সিয়ামরত অবস্থায় আমলসমূহ (প্রথম পর্ব)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

রমজান মাসের ইবাদাত অন্যান্য মাসের ইবাদাতের উপর স্থান দেয়া হয়েছে। অনেক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রমজানকে বিশেষ স্বাতন্ত্র দান করেছেন। বৈশিষ্ট্য মন্ডিত রমজান মাস হল ইবাদত করার মাস। এই মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত ইবাদাত করতেন অন্য কোন মাসে এত ইবাদাত করতেন না। সহিহ হাদিসে এসেছে,

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং রাতে জাগতেন এবং পরিবার-পরিজনদেরকেও জাগাতেন। আর (ইবাদতের জন্য) কোমর বেঁধে নিতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩১ এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহীহ বুখারী ২০২৪, সহিহ মুসলিম ১০৭৪, তিরমিযী ৭৯৬, নাসায়ী ১৬৩৯, আবূ দাউদ ১৩৭৬, ইবনু মাজাহ ১৭৫৭, ১৭৬৮, আহমাদ ২৩৬১১, ২৩৮৫৬, ২৩৮৬৯, ২৪৩৯২, ২৫৬৫৬)।

তাই এ মাসের প্রতিটি মুহুর্তই ইবাদতের কাজে অতিবাহিত করা সকল মুসলিমের কাজ। এই লক্ষে, সকাল থেকে নিয়ে ইফতার পর্যান্ত একভাগ করা আবার ইফতার থেকে নিয়ে ফজরের সালাত পর্যান্ত একভাগ করে আমল করা। তাই রমজানের আমলকে দুই ভাগ করে আমল করা।

১। দৈনিক রুটিন ও

২। মাসিক রুটিনে

দৈনিক রুটিনঃ দৈনিক রুটিন বলতে রমাজান মাসে দিন রাত মিলে ২৪ ঘন্টায় কি কি আমল করা যায় তার একটি রুটিন করে নেয়া যায়। এখানে আমি বুঝার জন্য একটি রুটির উল্লেখ করলাম। সমাজে বিভিন্ন পেশার মানুষ বাস করে যার যার পেশার সাতে খাপ খায়িয়ে রুটির তৈরি করতে হবে। তবে বছরের অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে যেহেতু আমল বাড়াতে হবে তাই যার যার কর্ম অনুসারে কাজকে হালকা করে নিতে হবে। ব্যবসায়ী রমজানের কথা মাথায় রেখে ব্যবসা সাজাবে, দিন মজুর তার কর্ম পরীধি করিয়ে আনবে, মালিক তার শ্রমিকের উপর সহনশীল হয়ে ইবাদাতের সুযোগ দিবে। যেমনি ভাবে আমাদের দেশের সরকার তার অফিসের কর্ম ঘন্টা সমন্নয় করে থাকে। আমি শুধু একজন কর্মজীবি মানুষের ২৪ ঘন্টার আমলের একটি চার্ট তুলে ধরলাম বিঝার জন্য। এমনিভাবে যে যারমত করে তার ২৪ ঘন্টার রুটির সাজিয়ে নিবে।

