মাযহাব সৃষ্টির ইতিহাস

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

 ইমাম চতুষ্টয়ের পরবর্তী যুগে মাযহাবের অবস্থানঃ  (২২০ হিজরী থেকে ৩২০ হিজরী)

পূর্বের আলোচনায় এ কথাটি পরিস্কার যে, ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের প্রথম দুই শতকে সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী বা মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগন কেউ মাযহার সৃষ্টি করেনি। এমনকি কেউই তাদের নামে মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেনি। তারা সকলে হাদিস শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া, ফতওয়া প্রদান করা, হাদিস মুখস্ত করা, হাদিসের গ্রন্থ রচনা করার কাজেই ব্যাস্ত থাকতেন। এবার গবেষনা করে দেখব তাহলে তাদের পরবর্তীতে কখন কিভাবে মাযহাব সৃষ্টি হল।

তাদের পরবর্তী যুগে তাদের মত অনেক আলেমই হাদিস শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া, ফতওয়া প্রদান করা, হাদিস মুখস্ত করা, হাদিসের গ্রন্থ রচনা করার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। তাই বলা যায় ইমাম চতুষ্টয়ের পরবর্তী যুগ মুলত হাদিস সংকলনের যুগ। সহিহ, জয়ীফ ও জাল হাদিস নির্নয়ের যুগ। ইমাদের মত তাদেরও অনেক অনেক খেদমত, হয়ত তারা ইমামদের মত এত খ্যাতি লাভ করতে পারে নাই। তবে ইমাম সুফিয়ান ছাওরীর নামে “ছাওরী’ মাজহাব, লাইছ ইবন সা’দ এর নামে “ লাইছী” মাযহাব এবং ইমাম আওযাই এর নাম “আওযাই” মাযহাব  প্রবর্তিত হয়। কারণ এরা সকলে তৎকালিন সময়ে প্রখ্যাত ইমাম ও মুজতাহিদ ছিলেন।

তারা ইমামদের মত এত বেশী খ্যাতি লাভ করতে পারে নাই। তাই এবার ইমাম চতুষ্টয়ের সমসাময়িক পরে যে সকল কিতাব লেখা হয়েছে, সেই সকল কিতাবের নাম ও তাদের লেখদের নাম উল্লেখ করব।

১। ‘কিতাবুল আছার” ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ এর কয়েক জন ছাত্র।

২। ‘আলজামে’ ইমাম সুফিয়ান সাওরী

৩। “কিতাবুস সুনান” ইমাম মাকহুল।

৪। “কিতাবুস সুনান” ইমাম আবু আমর আওযায়ী।

৫। “কিতাবুস সুনান”  আবু সাঈদ ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া।

৬। “কিতাবুল মাগাযী” আবু বক্র ইবনে হাযম।

৭। “কিতাবুস সুনান, কিতাবুযযুহদ, কিতাবুল মানাকিব যায়েদ ইবনে কুদাম।

৮। “সুনানে দারেমী” ইমাম ইবনে আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান সমরকন্দী। বর্তমানে উজবেকিস্তানের অন্তরগত।

৯। সহিহ আবু আওয়ানাহ লিখেছেন, ইয়াকুব ইবনে ইসহাক, মৃত্যু ৩১১ হিজরী।

১০। ইমাম শাবী একই বিষয়ের হাদিস একই স্থানে একত্রিত করে একখানি গ্রন্থের রূপ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু তার গ্রন্থে মাত্র কয়েকটি অধ্যায় ছিল। এর বেশী তার পক্ষ সম্ভর হয়নি।

ইমাম চতুষ্টয়ের পরবর্তী যুগেই হাদিস সংকলেন যে ভিত্তি রচিত হয়েছে। যার উপর দাড়িয়ে পরবর্তীকালে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলীম, ইমাম তিরমিজি, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম নাসাঈ এর মত জগৎ বিখ্যাত হাদিসের মুহাদ্দিস তৈরি হয়েছে। তারা সকলে হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও বাছাই-ছাঁটাইর পর সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরণের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই শতকের অপূর্ব গুরুত্ব, মর্যাদা এবং ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হইয়াছে। এই বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্য যে প্রতিভা ও দক্ষতা অপরিহার্য ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহে তাহাতে ভূষিত হইয়াছে কয়েকজন ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তাঁহারা হইতেছেন ছয়খানি সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ প্রণেতা ছয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। এই ছয়টি গ্রন্থকে অনেকে “সিহা সিত্তাহ” বা “ছয়টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ” বলে থাকেন। কিন্তু, আমাদের উপমহাদেশে এ রকম বলা হলেও আরব বিশ্বে এগুলোকে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়না, কুতুবে সিত্তাহ বা “ছয়টি কিতাব” বলা হয়। সমস্ত আলেমরা এই ব্যাপারে একমত, শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমই সহিহ হাদিস গ্রন্থ। এই দুইটি গ্রন্থের সবগুলো হাদীস “সহীহ”। এই জন্য এই দুইটি গ্রন্থকে একত্রে “সহীহাইন” বা “দুইটি সহীহ গ্রন্থ” বলা হয়। আর বাকী চারটি, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে জাল ও জয়ীফ হাদীস থাকার কারণে সেগুলো সহীহ না বলে “সুনানে আরবা” বা “চারটি সুন্নাহর কিতাব” বলা হয়। অনেক সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, অনেক আলেমকেও দেখা যায় “সিহাহ সিত্তাহর” সবগুলো হাদীস সহীহ বলে দাবী করতে। অথচ বাকি চারটি সুনানে এর মধ্যে শুধু জয়ীফ নয়, মুনকার (বাতিল) ও মওজু (জাল) হাদীস বিদ্যমান আ্ছে। মিথ্যা কথা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নামে চালানো হয়েছে। সুনানে নাসায়ীতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা প্রায় ৪৪০ টি, সুনানে আবু দাউদ যঈফ হাদিসের সংখ্যা প্রায় ১১২৭ টি, সুনানে তিরমিজী যঈফ হাদিসের সংখ্যা প্রায় ৮২৯ টি, সুনানে ইবনে মাজাহ যঈফ হাদিসের সংখ্যা প্রায় ৯৪৮ টি এবং ৪০ টারও বেশি জাল হাদীস রয়েছে।

ইসলামি জগতে যে ছয়টি কিতার কে “কুতুবে সিত্তাহ” বলা হয় সেগুলির লেখকের নাম উল্লখ করা হয়ঃ

হাদিস গ্রন্থের নাম লেখকের নাম/সংগ্রহক  পরিচিতি নাম জম্ম-মৃত্যু
সহিহ বোখারী আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারী ইমাম বুখারী জম্ম ১৯৪ হিজরী মৃত্যু ২৫৬ হিজরী
সহিহ মুসলিম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল-কুশাইরি ইমাম মুসলিম  জম্ম ২০৪ হিজরী মৃত্যু ২০৬ হিজরী
সুনানে আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে আসআছ সাজিসতানী ইমাম আবু দাউদ জম্ম ২০২ হিজরী মৃত্যু ২৭৫হিজরী
সুনানে তিরমিজী আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাহ ইবনে মুসা ইমাম তিরমিযী জম্ম ২০১ হিজরী মৃত্যু হিজরী
সুনানে নাসায়ী সংগ্রহক, আহমাদ ইবনে মাআ’ঈব ইমাম নাসায়ী জম্ম ২১৫ হিজরী মৃত্যু ৩০৩ হিজরী
সুনানে ইবনে

মাজাহ

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ কাযভীনি ইমামইবনে মাজাহ জম্ম ২০৯ হিজরী মৃত্যু ২৭৩ হিজরী

 

এই সকল মহান ইমাম হাদিসের মুহাদ্দিস যারা হাদিস সংকলেন মহতি কাজে আত্ম নিয়োগ করছেন। তারাও মাযহাব সম্পর্কে তেমন কিছু লিখে যাননি বা বলেন নি যে, আমি কোন নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণ করি। এ থেকে বুঝা যায় তারা কোন মাযহাব অনুসরণ করতেন না, আর কি করেই মাযহাবের অনুসরণ করবেন, যেহেতু তাদের সময় মাযহাব নামের কোন অস্তিত্বই ছিল না। যদিও অনেক মাযহাবি ভাইদের কিতাবে পাওয়া যায়, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলীম, ইমাম তিরমিজি, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম নাসাঈ কোন না কোন ইমামের অনুসারি ছিলেন। উক্ত মুহাদ্দিসগণ হাদিসের কিতাব সংকলন করেছেন আর মাযহাবের ইমামগনও হাদিস সংকলণ করেছেন। কাজেই মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগনের বর্নিত হাদিস তাদের কিতাবে স্থান পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, তাই বলে তারা ঐ  মাযহাবের অনুসারি ছিল বলে প্রচার করা কতটুকু যৌক্তিক।

*** মাযহাব সৃষ্টি ইতিহাসঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর সাহাবিদের মাঝে ফিকহি বিষয় মতভেদ ছিল কিন্তু উম্মতের ঐক্য নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করেনি। মহান চার খলিফায়ে মুসলীমিনদের ওফাতের পর ইসলাম ও মুসলিমদের উপর যেমন যুলুম চলছিল, ঠিক তেমনিভাবে কুরআন হাদিস এর চর্চাও চলছিল। সম্মানিত চার ইমাম নিজ নিজ সময়ে স্ব স্ব এলাকায় বড় আলিম হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ফলে লোকজন তাঁদেরকে জরুরী মাসআলা-মাসাইল জিজ্ঞাসা করতো। তাঁরা ফয়সালা দিতেন। ইমামগণের ইস্তেকালের পর তাঁদের ভক্তরা তাঁদের মতামত ও নীতি প্রচার প্রসার করেন। এমনকি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করতে থাকেন। এক ইমামের ভক্তরা অন্য ইমামের ভক্তদের সাথে তর্ক-বাহাস করতে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন দলে এবং এলাকা কেন্দ্রীক ইমাম ও মুহাদ্দিসদের অনুসরণ শুরু হয়।

 যেমনঃ কুফা শহর কে কেন্দ্র করে ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ চলতে থাকে। মদিনা শহরকে কে কেন্দ্র করে ইমাম মালিক এর অনুসরণ চলতে থাকে। বাগদাদকে কেন্দ্র করে ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল এর অনুসরণ চলতে থাকে। মিশর কে কেন্দ্র করে ইমাম শাফেঈ এর অনুসরণ চলতে থাকে। এভাবে ইমাম সুফিয়ান ছাওরীর, ইমাম লাইছ ইবন সা’দ, ইমাম মুবারক, ইমাম আওযাইসহ প্রায় ১১/১২ জন মুজতাহিদ আলেমের নামে ১১/১২ টি মাযহাবের সৃষ্টি হয়। কিন্তু মজার ব্যাপর হল, এই সকল ইমামদের কেউই মাযহার সৃষ্টি করে নাই এমন কি সৃষ্টি করতেও বলেন নাই। তারা সকলে একনিষ্টভাবে কুরআন ও হাদিসের অনুসারি ছিলেন এবং সমসাময়িক জটিল ব্যপারে ইজতিহাদ করতেন। তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লষণের কারনে সমসাময়িক আলেম ও সাধারণ লোকদের মাঝে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, যার প্রভাব পরবর্তী প্রজম্মের পর প্রজম্মের চলেত থাকে। মুসলিমগণ নবুয়ত থেকে যত দূরে যেতে থাকে, তাদের নিকট থেকে কুরআন হাদিস এর চর্চাও কমতে থাকে। আস্তে আস্তে তারা  কুরআন হাদিস বিমুখ হতে থাকে এবং আলেমদের ব্যাখ্যা নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে কুরআন হাদিসের ব্যবহারিক পতন ঘটতে শুরু করে। এরই পটভূমিতে মুসলিমদের মাঝে ফির্কাবন্দী হয়ে বিভিন্ন জন বিভন্ন মুজতাহিদ আলেমকে একমাত্র অনুসরণীয় ভাবতে থাকে। যার যার অনুসারী ইমামের নামে মাযহাব এর সৃষ্ট করে তারই অনুসরণ করতে থাকে। রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে শাসকবর্গও এতে জড়িত হয়ে পড়েন। এভাবে কালক্রমে ধীর ধীর প্রচলিত চার মাযহাবের রূপ ধারণ করেছে। ৩১৭ হিজরী আগ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি নিজেকে হানাফী, শাফেয়ী ইত্যাদি বলতেন না বরং স্ব স্ব অনুসরণীয় আলেমদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা করতেন। পরবর্তীতে প্রত্যেকেই নিজের জন্য পৃথক পৃথক দলীয় নাম নির্ধারিত করে নিতেন এবং নিজ অনুসরণীয় আলেমদের নির্দেশ খুঁজে বের না করা পর্যন্ত কোরআন ও হাদীসের ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতেন। সুতরাং মতভেদ দৃঢ়তর হল, মাযহাবের সূত্রপাত হল। মাযহাবের মহাব্যাধি মুসলমানগণের জাতীয় জীবনে প্রবেশ করায় ইসলামের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন। ৩১৭ হিজরীতে একটি আয়াতের অন্তর্ভুক্ত মকামে মাহমুদের ব্যাখ্যা নিয়ে বাগদাদে হাম্বলী ও অপর তিন মাযহাবের অনুসারীগণের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়, এই সংগ্রামে সৈন্য বাহিনী ও জনসাধারণও যোগ দেয় এবং শত সহস্র লোক হতাহত হয়। ৩২৩ হিজরীতে হাম্বলী ও শাফেয়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে ৭ বৎসর পর্যন্ত চলে।

উপমহাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলিম, ভারতবর্ষের বিখ্যাত হাদীসশাস্ত্রবিদ ও হানাফীদের শিক্ষাগুরু যাকে হানাফীরা ভারতবর্ষের ‘ইমাম বুখারী’ বলে থাকেন সেই শাহ আলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহেলভী (রহ) বলেছেন। তোমরা জেনে রাখ যে ৪০০ হিজরীর আগে লোকেরা কোন একটি বিশেষ মাযহাবের উপর জমে ছিল না। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ পৃষ্ঠা নম্বর ১২৫)।

ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ গ্রন্থের ৪৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেনঃ হিজরী চতুর্খ শতাব্দী পর্যান্ত চার মাযহার ছাড়া অন্য মাযহাবের অনুসরণ করা হত। কিন্ত অন্যান্য মুজতাহীদের মাযহাবগুলো এরূপে সংরক্ষিত হয়নি, যার ফলে সেগুল অনেক দীর্ঘ সময় পর্যান্ত সংকলিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকবে নি। ফলে চতুর্খ শতাব্দীর পর চার মাযহাব ব্যতিত অন্য কোন মাযহাব অবশিষ্ট থাকেনি। আল্লাহর রহমতে এই মাযহাব চতুষ্টয়ে তাকলীদে শাখসি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

অর্থাৎ ৪০০ হিজরীর আগে নিজেকে হানাফী, শাফেয়ী বা মালেকী বলে পরিচয় দিতো না। আর চারশো হিজরীর অনেক আগে ইমামরা ইন্তেকাল করেন।

বিশিষ্ট হানাফী বিদ্বান শাহ ওলিউল্লাহ দেহেলভী (রহ) এর কথা যদি মেনে নেওয়া হয় যে, ৪০০ হিজরীর আগে কোনো মাযহাব ছিল না, এবং ৪০০ হিজরীর পরে মানুষেরা মাযহাব সৃষ্টি করেছে। তার মানে এটা দাঁড়ায় যে আবু হানীফার ইন্তেকালের ২৫০ বছর পর হানাফী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম মালেকের ইন্তেকালের ২২১ বছর পর মালেকী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম শাফেরীর ইন্তেকালের ১৯৬ বছর পরে শাফেয়ী মাযহাব এবং ইমাম আহমাদের ইন্তেকালের  ১৫৯ বছর পর হাম্বলী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে।  তাহলে আমরা কি করে বলি যে, চার ইমামের যে কোন একজনকেই মানতে হবে। সর্ব বিষয়ে এক মাযহাবের মাসআলা মতেই চলতে হবে। অন্য কোর ইমামের অনুসরণ করা যাবেনা।

মহান ইমাম যাদের নামে আমরা মাযহাব রচনা করেছি, তারাও এই নাম গুলো দেয়নি। মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত চারটি মাযহাব, দল বা ফির্কাহ ইসলামের কোনো নিয়ম বা বিধান মেনে তৈরি করা হয়নি। কারন ইসলাম ধর্মে কোনো দলবাজী বা ফির্কাবন্দী নেই। মুসলমানদের বিভক্ত হওয়া থেকে এবং ধর্মে নানা মতের সৃষ্টি করা থেকে কঠোরভাবে সাবধান করা হয়েছে, (সূরা আনাম ৬:১৫৯)। এই মাযহাবগুলো রসুল (সাঃ) এবং সাহাবাদের (রা) সময় সৃষ্টি হয়নি। এমনকি ঈমামগনের সময়ও হয়নি।

ইমাম কুশয়রী ৪৪৮ হিজরীতে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং আকীদা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি হাম্বলীদের সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হন, কারণ তিনি নিজে গোড়া আশাইরা মতবাদের ছিলেন। এই বিবাদ শেষে সংগ্রামে রূপ নেয় এবং উভয় পক্ষে বহু লোক হতাহত হয়। ৫৫৪ হিজরীতে নেশাপুর শহরে হানাফী ও শাফেয়ীগণের মধ্যে, পুনরায় ৫৬০ হিজরীতে হানাফী শাফেয়ীদের মধ্যে, ৫৮৭ হিজরীতে মিসরে হাম্বলী ও শাফেয়ীগণের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মাযহাবী কোন্দলের মাঝে ৩৯৮, ৪৮৩ এবং ৬৫৫ হিজরীতে শিয়া ও সুন্নীগণের মধ্যে সংঘর্ষে ভয়াবহ লুটতরাজ, হত্যাকান্ড চলে, বহু বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হয়। মুসলমানদের মধ্যে মাযহাব নিয়ে আত্মকলহ মারাত্মক আকার ধারণ করলে বিবরুহ বাদশাহর আমলে মিশরে চারটি মাযহাব সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে এবং চার মাযহাবের জন্য চারজন সরকারী কাজীও নিযুক্ত করা হয়। ৬৬৫ হিজরীতে সরকারীভাবে চার মাযহাব স্বীকৃতি লাভ করায় ইসলামী দুনিয়া হতে অন্য মাযহাবগুলি লোপ পেতে থাকে। এ কারনে বহু মাযহাবের ইমাম থাকলেও এই চারটি মাযহার সরকারী পৃষ্ঠপোশকতা পেয়ে মুসলিম দুনিয়ায় টিকে আছে। এ ধরণের মাযহাবগত দলাদলি অন্যান্য মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই সুযোগ নিয়ে চীনের মঙ্গোলিয়া হতে আগত চেঙ্গীস খাঁ ও হালাকু খাঁ বাগদাদকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। ৬৫৬ হিজরীর ১২ই মুহাররম হালাকুর সৈন্যদল বাগদাদে প্রবেশ করে এবং ১৪ ই সফর বুধবার খলীফাতুল মুসলেমীন শহীদ হন। খলীফার দুই পুত্র আমীর আবু বকর আহমদ ও আবুল ফাযায়েল আবদুর রহমানকে তাতারীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং খলীফার কন্যাসহ সকল মহিলাগণকে দাসীতে পরিণত করে।

অতঃপর ৮০৯ হিজরীতে কাবার ইব্রাহিমী মুসাল্লাতে দাঁড়াই ইমামতি নিয়ে ১০/১১টি মাযহাবী দলের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাঁধে। তাহাতে বহু মুসলমান হতাহত হয়। জাহল বাদশা ফারহা ইবনে বয়কুফ সংঘর্ষ মিটাবার উদ্দেশ্যে বিবাদরত দলগুলির মধ্যে হতে চারটি দলকে কাবার চার পার্শ্বে খাড়া করিয়া দিলেন। অন্যান্য দল এই চার মাযহাবের মধ্যে মিশিয়া গেল। ফলে কাবাঘরের চার কোণে চার মাযহাবের চারখানা ভিন্ন ভিন্ন মুসাল্লাহ তৈরী হইল। প্রতি ওয়াক্তে চার মাজহাবের চার ইমাম চার মুসাল্লায় দাঁড়িয়ে পর্যায়ক্রমে নামাজ আদায় করিতে থাকেন। এই নিয়ম প্রায় ৫০০ বৎসর পর্যন্ত চালু থাকে।  তখন থেকে এক আল্লাহর দ্বীন এবং মুসলিম জাতির প্রতিষ্ঠাকেন্দ্র চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। অর্থাৎ সত্য ধর্মকে চারটি মাযহাবে বিভক্ত করে নবীর দ্বীনে বিপর্যয় ঘটান হল।

যার ফলে চার মাযহাবের অনুসারীগণ চার ইমামের পেছনে ভিন্ন-ভিন্নভাবে জামাআতে নামায আদায় করেছেন। হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ হানাফী অনুসারীগণ হানাফী মাযহাবের ইমামের পেছনে, মালেকী মাযহাবের অনুসারীগণ মালেকী মাযহাবের ইমামের পেছনে, এভাবে অপর দুটি মাযহাবের অনুসারীগণও তাঁদের স্ব-স্ব মাযহাবের ইমামের পেছনে নামায আদায় করতেন। এই ঘটনার সাড়ে পাঁচশত বৎসর পর সৌদী আরবের বাদশাহ আব্দুল আযীয আল সউদের রাজত্বকালে ১৩৪৩ হিজরীতে বাদশা সাউদ ইবনে আবদুল আযীয তাঁর সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ প্রবেশ করেন। তিনি তখন তিনি হারাম শরীফে সকল মুসল্লিকে একই ইমামের পেছনে একই সাথে জামাআতে নামায আদায়ের নির্দেশ জারী করেন। কাবার হেরেম হতে এ জঘন্য বিদ’আত রহিত করেন। কাবার হেরেম থেকে মূল উৎপাটিত হলেও পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম প্রধান দেশে এই মাযহাবগত বিভক্তি এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান।

৩১৭ হিজরীতে আগে কেহ তাদের পরিচয় মাযহাবের সাথে সম্পিক্ত করে নাই। ফিকহি মাসায়েলের মতভেদ থেকে শুরু মতবিরোধ, আর শেষ হয় ফির্কাবাজি, দলাদলি, রেসারেসি মাধ্যমে। এর আগের তিনটি যুগ অতিবাহিত হয়েছে যাদের মাঝে বহু মতভেদ ছিল কিন্তু কোন মাজহাবী পরিচয় ছিলনা। অথচ ঐ যুগ সম্পর্কে সহিহ বুখারীতে এসেছে।

ইমরান ইবনে হুসাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের সর্ব শ্রেষ্ঠ যুগ আমার (সাহাবীগনের) যুগ। এরপর তৎসংলগ্লনযুগ (তাবেয়ীগনের)। এরপর তৎসংলগ্লনযুগ (তাবে-তাবেয়ীগনের)। ইমরান (রাঃ) বলেন, তিনি তার যেগের পর দু’যুগ অথবা তিন যুগ বলেছেন তার আমার স্মরন নেই। তারপর (তোমাদের যুগের পর) এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা সাক্ষ্য প্রদানে আগ্রহী হবে অথচ তাদরে নিকট সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে তাদেরকে কেউ বিশ্বাস করবে না। তারা মানত করবে কিন্তু পূরণ করবে না। পার্থিব ভোগ বিলাসের কারনে তাদের মাঝে চর্বি যুক্ত স্থূলদেহ প্রকাশ পাবে। (সহিহ বুখারী ৩৩৮৮ ইঃ ফাঃ)

এই তিনটি যুগ যেহেতু শ্রেষ্ঠ এবং তাদের মাঝেও মতভেদ ছিল কিন্তু তারা মাযহাব সৃষ্টি করেননি কেন।  তাদের পরে অনেক মুহাদ্দিস বহু সহিহ হাদিস সংকলণ করেছেন, কিন্তু তাদের নামে মাযহাব তৈরি করতে বলেনি। এ ব্যাপারটি পরিস্কার করার জন্য ৩১৭ হিজরী পর্যান্ত কয়েক জন তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ীদের জীবনি এই গ্রস্থের শেষে বর্ণনা করা হয়েছে।

 সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment