এক নজরে আশুরার বিদআতসমূহ

এক নজরে আশুরার বিদআতসমূহ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

উপরের আলোচনার মাধ্যমে আশা করি আশুরা সম্পর্কে একটা ষ্পষ্ট ধারনা হয়েছে। নিজে নিজেই আশুরার বা মুহাররম মাসের দশ তারিখের সুন্নাহ সম্মত আমল পালন করতে পাবর। তারপর আশুরার কয়েকটি জঘন্য বিদআত আলোচনা করব।

১। আশুরার দিনে মাতম করাঃ

উপরের আলোচনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বর্তমানে আশুরার দিনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নামে যে অনুষ্ঠান, মাতম, বুক ও গাল থাপড়ানো, উচ্চ স্বরে ক্রন্দন এবং বিলাপ করে থাকে তার কোনো ভিত্তি নেই। এমন কি আহলে বাইতের নামে প্রচলিত মাজহাবেও তার কোনো দলীল নেই এবং সর্বোপরি ইসলামী আকীদার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই নিকৃষ্ট বিদআত আস্তে আস্তে তাদের মধ্য প্রসার ঘটে। শীয়াগণ সঠিকভাবে কখন এর দলীল দিতে পারবেনা। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর বহু সাহাবী শহীদ হয়েছেন। এমন কি মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ট খলিফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়েছেন। তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বাদে সকল সাহাবীদের শাহাদত বরণে শোক তো দূরের কথা, বরং আনন্দ দিবসে পরিণত হয়। আববাসীয় খলীফা মুত্বী বিন মুক্বতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃঃ) তাঁর কট্টর শীয়া আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে মুইযযুদ্দৌলা ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখে বাগদাদে উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদত বরণের তারিখকে তাদের হিসাবে খুশীর দিন মনে করে ‘ঈদের দিন’ হিসাবে ঘোষণা করেন। শীয়াদের নিকটে এই দিনটি পরবর্তীতে ঈদুল আযহার চাইতেও গুরুত্ব পায়। অতঃপর ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদত বরণের ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন এবং মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শীয়ারা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা নিষ্ক্রিয় থাকেন। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারি করা হলে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। (ইবনুল আছীর, তারীখ ৮/১৮৪ পৃঃ; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়, পৃঃ ৬-৭)।

এমনিভাবে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিষিদ্ধ জাহেলী জামানার একটি অভ্যাসকে তারা ইবাদাত মনে করে চালিয়ে যাচ্ছে। মনে করছে তারা আহলে বাইতের সঠিক সম্মান দিচ্ছে। আসলে তারা এর মাধ্যমে ইসলামের মুল শিক্ষাকে অপমান করে আহলে বাইতের মর্জাদাকে ছোট করছে। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে তাদের আলেমগণ আশুরার দিনে মাতম ও হায় হুসাইন হায় হুসাইন বলে চিৎকার করাকে আল্লাহর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে নিম্নের আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন,

*ذَلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ*

অর্থঃ এ হচ্ছে আসল ব্যাপার (এটি বুঝে নাও), আর যে ব্যক্তি আল্লাহ নির্ধারিত রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখায়, তার সে কাজ তার অন্তরের আল্লাহভীতির পরিচায়ক। (সুরা হাজ্জ্ব ২২:৩২)।

আল্লাহর নির্ধারিত রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখায় হল তার আনুগত্যের করা। যেমন, নামায, রোযা, হজ্জ ইত্যাদি যথাযতভাবে পালন করা। এই আমলগুলি হল বান্দার হৃদয়ের অভ্যন্তরের তাকওয়ার ফল এবং মানুষের মনে যে কিছু না কিছু আল্লাহর ভয় আছে তা এরি চিহ্ন। তাইতো সে তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করছে।

কিন্ত শীয়াগণ বিলাপ করা, গাল ও বুক থাপড়ানো, আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের সাহাবীদেরকে গালাগালি করাকে আল্লাহর সম্মানিত নিদর্শন মনে করেই করে থাকেন। এর চেয়ে অধিক মূর্খতা আর কি হতে পারে? আবার দেখুন, মাতম করার পর তারা তারা মানুষের মাঝে গোশত, খাদ্য-পানীয় এবং অন্যান্য বস্তু বিতরণ করে। কারবালা সম্পর্কিত বিভিন্ন শির্কী কবিতা আবৃতি করে রাত পার করে। অপর পক্ষে কিছু লোক এই দিনে সিয়াম রাখল, জিকির আজকার করল, কুরআন তেলাওয়াত করল এবং অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে এই দিন অতিবাহিত কর। এই দুই জনে কে শোক পালনের কাজ করল। যদিও শোকা পালন করা শরীয়ত সম্মত নয়। বিষয়টি বুঝার জন্য বললাম। শীয়াগণ ভাল ভাল খাবার খায় আর শোক পালন করে নিজেদের আমলেই বৈপরত্য।

২। শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যে ছিয়াম পালন করাঃ

আলোচনার প্রথমে আশুরার সম্পর্কে হাদিসের আলোকো সুন্নাহ সম্মত সিয়াম পালনের কথা বলা হয়েছে। আমরা দেখেছি আশুরার সিয়াম একটি সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত। আশুরার চেতনা হল, অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মূসা আলাইহিস সালাম এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররম ছিয়াম পালন করা। বর্তমান সুন্নী মুসলিম সমাজে উক্ত দু’টি ছিয়াম পালনের প্রচলন রয়েছে। কিন্তু শীয়া ও তাদের পাশাপাশি সামান্য কিছু সুফি তরিকার লোক শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে এবং এর পাশাপাশি তারা শাহাদতে হুসাইনের শোক পালনের উদ্দেশ্যে ছিয়াম পালন করে থাকে, যা সম্পূর্ণরূপে সহিহ হাদিসবিরোধী এবং স্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা এই সিয়ামের সূচনা হয়েছে মূসা আলাইহিস সালাম এর সময় থেকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশাতেই মুহাররমের ছিয়াম পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার ছিয়াম পালন করেছিলেন অত্যাচারী শাসক ফেরাঊনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের আনন্দে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ। পক্ষান্তরে আমরা আজ তা পালন করছি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের শোক স্বরূপ। অথচ ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) সহ আরো অনেক ছাহাবী শাহাদত বরণ করেছেন। আমরা তাঁদের স্মরণে কিছুই করি না। যদি হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের কারণে শোক দিবস পালন করা হয়, তাহ’লে ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর শোক দিবস পালনের অধিক হক রাখে।

৩। ১০ই মুহাররমকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করাঃ

 শীয়াদের একটি দল হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদতের শোক স্বরূপ শোক দিবস পালন করে। পক্ষান্তরে একটি গোষ্ঠী রাফেযীদের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে এ দিনটিকে আনন্দ উৎসবে পরিণত করে। এ দিনে রাফেযীদের শোক দিবস যেমন বিদ‘আত; তেমনি তাদের বিরোধিতার লক্ষ্যে এ দিনে আনন্দ উৎসব করাও বিদ‘আত। এটা যেন বিদ‘আত দিয়ে বিদ‘আত এবং মিথ্যা দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করার চেষ্টা। অথচ উচিত ছিল সুন্নাত দিয়ে বিদ‘আত প্রতিহত করা। সত্য দিয়ে মিথ্যা প্রতিহত করা। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এ দিনটিকে শোক দিবস হিসাবেও পালন করেননি। আবার আনন্দ উৎসবেও পরিণত করেননি। তাঁরা শুধুমাত্র ফেরাউনের কবল থেকে মূসা আলাইহিস সালাম এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ ছিয়াম পালন করেছেন।

৪। তাযিয়া মিছিল বাহির করাঃ

পূর্বের আলোচানায় উল্লেখ করেছি, কট্টর শীয়া আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে মুইযযুদ্দৌলা ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদত বরণের ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন এবং মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শীয়ারা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। তার চালু করা বিদআত আজও শীয়ারা পালন করে আসছে। অথচ এই সকল কাজ শরীয়ত সম্মত নয়।

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যারা শোকে গালে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে ও জাহিলী যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহিহ বুখারী হাঃ ১২৯৬)

আবূ মূসা (রাঃ) কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মাথা তাঁর পরিবারের এক মহিলার কোলে ছিল। সে মহিলা চিৎকার করে উঠলো। তিনি তাকে তা থেকে বাধা দিতে পারেননি। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরলো তখন বললেন, আমি তার থেকে সম্পর্কহীন, যার থেকে রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। যে ব্যক্তি (মৃতের শোকে) উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করে, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ( সহিহ মুসলিম ১৮৯ ইফাঃ. ১৮৯))

মিডিয়ার কারনে ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে এখন সকলে মনে করে, আশুরা তাযিয়া মিসিল।  তাযিয়া অর্থ বিপদে সান্ত্বনা দেওয়া। যেটা বর্তমানে শাহাদাতে হোসাইনের শোক মিছিলে রূপ নিয়েছে। অথচ ইসলামে কারো মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক পালন করা নিষেধ।

যায়নাব বিন্‌তু আবূ সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণী উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর নিকটে গেলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যে স্ত্রীলোক আল্লাহ্‌ এবং ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা বৈধ নয়। তবে স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন (বৈধ)। হাদিসের মান সহিহ, সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১২৮১)

অথচ শীয়ারা এর শোক যুগের পর যুগ চালিয়ৈ যাচ্ছে। শীয়াদের উদ্ভাবিত এই বিদআতী প্রথার অনুসরণেই বাংলাদেশের বিদ‘আতীরা ১০ই মুহাররমে মিছিল বের করে থাকে। প্রত্যেক আল্লাহভীরু মুসলমানের এই সব বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকা আবশ্যক।

৫। ১০ই মুহাররমে চোখে সুরমা লাগানোঃ

অনেকেই আশুরার দিন বা ১০ই মুহাররমে বিশেষ ফযীলতের আশায় চোখে সুরমা লাগিয়ে থাকে; যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরাম আশূরার দিনে চোখে সুরমা লাগাননি এবং এর কোন ফযীলত বর্ণনা করেননি। ‘আশূরার দিনে চোখে ইছমিদ সুরমা লাগালে কখনোই চোখে রোগ হবে না’ মর্মে প্রচলিত হাদীছটি মাওযূ বা জাল। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/২০৩; মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূ‘আহ, পৃঃ ৪৪)।

৬। ১০ই মুহাররমে বিশেষ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করাঃ

শীয়াগণ ১০ই মুহাররমে বিশেষ ফজিলতের আশায় বিশেষ পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে। যা সুস্পষ্ট বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ও ছাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বিশেষ কোন ছালাত আদায় করেছেন মর্মে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া যায় না। এ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় তার সবগুলিই জাল বা বানোয়াট। যেমনঃ

ক। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আশূরার দিনে যে ব্যক্তি চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাক‘আতে একবার সূরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সূরা ইখলাছ তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অতীতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’। উল্লিখিত হাদীছটি জাল বা বানোয়াট। (আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২) ।

খ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আশূরার দিনে যোহর ও আছরের ছালাতের মাঝখানে চল্লিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। প্রত্যেক রাক‘আতে একবার সূরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসী, দশবার সূরা ইখলাছ, পাঁচবার সূরা ফালাক্ব এবং পাঁচবার সূরা নাস তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন’। অত্র হাদীছটিও জাল বা বানোয়াট। (আল-মাওযূ‘আত পৃঃ ২/১২২-১২৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ পৃঃ ৪৮)।

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, সিয়াম  ব্যতীত আশূরা সম্পর্কিত কোন সহিহ হাদীছ নেই। এই দিনে নির্দিষ্ট ছালাতের ফযীলত সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছগণের ঐক্যমতে তার সবগুলিই মিথ্যা ও বানোয়াট। মুহাক্কিক আলেমদের কেউই তাদের কিতাব সমূহে এ সমস্ত হাদীছ সংকলন করেননি। (শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/১১৬)।

অতএব এ উপলক্ষে আশূরার দু’টি সিয়াম ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, ইমাম চতুষ্টয়ের কেউ কখনোই করেননি। আর তাঁরা সিয়াম দু’টি পালন করেছেন কেবল ফেরাউনের কবল থেকে মূসা আলাইহিস সালাম এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ। শাহাদতে হুসাইনের শোক স্বরূপ নয়। সুতরাং বর্তমানে আশূরা উপলক্ষে যা হচ্ছে তার সবগুলিই পরবর্তী যূগের বিদ‘আতীদের আবিষ্কার, যা অবশ্যই বর্জনীয়।

৭। তাবেঈ ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়াকে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়াঃ

ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়াকে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেওয়া আদৌ ঠিক নয়। বরং সকল মুসলমানের ন্যায় তার মাগফেরাতের জন্য দো‘আ করা উচিত। কেননা মানুষ হিসাবে তার কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলেও কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তিনি দায়ী নন। এজন্য মূলতঃ দায়ী বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসী ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ। কেননা ইয়াযীদ কেবল হুসাইন (রাঃ)-এর আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসাইন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী হুসাইনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। হুসাইন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হলে তিনি কেঁদে বলে ওঠেন, ‘ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর আল্লাহ লা‘নত করুন। আল্লাহর কসম! যদি হুসাইনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহলে সে কিছুতেই তাঁকে হত্যা করত না। তিনি আরো বলেন, হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম। (ইবনু তায়মিয়া, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ, ১/৩৫০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১৭৩; আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়, পৃঃ ৭-১০।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ  সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকের ঐকমত্যে ইয়াযীদ ইবন মু‘আওয়িয়া হুসাইনকে হত্যার আদেশ দেন নি। বরং তিনি উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে চিঠির মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইরাকের জমিনে হুসাইনকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেন। এতটুকুই ছিল তার ভূমিকা। বিশুদ্ধ মতে তার কাছে যখন হুসাইন নিহত হওয়ার খবর পৌঁছল তখন তিনি আফসোস করেছেন। ইয়াযীদের বাড়িতে কান্নার ছাপ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি হুসাইন পরিবারের কোনো মহিলাকে বন্দী বা দাসীতে পরিণত করেন নি, বরং পরিবারের সকল সদস্যকে সম্মান করেছেন। সসম্মানে হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। যে সমস্ত বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, ইয়াযীদ আহলে বাইতের মহিলাদেরকে অপদস্থ করেছেন এবং তাদেরকে বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে বেইজ্জতি করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই।


ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এটি প্রায় নিশ্চিত যে ইয়াযীদ যদি হুসাইনকে জীবিত পেতেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করতেন না। তাঁর পিতা মুয়াওয়িয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে এ মর্মে অসীয়তও করেছিলেন। ইয়াযীদ এই কথাটি সুস্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছিলেন।

ইবনে আবী নু‘ম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একজন লোক তাঁকে ইহরাম অবস্থায় মশা হত্যা করার হুকুম জানতে চাইল। তিনি তখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোনো দেশের লোক? সে বলল, ইরাকের। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা এই লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর। সে আমাকে মশা হত্যা করার হুকুম জিজ্ঞেস করছে। অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাতিকে হত্যা করেছে। আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল। (সহিহ বুখারী, হাদীছ নং- ৫৯৯৪)

ইয়াযীদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা কেমন হওয়া উচিতঃ

এই বিষয়টি খুবই স্পর্ষ কাতর একদিকে আমাদের নয়ন মনি নবী এর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দহিত্র। অপর পক্ষে একজন তাবেয়ী ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফা যে সরাসরি এই কাজে অংশগ্রহণ করেনি। এই ইতিহাস সঠিকভাবে লেখা হয়নি। শীয়াগণ হত্যার জন্য তাবেঈ ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়াকে ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলে গালি দেয়। তারা তাকে কাফির ও ফাসিক বলেই মনে করে। আবার অনেকে আছে যারা তাকে প্রসংশা করতে করতে এই হত্যা কান্ড থেকে মুক্ত ঘোষনা করে। কিন্তু বিষয় যেহেতু আমাদের নিকট অষ্পষ্ট তাই কাউকে গালি বা অভিশাপ না দিয়ে বিচারের ভার মহান আল্লাহ উপর ছেড়ে দেই। যারা সরাসরি এই কিলিং মিশনে ছিল দুনিয়াতেই তাদের কিছু শাস্তি হয়েছে। যেমনঃ পরবর্তীতে আল-আশতার নাখ‘য়ীর হাতে উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ নির্মমভাবে নিহত হন। যখন নিহত হলেন তখন তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মসজিদে রাখা হল। তখন দেখা গেল একটি সাপ এসে মাথার চারপাশে ঘুরছে। পরিশেষে উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বের হল। ফের মুখ দিয়ে প্রবেশ করে নাকের ছিদ্র দিয়ে তিনবার বের হতে দেখা গেল। (দেখুন: তিরমিযী, ইয়াকুব ইবন সুফীয়ান)

আলহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ইতিহাস ও জীবনীর কিতাবগুলোতে দেখা যায় সালাফে সালেহীনের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় কোনো ইমামের কিতাবে ইয়াযীদের উপর লানত করা বৈধ হওয়ার কথা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। কেউ তার নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বা লা‘আনা হুল্লাহ- এ দু’টি বাক্যের কোনোটিই উল্লেখ করেন নি। সুতরাং তিনি যেহেতু তার আমল নিয়ে চলে গেছেন, তাই তার ব্যাপারে আমাদের জবান দরাজ করা ঠিক নয়। তাকে গালাগালি করাতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু অর্জিত হবে না। তার আমল নিয়ে তিনি চলে গেছেন। আমাদের আমলের হিসাব আমাদেরকেই দিতে হবে। তার ভাল মন্দ আমলের হিসাব তিনিই দিবেন।

ইমাম যাহাবী ইয়াযীদের ব্যাপারে বলেনঃ

আমরা তাকে গালি দিবো না এবং ভালও বাসবো না।” মদ পান করা, বানর নিয়ে খেলা করা, ফাহেশা কাজ করা এবং আরও যে সমস্ত পাপ কাজের অপবাদ ইয়াযীদের প্রতি দেওয়া হয়, তা সহিহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে তাঁর চেয়ে হুসাইন যে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মন্তব্যঃ আমাদের বিশ্বাস হবে ইয়াযীদ মুসলিম ছিলেন। আমরা তাকে গালি দিবো না এবং ভালও বাসবো না। তার নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বলে দোয়া করবনা। আবার  লা‘আনা হুল্লাহ বলে অভিসাপ দিব না। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমরা যেহেতু উপস্থিত ছিলাম না, তাই তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই অধিক নিরাপদ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment