাছে এর কারণ বর্ণনা করেছি। কেননা দাঁত হলো হাড় বিশেষ, আর নখ হলো হাবশীদের ছুরি। রাবী বলেন, আমরা গনীমাতের কিছু উট ও বকরী পেলাম। সেখান থেকে একটি উট ছুটে গেলে এক লোক তীর মেরে সেটাকে আটকিয়ে ফেললো। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এসব উটের মধ্যেও বন্য প্রাণীর মতো আচরণ রয়েছে। অতএব এগুলোর মাঝে কোন একটি যদি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে যায় তবে তার সঙ্গে এরূপ ব্যবহারই করবে। (সহিহ মুসলিম ৪৯৮৬)

রাফি‘ ইবনু খাদীজ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম। আগামী দিন আমরা শত্রুর সম্মুখীন হব অথচ আমাদের সঙ্গে কোন ছুরি নেই। তিনি বললেনঃ সতর্ক দৃষ্টি রাখ কিংবা তিনি বলেছেন, জলদি কর। যে জিনিস রক্ত প্রবাহিত করে এবং যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়, সেটি খাও। যতক্ষণ না সেটি দাঁত কিংবা নখ হয়। এ ব্যাপারে তোমাদের জানাচ্ছি, দাঁত হল হাড়, আর নখ হল হাবশীদের ছুরি। দলের দ্রুতগতি লোকেরা আগে বেড়ে গেল এবং গনীমতের মালামাল লাভ করল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন লোকজনের পেছনে। তারা ডেকচি চড়িয়ে দিল।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে তা উল্টে দেয়ার আদেশ দিলেন, তারপর সেগুলো উল্টে দেয়া হল। এরপর তিনি তাদের মধ্যে মালে গনীমত বণ্টন করলেন এবং দশটি বক্রীকে একটি উটের সমান গণ্য করলেন। দলের অগ্রভাগের নিকট হতে একটি উট ছুটে গিয়েছিল। অথচ তাদের সঙ্গে কোন অশ্বারোহী ছিল না। এ অবস্থায় এক ব্যক্তি উটটির দিকে তীর ছুঁড়লে আল্লাহ উটটিকে থামিয়ে দিলেন। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ সকল চতুষ্পদ জীবের মধ্যে বন্য পশুর স্বভাব আছে। কাজেই, এগুলোর কোনটি যদি এমন করে, তাহলে তার সঙ্গে এরকমই ব্যবহার করবে। (সহিহ বুখারি ৫৫৪৩)

১২। আল্লাহর নামে জবেহ করতে হবেঃ

দাড়ান বা কাত করে শোয়ানোর পর ‘বিস্‌মিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহ আকবার’ বলে ছুরি দ্বারা রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। জবেহ করার সময় কমপক্ষে (بسْمُ اللَّهِ) ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ফরজ কাজ। কারণ, কোন পশুর জবেহ করার পূর্বে আল্লাহর নাম না পাঠ করলে সেই পশুর গোশত খাওয়া হারাম।

মহান আল্লাহ বলেন,

فَكُلُواْ مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللّهِ عَلَيْهِ إِن كُنتُمْ بِآيَاتِهِ مُؤْمِنِينَ

অতঃপর যে জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, তা থেকে ভক্ষণ কর যদি তোমরা তাঁর বিধানসমূহে বিশ্বাসী হও। (সুরা আন’য়াম ৬:১১৮)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

وَلاَ تَأْكُلُواْ مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না, সেগুলো থেকে ভক্ষণ করো না; এ ভক্ষণ করা গোনাহ। নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরেক হয়ে যাবে। (সুরা আন’য়াম ৬:১২১)

মন্তব্যঃ এই কারনে মৃ্ত পড়ে থাকা জন্তু খাওয়া হলাল নয়। কেননা, কেউ জানেনা এই জন্তু আল্লাহর নাম নিয়ে শিকার বা জবেহ করা হয়েছিল কি না!

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’ শিং বিশিষ্ট সাদা-কালো ধুসর রংয়ের দু’টি দুম্বা স্বহস্তে যাবাহ করেন। তিনি ‘বিস্‌মিল্লাহ’ ও ‘আল্লহু আকবার’ বলেন এবং (যাবাহ্‌কালে) তাঁর একখানা পা দুম্বা দু’টির ঘাড়ের পাশে রাখেন। (সহিহ মুসলিম ৪৯৮১, আবু দাউদ ২৭৯৪)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’শিং যুক্ত সাদা-কালো বর্ণের দু’টি দুম্বা কুরবানী করেন। তিনি আরও বলেন, আমি-তাঁকে দুম্বা দু’টি স্বহস্তে যাবাহ করতে দেখেছি। আরও দেখেছি, তিনি ও দু’টির ঘাড়ের পাশে নিজ পা দিয়ে চেপে রাখেন এবং ‘বিস্‌মিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহ আকবার’ বলেন।  (সহিহ মুসলিম ৪৯৮২)

আয়িশাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী করার জন্য শিংওয়ালা দুম্বাটি আনতে নির্দেশ দেন- যেটি কালোর মধ্যে চলাফেরা করতো (অর্থাৎ- পায়ের গোড়া কালো ছিল), কালোর মধ্যে শুইতো (অর্থাৎ- পেটের নিচের অংশ কালো ছিল) এবং কালো মধ্য দিয়ে দেখতে (অর্থাৎ- চোখের চারদিকে কালো ছিল)। সেটি আনা হলে তিনি ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বললেন, ছোরাটি নিয়ে এসো। অতঃপর বলেন, ওটা পাথরে ধার দাও। তিনি তা ধার দিলেন। পরে তিনি সেটি নিলেন এবং দুম্বাটি ধরে শোয়ালেন। তারপর সেটা যাবাহ করলেন এবং বললেন,

** بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ‏”‏ **

অর্থঃ আল্লাহ্‌র নামে। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার ও তাঁর উম্মাতের পক্ষ হতে এটা ক্ববূল করে নাও। তারপর এটা কুরবানী করেন। (সহিহ মুসলিম ৪৯৮৫, আবু দাউদ ২৮১০)

১৩। গাইরুল্লাহ নামে জবেহ করা যাবে নাঃ

গাইরুল্লাহ নামে জবেহ করা যাবে হারাম। হান আল্লাহ আরও বলেন,

((*وَلاَ تَأْكُلُواْ مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ*))

যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না, সেগুলো থেকে ভক্ষণ করো না; এ ভক্ষণ করা গোনাহ। নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরেক হয়ে যাবে। (সুরা আন’য়াম ৬:১২১)

আবূ তুফায়ল ‘আমির ইবনু ওয়াসিলাহ্‌ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক লোক তাঁর নিকট এসে বলল, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে আড়ালে কি বলেছিলেন? রাবী বলেন, তিনি রেগে গেলেন এবং বললেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের কাছ থেকে গোপন রেখে আমার নিকট একান্তে কিছু বলেননি। তবে তিনি আমাকে চারটি (বিশেষ শিক্ষণীয়) কথা বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি বলল হে আমীরুল মু’মিনীন! সে চারটি কথা কি? তিনি বললেনঃ ১. যে লোক তার পিতা-মাতাকে অভিসম্পাত করে, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেন, ২. যে লোক আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কারো নামে যাবাহ করে আল্লাহ তার উপরও অভিসম্পাত করেন, ৩. ঐ ব্যক্তির উপরও আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, যে কোন বিদ‘আতী লোককে আশ্রয় দেয় এবং ৪. যে ব্যক্তি জমিনের (সীমানার) চিহ্নসমূহ অন্যায়ভাবে পরিবর্তন করে, তার উপরও আল্লাহ অভিসম্পাত করে। (সহিহ মুসলিম ৫০১৮)

১৪। জবেহ হবে পরিবারের পক্ষ থেকেঃ

আতা ইবনু ইয়াসার (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ আবূ আইয়ূব (রাঃ)-কে আমি প্রশ্ন করলাম, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর যামানায় কুরবানীর বিধান কেমন ছিল। তিনি বললেন, কোন লোক তার ও তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষে একটি ছাগল দ্বারা কুরবানী আদায় করত এবং তা নিজেরাও খেত, অন্যান্য লোকদেরকেও খাওয়াত। অবশেষে মানুষেরা গর্ব ও আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ফলে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তা তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ। (সুনানে তিরমিজি ১৫০৫)

আতা’ ইয়াসার বলেন থেকে বর্ণিতঃ আমি আবূ আইউব আল-আনসারী (রাঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে আপনাদের কোরবানী কিরূপ ছিল? তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে কোন ব্যক্তি নিজের ও স্বীয় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি বকরী কোরবানী করতো। তা থেকে তারাও আহার করতো এবং (অন্যদেরও) আহার করাতো। পরবর্তী কালে লোকেরা কোরবানীকে অহমিকা প্রকাশের বিষয়ে পরিণত করে এবং এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা তো দেখতেই পাচ্ছ। (ইবনে মাজাহ ৩১৪৭)

১৫। শরীয়ত সম্মতভাবে গোশ্ত বন্টন করাঃ

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ

অর্থঃ যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাব গ্রস্থকে আহার করাও। (সুরা হাজ্জ্ব ২২:২৮ )

১. সালামাহ্‌ ইবনু আক্‌ওয়া’ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি কুরবানী করবে, সে যেন ঈদের তৃতীয় রাতের পর তার বাড়িতে কুরবানীর পশুর কোন কিছু সঞ্চিত না রাখে। আগামী বছর যখন আগত হলো, তখন লোকজনেরা বলল, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা কি গত বছরের মতো করবো? তিনি বললেন, না। সে বছর তো মানুষ খুব দুর্দশায় ছিল, তাই আমি চেয়েছিলাম যাতে সকলের কাছে কুরবানীর (গোশ্‌ত) পৌঁছে যায়। (সহিহ মুসলিম ৫০০৩)

২. আবদুল্লাহ ইবনু ওয়াকিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিন দিনের উপরে কুরবানীর গোশ্‌ত খেতে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ বাক্‌র (রহঃ) বলেন, আমি বিষয়টি ‘আম্‌রাহ্‌ (রাঃ) এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ইবনু ওয়াকিদ সত্যই বলেছেন। আমি ‘আয়িশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যামানায় ‘ঈদুল আযহার সময় বেদুঈনদের কিছু পরিবার শহরে আগমন করে, তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমরা তিনদিনের পরিমাণ জমা রেখে বাকী গোশ্‌তগুলো সাদাকাহ্‌ করে দাও। পরবতী সময়ে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! মানুষেরা তো কুরবানীর পশুর চামড়া দিয়ে পাত্র প্রস্তুত করছে এবং তার মাঝে চর্বি গলাচ্ছে। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাতে কি হয়েছে? তারা বলল, আপনিই তো তিনদিনের বেশি কুরবানীর গোশ্‌ত খাওয়া হতে বারণ করেছেন। তিনি বললেনঃ আমি তো বেদুঈনদের আগমণের কারণে এ কথা বলেছিলাম। অতঃপর এখন তোমরা খেতে পার, জমা করে রাখতে পার এবং সাদাকাহ্‌ করতে পার। (সহিহ মুসলিম ৪৯৯৭)

৩. জাবির (রাঃ) কর্তৃক নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃতিনি তিনদিনের পরেও কুরবানীর গোশ্ত খেতে বারণ করেছেন। তারপর পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, এখন তোমরা খেতে পার, পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করতে পার এবং সঞ্চয় করে রাখতে পার। (সহিহ মুসলিম ৪৯৯৮

৪. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা মিনায় তিনদিনের বেশি কুরবানীর গোশ্‌ত খেতাম না। পরে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি দিয়ে বললেনঃ তোমরা খেতে পার এবং অতিরিক্ত হিসেবে জমাও রাখতে পার। (ইবনু জুরায়জ বলেন) আমি ‘আতাকে বললাম, জাবির (রাঃ) কি ‘মাদীনায় আগমন করা পর্যন্ত’ কথাটি বলেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। (সহিহ মুসলিম ৪৯৯৯)

৫. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা তিনদিনের বেশি কুরবানীর গোশ্‌ত জমা করে রাখতাম না। পরে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনদিনের পরেও এ থেকে খাওয়ার এবং পথেয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য আমাদের অনুমতি দেন। (সহিহ মুসলিম ৪৯৮৫)

৬. ইবনু বুরাইদাহ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছিলাম। এখন আমি শেষ বিষয়ে তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত করো। কেননা তা দর্শনে (মৃত্যুকে) স্মরণ হয়।

৭. আমি তোমাদেরকে পানপাত্র সম্পর্কে নিষেধ করেছিলাম যে, তোমরা চামড়ার পাত্রে নবীয পান করবে। এখন তোমরা যে কোনো পাত্রে পান করতে পারো। কিন্তু তোমরা কখনো মাদক দ্রব্য পান করো না। আমি তোমাদের উপর কুরবানীর গোশতের ব্যাপারে তা তিন দিনের পর না খেতে বলেছিলাম। এখন তোমরা তা (দীর্ঘদিন) খেতে পারো এবং তোমাদের সফরে তা কাজে লাগাতে পারো। সুনানে আবু দাউদ ৩৬৯৮)

মন্তব্যঃ আমাদের সমাজ প্রচলিত আছে, কুরবানীর গোশ্ত সমান তিন ভাগ করার পর এক ভাগ গরিব-দুঃখীকে, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে এবং এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। এই কথার সুন্নাহ সম্মত কোন দলিল নাই। তবে সুন্নাত হলো, কুরবানীর গোশ্ত নিজে খাওয়া এবং তা হতে অন্যদেরও খাওয়ানো। আর প্রয়োজন হলে ভবিশ্যতের জন্য সংরক্ষন করে রাখবে।

অনেক হাজ্জিকে দেখা যায় কুরবানী করা পর গোশ্ত ফেলে রেখে আসে। কিন্তু কুরবানীর গোশ্ত নিজে না খেয়ে এবং অপরকে তা দান না করে শুধু-শুধু যবহ করে ফেলে রেখে দেয়া যথেষ্ট নয়। কারণ, ইহা ধন-সম্পদ বিনষ্ট করার শামিল। তাই যতক্ষণ এমন স্থানে না যবহ করবে যেখানে নিজের আশে-পাশ্বে দরিদ্র-অভাবীরা থাকবে, অতঃপর কুরবানীর পশু যবহ করে তাদেরকে দান করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কুরবানীকারী দায়িত্ব মুক্ত হবে না। সুতরাং হাজীর জন্য উচিত যে, সার্বিক দিক থেকে নিজ কুরবানীর প্রতি গুরুত্ব দিবে, যাতে করে তার কুরবানী মহান আল্লাহর নিকট গৃহিত হয় ও তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হয় এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য তা যেন লাভজনক হয়।

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর বাহনে সওয়ার অবস্থায় কঙ্কর মারতে দেখেছি। এ সময় তিনি বলছিলেন : তোমরা হাজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি শিখে নাও। তিনি আরো বলেনঃ আমি অবহিত নই আমার এই হাজ্জের পর আবার হাজ্জ করার সুযোগ পাবো কি না। (আবু দাউদ ১৯৭০)

১৬। কাসাইকে পারিশ্রমিক হিসাবে কুরবানীর কোন অংশ দেয়া যাবে নাঃ

‘আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তাঁকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের কুরবানীর জানোয়ারের পাশে দাঁড়াতে আর এগুলোর সমুদয় গোশ্ত, চামড়া এবং পিঠের আবরণসমূহ বিতরণ করতে নির্দেশ দেন এবং তা হতে যেন কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছুই না দেয়া হয়।  (সহিহ বুখারি ১৭১৭)

কুরবানীর জন্তুর কিছুই কসাইকে দেয়া যাবে না।

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে পাঠালেন, আমি কুরবানীর জানোয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, অতঃপর তিনি আমাকে আদেশ করলেন। আমি ওগুলোর গোশ্‌ত বণ্টন করে দিলাম। এরপর তিনি আমাকে আদেশ করলেন। আমি এর পিঠের আবরণ এবং চামড়াগুলোও বিতরণ করে দিলাম। (সহিহ বুখারি ১৭১৬)

১৭। কুরবানী নিয়তকরী নিজের চুল ও নখ কাটবে নাঃ

১. উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যখন (যিলহাজ্জ মাসের) প্রথম দশদিন উপস্থিত হয় আর কারো নিকট কুরবানীর পশু উপস্থিত থাকে, যা সে যাবাহ করার নিয়্যাত রাখে, তবে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (সহিহ মুসলিম ৫০১২, আবু দাউদ ২৭৯১)

২. নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে লোকের কাছে কুরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহাজ্জের নতুন চাঁদ দেখার পর ঈদের দিন থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।(সহিহ মুসলিম ৫০১৫)

কুরবানী সংক্রান্ত কয়েকটি মাসায়েল

১। কুরবানী না করে হালাল হওয়া যাবে নাঃ

হাফসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম! লোকদের কী হল যে, তারা ‘উমরাহ করে হালাল হয়ে গেল অথচ আপনি ‘উমরাহ হতে হালাল হননি! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো আমার মাথায় আঠালো বস্তু লাগিয়েছি এবং পশুর গলায় কিলাদা ঝুলিয়েছি। তাই কুরবানী না করে আমি হালাল হতে পারি না। (সহিহ বুখারি ১৭২৫)

ব্যতিক্রমি মাসায়েলঃ

১। হাদীর পীঠে সওয়ার হওয় যায়ঃ

*** আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে কুরবানীর উট হাঁকিয়ে নিতে দেখে বললেন, এর উপর সওয়ার হয়ে যাও। সে বলল, এ তো কুরবানীর উট। তিনি বললেন, এর উপর সওয়ার হয়ে যাও। লোকটি বলল, এ তো কুরবানীর উট। তিনি বললেন, এর উপর সওয়ার হয়ে যাও। এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। সহিহ বুখারি ১৬৯০)

২। মক্কায় নিজে না গিয়ে শুধু হাদী পাঠালে ইহরাম সাব্যস্ত হয় নাঃ

আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদ্বীনা হতে কুরবানীর পশু পাঠাতেন, আমি তার গলায় কিলাদার মালা পাকিয়ে দিতাম। এরপর মুহরিম যে কাজ বর্জন করে, তিনি তার কিছু বর্জন করতেন না। (সহিহ বুখারি ১৬৯৮)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীর (কুরবানীর জন্তুর) কিলাদা পাকাতাম। তিনি সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন। পরে হাদীর পশু তার যথাস্থানে (হারামে) পৌঁছার পূ্ববর্তী সময় পর্যন্ত তিনি ঐ সমস্ত কাজই করতেন, যা একজন হালাল ব্যক্তি করে থাকে। (সুনানে নাসাঈ ২৭৭৬)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীর (কুরবানীর জন্তুর) কিলাদা পাকাতাম। তারপর তিনি মদীনায় অবস্থান করতেন, ইহরাম বাঁধতেন না। (অর্থাত ‘ইহরাম বেঁধেছেন’ বলে সাব্যস্ত হত না। (সুনানে নাসাঈ ২৭৭৭)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীর (কুরবানীর জন্তুর) কিলাদা পাকাতাম। তারপর তিনি তাঁর হাদীকে তা পরিয়ে (মক্কাভিমুখে) পাঠিয়ে দিতেন। পরে তিনি মদীনায় অবস্থান করতেন এবং মুহরিম যা পরিহার করে, তার কিছুই পরিহার করতেন না। (সুনানে নাসাঈ ২৭৭৮)

মন্তব্যঃ কিলাদা (قِلادة) একটি আবরী শব্দ যার অর্থ নেকলেস, মালা ।

৩। হাদী ছাড়াও অতিরিক্ত কুরবানী করার বিধান

বিজ্ঞ আলিমগণ হজের হাদীকে হাদী ও কুরবানী উভয়টার জন্যই যথেষ্ট হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে কুরবানী করলে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। হাজী যদি মুকীম হয়ে যায় এবং নেসাবের মালিক হয়, তার ওপর ভিন্নভাবে কুরবানী করা ওয়াজিব বলে ইমাম আবূ হানীফা রহ. মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে হাজী মুকীম না মুসাফির, এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক থাকলেও বাস্তবে হাজী সাহেবগণ মুকীম নন। তারা তাদের সময়টুকু বিভিন্নস্থানে অতিবাহিত করেন। তাছাড়া দো‘আ কবুল হওয়ার সুবিধার্থে তাদের জন্য মুসাফির অবস্থায় থাকাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

৪। অজানা ভুলের জন্য দম দেয়ার বিধান

হজকর্ম সম্পাদনের পর কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন যে কে জানে কোথাও কোনো ভুল হল কি-না। অনেক গ্রুপ লিডার হাজী সাহেবগণকে উৎসাহিত করেন যে ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে তাই ভুলের মাশুল স্বরূপ একটা দম দিয়ে দিন। নিঃসন্দেহে এরূপ করা শরীয়ত পরিপন্থি। কেননা আপনি ওয়াজিব ভঙ্গ করেছেন তা নিশ্চিত বা প্রবল ধারণা হওয়া ছাড়া নিজের হজকে সন্দেহযুক্ত করছেন। আপনার যদি সত্যি সত্যি সন্দেহ হয় তাহলে বিজ্ঞ আলেমগণের কাছে ভাল করে জিজ্ঞেস করবেন। তারা যদি বলেন যে, আপনার ওপর দম ওয়াজিব হয়েছে তাহলে কেবল দম দিয়ে শুধরিয়ে নেবেন। অন্যথায় নয়। শুধু সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে দম দেওয়ার কোনো বিধান ইসলামে নেই। তাই যে যা বলুক না কেন এ ধরনের কথায় মোটেও কর্ণপাত করবেন না। অনেক এটাকে দমে-খাতা ভুলের মাশুল বলা হয়।

৫। হজ্জের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাঃ

হাজ্জিগণ হজ্জের কার্যক্রমের একটি ধারাবাহি কাজ করে থাকে। মুজদালিফা থেকে মিনায় আসার পর তার সামনে চারটি তিনটি ওয়াজিব ও একটি ফরজ কাজ থাকে। অর্থাৎ মিনায় এসে তিনি প্রথম বড় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন তারপর কুরবাণী করবেন। কুরবাণী আদায়ের পরই তিনি মাথা মুন্ডন করার মাধ্যমে ইহরাম ত্যাগ করে হালাল হয়ে যাবেন। হালাল হওয়ার পরও তাওয়াফ করা যায়। তবে মুজদালিফা থেকে মিনায় আসার দিনে না পারলে পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে বা অন্য যে কোন সময় করলেও চলবে। হানাফি মাযহাবের মতে হজ্জের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও ওয়াজিব। অর্থাৎ কুরবাণী করার আগে মাথা মুন্ডান বা চুল ছোট করা যাবেনা। তাদের দলিলঃ

মহান আল্লহ কালাম।মহান আল্লাহ বলেন,

*وَأَتِمُّواْ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلّهِ فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ وَلاَ تَحْلِقُواْ رُؤُوسَكُمْ حَتَّى يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ*

অর্থঃ আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব ওমরাহ পরিপূর্ণ ভাবে পালন কর। যদি তোমরা বাধা প্রাপ্ত হও, তাহলে কোরবানীর জন্য যাকিছু সহজ্জলভ্য, তাই তোমাদের উপর ধার্য। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা মুন্ডন করবে না, যতক্ষণ না কোরবাণী যথাস্থানে পৌছে যাবে। ( সুরা বাকারা ২:১৯৬ )

মন্তব্যঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির আহসানুল বায়ান লিখেনঃ

যদি পথে শত্রু অথবা কঠিন অসুস্থতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে একটি পশু, উট অথবা গরু (গোটা অথবা এক সপ্তমাংশ) অথবা ছাগল বা ভেড়া সেখানেই যবেহ করে মাথা নেড়া করে হালাল হয়ে যাও। যেমন, নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণ হুদাইবিয়্যাতে কুরবানী যবেহ করেছিলেন। আর হুদাইবিয়্যা হারাম সীমানার বাইরে। অতঃপর আগামী বছরে তার কাযা কর। যেমন, নবী করীম (সাঃ) সন ৬ হিজরীর উমরার কাযা সন ৭ হিজরীতে করেছিলেন। আর এর সম্পর্ক হল নিরাপদ পরিস্থিতির সাথে। অর্থাৎ, নিরাপদ অবস্থায় ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা নেড়া করবে না (ইহরাম খুলে হালাল হবে না), যতক্ষণ না হজ্জের সমস্ত কার্যাদি পূরণ করেছ। (তাফসিরে আহসানুল বয়ান সুরা বাকারার ১৯৬ আয়াতের ব্যাখ্যা)

তাই হানাফি মাযহাবের ফিকাহবিদগন মনে বলে থাকেন, যদি কেই কুরবানির আগে মাথা মুন্ডন করে তবে তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর প্রখ্যাত দুই ছাত্র ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রহ. ১০ যিলহজের কাজসমূহে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারলেও দম ওয়াজিব হবে না বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। (বাদায়েউস্সানায়ে  ২/১৫৮)

অপর পক্ষে নবীজীর বিদায় হজ্জের আমল অনুসারে ১০ যিলহজের ধারাবাহিক আমল হল, প্রথমে কঙ্কর নিক্ষেপ করা, অতপর হাদীর পশু যবেহ করা, এরপর মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছোট করা। এরপর তাওয়াফে যিয়ারত সম্পন্ন করা ও সা‘ঈ করা। সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে এ দিনের এই চারটি আমলের ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করা তথা আগে-পিছে করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের পরিপন্থি কাজ। তবে যদি কেউ উযর বা অপারগতার কারণে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারে, অথবা ভুলবশত আগে-পরে করে বসে, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হজ করার সময় সাহাবায়ে কিরামের কেউ কেউ এরূপ আগে-পিছে করেছেন। উযর কিংবা অপরাগতার কারণে সেসবের আলোকে আমল করলে ইনশাআল্লাহ হজের কোনো ক্ষতি হবে না। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে হাজীদের প্রচণ্ড ভিড় আর হাদী যবেহ প্রক্রিয়াও অনেক জটিল। তাই বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন সহজভাবে দেখেছেন আমাদেরও সেভাবে দেখা উচিত।

দলিলঃ

১. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘আমর ইব্‌নু ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ  আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হাজ্জের দিবসে মিনায় লোকদের সম্মুখে (বাহনের উপর) দাঁড়ালেন। লোকেরা তাঁকে বিভিন্ন মাসআলা জিজ্ঞেস করছিলো। জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে বললো, আমি ভুলক্রমে কুরবানীর পূর্বেই মাথা কামিয়ে ফেলেছি। তিনি বললেনঃ যবেহ করো, কোন ক্ষতি নেই। আর এক ব্যক্তি এসে বললো, আমি ভুলক্রমে কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্বেই কুরবানী করে ফেলেছি। তিনি বললেনঃ কঙ্কর ছুঁড়ো, কোন অসুবিধে নেই। ‘আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নু ‘আমার (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেদিন পূর্বে বা পরে করা যে কোন কাজ সম্পর্কেই জিজ্ঞাসিত হচ্ছিলেন, তিনি এ কথাই বলেছিলেন, করো, কোন ক্ষতি নেই। (সহিহ বুখারী ৮৩, ১২৪, ১৭৩৬, ১৭৩৭, ১৭৩৮, ৬৬৬৫)

২. ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, হাজ্জের সময় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসিত হলেন। কোন একজন বললো : আমি কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্বেই যবেহ (কুরবানী) করে ফেলেছি। ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, তখন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেনঃ কোন অসুবিধে নেই। আর এক ব্যক্তি বললো, আমি যবেহ করার পূর্বে মাথা মুন্ডন করে ফেলেছি। তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেন, কোন ক্ষতি নেই। (সহিহ বুখারি ৮৪, ১৭২১, ১৭২২, ১৭২৩, ১৭৩৪, ৬৬৬৬)

মন্তব্যঃ এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে অনেক সালাফি আলেম হজ্জের সময়ের আমলগুলোর ধারা বাহিকভাবে রক্ষা করার জন্য বাধ্যবাধকতা আরপ করেন না। তারা মনে করেন এর মাধ্যমে ইহরাম ভঙ্গ করার নিদর্শন বলে সাব্যস্ত হয় মাত্র। যা হোক মাসায়েলটি একটু মতভেদ পূর্ন। আশা করি দুটি মতই সঠিক আপনি যে কোনটি আমল করতে পারেন। কিন্তু ইহা নিয়ে বিবেভ সৃষ্টি করা হারাম। সতর্ক হই। আল্লাহু আলাম।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “কুরবানির দেওয়ার ১৭ টি শর্তসমূহ

Leave a comment