রমজান মাসে একজন কর্মজীবি মানুষের ২৪ ঘন্টার আমলের রুটিনঃ

ক্রঃ নং সময় আমল
০১ ইফতারির পর মাগরীবের সালাত আদায় করা সম্ভব হলে ৪/৬ রাকাত নফল সালাত আদায় করা
০২ ইশার সালাত সাথে ইশার সালাত সাথে নিয়মত তারাবির সালাত আদায়  করা সম্বব হলে ইমামের সাথে শেষ পর্যান্ত থাকা।
০৩ ইশা ও তারাবির সালাতের পর ইশা ও তারাবির সালাতের পর পরবর্তী আমলের নিয়তে ঘুম যাওয়া।
০৪ সেহেরীর পূর্বে সেহেরীর করতে কম পক্ষে আধা ঘন্টা সময় লাগে তাই সম্ভব হলে এক বা দেড় ঘন্টা আগে উঠে তাহাজ্জুদ এর সালা আদায় করা
০৫ সেহেরীর পর সেহেরীর পর অফিসের দিন তাড়াতাড়ি বাসায় এসে ঘুমিয়ে যাওয়া। আর অফিস না থাকলে ইশরাক পর্যান্ত মসজিদে অপেক্ষা করা।
০৬ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর অফিসে যাওয়ার আগ পর্যান্ত কুরআনের অর্থ বুঝে তেলওয়াত করা।
০৭ অফিসের সময় অফিসের কর্ম ঘন্টায় কোন ফাঁকি দেয়া যাবেনা। কোন প্রকার অবৈধ কাজ বা অবৈধ লেনদেন করা যাবে না। সময় সুযোগ হলে মহান আল্লাহর জিকির করা। অফিসের কাজে ফাকে সালাত আদায় করা এবং মহান আল্লাহর কথা স্বরণ করে এই ভেবে ভীতি সন্তত্ব থাকা যে, আমি কি আমার কাজ দ্বারা মহান আল্লাহকে সন্ত্বস্তি করতে পারব।
০৮ অফিস থেকে এসে যারা অফিস থেকে আছরের সালাতে পূর্বে বাসায় ফিরবে তারা আবার কুরআন নিয়ে বসে যাবে। আর যারা পরে আসরে তারা ইফতার জোগারে সাহায্য করতে পার এবং সাথে বাজারের কাজ ও সেরে নিতে পারে।
০৯ আসরের পর আসরের পর ইফতার জোগারে সাহায্য করতে পারে এবং সাথে বাজারের কাজ ও সেরে নিতে পারে।
১০ সূর্য অস্তের সাথে সাথে সূর্য অস্তের সাথে সাথে ইফতারির করে নেয়া

মাসিক রুটিনঃ দৈনিক আমলের সাথে সাথে মাস ব্যাপিয়া অনের আমল আছে। দৈনিক আমলের সাথে সমন্নয় করে মাসিক রুটিনও আদায় করা যায়। মাসিক রুটিনে অনেক আমল আছে যা ফরজ তা কোন অবস্থায়ই ত্যাগ করা যাবেনা। আর কিছু আমল আছে ঐচ্ছিক যা করলে বহু নেকী আর না করলে কোন গুনাহ হওয়ার  সম্ভাবনা নেই। আবার কোন আমল (যাকাত) আছে রমজানে একবার করলেই চলে, কোন আমল (ইতিকাফ) আছে রমাজানের শেষ দশকে করতে হয়, কোন আমল (জিকির) আছে সারা দিন করা যায়। তাই দৈনিক রুটিনের পাশাপাশি মাসিত ইবাদের রুটিন বানালে ভাল হয়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে এভাবে রুটিন বানিয়ে নিজের উপর ওয়াজিব করে নিলে বিদআত হয়ে যাবে। রুটিন করব সময়ে অপচয় রোধের জন্য। তাই রুটিন মাফিক আমল না করতে পারলে আফসস করা যাবে না। রমদান মাসে নিম্নের আমলগুলি করে মহান আল্লাহর সন্ত্বস্তি অর্জণ করার চেষ্টা করা। এই আলগুলি তিনটি পর্যায় ভাগ করা। যেমনঃ

ক. যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্টঃ

খ. যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়ঃ

গ. যে আমলগুলি দ্বারা কুরআনে হক আদায় হবেঃ

প্রথম পর্বঃ

ক. যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্টঃ

১।  সিয়াম পালন করা

২।  পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে আদায় করা

৩। নিয়মিত তারবির সালাত আদায় করা

৪। সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া

৫। সাহরী খাওয়া

৬। ইফতার করা৮

৭।  ইফতার করানো

৮। ইতিকাফ করা

৯। লাইলাতুল কদর তালাশ করা

১০। ফিতরাহ দেয়া

দ্বিতিয় পর্বঃ

যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়ঃ

১। নফল সালাতের পাবন্দি করা

২। তওবা, দুয়া ও কান্নাকাটি করা

৩। নেক আমল, কল্যাণকর কাজ ও সৎকর্ম বেশি বেশি করা

৪। বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা

৫। আল্লাহর যিকর করা 

৬। অপরকে খাদ্য খাওয়ানো

৭। আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করা

৮। ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা

৯। সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা

তৃতীয় পর্বঃ

গ. যে আমলগুলি দ্বারা রমজানে কুরআনের হক আদায় হবেঃ

১। কুরআনের প্রতি ঈমান আনা

২। বিশুদ্ধ উচ্চারনে কুরআনের তেলওয়াত শিক্ষা করা

৩। অপরকে কুরআন পড়া শিক্ষা দেয়া

চতুর্থ পর্বঃ

গ. যে আমলগুলি দ্বারা রমজানে কুরআনের হক আদায় হবেঃ

৪। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা ও শ্রবন করা

৫। কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা

পঞ্চম পর্বঃ

গ. যে আমলগুলি দ্বারা রমজানে কুরআনের হক আদায় হবেঃ

৬। সহিহ হাদিসে বর্ণিত সুরা বা আয়াত মুখস্থ করে নিয়মিত তেলওয়াত করা

৭। অর্থ বুঝে বুঝে কুরআন পড়া

৮। সম্ভব হলে বিশুদ্ধ তাফসিরের আলোকে পড়াকুরআন অর্থবুঝে পড়া করা

৯। কুরআন অনুসারে জীবন যাপর করা

ষষ্ঠ পর্বঃ

গ. যে আমলগুলি দ্বারা রমজানে কুরআনের হক আদায় হবেঃ

১০। কুরআন অন্যেনর নিকট পৌছান

ক। যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্টঃ

১।  সিয়াম পালন করাঃ রমজান মাসের প্রধান বৈশিষ্টই হল সিয়াম পালন করা যা মহান আল্লাহ আমাদের উপর ফরজ করছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাই হল এই গ্রন্থের প্রধান ও একমাত্র উদ্দ্যেশ্য। 

২। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে আদায় করাঃ

রমজান ও রমজানের বাহিরে কোন ওজর ছাড়া সকল অবস্থায় সকল মানুষের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরজ। সকল মুজতাহীদ ইমামদের মতে জামাতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব। কাজেই রমজান মাসে কোন অবস্থায়ই এই ওয়াজিব তরফ করা যাবেনা।

ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জামাআতে সালাত আদায় করার মর্যাদা একাকী সালাত আদায়ের চাইতে সাতাশ গুন বেশী। (সহিহ মুসলিম ১৩৫২ ইফাঃ)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঘরে কিংবা বাজারে একাকী সালাতের চেয়ে মসজিদে জামাতে সালাত আদায়ে ২৫ বা ২৭ গুন সওয়াব বেশী।তিনি বলেন, ২ জনের সালাত একাকীর চেয়ে উত্তম। জামাত যত বড় হয় নেকী তত বেশী হয়। (মিশকাত-৭০২, ১০৫২, আবু দাউদ, নাসাই, মিশকাত- ১০৬৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তা কসম করে বলছি, আমার মন চায় আযান হওয়ার পরেও যারা জামা’য়াতে আসেনা, ইমামতির দায়িত্ব কাউকে দিয়ে আমি নিজে গিয়ে তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে আসি’। (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, মিশকাত- ১০৫৩)

মন্তব্যঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্রোধ থেকে বাচতে এবং অধিক নেকি হাসিল করতে জামাতে সালাতের বিকল্প নাই। আর রমজান মাসে তার সওয়ার আরও সত্তর গুন বেড়ে যায়। কাজেই নফল ইবাদাত না করতে পারলেও জামাতে সালাত যেন কোন অবস্থায় মিস না হয়।

৩। নিয়মিত তারাবির সালাত আদায় করাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তিনি আমাদের তারাবির সালাত আদয় করতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “এটি এমন মাস যাতে আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য রোযাকে ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য এর রাতের নামাযকে সুন্নত করেছি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩২৮, সুনানে নাসায়ী, হাদীসস নং-২২১০)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮২ ইসলামি ফাউন্ডেশ

মন্তব্যঃ যেহেতু তারাবির সালাত রমজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট তাই এই মাসে এই সালাতের প্রতি একটু আলাদা নজর দিতে হবে, যাতে করে নিয়মিত সবার সাথে মসজিদে গিয়ে এই সালাত আদায় করা যায়।

৪। সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়াঃ

রমাদান মাসে তারাবি সালাত আদায় করে ঘুমিয়ে আবার সিহরীর কিছু পূর্বে উঠে সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমাদানের কারণে আরো বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমাদান মাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত। (সহীহ মুসলিম : ২৮১২)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহামহিম আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছ এমন যে, আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছ এমনে, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।(সহিহ বুখারী ১০৭৯ ইফাঃ)।

৫। সাহরী খাওয়াঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) খেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে। (সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৮০১, মিশকাত-১৯৮২, মুসলিম ১০৯৫, তিরমিযী ৭০৮, নাসায়ী ২১৪৬, ইবনু মাজাহ ১৬৯২)।

আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমাদের রোযা ও কিতাব-ধারীদের (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) রোযার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সেহরি খাওয়া।” (হাদিসের মান সহিহঃ মিশকাত-১৯৮৩, হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৪০ এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১০৯৬, তিরমিযী ৭০৯, নাসায়ী ২১৬৬, আবূ দাউদ ২৩৪৩, আহমাদ ১৭৩০৮, ১৭৩৪৫, দারেমী ১৬৯৭)।

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাহরী হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সাহরী করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও ফেরেশ্‌তাগণ সাহরীতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন। (আহমদ : ১১৩৮৪)।

মন্তব্যঃ সাহরী খেতে দেয়া মহান আল্লাহর একটি বিরাট নিয়ামত। তার উপর সাহরীর মাঝে মহান আল্লাহ বরকত ও রেখেছেন। তাই রমজান মাসের এই বরকত ঘুমের ঘোরে অবহেলা করে ত্যাগ করা উচিৎ নয়।

৬। ইফতার করাঃ

ইফতার মহান আল্লাহর একটি নিয়ামত। সময় মত ইফতারি করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ আমল। সাহল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যতদিন পর্যন্ত মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৮৪, বুখারী ১৯৫৭, মুসলিম ১০৯৮, তিরমিযী ৬৯৯, মুয়াত্ত্বা মালিক ১০১১)।

মন্তব্যঃ রমজান মাসে সুন্নত সম্মত পদ্দতিতে ইফতারির প্রস্ততি নেই। যথা সময় ইফতারি করাও নেকীর কাজ। তাই ইফতারির সময় জেনে, সঠিক সময় করতে হবে। অধিক নেকীর আশায় ইয়াহুদিদের মত রাত পর্যান্ত সিয়াম পালন করা গুনাহের কাজ।

৭। ইফতার করানোঃ

যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি সায়িমকে ইফতার করাবে অথবা কোন গাযীর (যোদ্ধার) আসবাবপত্র ঠিক করে দেবে সে তাদের (সায়িম ও গাযীর) সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৯২, বায়হাক্বী- শু‘আবূল ঈমান-এ আর মুহয়্যিইউস্ সুন্নাহ্- শারহে সুন্নাহ্’য় এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি)।

মন্তব্যঃ মহান আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষার জন্য সকলকে সমান সম্পদ দান করেনি। সমাজে যারা অঢেল সম্পদের মালিক তাদের উচিৎ সমাজের গরীব অসহায়দের প্রতি খেয়াল রাখা। তাদের ইফতারির ব্যাবস্থা করে দেয়া। দায় সারা গোছের একটা ইফতারী পার্টির আয়োজন করলেই হবে না। কারন তার ইফতারী পার্টির এসেছে তার মতই সম্পদশালী ব্যাক্তি। গরীব অসহায় কেউ আসলে কুকুরের মত দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়। অথচ ইফতার দরকার ছিল এদেরই।

৮। ইতিকাফ করাঃ

ইতিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই রাত্র পেতে শেষ দশকের ইতিকাফ করার কোন বিকল্প নেই। লাইলাতুল কদর যে কোন এক রাতে হয় কিন্তু এই রাতের আশায় শেষ দশকে ইতিকাফকারীর আমল করার ধরন ও পরিমান বেড়ে যায় আর রমজান মাসের বরকতে উহার মর্জান আরও বেড়ে যায়।

আবূ সাঈদ খূদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রমযানের) মাঝের দশকে ইতিকাফ করেন। অতঃপর ২০তম দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এবং ২১তম দিনের সূচনাতে তিনি নিজ বাসস্থানে ফিরে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে যারা ইতিকাফ করেন, তারাও নিজ নিজ আবাসে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর একবার রমযান মাসের মাঝের দশকে ইতিকাফ করলেন। যে রাতে তাঁর ইতিকাফ হতে ফিরে আসার কথা, সে রাতে (পূনরায়) ইতিকাফ আরম্ভ করলেন ও লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি বললেন, আমি সাধারণত এই (মধ্যম) দশকে ইতিকাফ করতাম। এরপর শেষ দশকেও ইতিকাফ করা আমার কাছে সমীচীন মনে হল। অতএব যে ব্যাক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন নিজ ইতিকাফের স্থানে অবস্থান করে। আমি এই (কদরের) রাত স্বপ্নে দেখেছিলাম কিন্তু আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোত তা অনুসন্ধান কর। আমি স্বপ্নে নিজেকে পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ২১তম রাতে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তিনি যখন ফজরের সালাত থেকে ফিরলেন, তখন আমি তাঁর মুখমন্ডল কাদা ও পানিতে সিক্ত দেখলাম। (সহিহ মুসলীম হাদিস নম্বর ২৬৪০ ইসঃ ফাঃ)।

ইতিকাফকারীকে যেহেতু সারাক্ষন মসজিদে থাকতে হয়। সালাতের জন্য মসজিদে অপেক্ষারত ব্যক্তি ন্যায় ফেরেশতারা দোয়া পেতে থাকে। আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন ওযূ অবস্থায় সালাতের অপেক্ষায় বসে থাকে সে যেন সালাতেই রত। তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, হে আল্লাহ! তুমি তার প্রতি দয়া করো। (সহিহ মুসলীম ৬১৯)।

মন্তব্যঃ রমজানে ইতিকাফ করা সুন্নহ। এই সুন্নাত পালন করতে ছেষ্টা করি।

৯। লাইলাতুল কদর তালাশ করাঃ

লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন,

إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ (١) وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ (٢) لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬ (٣) 

অর্থঃ আমি একে নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জান কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা কদর : ১-৩।)

এ আয়াতের ব্যাখায় মুফাসসির সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘এ রাতের ইবাদত অন্য হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। (তানবিরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস : ৬৫৪ পৃষ্ঠা।)

তাবেয়ি মুজাহিদ (র.) বলেন, এর ভাবার্থ হলো, ‘এ রাতের ইবাদত, তেলাওয়াত, কিয়াম ও অন্যান্য আমল লাইলাতুল কদর ছাড়া হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’ মুফাসসিগণ এমনই ব্যাখ্যা করেছেন। আর এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। (ইবনে কাসির : ১৮ খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা।) 

এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই রজনী অনুসন্ধানের জন্য তারা রমজানের শেষ দশকে মসজিদে মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে। তা সম্ভব না হলে, অন্তত শেষ দশকে রাতগুলি মসজিদে ইবাদতের নিমিত্তে কাটান।

১০। ফিতরাহ দেয়াঃ

রমজানের অন্যতম ফরজ ইবাদাত হল সাদাকাতুল ফিতর। রমজানে রাত না জাগলে, ইতিকাফে না বসলে, কুরআন তিলওয়া না করলে, কোন নফল না আদায় করলে বিরাট সওয়াব থেকে মাহরুম থাকবে কিন্ত গুনাহ কবে না। কিন্তু সাদাকাতুল ফিতর আদায় না করলে নিশ্চই গুনাহ হবে। কেননা এটি নারী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে সকলকেই জন্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কোরআনে কিছু বর্ণিত না হলেও কিন্তু সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত একটি ফরজ ইবাদত। রাসূলের সকল আদেশ নিষেধ আমাদের জন্য বিনা বাক্যে মেনে নেয়া ফরজ। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧﴾ [الحشر: ٧]

অর্থঃ ‘আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।’ (সুরা হাসর ৫৯:৭)।

ফিতরার ব্যাপারে বোখারি শরিফের মূল্যবান একখানা হাদিস হলো, আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমান গোলাম-স্বাধীন, পুরুষ-নারী এবং ছোট-বড় সকলের উপর এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব জাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ করেছেন। এবং আদেশ করেছেন, লোকজনের ঈদগাহে যাওয়ার আগেই যেন তা আদায় করা হয়। (সহিহ বুখারী ইসলামি ফাউন্ডেশন-১৪২৩)

এই হাদিস ইমাম মুসলিমের ভাষ্যতে ইবনে উমার (রা) থেকে বর্নিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমান দাস-দাসি ও স্বাধীন পুরুষ ও মিহিলা সকলের উপর এক সা হিসেবে খেজুর বা সব রমজান মাসে সদকায়ে ফিতর নির্ধারন করেছেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ২১৪৯, ২১৫০ ও ২১৫১)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য ও মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা সদাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গন্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

মন্তব্যঃ কাজেই ঈদের সালাত আদায় করার পূর্বেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করি।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment