আকিদাহ কি?

লেখকঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

আকিদা শব্দটি আক্দ মূলধাতু থেকে গৃহিত। আরবি শব্দ আক্দ অর্থ বন্ধন বা গিরা। সে মতে আকিদাহ হল মজবুত করে বাঁধা বা দৃঢ় বিশ্বাস। মানুষ ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে হৃদয়ে গহিনে যা ধারনকরে তাকে আকিদা বলে।

আকিদার ব্যাখ্যা:  ঈমান ও আকিদার মধ্যে কি সম্পর্ক আছে তাহা জানা জরুরি। ঈমান অর্থ বিশ্বাস আর আকিদা অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস। শাব্দিক অর্থে তেমন কোন পার্থক্য নেই, তাছাড়া মুসলিম সমাজের সকলেই ধর্মবিশ্বাস বলতে ‘ঈমান’ ও ‘আকিদা’ দুটি শব্দকে সমান বুঝে। মজার ব্যাপার হল ঈমান শব্দটি কুরআন হাদিসে ব্যাপরভাবে ব্যবহৃত হলেও আকিদা শব্দটি কুরআন হাদিসে খুজে পাওয়া যায়না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোন সাহাবি এ পরিভাষাটি ব্যবহার করছেন বলে যানা যায়না। হিজরি চতুর্থ শতক থেকে আকিদা শব্দটির প্রচলন লাভ করে। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্র পরবর্তীতে এটাই একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।

‘আকীদার’ পারিভাষিক অর্থ:

العقيدة الإسلامية: هي الإيمان الجازم بالله، وملائكته، وكتبه، ورسله، واليوم الآخر، والقدر خيره وشره، وبكل ما جاء في القرآن الكريم، والسنة الصحيحة من أصول الدين، وأموره، وأخباره. (رسائل الشيخ محمد بن إبراهيم في العقيدة 7/2).

অর্থঃ “শারী‘আতের পরিভাষায় ‘আকীদাহ্ হচ্ছে, মহান আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, শেষ দিবস তথা মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় বিষয় ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি এবং আল-কুরআনুল হাকীম ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত দীনের সকল মৌলিক বিষয়ের প্রতি অন্তরের সুদৃঢ় মজবুত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের নাম ‘আকীদাহ।” (রিসালাতুম শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ফিল ‘আকীদাহ্ ৭/২)

‘আকীদার’ পারিভাষিক অর্থে ও ঈমানের ছয়টি মূলভিত্তির উপর সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। উক্ত ছয়টি এবং এর আনুসঙ্গিক বিষয়গুলির প্রতি সঠিক বিশ্বাস না রেখে নেতিবাচক ধারনা করলে অথবা অবিশ্বাস করলে কিছুতেই ঈমানদার হবে না। এই নেতিবাচক বা অবিশ্বাস ধারনা থেকে মানুষ নিজ নিজেই অনেক ভ্রাস্ত বিশ্বাসের জম্ম দেয়। এই ভ্রাস্ত বিশ্বাস থেকেই ভ্রান্ত আকিদার জম্ম। ইসলামের দাবি, ঈমান আনার ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য ও ইতিবাচক সংবাদের প্রতি বিশ্বাস।

সঠিক আকিদা অর্জন ও ভ্রান্ত আক্বীদা বর্জনের না করলে আমাদের কোন আমলই কবুল হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ মানুষ ইসলামের সঠিক আকিদা পোষন করে না। আকিদার সাথে শির্ক মিশ্রিত বিশ্বাস রাখে, ফলে আমল ও শির্ক মিশ্রিত হয়। আকিদা ও আমলের সাথে শির্ক মিশ্রিত রাখার ফলে সে মুশরিকে পরিনত হয়।

 তাই তো আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

 وَمَا يُؤۡمِنُ أَڪۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ (١٠٦)

অর্থ: তাদের বেশীর ভাগ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্বেও মুশরিক, (ইউসুফ ১২:১০৬)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

 وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ (٨)

অর্থ: কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়, (বাকারা ২:৮)।

মানুষ সাধরনত কুরআন হাদিসের অনুসরন, অলীদের অনুসরন, সমাজের প্রচলনের অনুসরন, বাপ দাদার অনুসরন, যুক্তি, বৈজ্ঞানিক আবিস্কার, কল্পিত মাবুদের এবাদাত, গাজাখুরি গল্প, কথিত অলিদের নামে বে নামে রচিত হাজার কেরামতি থেকে আকিদা আবিস্কার করে। তাই উৎস নির্বাচনের উপর তার আকিদা নির্ভর করে। উৎস নির্বাচনে ভুল করলে আকিদা ভূল হবে এটাই সতসিদ্ধ কথা। আমাদের দ্বীনের উৎস হল কুরআন হাদিস হলে আকিদা পরিশুদ্ধ হবে আর সমাজের প্রচলন, বাপ দাদার অনুসরন হলেতো ভ্রান্ত হবে। বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিমগণ আকিদার ক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারণা পোষন করে থাকে। কারন আমারা দ্বীনের উৎস হিসাবে অনেক ক্ষেত্রে কুরআন হাদিস পাইনি। প্রাথমিক ভাবে আমাদের উপমহাদেশে দুটিটি ধারায় দ্বীন আসে।

 ১.     আমাদের উপমহাদেশে প্রায় আটশত বছর মুঘোলরা শ্বাসন করছে আর ইংরেজরা দুইশত বছর।   মুঘোলদের শ্বাসন আমলেই মুলত উপমহাদেশে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। মুঘোলরা ছিল পারশ্যের অধিবাসি (ইরান)। পারশ্যের অধিকাংশ আগ্নিপুজক ছিল, সহিহ ইসলাম তাদের মধ্যে প্রবেশ করার সময় মুসলিদের নিজেদের মধ্যে ব্যপক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং বিভিন্ন ফিরকা (শীয়া, খারিজী, রাফজি) তৈরি হয়। ফলে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যেই আকিদা আমলে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তৎকালিন পারশ্যে শীয়াদের প্রধান্য ছিল যা আজ ও আমারা ইরানের দিকে তাকালে দেখতে পাব। এই জন্য মুঘোলদের সময় সহিহ ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের  সাথে সাথে ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাসের উপমহাদেশে প্রবেশ করে। কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান না থাকার জন্য ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাসের উপর উপমহাদেশের ইসলামের জম্ম।

২.      মুঘোলদের পাশাপাশি সুফিদের মাধ্যমে ও দ্বীন প্রচার প্রসার লাভকরে। অধিকাংশ সুফিদের দ্বীনের প্রতি খুবই মহব্বত ছিল, ইবাদাত বন্দেগিতে একনিষ্ট ছিল, ইবাদাতের জন্য কঠর সাধনায় জীবন দানে কুন্ঠাবোধ করতনা কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান বা ইলম কম থাকার কারনে সঠিকভাবে ইবাদাতটি সম্পন্ন করতে পারতোনা। সেই সময়কার সুফিদের প্রচলিত আকিদা ও ইবাদাত এখন ও মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। ইবাদতের নামে গান করা, মাজার তৈরি করা, উসবের নামর উরশ করা, মৃত পীর বা অলীদের জম্ম ও মৃত্যু বার্ষিকি পালন করা ইত্যাদি সুফিদেরই আবিস্কৃত আমল।

৩. এই দুটি ধারার পাশাপাশি উপমহাদেশে আগে থেকেই মজুদ ছিল শত শত কল্পিত দেবদেবীর আরাধনা, সন্যাসি ধারার জীবন জাপন, হাজারো কুসংস্কার ও লোকাচার। তদুপরি যে পরিমানে লোক এক সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল, আলেমদের অভাবে এক সাথে সেই পরিমান ইসলামি জ্ঞান দান করা সম্ভব ছিল না। ফলে ইসলামের সাথে আগেকার কুসংস্কার ও লোকাচার রয়েই গেছে। এর উদাহরন সরূপ বলা যায়: আজ ও মুসলিমগন শুভ অশুভ জ্ঞান করে, ঘটি পুজা করে, হাল খাতা পালন করে, নবান্ন উৎসব পালন করে, বৈশাখী মেলার আয়জন করে, নববর্ষ পালন করে।

আমাদের এ ভ্রান্ত ধারণা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, ঈমানের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার উপক্রম। আকিদার ক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারণাগুল সংশোধন করতে পারলে, আশা করা যায় পরকালে যাবতীয় কল্যাণ লাভ করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আমাদের সকলকে জেনে রাখা উচিত যে, আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক বিশুদ্ধ ‘আমল ছাড়া অন্য কিছু মহান আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার নিকট কবুল হবে না, আর বিশুদ্ধ ‘আমলের পূর্বশর্ত হল বিশুদ্ধ আকিদা কারন বিশুদ্ধ আকিদা ব্যতীত একজন মুসলিম কখনো খাঁটি মুমিন হতে পারবে না। ধরুন একজন লোকের আকিদা বা দৃঢ় বিশ্বাস হল মৃত ব্যক্তি কবর থেকে মানুষের উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখেন। এই একটি মাত্র ভ্রান্ত আকিদা দ্বারা সে অনেক শির্কি আমল করবে। কারন উপকার অপকার করার এক মাত্র মালিক আল্লাহ।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ‌ۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذً۬ا مِّنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ (١٠٦)

আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কোন সত্তাকে ডেকো না, যে তোমার না কোন উপকার করতে না ক্ষতি করতে পারে৷ যদি তুমি এমনিটি করো তাহলে জালেমদের দলভুক্ত হবে, (ইউনুস ১২:১০৬)

. আকিদার উপর নির্ভর করেই সকল মানুয়ের কর্ম কান্ড পরিচালত হছ্ছে। আকিদার কারনেই  আদম সন্তানের কেই মুমিন, কেউ কাফির, কেই মুশরিক, ইহুদি আবার কেউ বা খৃষ্টান। বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে আমল ও তত দৃঢ় হবে। এখানে দুটি বিষয়ের আলোকপাত করা হল। একটি হল বিশ্বাস অপরটি হল আমল। যতক্ষন বিশ্বাস স্থাপন হয়নি ততোক্ষন আমল ও শুরু হয়নি। যেমন ধরুন কাউকে মোবাইলে কল করে বলা হল, আপনার অফিসে/কারখানায় আগুন লেগেছে। লোকটি যদি সংবাদটি বিশ্বাস করে তবে সে নিশ্চয়ই আগুন নিভাবার জন্য যা যা করা দরকার সবই করবে। আর যদি সংবাদটি বিশ্বাস না করে, তবে সে নিশ্চয়ই কোন কর্ম তৎপড়তা চালাবে না। কিন্তু সে যদি মোবাইলে কল না পেয়ে সরাসরি টিভিতে লাইভ দেখতে পেল যে, তার অফিসে/কারখানায় আগুন লেগেছে। তখন কিন্তু আর বিশ্বাস অবিশ্বাস কথা আসে না। কাজেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসে অদৃশ্যের সংবাদের জন্য। কাজেই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর ঈমান আনার বা ন আনার প্রশ্ন আসে না। যা নিজ চোখে দেখলাম তাকে অস্বীকার কি আছে। দেখা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান নয়। মুমিনকে তো এজন্য মুমিন বলা হয় যে, সে অদৃশ্যের বিষয় শুধু কুরআন হাদিসের সংবাদের ভিত্তিতে মেনে নিবে ও বিশ্বাস করবে। এই জন্যই  আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা কোরআনের সুরা বাকারার শুরুতে বলেন: মুত্তাকিদের জন্য হিদায়েত। আর মুত্তাকিদের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে তারাই মুত্তকি।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন:

الٓمٓ (١) ذَٲلِكَ ٱلۡڪِتَـٰبُ لَا رَيۡبَ‌ۛ فِيهِ‌ۛ هُدً۬ى لِّلۡمُتَّقِينَ (٢) ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ يُنفِقُونَ (٣) وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأَخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ (٤)

 আলিফ লাম মীম ৷ এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে , নামায কায়েম করে  এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে ৷ আর যে কিতাব তোমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে আর আখেরাতের ওপর একীন রাখে ৷   বাকারা ২:১-৫)।

তাহলে বুঝতে পালাম অদৃশ্যের সংবাদের প্রতি বিশ্বাসই হল ঈমান। পৃথিবীতে চলমান ও দৃশ্যমান কোন কিছুর উপর বিশ্বাস ঈমান নয়। অতীতের যে ঘটনাবলী ঘটেছে (কুরআন হাদিসে উল্লেখিত) আর ভবিষ্যতে ঘটনাবলী পরকালে ঘটবে, সেই সব অদৃশ্যের সংবাদের প্রতি বিশ্বাসই হল ঈমান।

আকিদা অর্থ হল দৃঢ় বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাসের তিনটি দিক আছে, তা হল ইতিবাচক, নেতিবাচক ও সংশয়। ইতিবাচক হল বিশ্বাস, নেতিবাচক হল অবিশ্বাস আর সংশয় হল দোদুল্যমান থাকা। ইতিবাচকের কাজের ধরন আর নেতিবাচকের ধরন এক নয়। কেউ ইতিবাচক ধারনা নিয়ে অদৃশ্যর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে সে ইসলামে প্রবেশ করল। নেতিবাচক ধারনায় বিশ্বাসি কাফির বলে পরিগনিত হয়। আধা আধা বিশ্বাস করা বা সংশয় থাকা ঈমান হীনতারই পরিচয় আর এটা মুনাফিকের লক্ষন। সংশয়ই যদি থাকল তাহলে ঈমার হয় কিভাবে?

কুরআন মজীদের আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন:

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ

তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই সত্যনিষ্ঠ, (হুজুরাত-৪:১৫)।

সংশয় থাকা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য :: আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ * إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ

অর্থঃ যারা আল্লাহে ও শেষ দিবসে ঈমান আনে তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদে অব্যাহতি পাওয়ার প্রার্থনা তোমার নিকট করে না। আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। তোমার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা শুধু ওরাই করে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে না এবং যাদের চিত্ত সংশয়যুক্ত। ওরা তো আপন সংশয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, (তাওবা-৯:৪৪-৪৫)

আমরা বুঝতে পারলাম আকিদা বা বিশ্বাসের উপরই মানুষের আলম করে থাকে। এখানে অবিশ্বাস বা সংশয়ের কোন স্থান নাই।  আকিদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে, সহিহ আকিদা অর্জন করে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করতে হবে। সুতারং আমাদের এখনই এই ভ্রান্ত আকিদাগুলির সংশোধন দরকার।

এই লক্ষে প্রথমে জানতে হবে এই বিশুদ্ধ আকীদাহ উৎস  কি?  মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করে তা থেকে তার আকিদা বা বিশ্বাসের জম্ম নেয়। মানুষের জ্ঞানের উৎস হল, প্রাকৃতি, চারপাশের পরিবেশ, সমাজ, লোকাচার, বিজ্ঞান ভিত্তিক পড়াশুনা, দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি। এই উৎসের আকিদা শুদ্ধ ও অশুদ্ধ যে কোনটাই হতে পারে। ইসলামি আকিদা বিশ্বাস সব সময় আল্লাহ কে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। ইসলামি আকিদার মুল উৎস বা ভিত্তি হল কুরআন, সহীহ সুন্নাহ ভিত্ত্বিক। মনে রাখতে হবে আকিদা ও ফিকহের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো, ফিকহের ক্ষেত্রে ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে  ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন নেই।

পৃথিবীতে শতকরা এক ভাগ ও পাওয়া যাবেনা যে এক মাত্র স্রষ্টা আল্লাহকে মানে না। কাজেই আল্লাহর একত্ত্বাবাদ বা তাওহীদের জ্ঞান মানুষ কে সহিহ আকিদা অর্জনে সাহায্য করবে। তাই ভ্রান্ত আকিদাগুলির সংশোধনের জন্য এক মাত্র অহীর জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হবে। যখনই কুরআন ও সহিহ হাদিসের কোন জ্ঞান জানতে পারবে তখন মুমিনের গুনাবলী হবে আল্লাহর বিধান শুনলাম এবং  মেনে নিলাম। আকিদার বিষয় আলোচনার ক্ষেত্রে কুরআনো সহিহ হাদীসের  বর্নণা পেলে বলতে হবে শুনলাম এবং  মেনে নিলাম কারন সকল মুস্তাহীদ আলেমগন এ ব্যাপারে একমত যে আকিদার ক্ষেত্রে  ইসতিহাদ, কিয়াস যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন নাই। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

وَقَالُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَا‌ۖ غُفۡرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ (٢٨٥)

অর্থ: আমরা নির্দেশ শুনেছি ও অনুগত হয়েছি ৷ হে প্রভু ! আমরা তোমার কাছে গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করছি ৷ আমাদের তোমারই দিকে ফিরে যেতে হবে, (বাকারা – ২:২৮৫)

অপর পক্ষে আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামীন তার নাজিল কৃত বিধানের (আয়াতের)  অনুসরণকে  বুদ্ধিমান ও মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে যালেম বলেছেন।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

ٱلَّذِينَ يَسۡتَمِعُونَ ٱلۡقَوۡلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحۡسَنَهُ ۥۤ‌ۚ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ ٱلَّذِينَ هَدَٮٰهُمُ ٱللَّهُ‌ۖ وَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمۡ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ ١٨

অর্থঃ “যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান, (জুমার ৩৯:১৮)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

 وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بِـَٔايَـٰتِ رَبِّهِۦ ثُمَّ أَعۡرَضَ عَنۡهَآ‌ۚ إِنَّا مِنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَ مُنتَقِمُونَ (٢٢)

  অর্থঃ আর তার চেয়ে বড় জালেম কে হবে যাকে তার রবের আয়াতের সাহায্যে উপদেশ দেয়া হয় এবং সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ? এ ধরনের অপরাধীদের থেকে তো আমি প্রতিশোধ নেবোই ৷ [সাজদা ৩২: ২২]

        ঈমানের মৌলিক ছয়টি  বিষয়ের প্রতি সুদৃঢ় ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের জন্য কিয়াস যুক্তি বা আকলি দলিল কোন সুযোগ নেই। কারন অদৃশ্যে বা গায়েবের বিষয় মহান আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার ছাড়া কেউই জানেন, (সুরা আনআম-৫:৫৬; আরাফ ৭: ১৮৮)। তিনি সে সব বিষয়কে  ওহীর মাধ্যমে মানুষ জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা যা বলবে তাতো শুধুই আন্দাজ। আর আন্দাজে কথা বলাকে আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার নিষেধ করছেন।

আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আরাফ ও বাকারায় বলেন:

أَتَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ (٢٨)

অর্থঃ তোমরা কি আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে এমন কিছু বল যা তোমরা জান না, (আরাফ ৭:২৮)।

وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ (٣٣)

এবং আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নাই, (আরাফ ৭:৩৩)।

وَمِنۡہُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَـٰبَ إِلَّآ أَمَانِىَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ (٧٨)

অর্থঃ তাদের মধ্যে কিছু নিরক্ষর লোক আছে, যারা [নিজেদের] আশাআকাঙ্ক্ষা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নাইতারা অনুমান ব্যতীত আর কিছু করে না, বাকারা ২:৭৮।

 إِنَّمَا يَأۡمُرُكُم بِٱلسُّوٓءِ وَٱلۡفَحۡشَآءِ وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ (١٦٩)

অর্থঃ সে [শয়তান] তোমাদের মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে তোমাদের যে জ্ঞান নাই এমন সব বিষয়ে বলার জন্য নির্দেশ দেয়, (বাকরা ২:১৬৯)

সুতরং আকিদার ক্ষেত্রে ওহির বা কুরআনই দ্বীনের মুল ভিত্তি। অহীর  সরল ও বাহ্যিক অর্থ গ্রহন করতে হবে যে অর্থ সাহাবাগন বুঝেছেন। অগীর রূপক অর্থ বা ব্যাখ্যার দরজা খোলা রাখলে ধ্বংশ সুনিশ্চত। অপর পক্ষে ওহীর বক্তব্য সকলের জন্য সহজ করব হইয়াছে। আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা কামারে বলেন:

وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ

অর্থ: আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি? (সূরা কামার ৫৪:১৭,২২,৩২,৪০)।

আকিদা যদি শির্কি হয় তবে কোন আমলই গ্রহন যোগ্য হবে না। এ কারনে আকিদা পরিস্কার হতে হবে। ভ্রান্ত আকিদার ফলে ঈমানের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। আমরা আল্লাহর একত্ববাদ, আল্লাহর পরিচয়,  আল্লাহর অবস্থান, রিসালাত ও ইসলামের অন্যান্য হুকুম-আহকাম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ‘আকীদাহ্ গুলো পোষণ করি তা সংশোধন করার বাংলায় লিখিত আকিদাহ সর্ম্পকে অনেক মুল্যবান কিতাব রচনা করা হইয়াছ,  যেমন:  ফিকহুল আকবার, আকিদা ইসলামীয়া, আকিদা ওযাসেত্বিয়া, আকিদা সম্পকিত গুরুতআ মাসআলা, ইসলামী মুল আক্বীদার বিশ্লেষণ, কিতাবুত তাওহীদ. আরকানুল ইসলাম ওয়াল ইমান. তাওহীদ ও কালিমা ত্বাইবার তাৎপর্য. তাওহীদ রেসালাত ও আখিরাত. কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদাহ ইত্যাদি কিতাবগুল পড়া যেতে পাবে।   

মহান আল্লাহ আমাদের কুরআন সুন্নাহ মোতাবেগ সহিহ আকিদা অর্জন করে তার দেয়া নিয়ামতের ছায়া তলে যেন সকল মুসলিমকে স্থান দেয়। আমিন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

 

 

 

Leave a comment